ডিসেম্বরের শেষ, শীতের বিকেল। অফিস থেকে একটু আগেই বেরিয়ে পরলেন আকরাম সাহেব। রাস্তায় নেমে হাত ঘড়িতে দেখলেন চারটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। কালো প্লাস্টিকের বেল্টের ক্যাসিও ঘড়ি, ডিজিটাল ডায়াল। কই মাছের প্রান টাইপের জিনিস। আকরাম সাহেবের ছেলেবেলায় এই ধরনের ঘড়ি সাধারণত ক্লাস ফাইভ বা এইটে বৃত্তি পেলে কিংবা বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে বাবারা ছেলেদের পড়াশোনায় আরও উৎসাহ দেয়ার জন্য কিনে দিতেন। আকরাম সাহেবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন ঘটেনি। কারন স্কুল জীবনে তিনি কখনোই খুব ভালো ফলাফল করতে পারেন নি, আবার খুব খারাপও করেন নি। তিনি যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন তখন তাঁর ছোটমামা সৌদিআরব থেকে এই ঘড়ি নিয়ে এসেছিলেন। একটা ঘড়ি, একটা জায়নামাজ, ২ টা তসবি আর এক বোতল জমজমের পানি তাঁদের বাসায় পাঠানো হয়েছিল। তখন আকরাম সাহেবের পরিবারে ছিলেন তাঁর বাবা, মা আর ছোটবোন। এই ঘড়ি হাতে পরার মত তাঁর চেয়ে বেশি উপযুক্ত কাউকে বাসায় পাওয়া যায়নি বলে তিনি এটা লাভ করেছিলেন। তা প্রায় ২০ বছর আগের কথা। এর মাঝে আকরাম সাহেবের জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবা মারা গেছেন, তিনি চাকরীর সন্ধানে মফঃস্বল থেকে ঢাকায় পাকাপাকিভাবে চলে এসেছেন, বোনের বিয়ে হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এত কিছুর মাঝেও এই ২০ বছরে ঘড়িটা কিভাবে টিকে গেল, আর টিকে গেলেও কেন হারিয়ে গেলনা তা এক রহস্য। তিনি অংকের ছাত্র না হলেও এতটুকু বোঝেন যে এতদিনে এটার হারিয়ে যাবার কিংবা নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাব্যতাই বেশি ছিল, কিন্তু তা হয়নি। যেটা হয়ত ওয়ান ইন আ মিলিয়ন টাইপ ঘটনা। এমন কত আপাত তুচ্ছ, কিন্তু রহস্যময় ঘটনাই আমাদের চারপাশে সবসময় ঘটছে। কে তার খবর রাখে? রহস্যময় ভাবলেই রহস্যময়, না ভাবলে নাই।
আকরাম সাহেবের অফিস মোহাম্মদপুরে। তিনি একটা বহুজাতিক কোম্পানীর একাউন্টসে কাজ করেন। বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বলে সবাই একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায়। আকরাম সাহেবও বৃহস্পতিবার বিকেলটা নিজের মত করে ঘুরে-ফিরে কাটান। তিনি বিয়ে করেন নি, একাই বক্সিবাজার একটা মেসে থাকেন। আকরাম সাহেবের মা, তাঁর বোনের সাথে সিলেটে থাকেন। তাই বাড়ি ফেরার তাড়া আকরাম সাহেবের কখনই ছিলনা। তিনি ঝুলতে ঝুলতে মোহাম্মদপুর থেকে নিউমার্কেটগামী একটা বাস এ উঠে পড়লেন। বাহ, বেশ ফাঁকা বাস। তিনি জানালার ধারের একটা সিটে বসে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিলেন। এই বাস বক্সিবাজার যাবেনা, আজিমপুর পর্যন্ত যাবে। অন্যদিন হলে তিনি আজিমপুর থেকে বক্সিবাজারের জন্য রিকশা নিতেন। যেহেতু আজ তিনি কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে সময় কাটাবেন, তাই তিনি নীলক্ষেতে নেমে পড়লেন। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি নীলক্ষেত থেকে হাটতে হাটতে বক্সিবাজার চলে যান। মাঝখানে পলাশীর মোড়ে বিকেলের নাস্তাটা সেরে নেন।
নীলক্ষেতে ফুটপাতের বইয়ের দোকানের সামনে ঘুরতে তাঁর বেশ লাগে। এমনিতে তিনি যে অনেক বই পড়েন কিংবা পড়াশুনা করেন এমন নয়। মেসের ডাইনিঙে প্রতিদিন ২-৩ টা খবরের কাগজ রাখা হয়, সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় তিনি সেগুলোর মাঝে যেটা ফাঁকা পান, উলটে পালটে দেখেন, ঐটুকুই। পৃথিবীতে যে কত বিচিত্র বিষয়ের উপর বই লেখা হয়েছে তা নীলক্ষেতের এই ফুটপাতগুলোর উপর চোখ বোলালে বোঝা যায়। এই ব্যাপারটা তাঁকে বেশ চমৎকৃত করে! বই এর দিকে চোখ রাখতে রাখতে তিনি জনস্রোতে ভেসে ভেসে বামে মোড় নিলেন, এবার শুরু হয়েছে তেহারীর দোকান। সর্ষের তেলের গন্ধ তাঁর নাকে আসছে, দোকানের বেয়ারারা হাঁক -ডাক দিচ্ছে কাস্টমার ধরার আশায়। খিদেয় আকরাম সাহেবের পেট মোচড় দিচ্ছে, কিন্তু তিনি তেহারি খেতে তেমন আগ্রহবোধ করলেন না। একবার নীলক্ষেতের তেহারি খেয়ে তাঁর ভয়াবহ ফুড পয়জনিং হয়েছিল, মেসের লোকজন ধরাধরি করে ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যায়, পাক্কা ৪৮ ঘন্টা ভর্তি থাকার পর তিনি সুস্থ হন। এরপর থেকে তিনি নীলক্ষেতে তেহারি খাওয়া বাদ দিয়েছেন।
তেহারির দোকান শেষ হলে শুরু হল প্রিন্টিং, ফটোকপি আর লেপ-তোষকের দোকান। দুইটা জোয়ান ছেলে দোকানের সামনে কাপড় বিছিয়ে তুলো ফেলে বড় বড় লাঠি দিয়ে ধুনছে। দোকানের ভেতর এক বয়স্ক বিক্রেতা, মাথায় টুপি, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। আকরাম সাহেব কে আয়েশি ভঙ্গিতে হাটতে দেখে বললেনঃ “ বালিশ লাগবো নাকি ভাই? অরিজিনাল শিমুল তুলার বালিশ, একটা নিয়া যান।“ বিক্রেতার চেহারা দেখে তিনি ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। অবিকল উনার মৃত বাবার মত দেখতে, একটুও ভুল নেই! তিনি থতমত খেয়ে কোনমতে বললেন “না, বালিশ লাগবেনা।“ বৃদ্ধ বললেন “ আরে ভাই ভিতরে আইসা জিনিসটা দেখেন, ভালো না লাগলে নিয়েন না।“ তিনি সম্মোহিত হয়ে দোকানে ঢুকে সাদা গদি আঁটা টুলে বসে পড়লেন। তাঁর বিস্ময় কাটছেনা। তিনি শুনেছেন এই পৃথিবীতে নাকি একই রকম চেহারার ৭ জন মানুষ একই সময়ে থাকার সম্ভাবনা আছে। তাই বলে এত মিল! আশ্চর্য তো। লোকটা তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। এরকম মানুষ তিনি আগেও দেখেছেন, বিনা কারনে হাসে কিংবা তাদের মুখটাই হাসি-হাসি।
লোকটা আতর ব্যাবহার করে। আকরাম সাহেব কড়া আতরের গন্ধ পাচ্ছেন। লোকটার চোখে চোখ পড়তে তিনি দেখলেন লোকটার চোখে টেনে সুরমা দেয়া, আজকাল কেউ কি সুরমা পরে? তিনি কিন্তু লোকটার দিকে বেশিক্ষন তাকাতে পারলেন না, তাঁর খুব অস্বস্থি হচ্ছে; হয়ত তাঁর বাবার সাথে চেহারায় মিল বলে। তিনি পাশে গাদা করে রাখা বালিশগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “ঠিক আছে, দেখান, এই বালিশটা দেখান।“ বৃদ্ধ গাদা করা বালিশগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “আপনের জন্য এইগুলা না, সবাইরে কি সব জিনিস দেওন যায়?” এই বলে বৃদ্ধ তাঁর পেছনের শোকেসের তালা খুলে, তাকের ভেতর থেকে একটা লাল কাভার পরানো প্রমান সাইজের বালিশ বের করলেন। বালিশটা আর পাঁচটা বালিশের মতই তো! এতে বিশেষ কি আছে? তিনি বললেনঃ “দাম কত?” বৃদ্ধ বললেনঃ “আপনের ইনসাফ মত দেন।“ আতরের গন্ধে আকরাম সাহেবের মাথা ঝিমঝিম করছে, তিনি কোনরকম দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেন। পকেট থেকে তিনটা ১০০ টাকার নোট বের করে বুড়োর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলেন। আকরাম সাহেবের অস্বস্তি কাটছেনা। তিনি বিনা কারনে একটা বালিশ কিনেছেন, এই ব্যাপারটা হজম করতে তাঁর সময় লাগছে। তিনি এতটাও বোকা প্রকৃতির নন যে কেউ তাঁকে একটা বালিশ গছিয়ে দিয়ে টাকা হাতাবে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটেছে। তিনি অনেকটা তাড়াহুড়া করেই দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু কেন? আকরাম সাহেবের জানা নেই।
রাস্তায় নেমে তিনি বুকভরে নিঃশ্বাস নিলেন, আতরের গন্ধে ভেতরে দম আঁটকে আসছিল। তাঁর হাতে লাল তুলতুলে একটা বালিশ, তিনি নীলক্ষেত থেকে পলাশীর মোড়ের দিকে হেটে চলেছেন। কত অদ্ভুত ঘটনা-ই না ঘটে মানুষের জীবনে, একটু আগেও কি তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি বালিশ হাতে বাসায় ফিরবেন? এটাও কি সচরাচর তাঁর জীবনে ঘটবে যে তিনি বিনা কারনে বালিশ কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন? নিশ্চয়ই না। এটাও হয়ত তাঁর হাত ঘড়ি টিকে যাওয়ার মতই ওয়ান ইন আ মিলিয়ন টাইপ ঘটনা। আকরাম সাহেব ভাবতে লাগলেন আসলে মানুষের জীবনের প্রতিটা দিনই কিছু দিক থেকে আলাদা, আবার বেশিরভাগ দিক থেকে একইরকম। তাই অল্প পরিবর্তনটা মানুষ উপলব্ধি করেনা। তিনি প্রতিদিনই বাড়ি ফেরেন, এটা একঘেয়ে। আবার আজকের বিনা কারনে বালিশ কেনাটা নতুন। আগামীকাল হয়ত ফেরার সময় উনি জীবনে প্রথমবারের মত ছিনতাই হলেন, সেটা হবে নতুন। এমন নতুন পুরাতন ঘটনার মিশেলে জীবন কেটে যায় বলেই জীবন একই সাথে একঘেয়ে আবার রোমাঞ্চকর। একঘেয়ে জীবনের সাদামাটা পথে ওয়ান ইন আ মিলিয়ন টাইপ ঘটনা একের পর এক বাঁক সৃষ্টি করে রাখে; এসব ভাবতে ভাবতে তিনি পলাশীর মোড় চলে এলেন।
আকরাম সাহেব ঘড়ি দেখলেন, ছয়টা ত্রিশ। সূর্য আরও আগেই অস্ত গেছে, শীতের বিকেলে এমনই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। রাস্তার ধারে দোকানীরা নানা গরম খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছে। শহরের এই দিকটায় এখনও কিছু গাছপালা টিকে আছে। গাছপালার গা-গলে কুয়াশা বেরিয়ে এসে যেন শহরটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। কয়েকজন দোকানী গরম ভাপা পিঠা বানাচ্ছেন। তিনি তিনটা ভাপা পিঠা অর্ডার করলেন। ভাপা পিঠা থেকে গুড় আর নারকেলের গন্ধ মেশানো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে কুয়াশার চাদরে মিশে চারপাশটাকে কেমন মিষ্টি আর আদুরে করে তুলছে। আকরাম সাহেবের কেমন যেন আবছা আবছা ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বার্ষিক পরীক্ষার পর গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া, শীতের সন্ধ্যা, দাদীর হাতে বানানো খেজুরের গুড়ের পায়েস, আহ কি দিন-ই না গেছে!
রিকশার টুংটাং শব্দে তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন। দোকানী প্লাস্টিকের পিরিচে করে একের পর এক পিঠা দিতে লাগল। এবার আকরাম সাহেব বিপদে পড়লেন। উনার মনেই ছিলনা যে উনার হাতে ঢাউস সাইজের একটা বালিশ। বালিশ হাতে খাবেন কিভাবে! তিনি ইতস্তত করে আশেপাশে তাকাতে লাগলেন। একটা টোকাই-মত ছেলে গুটিশুটি মেরে পিঠার চুল্লীর পাশে আগুন পোহাচ্ছিল। তিনি ছেলেটাকে ডেকে বালিশ টা দিয়ে বললেনঃ “তুই বালিশটা ধর, আমি পিঠা খাই, তারপর তুই খাবি আমি বালিশ ধরব।“ ছেলেটা মাথা নেড়ে বালিশ হাতে আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল। পিঠা খাওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ আছে বলে মনে হল না। আকরাম সাহেব সময় নিয়ে আরাম করে তিনটা পিঠা খেলেন। ছেলেটার হাত থেকে বালিশ নিয়ে বলতে যাবেন- এবার তুই পিঠা খা; ছেলেটা বলে উঠল “পিঠা খামুনা।“ উনি বললেন তাহলে “কি খাবি?” ছেলেটা বলল “হালিম খামু।“ আকরাম সাহেব লক্ষ করলেন পাশেই ভ্রাম্যমান হালিমের গাড়িতে টিমটিমে হ্যারিকেন জলছে। তিনি পিঠার দাম মিটিয়ে হালিমের গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন। হালিমের দাম দিয়ে তিনি দোকানীকে বললেন ছেলেটাকে হালিমটা দিতে। একবাটি হালিম মাত্র ১০ টাকা! খাসীর মাংস দেয়ার তো প্রশ্নই আসেনা, মুরগি-ই দিক আর ডাল-ই দিক, সবকিছুর-ই যেমন অগ্নিমূল্য ১০ টাকায় এরা কিভাবে হালিম দেয়! কাউয়া বিরানী বলে একটা ব্যাপার তিনি শুনেছেন। মামা হালিম শুনেছেন,শাহী হালিম শুনেছেন, কাউয়া হালিম বলেও কিছু আছে নাকি? উনার জানা নেই, জানার প্রয়োজনও নেই। ছেলেটা এত গভীর মনোযোগে হালিম খাচ্ছে যে উনার মনে হল এই মুহূর্তে হালিম আর বাচ্চাটার মাঝে আর কিছু নেই। সে আকরাম সাহেবের কথাও পুরোপুরি ভুলে গেছে। বাটির হালিম যতক্ষন থাকবে ছেলেটা একটা সুন্দর স্বপ্নের মাঝে থাকবে, বাকি সব ভুলে থাকবে। স্বপ্নটা কে আকরাম সাহেব ভাঙতে চাইলেন না, কিছু না বলেই তিনি আবার মেসের পথ ধরলেন।
আকরাম সাহেব যখন তার বক্সিবাজারের মেসে ফিরে এলেন তখন রাত আট-টা বাজে। সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় পাশের ঘরের মোতালেব সাহেবের সাথে দেখা হল। মোতালেব সাহেব বললেন “আরে আকরাম ভাই! এত দেরিতে ফিরলেন আজকে। আমরা সবাই কার্ড খেলব বলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন যাচ্ছি সিঙ্গারা আর চা আনতে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আমার ঘরে আসুন, জমিয়ে আড্ডা হবে। একি, বালিশ কিনেছেন দেখছি, হঠাৎ বালিশ কিনলেন যে, আগেরটার কি হল !” আকরাম সাহেব কিছু না বলে মৃদু হাসলেন। মোতালেব সাহেব সবসময়ই বেশি কথা বলেন, তার সব কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করেনা। সে অবশ্য জবাবের অপেক্ষাও করেনা। কিছু মানুষ শুধু বলতে চায়, শুনতে চায়না। কেউ আবার শুনতে চায়, বলতে চায়না। আকরাম সাহেব ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন তাঁর আশেপাশে বলতে চাওয়া মানুষই বেশি।
নিজের ঘরে ঢুকে আকরাম সাহেব বালিশটা খাটের উপর রেখে জামাকাপড় ছাড়লেন, কেন যেন খুব ক্লান্ত লাগছে। পায়ে হেঁটে এতটা পথ আসার কারনে হতে পারে। তিনি বাথরুমে ঢুকে লম্বা গোসল দিলেন। ক্লান্তি কেটেছে কিছুটা, কিন্তু ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তিনি বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। নতুন বালিশটা মাথার নিচে দিয়ে পুরাতন বালিশটা কোলবালিশের মত জড়িয়ে চোখ বুঝলেন। আজকে আর আড্ডা দেয়ার ইচ্ছা নেই, মোতালেব সাহেব এসে কাঁচা ঘুমটা না ভাঙ্গালে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।
আকরাম সাহেবের ঘুম যখন ভাঙল তখন পরদিন সকাল ৯ টা। জানালার ফাঁক গলে শীতের সকালের সোনা রোদ এসে মুখে পড়ছে। অবশ্য এই আলোর জন্য উনার ঘুম ভাঙ্গেনি। উনার ঘুম ভেঙ্গেছে অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন দেখে। অদ্ভুত এই কারনে যে এমন দুঃস্বপ্ন তিনি কখনোই দেখেন নি। তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে তিনি কিশোর বয়সী। তার সাথে গ্রামের আরও অনেক কিশোর একসাথে ডোবায় নেমে পোলো দিয়ে মাছ ধরছে। তাদের একজনের নাম সুজন। কেউ তাঁকে বলে দেয়নি, কিন্তু তিনি জানেন যে এর নাম সুজন। সুজন আর তিনি মাছ ধরতে ধরতে এক পর্যায়ে পাশাপাশি চলে এলেন। হঠাত সুজনের পোলোর ভেতরে কোন একটা কিছু খলবল করে উঠল। সুজন দু-হাতে তার পোলো চেপে ধরে আকরাম সাহেবকে ইশারা করল তিনি যাতে মাছটা ধরেন। আকরাম সাহেব পোলোর উপর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মাছটা ধরতে গেলেন। সম্ভবত শিং/মাগুর প্রকৃতির মাছ, বার বার পিছলে যাচ্ছে। তিনি কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না। হঠাত মাছটা তাঁর ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে কাটা ফুটিয়ে দিল। তিনি প্রচন্ড ব্যাথায় হাত বের করে নিলেন।
দুঃস্বপ্ন টা অদ্ভুত তার দুটি কারন আছে। প্রথম কারন হল তিনি কখনো পাকাপাকিভাবে গ্রামে থাকেন নি। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেলেও কখনো মাছ ধরেন নি। আসলে তিনি মাছ ধরতে জানেন-ই না। যেইরকম ঘটনা নিয়ে তাঁর মস্তিষ্কে কোন স্মৃতিই নেই, সেটা স্বপ্নে কিভাবে আসে তিনি ভেবে পেলেন না। হতে পারে তিনি কখনো কোন সিনেমা-নাটকে অমন মাছ ধরার দৃশ্য দেখেছেন। কিংবা কারো কাছে মাছ ধরার গল্প শুনেছেন। এসব থেকেই হয়ত তাঁর মস্তিষ্ক এই স্বপ্ন দাঁড় করিয়েছে।
দুঃস্বপ্ন-টা অদ্ভুত হওয়ার দ্বিতীয় কারণটার কোন ব্যাখ্যা তিনি দাঁড় করাতে পারলেন না। আর তা হল- উনার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে প্রচন্ড ব্যাথা। মাছের কাটা ফোটার মত ছোট একটা ক্ষত, এক্টূ যেন ফুলেও উঠেছে। আকরাম সাহেবের মাথা ঘুরে গেল। তিনি শীতের সকালেও ঘামতে লাগলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন গতকাল কখনও তিনি আঙ্গুলে ব্যাথা পেয়েছিলেন কিনা। অফিসে কাজ শুরু করা থেকে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত পুরো সময়টা তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন। সেরকম কিছুই মনে করতে পারলেন না। তিনি আঙ্গুলে তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। তিনি আর শুয়ে নেই, উঠে বসেছেন। রোদটা এখন আর মুখে পড়ছেনা, তাঁর আঙ্গুলে পড়ছে। রোদের আলোতে বাতাসে ভেসে বেড়ানো প্রতিটা ধুলিকনার অস্থির ছোটাছুটি পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আকরাম সাহেবের মাথায় পাক খেয়ে ওঠা দুশ্চিন্তা মেশানো ভাবনাগুলো এমন ভাবেই তাঁর মনের ভিতর ছোটাছুটি করছে। কিন্তু তিনি কোন রোদের ছিটেফোটাও দেখতে পাচ্ছেন না, যা ধুলিকনাগুলির মত তাঁর মনের প্রশ্নগুলিকেও আলোর পথ দেখাবে।
মন্তব্য
চমৎকার লেখা। পরের পর্বটার জন্য এখনই অস্থির লাগছে। এখন একটা লেখা প্রথম পাতা থেকে সরতে অনেক সময় লেগে যায়। দেখা যায় পরের পর্বটা পড়ার সময় ঘটনার খেইটাই হারিয়ে ফেলেছি। গল্প যদি খুব বড় না হয় তবে একদফাতেই দিয়ে দেওয়া ভালো। লেখা চলুক।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অনেক ধন্যবাদ। আসলে পুরোটা লেখা হয়নি। হলে দিয়ে দিতাম। পরিকল্পনা করছি কি কি প্যাঁচ কষবো।
একটানে পড়ে ফেললাম। খুঁটিনাটি বর্ণনাগুলো চমৎকার! পরের পর্বের অপেক্ষায়।
নুশান
অশেষ ধন্যবাদ
খুবই উৎসাহ জাগানিয়া লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায়...
অজস্র ধন্যবাদ
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম
অসংখ্য ধন্যবাদ
দারুণভাবে নিয়ে যাচ্ছেন গন্তব্যে। দেখা যাক সামনে কি অপেক্ষা করছে।
অধীতি
অসংখ্য ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন