মানুষের কাজই উদ্ভট সব কথা বলা, ভাবে সান্টিয়াগো। মাঝে মাঝে মনে হয়, ভেড়ারাই ভালো, কোনো কথাবার্তা বলেনা, চুপচাপ থাকে। আর না হলে বইতো আছেই। যখন যেমন ইচ্ছা, বই থেকে কত অবিশ্বাস্য সব কাহিনী জেনে নেওয়া যায়! অথচ মানুষের সাথে কথা বলতে গেলেই যত সমস্যা, কেউ কেউ এমন কথা বলে, এমন আজব সব কথা যে আর আলাপ চালিয়ে যাওয়ার উপায় থাকেনা।
“আমার নাম মেলখিযেডেক,” বলল বুড়ো। “কতগুলো ভেড়া আছে তোমার?”
“যথেষ্টই” বলে সান্টিয়াগো। বেশ বুঝতে পারছে ওর সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাচ্ছেন বুড়ো।
“ও আচ্ছা, তাহলে তো সমস্যা। যদি মনে কর তোমার যথেষ্টই ভেড়া আছে, তাহলেতো আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবোনা।”
সান্টিয়াগোর এবার মেজাজটা সত্যিই খারাপ হলো। মনে হয় সে বুড়োর কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছে! বুড়ো নিজেইতো প্রথমে এসে ওর কাছ থেকে ওয়াইন খেতে চাইল তারপর আলাপ জুড়লো।
“বইটা দিন” বলে ও “আমাকে এবেলা উঠতে হবে, ফিরে গিয়ে আবার ভেড়াগুলো জড়ো করে পথ ধরতে হবে।”
“দশ ভাগের একভাগ ভেড়া আমাকে দাও, আমি বলে দিচ্ছি কি করে গুপ্তধনের খোঁজ পাবে।” বলে বুড়ো।
স্বপ্নটার কথা মনে পড়ল সান্টিয়াগোর, হঠাৎ সব বুঝতে পারলো ও, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল। তাহলে এই কথা! এই বুড়ো তাহলে হয়তো সেই জিপসি বুড়ির স্বামী। নিজে স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার নামে কোনো ফী নেয়নি, এখন স্বামীটাকে পাঠিয়েছে, স্বপ্নটার অছিলায় যদি আরো কিছু আদায় করা যায় সেই আশায়। যে গুপ্তধনের অস্তিত্বই নেই সেটাকে ছুতো করে এখন ব্যাবসা করে নেয়ার ধান্দা আর কি। এই ব্যাটাও নিশ্চয় জিপসি।
কিন্তু সান্টিয়াগো কিছুই বলার সুযোগ পেলোনা, তার আগেই বুড়ো উবু হয়ে একটা কাঠি মতো কিছু তুলে নিয়ে চত্বরের বালিতে কিসব লেখা আরম্ভ করল। ঠিক তখনি বুড়োর বুকের ওখানটায় যেন উজ্জ্বল কিছু একটা দেখতে পেলো সান্টিয়াগো, সেই ঔজ্জ্বল্যের তীব্রতায় মুহূর্তের জন্য সবকিছু অন্ধকার মনে হলো। ব্যাপারটা মুহূর্তেই বুঝতে পেরে চোখের পলকে বুড়ো তার উত্তরীয়টা দিয়ে সেটা ঢেকে ফেলল। দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এলে সান্টিয়াগো দেখল বালির ওপর বুড়ো কি লিখেছে।
সেখানে, ছোট্ট সেই শহরের চত্বরটার বালিতে, সান্টিয়াগো ওর বাবা-মা’র নাম পড়লো, পড়লো যে আশ্রমে গিয়েছিলো সেটার নাম। পড়লো সেই বণিক তনয়ার নাম, এমনকি ও নিজেও সেটা জানতোনা। যা ওর কখনোই কাউকে বলা হয়নি এমন কিছু কিছু জিনিসও পড়তে পেলো সেই লেখার মধ্যে।
“আমি সালেমের রাজা,” আবার বলল বুড়ো।
“একজন রাজা কেন একটা রাখালের সাথে আলাপ করবেন?” ভক্তিতে, বিস্ময়ে হতবাক সান্টিয়াগো বিব্রত হয়ে জানতে চায়।
“একজন রাজা একটা রাখালের সাথে আলাপ করবেন বেশ কিছু কারনে। কিন্তু আপাতত বরঞ্চ এটাই বলি যে, তোমার সাথে আমার আলাপের সবচেয়ে বড় কারনটা হলো তুমি তোমার জীবনখাতার গল্প অন্বেষণে উতরে গেছ।”
সান্টিয়াগো জানেওনা “জীবনখাতার গল্প” কি জিনিস।
“তুমি সবসময় যা করতে চেয়েছ। শুরুর দিকটায়, মানে ছেলেবেলায়, সব মানুষই জানে তার জীবনখাতার গল্পটা কেমন হবে। সেই সময়টাতে, সব কিছুই পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়, মনে হয় সবই সম্ভব। স্বপ্ন দেখতে একটুও ভয় লাগেনা, জীবনের কাছ থেকে যা কিছু পেতে চায় সেটার আকাঙ্খায়ও সেই সময়টায় কোনো ভয় থাকেনা। কিন্তু যতই সময় যায় ততই কোনো এক রহস্যময় শক্তি যেন মানুষকে পটাতে থাকে যে নিজের জীবন গল্পের গন্তব্য অনুধাবন তার পক্ষে সম্ভব না।”
বুড়োর কোনো কথাই সান্টিয়াগোর খুব একটা বোধগম্য হচ্ছেনা, কি সব বলছে বুড়ো। তারপরও ওর জানতে চাইল ‘রহস্যময় শক্তি’ সেটাই বা কি?
ভাবছে, ওর মুখে বনিকের মেয়ে যখন এই রহস্যময় শক্তির কথা শুনবে, তখন না জানি কত মুগ্ধ হবে!
“একটা শক্তি, যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে প্রতিকূল কিছু একটা, কিন্তু আসলে কি বলোতো, ওটাই তোমাকে আস্তে আস্তে উপলব্ধি দেবে; জীবন গল্পের গন্তব্যের পথে হাঁটার উপলব্ধি দেবে। হৃদয়স্পৃহা দেবে, ইচ্ছাশক্তি দেবে। কারন কি জানো, এ জগৎসংসারের একটা মহান সত্য হলোঃ তুমি যেই হও না কেনো, যাই করো না কেনো, যখন তুমি সত্যি কিছু চাবে, বুঝবে সে চাওয়ার শুরু এ মহাবিশ্বের হৃদয় থেকেই। আর জেনে রেখ, এই মর্ত্যের পৃথিবীতে ওটাই তোমার আসার কারন।”
“এমনকি তা যদি হয় শুধুই ঘুরে বেড়ানো? অথবা কোনো কাপড়ের ব্যাপারীর মেয়েকে বিয়ে করা?”
“অবশ্যই, অথবা গুপ্তধনের সন্ধান করা। একটা কথা জেনে রাখো বাছা, মানুষের মনের প্রশান্তি কিন্তু ধরিত্রীর মনেরও খোরাক যোগায়। দুঃখ-জরা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। আসলে, নিজের জীবনগল্পের গন্তব্য খোঁজা কিন্তু মানুষ হিসেবে একজন মানুষের একমাত্র সত্যিকারের দায়িত্ব। কারন আমরা সবকিছু একসাথে একটা অভিন্ন স্বত্তা। আর তুমি যখন কিছু চাও, জেনো, এ মহাবিশ্ব তোমাকে সেটা পাইয়ে দেয়ার নীলনকশা বুনতে থাকে।”
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। চত্বর আর শহুরে লোকের আনাগোনা দেখছে। বুড়োই প্রথমে মুখ খুলল।
“মেষপাল নিয়ে ঘোরো কেন তুমি?”
“ঘোরাঘুরি করতে আমার খুব ভালো লাগে, তাই।”
চত্বরের কোনায় একটা বেকারীর ভেতরে, জানলার কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, বুড়ো সেদিকে দেখাল। “দেখো, কৈশোরে, ওই লোকটাও ভ্রমন করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রথমে ভাবলো আগে একটা বেকারী হোক, কিছু টাকা জমুক। সময় তো আছেই, বয়সকালে মাসখানেক আফ্রিকায় গিয়ে থাকবে। কখনোই বোঝেনি যে মানুষ যা স্বপ্ন দেখে বা চায় তা যখন খুশী তখনই করতে পারে।”
“ওর তো তাহলে রাখাল হওয়া দরকার ছিলো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ও সেটা ভেবেও ছিল,” বলল বুড়ো। “কিন্তু একজন বেকারীর মালিক একটা রাখালের চেয়ে অনেক গণ্যমান্য। বেকারী মালিকদের বাড়ি আছে, আর রাখালরা খোলা মাঠে, ময়দানে ময়দানে ঘুরে বেড়ায়, এখানে ওখানে ঘুমায়। কোন মেয়ের বাপের সেটা ভালো লাগবে? মেয়েদের বাবারা চাবে মেয়ে রাখালের চেয়ে বরং বেকারী মালিককেই বিয়ে করুক।”
একথা শুনে বনিকের মেয়ের চিন্তায় সান্টিয়াগোর হৃদয়ে যেন রক্তক্ষরণ শুরু হলো। ওদের শহরে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বেকারীর মালিক আছে।
“রাখাল বা বেকারী মালিক যেই হোক, শেষ পর্যন্ত দেখা যায় কি জানো, নিজের জীবনগল্পের গন্তব্যের চেয়ে লোকে তাদের নিয়ে কি ভাবলো না ভাবলো সেটাই তাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়,” বলে গেল বুড়ো।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা পাতায় এসে আটকে গেল, সেখানটায় পড়া শুরু করতেই বৃদ্ধের মতোই কথার মাঝে বিঘ্ন ঘটিয়ে জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো “আর আমাকে আপনার এতসব বলার কারনটা কি?”
“কারন তুমি নিজেই নিজের জীবনগল্পের গন্তব্য উপলব্ধিটা করার চেষ্টা করছিলে। চেষ্টা করছিলে ভালোই করছিলে, আর হঠাৎ সেটাই কিনা এখন বাদ দেবার কথা ভাবছ।”
“আর সবসময় এই ধরনের পরিস্থিতিতেই কি দৃশ্যপটে আপনার আবির্ভাব ঘটে?”
“সবসময় এভাবে নয়, তবে একভাবে না একভাবে তো আমার আবির্ভাব ঘটেই। কখনো আমি সমস্যার সমাধান রূপে আসি, আবার কখনো আকারে ইঙ্গিতে সমাধানটা বুঝিয়ে দেই। আর বাকি সময়ে, মানে জরুরী পরিস্থিতিতে আরকি, যখন আর কোনো উপায় দেখিনা তখন আমি মানুষের কাজগুলো সহজ করে দেই। আরো অনেককিছুই আমি করি বাছা, তবে অধিকাংশ সময়ই, মানুষ বুঝতে পারেনা যে সেগুলো আমারই করা।”
বুড়ো বলল গত সপ্তাহে নাকি তাকে একরকম জোর করেই এক খনি শ্রমিকের কাছে পাঠানো হয়েছিলো, একটা পাথর রূপে। ওই লোকটা সব ছেড়ে ছুড়ে বেড়িয়ে পড়েছিলো পান্না সংগ্রহের জন্য। পাঁচ-পাঁচটা বছর ধরে কেবল একটা নদীতেই কাজ করেছে, শুধু একটা মাত্র পান্না পাবার আশায় শত-সহস্র পাথর পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেছে। যখন কেবল আর একটা মাত্র, আর একটা মাত্র পাথর যাচাই করলেই পান্নাটা পেয়ে যাবে, ঠিক তখনই খনি শ্রমিকটা কি ভাবলো; ভাবলো লাভ নেই, সব বাদ।
যেহেতু জীবন গন্তব্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে শ্রমিক লোকটা সব বিসর্জন দিয়েছিল, তাই সেদিন সেই মুহূর্তে বুড়ো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবারে ব্যাপারটায় সে নিজেই হস্তক্ষেপ করবে। একটা পাথরের রূপ নিয়ে গড়াতে গড়াতে গড়াতে গড়াতে লোকটার পায়ের কাছে এসে থেমেছিল। আর তখনই শ্রমিক লোকটা জীবনের নিষ্ফল পাঁচ-পাঁচটা বছরের হতাশার গ্লানি সামলাতে না পেরে, প্রচন্ড রাগে পাথরটা তুলে ছুড়ে ফেলল একদিকে। সেই ছুড়ে দেয়ায় এতোই জোর ছিল যে পাথরটা মাটিতে পড়েই দুই ভাগ, আর সেই ভাঙ্গা পাথর খন্ড থেকে বেরিয়ে আসলো ওটার ভেতরে প্রোথিত, পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পান্না।
“জীবনের প্রথম দিকটায় হয়কি বাছা, মানুষ বুঝতে পারে, জীবনের তাৎপর্যটা কি” একটু তিক্ততার সাথেই অবশ্য বলল বুড়ো। “আর হয়তোবা এতো তাড়াতাড়ি সেটার হাল ছেড়ে দেয়ার ওটাও একটা কারন। কিন্তু এটাইতো জগতের নিয়ম।”
গুপ্তধনের ব্যাপারে কি যেন বলছিল বুড়ো, সান্টিয়াগো মনে করিয়ে দিলো।
“প্রবাহিত জলের শক্তিই পারে সেই গুপ্তধন উন্মোচন করতে, আর সেই একই স্রোতের মাঝেই ওটা লুকিয়ে আছে,” বলল মেলখিযেডেক। “তুমি যদি তোমার গুপ্তধনের ব্যাপারে জানতে চাও, আমাকে তোমার ভেড়া পালের দশের একভাগ দিতে হবে।”
“আমার গুপ্তধনের দশের এক ভাগই বা নয় কেন?”
মেলখিযেডেককে হতাশ মনে হলো। “যেটা এখনো তুমি পাওইনি, তা দিয়েই যদি প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, তবে তা অর্জন করার ইচ্ছা তুমি সহজেই হারিয়ে ফেলবে।”
সান্টিয়াগো বলেই ফেলল যে এক জিপসি বুড়িকে ও এরমধ্যেই গুপ্তধনের দশের এক ভাগ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছে।
“জিপসিরা এ ব্যাপারে সিদ্ধ হস্ত,” বুড়োর দীর্ঘশ্বাস পড়তে শুনল সান্টিয়াগো।
“যাইহোক, ভালো লাগল যে তুমি বুঝেছো জীবনে সবকিছুই মূল্যবান। আলোর পথের যোদ্ধারা এটাই শেখানোর চেষ্টা করে।”
সান্টিয়াগোকে বইটা ফেরত দিল বুড়ো।
“আগামীকাল, একই সময়ে, তোমার ভেড়াপালের দশ ভাগের একভাগ আমায় এনে দিও। বলে দেব গুপ্তধন কি করে খুঁজে পাবে। শুভ সন্ধ্যা।”
চত্বরের এক প্রান্ত দিয়ে হারিয়ে গেল বুড়ো মেলখিযেডেক।
***
সান্টিয়াগো আবার বইয়ে ফিরে এলো, কিন্তু কোনোভাবেই মনোনিবেশ করতে পারছিলোনা। কিছুটা চিন্তিত, খানিকটা বিষন্ন হয়ে আছে, বেশ বুঝতে পারছে বুড়ো আসলে ঠিকই বলেছে। সেই বেকারীটাতে গেলো, একটা রুটিও কিনলো, একবার ভাবলো মালিককে জিজ্ঞেস করে দেখবে কিনা বুড়ো তার সম্পর্কে যা যা বলেছে। আবার ভাবে, থাক না, কি দরকার, কখনো কখনো কিছু কিছু জিনিস না ঘাটানোই ভালো। যদিও আজ বেকারী মালিক সবসহ এভাবেই ভালো আছে, তারপরও, ও ওসব কিছু জিজ্ঞেস করলে লোকটার আবার সেই অতীত কাহিনী মনে করে তিনটা দিন নষ্ট হতে পারে। সে বেচারার এমন অস্থিরতার কারন হবার কোনো ইচ্ছেই নেই ওর।
অলস ভাবে শহরে ঘুরতে ঘুরতে একসময় খেয়াল হলো শহরের একেবারে প্রবেশদ্বারের ওখানটায় চলে এসেছে। একটা ছোট্টমত ঘর, এক কোনায় একটা জানালা, সেটা দিয়ে লোকজন টিকেট কিনছে~ আফ্রিকা যাবার টিকেট। ও জানতো আফ্রিকাতেই মিশর।
ভেতর থেকে একজন জিজ্ঞেস করলো, “কি, কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“নাহ, থাক। কাল আসতে পারি একবার,” ওখান থেকে সরে আসতে আসতে বলল সান্টিয়াগো।
কেবল একটা মাত্র ভেড়া বিক্রির টাকা দিয়েই ও সাগরের ওপাশের তীরে পৌছাতে পারে। এই ভেবে রীতিমত আঁতকে ওঠার দশা হলো ওর।
“আরেক স্বপ্ন দ্রষ্টা, ওর যাওয়ারই পয়সা নাই,” ওকে সরে আসতে দেখে সহকারীটাকে বলল ভেতরের টিকেট বিক্রেতা লোকটা।
টিকেট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ভেড়াগুলোর কথা খুব মনে হচ্ছিল ওর, মুহূর্তেই ওদের জন্য ফিরে যেতে মন কেমন করলো। দুবছরে মেষপালনের খুঁটিনাটি কতকি ওর জানা হয়ে গেছিলোঃ ভেড়ার লোম ছাঁটা, সন্তানসম্ভাবা ভেড়ীর যত্ন-আত্তি, নেকড়ের হাত থেকে ভেড়াদের কিভাবে রক্ষা করতে হয় সব জানা হয়ে গেছিলো। আন্দালুসিয়ার যাবতীয় মাঠ-ঘাট, ঘাসের জমি সব ওর নখ দর্পনে। নিজের ভেড়াগুলোর কোনটার কত দাম সব জানা।
ঘুরপথে, যতটা সম্ভব সময় নিয়ে বন্ধুর আস্তাবলে ফেরার কথা চিন্তা করল সান্টিয়াগো। শহরের বড় প্রাসাদটার পাশ দিয়ে যেতেই থামলো, পাথরের ঢালু সুড়ঙ্গ দেয়াল ডিঙ্গিয়ে উঠে এলো একেবারে চুড়ায়। সেখান থেকে দূরের দিগন্তে দেখতে পাচ্ছিল আফ্রিকা। কেউ একজন ওকে বলেছিল ওখান থেকেই নাকি মুর রা এসেছিল এই স্পেইন দখল করতে।
যেখানে বসে আছে সেখান থেকে পুরো শহরটাই প্রায় দেখা যাচ্ছে, যে চত্বরে বসে বুড়োর সাথে এতক্ষন কথা বলছিল, সেটাও। কোন কুক্ষনে যে বুড়োটার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো~ ভাবছে ও। শহরে আসলো এক বুড়ির আশায় যে স্বপ্নের মানে বলে দিতে পারবে। ও যে একটা রাখাল এতে মনে হলো বুড়ি, বুড়ো দুজনের কেউই তার কদর একটুও বুঝলোনা। নির্লিপ্ত রকমের দুই আলাদা মানুষ, কিছুই বোঝানো যায়না ওদেরকে, যত্তসব। বুঝলোইনা যে রাখালরা ওদের ভেড়াদের সাথে কত গলাগলি করে জড়িয়ে আছে। ওর ভেড়াপালের প্রতিটা সদস্যের সব জানে ওঃ কোনটা খোঁড়া, কোনটার দু-মাসের মধ্যেই বাচ্চা হবে, কোনটা কুঁড়ের হাড়ি, কিভাবে উল ছাঁটতে হয়, জবাই করতে হয় সব জানে সান্টিয়াগো। কখনো ভেড়াগুলোকে ছেড়ে যেতে হলে কিযে হবে ওদের।
বাতাস বইতে আরম্ভ করলো। সেরেছে, এটা লেভান্টার, এই বাউল বাতাসের ওপর ভর করেই লেভান্ট এর মুর রা একদিন পূর্ব ভূমধ্য অঞ্চল থেকে এদিকটায় এসে খুঁটি গেড়েছিল।
লেভান্টারের বেগ ক্রমেই বাড়ছে। কি যে একটা অবস্থা হলো, একদিকে আমার ভেড়াপাল, আরেকদিকে ধন-রত্নের হাতছানি, ভাবে সান্টিয়াগো। একদিকে সুনিশ্চিত অভ্যস্ত এক জীবন, আরেকদিকে স্বপ্ন লালিত চাওয়া~ একটা প্রবল ইচ্ছে; আর এ দু’য়ের মধ্যে একটাকে তো বেছে নিতেই হবে। তারওপর আছে বনিকের মেয়ে, অবশ্য তার আবেদন ওর কাছতো আর ভেড়াদের মত না, মেয়েটাতো আর সান্টিয়াগোর পথ চেয়ে বসে নেই। এমনওতো হতে পারে, মেয়েটা ওকে আর মনেই রাখেনি।
সান্টিয়াগো নিশ্চিত যেদিন ওর সাথে মেয়েটার দেখা হয়েছিল, সেদিনটা মেয়েটার জন্য অন্তত কোনো আহামরি দিন ছিলনা; প্রতিদিনইতো তার কাছে একই রকম। যারা জীবনের চমৎকার ব্যাপার গুলোর মর্ম বোঝেনা, একেকটা দিনের শুরু যে একেকটা নতুন আর সুন্দর জিনিসের সম্ভাবনা নিয়ে আসে সেটা যারা বোঝেনা, তাদের আজ আর কাল তো একই রকম হবে।
মা-বাবা, আমার শহর, বড় দালান সেসব পর্বতো কবেই পার করে এসেছি। আমার অনুপস্থিতিতে ওরা আজ অভ্যস্ত, আমিও তাই। তাহলে একসময় হয়তো ভেড়ারাও আমার না থাকায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে, ভাবলো সান্টিয়াগো। এখানটায় বসে এখনো সেই চত্বরটা দেখতে পাচ্ছে। লোকজন সেই রুটিওয়ালার দোকানে ঢুকছে, বেরোচ্ছে। বুড়োর সাথে যে বেঞ্চিটায় বসে আলাপ করছিলো, সেখানটায় একটা তরুণ জুটি বসে আছে এখন, ওরা চুমু খেলো।
“বেচারা রুটিওয়ালা...” অজান্তেই নিজের মনে বলল সান্টিয়াগো। লেভান্টারের জোর তখনো বেড়েই চলছে, তার তীব্র ঝাপটা এসে লাগলো ওর মুখে। এই বাতাস এখানে মুর জাতি কে নিয়ে এসেছিল ঠিকই তবে আরও এনেছিল উষর মরু আর ঘোমটাবৃতা মেয়েদের সুবাস। এনেছিল সেইসব পরিশ্রমী মানুষের ঘাম আর স্বপ্ন যারা অজানার খোঁজে, সোনাদানা, দু: সাহসিক অভিযানের মোহে, আর পিরামিডের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল একদিন। বাতাসের এই যে স্বাধীনতা, এতে ঈর্ষা হয় সান্টিয়াগোর। দিব্যচোখে দেখতে পায় ঠিক এমনই অবাধ স্বাধীনতাতো ওর-ও হতে পারত। নিজের পিছুটান আর কেউই নয়, সে নিজেই। ওর ভেড়াগুলো, সেই যে বণিকের মেয়ে, আর আন্দালুসিয়ার চিরচেনা মাঠ- প্রান্তর ওর জীবনগল্পের গন্তব্যের পথে কেবল কয়েকটা সোপান মাত্র।
(চলবে)
অনুবাদ- জে এফ নুশান
মন্তব্য
আপনার লেখা পড়ছি।ভাষা জানা থাকেলেই অনুবাদ করা যায় এটা অনেকেরই ধারণা আমারও ছিলো। দু’একবার চেষ্টা করে বুঝেছি অনুবাদ জিনিসটা মহা ঝামেলার একটা ব্যাপার। কোন বিদেশী ভাষায় লেখা বই পড়তে পড়তে ভেবেছি বেশ ঝরঝরে অনুবাদ করা যায়। কিন্তু কয়েক ধাপ এগিয়েই চোরাবালিতে আঁটকে হাঁসফাঁস অবস্থা। যারা অনুবাদ করেন তাদের ধৈর্য আর পরিশ্রমের প্রশংসা না করে থাকতে পারিনা। আপনার লেখা থামাবেননা, চলুক।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ, সোহেল ইমাম। কেউ কেউ আছেন অন্যের ওপর আলো ধরেন, আবার কেউ কেউ সেটা করতে গিয়ে নিজের ওপর থেকে আলো সরিয়ে নেন; দ্বিতীয়টা কঠিন। শ্রদ্ধা।
নুশান
এই সিরিজটা পড়ছি নিয়মিত। ভালো লাগছে। অনুবাদের যে একটা কাটখোট্টা ভাব আছে যে, পড়লেই বোঝা যায় সেটা অনুবাদ - সে ভাবটা অবশ্য থাকবেই। এড়ানো খুবই কঠিন। এছাড়া ভালোই। ভিন্ন ভাষার নতুন একটা গল্প পড়তে পারছি, ভালো লাগছে। চালিয়ে যান। ধন্যবাদ।
আঘ্রাণ প্রান্তর
অনুপ্রেরণার জন্য ধন্যবাদ, নিবিড়। চালিয়ে যাব।
নুশান
নতুন মন্তব্য করুন