“স্যার আজকে হঠাৎ ডাকলেন যে...”, দবির মিয়া উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“দবির বর্ষাকাল তো এসে গেলো, এবার অনেক আগে চলে এসেছে…”, চেয়ারে হেলান দিয়ে অনেকটা আয়েশি ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন আজম সাহেব।
“হ্যাঁ, তা তো এসেছে, বৃষ্টিও পড়ছে বেশ ভালোই”
“আচ্ছা শহরের রাস্তাঘাটের অবস্থা কি?”
“রাস্তাঘাট তো মোটামুটি বেশিরভাগ খুঁড়ে ফেলেছি, এখন খুঁড়ে রেখে দেব যাতে বৃষ্টি পড়ে আরও একটু খারাপ হয় তাহলে পরে আবার ঠিক করার জন্য অর্থবরাদ্দ চাইতে পারবো। সব তো আপনিই শিখালেন স্যার”, হাসতে হাসতে জবাব দিলো দবির মিয়া।
আজম সাহেব সোজা হয়ে বসে দবির মিয়ার দিকে একটু সামনে এগিয়ে এলেন, “আরেকটা খুঁড়তে পারবেন আমার জন্য?”
“যেসব এলাকা আমার ঠিকাদারিতে ছিল তার কোনোটাতেই আর খোঁড়ার উপায় নাই, বেশিরভাগ খোঁড়া শেষ”
“আপনি আমার চেয়ে বেশি বুঝেন নাকি? আপনাকে ঠিকাদারি দিয়েছি আমি, আপনার এলাকায় কোথায় কি হচ্ছে আপনার চেয়ে আমি বেশি জানি”, ডেস্কের ড্রয়ার থেকে শহরের একটা ম্যাপ বের করতে করতে বললেন আজম সাহেব।
“এই যে শহরের উত্তরে বীরপুরের গাজীপাড়া এলাকাতে এখনো প্রায় তিন থেকে চারটা রাস্তা পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় আছে। গতবার এগুলাতে হাত দেই নাই ইমারজেন্সির কথা চিন্তা করে, এখন আমার ইমারজেন্সি, এখান থেকে একটা খুঁড়ে ফেলেন বাকিটা আমি দেখছি”
দবির মিয়া ম্যাপের উপর ঝুঁকে পড়লেন, “ও আচ্ছা, এই চারটা বাকি ছিল, একদম খেয়াল ছিল না, কিন্তু স্যার আপনার কিসের ইমারজেন্সি হঠাৎ?”
“আরে ভাই বুঝেন না? আমার ছেলেকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছি, ওখানে গিয়ে দুটা সাবজেক্টে ফেল করেছে। ঐ সাবজেক্টগুলো তো আবার নিতে হবে নাকি, ফ্রিতে তো আর বিদেশে পড়া হয় না”, আজম সাহেব মুখ ঝামটা দিলেন।
“সমস্যা নাই, একটা রাস্তাই তো খুঁড়বো। এ আর এমন কি, কত বছর ধরেই তো বর্ষাকালে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছি। কিন্তু স্যার এবার আমার দিকটা একটু দেখবেন। গতবার একটু কম পড়ে গিয়েছিল, বুঝেনই তো”, পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে একগাল হাসলেন দবির মিয়া।
দবির মিয়ার এই পানের পিকওয়ালা দাঁতগুলো ছাড়া আর সবই মোটামুটি ভালো, একটু বোকা প্রকৃতির। সচরাচর এমন বোকা টাইপ ঠিকাদার পাওয়া যায় না। ভাগে কম পড়লেও দবির মিয়া কিছু বলে না, নাকি বুঝেই না কে জানে। আজম সাহেব শুধু ঐ পান খাওয়া দাঁত একদম সহ্য করতে পারেন না, নগদে বমি এসে যায়।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, কোনো চিন্তা নাই, আপনি কাজ শুরু করে দিন, আর 'উন্নয়ন কাজ চলিতেছে' এই সাইনবোর্ডটা লাগাতে ভুলবেন না যেন ”, দবির মিয়াকে আশ্বস্ত করলেন আজম সাহেব।
আজম সাহেব শহরের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের একজন বড়কর্তা, অনেক বড় সরকারি পদ। অনেক কষ্টে এতদূর এসেছেন। কিন্তু কোথা থেকে বা কাদের মধ্য থেকে এ পর্যন্ত এসেছেন ওটা এখন আর তেমন মনে পড়ে না। তবে হ্যাঁ, যখন বর্ষাকালে শহরের রাজপথে নিজের সরকারি গাড়ি হাঁকিয়ে যান আর দূরে আমজনতার জলাবদ্ধ রাস্তা দেখতে পান, যখন দেখেন রিকশা উল্টে পড়ে মানুষ পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে তখন মাথায় একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে বারবার,
সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
কার যেন কবিতা, চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার সময় এগুলো কষে মুখস্ত করেছিলেন। চাকরি পেয়ে যাবার পর কে কোথায় কখন কোন কবিতা লিখেছে তাতে কারো কিছু এসে যায় না, আজম সাহেবও আর ওসব মনে রাখেননি।
আসল ব্যাপার হল অবচেতন মনে আজম সাহেব জানেন যে যখন তিনি বড়কর্তা ছিলেন না, তখন তিনিও ঐ জলাবদ্ধ রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতেন। বেশ কয়েকবার ঐ নোংরা পানিতে তিনিও পড়েছেন। একবার তো এক চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে যাবার সময় রিকশা উল্টে পানিতে পড়ে গেলেন, নিজে ডুবে হাত উপরে রেখে অনেক কষ্টে সার্টিফিকেটগুলো রক্ষা করেছিলেন। নিজের জীবন যাবে যাক, তাও সার্টিফিকেট তো বাঁচাতে হবে। হাজার হোক দিনশেষে উনার জীবনও তো বেশিরভাগ মানুষের মত কাগজ সর্বস্ব। সেই কাগজই যদি না থাকে তাহলে জীবনে আর কি থাকলো। শুধু একটা অসাড় দেহ যার মাঝখানটায় একটা হৃদপিণ্ড, দুপাশে দুটা ফুসফুস, নিচে পাকস্থলী আর যকৃত সাথে দুটা কিডনি, আর মাথায় কি আছে ওটা নিয়ে আজম সাহেব নিজে বা অন্য কেউ আর ইদানিং বিশেষ ভাবে না।
তবে বড়কর্তা হবার পর অনিবার্য কারণ বশত আজম সাহেব আর তাঁর পরিবার বেশে ফুলে ফেঁপে উঠলেন। এখন তাঁর স্ত্রী সন্তান সবাই ট্রেডমিলের উপর রাতদিন দৌড়ায়। না দৌড়ে উপায় কি? ওজনটা যা বেড়েছে না! অসুখ করলে তো আবার যেতে হবে সিঙ্গাপুর, তার চেয়ে দৌড়ই ভালো।
কিন্তু আজম সাহেব সম্প্রতি তাঁর স্ত্রী সন্তানের ওজন কমাবার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন। সরকারের নির্দেশে চুরি দমন কমিশন চোর ধরার জন্য বেশ উঠে পড়ে লেগেছে। কদিন আগে আজম সাহেবের এক সহকর্মী আরেক বড়কর্তা নিখিলেশ বাবু ধরা খেলেন, পত্রপত্রিকায় রীতিমত তোলপাড়। নিখিলেশ বাবুকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। নিখিলেশ বাবু শুরুতে বেশ ভীত ছিলেন, পরে উপরওয়ালাদের একজন তাকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, এটা শুক্রবার বিকেলে নাট্যমঞ্চে নাটক দেখতে যাবার মত একটি ব্যাপার। নাটক একটা নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয়ে আবার ঘণ্টাখানেক পর শেষ হয়ে যাবে। এরপর নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীরা যে যারযার মত বাসায় ফিরে যাবে, কিছুদিন পর ঐ নাটকের দর্শকরাও নাটকটা ভুলে যাবে। কাজেই নিখিলেশ বাবুর চিন্তার কিছু নেই।
এরপর থেকে বেশ কিছুদিন আজম সাহেব ভয়ে ভয়ে অফিসে যেতেন আর সারাক্ষন কেন যেন মাথায় মান্না দের কফি হাউজের সেই আড্ডাটা গানটা ঘুরতে থাকত কিন্তু ভিন্ন লিরিকে,
নিখিলেশ হাজতে আজম আছে পালিয়ে, নেই তারা আজ খোঁড়াখুঁড়িতে
যাহ্! নিখিলেশ বাবুর নামটাও কিভাবে যেন গানের এক চরিত্রের সাথে মিলে গেল।
কয়েক সপ্তাহ বাদে নিখিলেশ বাবু যখন হাসতে হাসতে অফিসে আসলেন, অফিসে সবার মাঝে আবার স্বস্তি ফিরে এলো। তখন তারা পুনরায় খোঁড়াখুঁড়ি, রড এবং বাঁশের প্রতিস্থাপনযোগ্যতা ইত্যাদি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে শুরু করলেন। কারণ নাটক তো শেষ, দর্শকও নেই কাজেই ভয় কিসের। উপরি পাওনা হিসেবে একই ধরণের পরবর্তী সঙ্কট ও তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্যতার ব্যাপারেও সবাই নিশ্চিন্ত হলেন। কারণ কবি বলেছেন ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে”। এটা ভাবসম্প্রসারণ আকারে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রায়ই আসে কাজেই সবারই মনে গেঁথে আছে। কবি সাহিত্যিকেরা সত্যিই অসাধারণ।
*
একদিন সকালে অফিসে এসে আজম সাহেব পত্রিকাটা হাতে নিলেন। প্রথম পাতাতেই বড় হেডলাইন ‘১৫ মিনিটের বৃষ্টিতেই রাজপথে নৌকা’। দেখে আজম সাহেব যারপরনাই বিরক্ত হলেন। পত্রিকাগুলো কি হেডলাইন দেয়ার জন্যে আর কিছু খুঁজে পায় না? বর্ষা কাল আসলেই হলো, এদের একেবারে পোয়া বারো। সবসময় কানের কাছে ভনভন না করলে এদের মনে হয় খাবার হজম হয় না। আর এ বছর বৃষ্টিটাও একটু আগেই এসে গেছে।
“স্যার আসবো?”, দবির মিয়া দরজা খুলে মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“আরে দবির, আপনি আজকে কেন? আপনার তো আজকে আসার কথা না”, আজম সাহেব দবির মিয়াকে দেখে একটু অবাক হলেন।
“না একটা জরুরী দরকার”
“কি দরকার?”
“আপনি মনে হচ্ছে কিছু শোনেন নাই?”
“কি শুনবো?”
“মন্ত্রী নাকি আজকে শহরের জলাবদ্ধতা সরেজমিনে দেখতে যাবেন, আপনারও যাবার কথা”, দবির মিয়া জানালেন।
“কি বলেন? হঠাৎ?”, আজম সাহেব উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
“না মানে, ধানসিঁড়ি ৭২ নম্বর রোডে নাকি বৃষ্টির পানিতে রিকশা উল্টে ভয়াবহ অবস্থা, মানুষ নাকি আহতও হয়েছে, আপনি জানেন না বোধ হয়?”
“আমি কিভাবে জানবো? আমি তো শহরের ম্যাপ নিয়ে ব্যস্ত, কোথায় কোথায় রাস্তাঘাট এখনো অক্ষত আছে ওটা ঘাটাঘাটি করছি বেশ কিছু দিন ধরে”, বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন আজম সাহেব।
“মন্ত্রী সাহেব আজকেই যাবেন নাকি?”, কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আজম সাহেব।
“তাইতো শুনলান, দুপুরের দিকে যাবেন। টিভি চ্যানেল, সাংবাদিক সবাই গিয়ে সরাসরি সম্প্রচার চালাচ্ছে আর যাকে পাচ্ছে তাকেই নাকি ফিলিংস কেমন জিজ্ঞাসা করছে!”
“ফিলিংস মানে? কিসের ফিলিংস?”, আজম সাহেব ঠিক বুঝলেন না।
“ফিলিংস মানে, এই যে রিকশা থেকে যাত্রীদের রাস্তায় নোংরা পানিতে পড়ে যাবার পরের অনুভূতি”, দবির মিয়া বুঝিয়ে বললেন।
“ও… আচ্ছা”, আজম সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। এরপর আজম সাহেব আর দবির মিয়া কিছুক্ষণ একে অন্যের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলেন।
আজম সাহেবের আজকে বিকেলে সবাই মিলে বইমেলাতে ঘুরতে যাবার কথা, গেলো সব প্ল্যান মাটি হয়ে। ভেবেছিলেন বইমেলা থেকে ফ্রানৎস কাফকার কিছু বই কিনবেন। ঠিক পড়বার জন্য নয়, ঘর সাজানোর জন্যে। কিছুদিন আগে একজনের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে শোকেসে কাফকার বই দেখেছিলেন, বাহ কি সুন্দর লাগছিলো। এই ধরণের বই বসার ঘরে সাজিয়ে রাখলে একটা আলগা সংস্কৃতিমনা ভাব আসে যেটা কিনা আজম সাহেবের খুব পছন্দ।
ধানসিঁড়ি ৭২ নম্বরে গিয়ে তো আজম সাহেবের রীতিমত আক্কেল গুড়ুম। এখানে রাস্তা কোথায় সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না, এ তো এক স্রোতস্বিনী তটিনী! গাড়িগুলোর চাকা কি আদৌ মাটি স্পর্শ করছে? নাকি ওগুলো অনেকটা ভেসে ভেসে চলছে। এসব দেখে আজম সাহেবের মাথায় হঠাৎ রবীন্দ্র সংগীত বেজে উঠলো,
ওগো নদী আপন বেগে পাগল-পারা,
আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা
কি জঘন্য গন্ধ পানি থেকে! যে কেউই তন্দ্রাহারা হতে বাধ্য।
“স্যার নামেন, মিনিস্টার সাহেব এখানেই নামছেন”, ড্রাইভার পিছনে ফিরে বলল।
নামবেন মানে? বলে কি! এই গন্ধ পানির মধ্যে কিভাবে কি? তার উপর আজম সাহেব আজকে এক জোড়া দামি জুতা পড়ে এসেছেন। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে গত মাস বিদেশে গিয়েছিলেন, ওখান থেকেই কেনা। ইশ এই অবস্থা হবে জানলে আজ এই জুতা জোড়া নিশ্চয় পড়ে আসতেন না।
এখন আর কিছু করার নাই, বুকে ফু দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। নামার সাথে সাথেই আজম সাহেবের বুকটা ধক করে উঠলো, দামি প্যান্ট, দামি জুতা সব শেষ। মন্ত্রী সাহেব আগে থেকে জানতেন দেখে নিজে সব সস্তা জিনিস পড়ে এসেছেন, অন্যদেরও একটু জানালেই হত। কিন্তু কি ব্যাপার মন্ত্রী সাহেবকে একটু বেসামাল মনে হচ্ছে কেন?
“উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেও রাস্তাঘাটে পানি উঠছে, কালই দেখলাম। আমাদের দেশেও উঠছে। তার মানে আমরাও উন্নত বিশ্বের কাতারে দাড়াচ্ছি। এটা উন্নয়নেরই একটি প্রতীকী ব্যাপার, সবকিছুতেই আমাদের ইতিবাচক কিছু খুঁজে নেয়া উচিৎ”, সাংবাদিকদের উদ্যেশ্যে বললেন মন্ত্রী।
আজম সাহেব মন্ত্রীর কথা শুনে বুঝতে উঠতে পারলেন না উনি আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন, শুরুতেই লোকটাকে একটু বেসামাল মনে হচ্ছিল। ভালো মন্দ কিছু খেয়ে এসেছে কিনা কে জানে।
“কিন্তু আপনি উন্নত বিশ্বের শহরে যে জলাবদ্ধতার কথা বলছেন ওটা সাইক্লোনের কারণে হয়েছে তাও সাময়িক”, জনৈক সাংবাদিকের পাল্টা বক্তব্য।
“আপনারা প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেন, তাও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার এ হাল কেন?”, রাগী রাগী চেহারার একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন।
“হ্যা নিশ্চয়, গত বছর আমরা দুশ কোটি টাকার একটা প্রকল্প শুরু করেছিলাম যার মধ্যে দেড়শ কোটি টাকা শেষ হয়ে গেছে আর বাকি পঞ্চাশ কোটি দিয়ে আমার স্ত্রীর নামে একটি…”, এই যাহ্! বেরিয়ে গেল।
আজম সাহেবের আর কোনো সন্দেহই রইল না। মন্ত্রী আসলেই কিছু খেয়ে এসেছেন, তবে যা ই খান না কেন খুব ভালো কাজ করছে।
“আসলে আমার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসি তো, তাই ভুলে ওর কথা মুখে এসে গেল, আপনারা কিছু মনে করবেন না”, হাসিহাসি মুখে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন মন্ত্রী।
তবে লাভ নেই, সংবাদ মাধ্যমে বোমা যা ফাটার তা ফাটলো। আশপাশে সবাই মন্ত্রীর কথা শুনে কিছুক্ষণ হা করে ছিল। সাংবাদিকদের সবার মুখে একটা খুশি খুশি ভাব। হবেই না বা কেন, এই মাত্রই যে তারা অমুল্য একটা নিউজ আইটেম পেলেন।
আজম সাহেবের চেহারা রাগে রক্তবর্ণ ধারণ করলো। মন্ত্রী ব্যাটা নিজে তো গর্তে পড়ল, সবাইকে নিয়েই পড়ল। এখন আজম সাহেব থেকে শুরু করে নিখিলেশ বাবু পর্যন্ত সবাইকে আবার দুরু দুরু বুকে থাকতে হবে। কারণ মন্ত্রীর মত আজম সাহেব আর তার সকল সহকর্মীও যে তাদের স্ত্রীদের অনেক ভালোবাসেন, সবকিছুই একেবারে নিঃস্বার্থভাবে স্ত্রীর নামে কেনেন।
পরদিন সকালে আজম সাহেব ভয়ে ভয়ে অফিসে গেলেন। ভয় পেলেও তা মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। কারণ ইদানিং মানুষের স্মৃতি গোল্ডফিশের চেয়েও খারাপ, কাজেই মন্ত্রী মুখ ফসকে কি বলেছেন ওটা সবাই ভুলে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।
কিন্তু অফিসে ঢুকে অবস্থা কিছুটা বেগতিক মনে হলো। সবার চেহারায় এক ধরণের আতঙ্কের ভাব। আজম সাহেব ভাবলেন এরা মিছেমিছি ভয় পাচ্ছে। আবার একটু সন্দেহও হচ্ছিলো কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছিলেন না, ভালোই যন্ত্রণা।
শেষমেশ দবির মিয়াকে একটা ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দবির মিয়া বোকাসোকা হলেও সব খবরাখবর রাখে।
“হ্যালো দবির, আপনি কোথায়?”
“আমি শহরের বাইরে চলে যাচ্ছি স্যার”, ফোনের ওপাশ থেকে হন্তদন্ত হয়ে উত্তর দিলো দবির মিয়া।
“আরে কি বলেন, আপনাকে কত কাজ দিলাম আর আপনি ওগুলো ফেলে কই যাচ্ছেন এই সময়? আমাকে তো আগে থেকে জানাননি”, আজম সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন।
“স্যার আপনি জানেন না যে নিখিলেশ বাবুকে গতকাল উনার বাসা থেকে চুরি দমন কমিশন ধরে নিয়ে গেছে? মন্ত্রী সাহেব মুখ ফসকানোর কারণে অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে। তাছাড়া গতবছর নিখিলেশ বাবুর সাথে মিলে হাড্ডিভাঙ্গা ইউনিউওনে ধানক্ষেতের উপর একটা ব্রিজ বানিয়েছিলাম, আমি আপাতত গা ঢাকা দিচ্ছি ”, দবির মিয়া বেশ উত্তেজিত।
আজম সাহেব কয়েকটা ঢোক গিললেন। গলাটা শুকিয়ে আসছে, “কিন্তু আমি তো অফিসে, আচ্ছা মানে আমার এখন কি করা উচিৎ? ইয়ে মানে …”, ইতস্তত করলেন আজম সাহেব।
“স্যার আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গা ঢাকা দিন, আর সরকারি গাড়িটা ব্যবহার করবেন না, অন্য যা কিছু পান তাতে করেই ভেগে যান”, অভিজ্ঞ দবির মিয়ার সুচিন্তিত পরামর্শ।
“আচ্ছা ঠিক বলেছেন। আমি তাই করছি, রাখি তাহলে”, আজম সাহেব ফোনটা রেখে আর দেরি করলেন না, জরুরী কিছু কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে গা ঢাকা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।
আজম সাহেব উনার রুম থেকে বের হয়ে দেখলেন আরো অনেকেই ভেগে যাচ্ছে। সবাই জানে যে তারা পালাচ্ছে তবে কেউ কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছে না। আজম সাহেবও কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন।
বাইরে এসে একটা রিকশা নিলেন, প্রথমে উনার শ্বশুরবাড়ী যাবেন তারপর অন্য কোথাও। রিকশার ঝাঁকুনিতে উনার মেরুদণ্ডের প্রতিটি স্ক্রু ঢিলা হয়ে যাবার যোগাড়। আজম সাহেব ভেবেই পাচ্ছেন না যে এমন রাস্তায় মানুষ প্রতিদিন চলে কিভাবে? হঠাৎ মনে পড়ল যে গতবার এই রাস্তাটা ঠিক করার জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ করেছিল। ঐ মুহূর্তেই পাশ দিয়ে শোঁ করে একটা নতুন মডেলের পাজেরো চলে গেলো, সাথে সাথেই আজম সাহেবের চোখে ভেসে উঠলো গত মাসে কেনা পাজেরোটা। এরপর রাস্তার ব্যাপারটা উনি জোর করে মন থেকে সরিয়ে দিলেন।
ভাবতে ভাবতে সামনে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হলো আজম সাহেব উপকূলীয় কোনো শহরে এসে গেছেন আর সামনে সমুদ্র। ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন যে না, সমুদ্র নয়। রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে আর সামনে বৃষ্টির পানি জমে আছে। রিকশাগুলো আধা ডুবে আছে, একটা গাড়ি সবাইকে বিনামুল্যে গোসল করাবার নিঃস্বার্থ দায়িত্ব নিয়ে দুপাশে পানি ছড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। কিছু করার নেই দেখে আজম সাহেব পা গুলো যতটা সম্ভব উপরে তুলে নিলেন। রিকশা নেমে গেলো পানিতে আর শুরু হয়ে গেলো এক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার।
পানি কেটে কেটে রিকশাটা এগিয়ে যাচ্ছে। আজম সাহেব আশপাশের রিকশায় বসা বিভিন্ন মানুষের দিকে তাকালেন। কিছু কিছু মানুষ উনার মত ভীত, কিছু মানুষ কিছুটা উত্তেজিত আর কয়েকজন একেবারেই ভাবলেশহীন নির্বিকার। এই অবস্থায় মানুষ ভাবলেশহীন থাকে কিভাবে? তাজ্জব ব্যাপার! এদের কোনরকম ভয়ডর নেই।
হঠাৎ একটা বিকট শব্দ! আজম সাহেবের প্রথমে মনে হল উনি আকাশে উড়ছেন, আবার মনে হল মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। এমন করতে করতে ঝপাস করে আরেকটা শব্দ আর আজম সাহেব আবিষ্কার করলেন উনি ময়লা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন, এই যাত্রায় কাগজপত্র আর বাঁচাতে পারলেন না। পিছনে ফিরে দেখেন উনার রিকশাটা পুরো উল্টে পড়ে আছে।
আজম সাহেব রাগে বিরক্তিতে আর শান্ত থাকতে পারলেন না। জোরে একটা চিৎকার দিলেন, “একটু বৃষ্টি পড়লেই পানি উঠে সব একাকার হয়ে যায়, আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে বাটপারি করা ছাড়া শহর কর্তৃপক্ষ আর কবে কি করেছে? এসব চোরের দলকে ধরে রীতিমত উত্তম মধ্যম দেয়া উচিৎ”
হঠাৎ আজম সাহেবের হুঁশ ফিরে এলো আর মনে পড়ল যে আজম সাহেব নিজেই শহর কর্তৃপক্ষের অন্যতম একজন বড়কর্তা। এদিক ওদিক ফিরে দেখলেন সবাই উনার দিকে তাকিয়ে। দূরে তাকিয়ে দেখলেন এক ভদ্রমহিলা হাঁটু পানিতে বাচ্চাকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, তার পাশে এক বয়স্ক ভদ্রলোক হাতে লাঠি নিয়ে এই ময়লার পানির মধ্যে কোনরকমে হাঁটছেন। তার মানে কি উনাদের প্রত্যেকেরই এখন মনে মনে আজম সাহেবকে ইচ্ছেমত পেটাতে ইচ্ছা করছে?
এখানে একটি কাল্পনিক শহরের কথা বলা হয়েছে। পাঠক তার কল্পনার খাতিরে উপযুক্ত যেকোনো শহরকে বেছে নিতে পারেন, তার জন্যে লেখক কোনভাবে দায়ী নয়।
রত্নদীপ তূর্য
মন্তব্য
সময় নিয়ে পড়ার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শহর আর শহরের অবস্থাটা হয়তো অনেক শহরের সাথেই মিলে যাবে কিন্তু শহরকর্তৃপক্ষের বিপদটা কাল্পনিক। এইটা দেখার জন্য এখনও অপেক্ষায় আছি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আমিও অপেক্ষায় আছি। পড়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন