আমাদের কবি নজরুলের(দুখু মিয়ার) জন্ম কলকাতার মত শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত ও ধন সম্পদে পরিপূর্ণ নগরীতে নয়; রবীন্দ্রনাথের মতো অভিজাত ব্রাহ্ম পরিবারে রুপোর চামচ মুখে নিয়ে পৃথিবীর মুখোদর্শনের সৌভাগ্যও তার হয়নি। তার সম্বন্ধে তাই নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া তার জীবনীকারদের জন্য সবসময় কঠিন ছিল। তার সম্বন্ধে গালগল্প বিচিত্র রঙে রঞ্জিত, কারণ বাস্তব ও কল্পনার ককটেল সেবন বাঙ্গালির সান্ধ্যবাতিকের অন্তর্ভুক্ত। তবে তার সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কেমন ছিল তা আধুনিক নজরুল গবেষকদের কৌতুহলের বিষয় বৈকি।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম দেখা হয়েছিল গবেষণার মতবিভেদে ১৯২১ বা ১৯২২ এর কোন এক সময়ে। পূজোর ছুটিতে একদিন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে নজরুল শান্তিনিকেতনে যান কবিগুরুর দেখা পেতে। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা তখনো প্রকাশিত হয়নি, তাই তার মত উঠতি কবিকে বিশেষ খাতির করার মত সঙ্গত কারণ বিশ্বকবির ছিলনা। বরং তার পূর্ব পল্টন জীবন আর হাবিলদার পদের কথা জেনে, রবীন্দ্রনাথ তাকে শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের শরীরচর্চার তদারকি করার আহবান জানান আর দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শেখার কথা বলেন। মুজফফর আহমেদ দাবি করেছেন যে নজরুল নিজেই তাকে একথা কোন এক সময় বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ এবং ১৯২২ এর বেশ কিছু সময় দেশের বাইরে ছিলেন। তাই সাহিত্য ক্ষেত্রে দুখু মিয়ার আবির্ভাব মোটামুটি তার অবর্তমানে ঘটেছিল। তা ছাড়া ভাবি বুলবুল যে সংগীত প্রতিভায় দিনেন্দ্রনাথের চেয়ে বহুগুণ সরেস হবেন তা রবীন্দ্রনাথ স্বল্প পরিচয়ে ধারণা করতে পারেননি।
এই সাক্ষাতের কিছুদিন পরেই ১৯২১ এর ডিসেম্বর মাসে এক রাতেই নজরুল লিখে ফেললেন তার উন্নত মম শির 'বিদ্রোহী' কবিতা। নার্গিসের সাথে তার বিয়ের আসর থেকে উঠে আসার নাটকীয়তার পর তিনি তখন সদ্য কিশোরী আশালতা ওরফে দোলনের (নজরুলের সাথে বিয়ের পর নাম হয় প্রমীলা) মন জয় করে কুমিল্লা থেকে ফিরে এসেছেন কলকাতায়। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার প্রাণ প্রাচুর্যের সেই উচ্চকিত মুহুর্তটি তিনি 'মুক্তক মাত্রাবৃত্ত' ছন্দে গেঁথে ফেললেন 'বিদ্রোহী' কবিতায়। এই কবিতায় তিনি হিন্দু পুরাণ আর ইসলামি উপকরণের সমন্বয় ঘটিয়েছেন সব্যসাচীর মত।
১৯২২ সালের জুন মাসে যখন কবি সত্যেন্দ্রনাথ মাত্র ৪১ বছর বয়সে মারা যান, তখন রামমোহন লাইব্রেরীতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুল তার নিজের রচিত 'সত্যেন্দ্রনাথ' নামে একটা কবিতা আবৃত্তি করেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় বিদ্রোহী কবিকে তখন কবিগুরু পাশে বসার আমতন্ন করেন। তাই বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের আগে ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা সভায় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে পাশে বসিয়ে খাতির করেছিলেন বলে যে গপ্পো চালু আছে তা আধুনিক গবেষকরা খারিজ করে দিয়েছেন।
তবে যাই হোক, নজরুলের কবি পরিচিতির কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বঙ্গ সাহিত্যে একটি শব্দের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেন। আর তা থেকেই বাংলা সাহিত্যে এক অভূতপূর্ব বিতর্কের জন্ম হয়; আর নজরুল জড়িয়ে পড়েন 'খুনের মামলায়'!
নজরুল ছিলেন তারুণ্যের সরব প্রকাশ। ইংরেজিতে যাকে 'লাউড' বললে অত্তুক্তি হবে না। তা প্রকাশ পেতো তার আচার ব্যবহার, জীবন যাত্রা আর বেশ-ভূষায়। লাল কাপড় পরতে ভালবাসতেন, লাল কালি দিয়ে লিখতেন, গলা ফাটিয়ে হাসতেন, কাউকে পরোয়া করতেন না, আর ডাগর কালো চোখ দিয়ে নির্ঘাৎ আমাদের দু-বেণী করা দাদিমাদের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতেন। কবি জীবনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রেমে পড়েছেন। কথিত আছে ১৯১৬-১৭ সালে শিয়ারশোলের এক হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। করাচীতে সৈনিক থাকাকালীন সেই প্রথম প্রেয়সীর চুলের কাঁটা ব্যর্থ প্রেমের স্বাক্ষর হিসাবে বুক পকেটে সংরক্ষিত থাকতো। তার 'ব্যাথার দান' গ্রন্থটি সেই হারিয়ে যাওয়া ভালবাসাকে উৎসর্গ করেন।
নজরুলই প্রথম যিনি বাংলা সাহিত্যে আরবি ফারসি শব্দের অনন্য সংযোজন ঘটান। শিয়ারশোল স্কুলে তাঁর শিক্ষক হাফিজ নুরুন্নবীর কাছে ফারসি ভাষায় হাতেখড়ি হয়েছিল এবং অবশ্যপাঠ্য আপাত-অধুনা ধ্রুপদী ভাষা হিসাবে সংস্কৃতের বদলে ফারসিকে বেছে নেন।এরপর সৈন্যবাহিনীতে এক পাঞ্জাবী মৌলভিকে পান এবং তার কাছ থেকে আর ভাল ফারসি শেখেন।১৯২০ এর সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার দেশপ্রেমের কবিতা 'উদ্বোধন'। পঁচিশ পংক্তির এই কবিতায় তিনি একটি আরবি ফারসি শব্দের প্রথম ব্যবহার করেন - 'খুন'। 'খুন' শব্দের প্রতি এরপর নজরুলের বিশেষ পক্ষপাত পরিলক্ষিত হয়। এবং খুনের দুই অর্থের মধ্যে 'রক্ত' অর্থে তিনি এ শব্দ বার বার ব্যবহার করেছেন, যেমন ধরা যাক তার 'মোসলেম ভারত' এ প্রকাশিত 'শাতিল আরব' কবিতার পংক্তিঃ
"শাতিল আরব! শাতিল আরব! পূত যুগে যুগে তোমার তীর
শহিদের লোহু, দিলীরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব বীর।"
১৯২০ এর দশকের বাংলা সাহিত্যে হাওয়া লাগে গণসচেতনতা, যৌনতা এবং 'খুনের' মত চমকপ্রদ শব্দ ব্যবহারের। অল্পদিন আগে ঘটে যাওয়া রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব থেকে শুরু করে ইংরেজি সাহিত্যে সিগমন্ড ফ্রয়েডীয় (১৮৫৬-১৯৩৯) যৌন চেতনার আবির্ভাব ছিল এর অনুসূচক। রবীন্দ্রনাথ এসব উপাদানকে সাহিত্যে ভাল চোখে দেখেন নি। তিনি সাহিত্যে দারিদ্র্য, লালসা আর অপ্রচলিত ভাষা আর ভঙ্গির ব্যবহারকে রান্নায় স্বাদ বাড়ানোর উপাদান - কারি পাউডারের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন 'সাহিত্যে দারিদ্র্যবোধেরও স্থান আছে। কিন্তু ওটার ব্যবহার একটা ভঙ্গিমার অংশ হয়ে উঠলে, সেই প্রয়াসের মধ্যে লেখকের শক্তির দারিদ্র্য প্রকাশ পায়।'
অপর পক্ষে আবাল্য দারিদ্র্যের মধ্যে লালিত নজরুল কোনো কোনো কবিতায় প্রধান বিষয় করেছিলেন দারিদ্র্যকে। তার নিজের ছিল টানাটানির সংসার। বেশ কয়েকবার গ্রন্থস্বত্ব বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রকাশকদের কাছে অগ্রীম টাকা চেয়ে তার পত্র গুলো ছিল করুণ, যার উদারহণ দিয়ে তাকে এখানে ছোট করতে চাই না। তা ছাড়া বংশ পরিচয় নিয়ে তার হীনমন্যতাও থেকে থাকবে। ১৯২০ এ যখন তিনি অপরিণত যুবক তখন নার্গিসের সাথে তার বিয়ের আমনত্রণ পত্রে (সে বিয়ে হয়নি) পিতার পদবীতে 'আয়মাদার' বিশেষণ ব্যবহার করার অতিরঞ্জন কলকাতার বন্ধু মহলে সমালোচনার সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া কবি ১৯৪০ এর দশকে অপ্রকৃতিস্থ হবার কিছুকাল পর থেকে নিজের নামের আগে 'সৈয়দ' লেখা শুরু করেন!
যাই হোক, যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল তা রীতিমত উত্তেজনা ছড়ালো বছরের শেষ দিকে ১৯২৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। প্রেসিডেন্সি কলেজে দেওয়া এক সভায় কবিগুরু দারিদ্র নয়, অশ্লীলতা নয়- রক্ত অর্থে ' খুন' শব্দ ব্যবহারের সমালোচনা করেন। একথা বলার প্রায় চল্লিশ বছর আগে তিনি নিজেও 'খুন' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বাল্মিকী- প্রতিভায় 'হত্যা করা' অর্থে। এখন অন্য অর্থে ( লাল রঙ) তা ব্যবহারে আপত্তি জানানোর তার সংগত কারণ ছিল না। একই শব্দের বহুধা ব্যবহার হতে পারে, এ কথা তার তুলনায় সভায় অন্য কারও বেশি জানা ছিলনা। তাই তার আপত্তি নিতান্তই ব্যক্তিগত খেয়াল বা রুচির বহিঃপ্রকাশ-যুক্তির ধোপে টেকে না।
বিদ্রোহী কবি সে সভায় ছিলেন না; কথাটা পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে জানতে পান পরের সপ্তাহে। ' খুন' শব্দটা নজরুলের প্রিয় শব্দ, তাই সম্ভবতঃ তাকে এটা বেশ দাগা দিল। তিনি অল্পেই আবেগপ্রবণ হবার মানুষ; সংযমী প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অভ্যস্ত নন। তিনি চট করে 'আত্মশক্তি' সাপ্তাহিকে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করে 'বড়র পিরীতি বালির বাঁধ' নামে একটা প্রবন্ধ লিখে বসেন ৩০ ডিসেম্বর।
'কাজী নজরুল ইসলাম
বাসায় একদিন গিছলাম।
ভায়া লাফ দেয় তিন হাত
হেসে গান গায় দিন রাত
প্রাণে ফুর্তির ঢেউ বয়
ধরার পর তার কেউ নয়।'
নজরুলের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রাণবন্ত জীবনী এভাবেই দিয়েছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা একদিন তাঁর বাসায় ঘুরে এসে। নজরুল চিরকাল ছিলেন শৌখিন, সংসারের প্রতি আপাত উদাসীন এবং অভিমানী। ১৯৩১ সালে কিস্তিতে ৬ সিলিন্ডারের বিলাসবহুল একটা কনভার্টেবল ক্রাইসলার গাড়ি কিনেছিলেন। (আমি নিজে মিশিগানে ক্রাইসলার কোম্পানিতে বেশ ক'বছর কাটিয়েছিলাম বলে এ তথ্যটা আমাকে বেশ মজা দিয়েছিল)। যা হোক, কিস্তির টাকা শোধ না করতে পারায় গাড়ি তাকে ফিরিয়ে দিতে হয় এবং জনসমক্ষে তিনি হেয় বোধ করেন। একবার নজরুলের ভোটে দাঁড়াবার ভূত মাথায় চাপে এবং ঢাকা বিভাগের মুসলমান কেন্দ্র হতে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদে প্রার্থী হয়ে বেশ কিছু টাকা খোয়ান ১৯২৬ সালে। অথচ বাসায় স্ত্রী আর সদ্যোজাত পুত্র সন্তানের প্রয়োজনীয় খাদ্য পানীয় কেনার মত সামর্থ্য তাঁর তখন ছিল কিনা সন্দেহ!
এছাড়া ১৯২১ এ 'বিদ্রোহী' কবিতা তাকে খ্যাতি যেমন দিয়েছিল তেমনি মুদ্রার অপর পিঠও দেখাতে ছাড়েনি। মুসলমানদের একাংশ তাকে নাস্তিক, শয়তানের পূর্ণাবতার, নমরুদ বলে কটু-কাটব্য করে কবিতার 'খোদার আসন আরশ ছেদিয়া' পংক্তির জন্য। একটি চলতি পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল হাকিম লেখেনঃ
'ওগো বীর
অসংযত বিদ্রোহী অধীর
সংযত হয়ে নমিত কর তব গর্বিত উন্নত শির।'
নজরুলের এই তকমা পূর্ব উল্লিখিত নির্বাচনে ভরাডুবির ছিল অন্যতম কারণ। নজরুলের ধারণা ছিল তিনি মুসলিম জাগরণ নিয়ে অতো লিখলেও মুসলমান সমাজ তাঁকে প্রাপ্য সন্মান দেয় নি। তার আরেক চিরশত্রু ছিলেন 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকার সজনীকান্ত দাশ। নজরুলের বেশ কিছু কবিতাকে অশালীন আখ্যায়িত করে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখে নালিশ পর্যন্ত করেছিলেন যার মধ্যে অন্যতম ছিল 'অ-নামিকা' কবিতাটিঃ
'প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু - অগণন।
বহু পাত্রে ঢেলে পিব সেই প্রেম- সে শরাব লোহু,
তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়,
ভৃঙ্গারে, গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায়।'
কবিগুরুর এ সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়া কি ছিল তা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গিয়েছে। তবে এসব ঘটনাপ্রবাহ নজরুলকে বিভিন্ন সময়ে তাড়িত করলেও নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের 'খুন' শব্দের বিরুপ সমালোচনা তাঁকে অত্যন্ত অভিমানী করেছিল। কারণ কোথায় এঁদো গলির সজনীকান্ত দাশরা আর কোথায় জোড়াসাঁকোর নোবেলজয়ী বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের প্রাণভোমরা রবিঠাকুর! এক রাশ অভিমান নিয়ে নজরুল পত্রিকায় 'বড়র পিরীতি বালির বাঁধ' প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের যুক্তি দেখান। তিনি বলেন কোথাও কোথাও এ ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়ে। তিনি এর দৃষ্টান্ত দেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ইটালিকে নিয়ে লেখা এক কবিতায় "উতারো ঘোমটা'র" মত একটি অনুবাক্য ব্যবহারেরঃ
' কহিলাম, 'ওগো রাণী,/ সাগরপারের নিকুঞ্জ হতে এনেছি বাঁশরি খানি। / উতারো ঘোমটা তব / বারেক তোমার কালো নয়নের আলোখানি দেখে লব" --'ইটালিয়া'(পূরবী)
নজরুল ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, 'যারা শুধু কুৎসিত বিদ্রুপ আর গালি-গালাজই করতে শিখেছে, তাঁকে [রবীন্দ্রনাথকে] তাদেরই বাহন হতে দেখলে আমাদের মাথা লজ্জায়, বেদনায় আপনি হেঁট হয়ে যায়। বিশ্বকবি-সম্রাটের আসন--রবিলোক--কাদা ছোঁড়াছুড়ির বহু ঊর্ধ্বে।' এ প্রবন্ধ পড়ে কবিগুরু তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কিছু বলেছিলেন কিনা তা জানা যায়না। তবে লিখিত ভাবে কোন মতামত দেন নি।
এ বিতর্ক যাতে আর ডালপালা না মেলে, তার জন্য প্রমথ চৌধুরী একমাস পরে আত্মশক্তি পত্রিকায় 'বঙ্গ-সাহিত্যে খুনের মামলা' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি নিজেই প্রেসিডেন্সী কলেজের সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রমথ বলেন, রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় নজরুল বা আরবি-ফারসি শব্দের সমালোচনা করেননি। কোন কোন উদীয়মান তরুণ কবির নবীন ভাষার উদাহরণ স্বরুপ রবীন্দ্রনাথ "খুনের" কথা বলেন। কোন উদিত কবির [নজরুলের] তিনি সমালোচনা করেননি। যাই হোক সাহিত্যের বিচারে কে উদিত আর কে উদীয়মান তার বিচার করে এত সহজ নয় বলে মন্তব্য করেছেন নজরুলের সাম্প্রতিক জীবনীকার গোলাম মুরশীদ সাহেব। তবু এ প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পরে, যদিওবা তরুণদের মনে কোন ক্ষোভ থেকে থাকে, তা আর প্রকাশ্যে ডানা মেলেনি।
পরিশেষে আমার মনে হয়, বাংলা সাহিত্যের এই দুই যুগপুরুষের সম্পর্ককে শুধু 'খুনের মামলায়' ফাইলবন্দী করে রাখলে অবিচার হবে। তাঁরা দুজনেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী এবং দেশপ্রেমিক। নজরুলই বাংলা কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে পুরোধা ব্যক্তিত্ব যিনি স্বদেশী আন্দোলনের জন্য জেলে যান। তার দ্রুত পরিচিতির অন্যতম কারণ হিসেবে এই আত্মত্যাগকে অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। নজরুলের আলিপুর কারাগারে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বসন্ত গীতিনাট্যটি উৎসর্গ করে 'নজরুল-প্রতিভার' এবং তার দেশপ্রেমের স্বিকৃতী দেন। ১৯৩৮ সালে 'গোরা' ছবির সংগীত পরিচালনা করেন নজরুল। এতে রবীন্দ্রনাথের গান গুলি শুদ্ধরুপে গাওয়া হয়নি বলে বিশ্বভারতী আপত্তি তুলেছিল। আপত্তি খন্ডনের জন্য নজরুল ফিল্ম আর প্রজেক্টর নিয়ে শান্তিনিকেতনে যান। রবীন্দ্রনাথ কিছুটা শুনেই অনাপত্তিপত্রে সই করে দেন। রবীন্দ্রনাথ চিরকালই বাংলা সংস্কৃতির এই শিকল-ভাঙা কুশীলবের অগ্রযাত্রা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করেছেন।
এ কথা বলেই শেষ করতে চাই যে, নজরুল ছিলেন বাঙ্গালীর 'কুছপরোয়া নেই', বেহিসেবী, অকারণ-চঞ্চল মানসের মূর্তমান বহিঃপ্রকাশ। পরম নিশ্চিন্তে যিনি বলতে পারতেন-'বেলা যাবে এবে পান খেয়ে।'
(সমাপ্ত)
গ্রন্থসূত্রঃ
১. বিদ্রোহী রণক্লান্ত-নজরুল জীবনী, ফেব্রুয়ারি ২০১৮, গোলাম মুরশীদ।
২.নজরুলের অটোগ্রাফ দ্রষ্টব্যঃ কল্যাণী কাজী সম্পাদিত Nazrul: The Poet Remembered, 2009.
৩. কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে,১৯৯৫, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়।
৪. বসন্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নজরুলকে এই বইটি উৎসর্গ করলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে উৎসর্গ পত্রটি ছিলনা।
৫. নজরুল নানা মাত্রা, ২০১২ শেখ মকবুল ইসলাম।
৬. রবীন্দ্রনাথের ১৯২৭ সালের ১৩ ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্সি কলেজে দেওয়া 'খুন' শব্দের বিরুপ সমালোচনা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক আত্মশক্তিতে ২০ ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে।
বিরিঞ্চি বেগ
মন্তব্য
দারুণ! নজরুল বিষয়ে হায়াৎ মামুদ রচিত জীবনীর বাইরে কিছু পড়া হয়নি।
আরো লিখুন।
..................................................................
#Banshibir.
ধন্যবাদ সত্যপীর ভায়া. আপনার উল্লিখিত নজরুল জীবনী টি আয়ত্তে নেই. আজকাল বই এর সংগ্রহশালা বাড়ানোর আকাঙ্খা আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ২৩ কেজির ১ কি ২ কেজি তে আটকে যায়. হিমায়িত মিঠাই আর বিরানি খেয়ে সুটকেস তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে. #বিরিঞ্চি বেগ
..................................................................
#Banshibir.
বেশ বেশ, ভালো লাগলো লেখা।
facebook
আপনাকে ধন্যবাদ তারেক অণু ভায়া লেখাটি আপনার অবসর সময়ের সাথী হতে পেরেছে জেনে আমার ভালো লাগলো. #বিরিঞ্চি বেগ
ভালো লাগল। পরের লেখা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনাকে ধন্যবাদ। লেখাটি আপনার অবসর সময়ের সাথী হতে পেরেছে জেনে আমার ভালো লাগলো. #বিরিঞ্চি বেগ
দারুণ লাগলো পড়তে। গল্প বলার স্টাইলটা আপনার দুর্দান্ত বিরিঞ্চি ভায়া।
নজরুলের এই 'লাউড' আর 'কুছপরোয়া নেই', বেহিসেবী, অকারণ-চঞ্চল প্রাণোচ্ছল মানসের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন যেসব প্রত্যক্ষদর্শী সমসাময়িকরা, তাদের মধ্যে শিবরাম চক্রবর্তী নিঃসন্দেহে অন্যতম। তার নজরুল সংক্রান্ত স্মৃতিচারণ নিয়ে অনেক আগে সচলায়তনেই একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। আপনার জন্যে সেটার একটা লিংক এখানে দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম নাঃ http://www.sachalayatan.com/guest_writer/35307 । শিব্রামের স্মৃতিচারণ আমার দারুন লেগেছে!
****************************************
এই লেখার লেখকের সাথে আপনার আলাপের সুবাদে আপনার চমৎকার লেখাটি পড়ে এলাম। খুব ভালো লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
খুব ভালো লাগলো আপনার শেয়ার করা লেখাটা পড়ে. ভবিষ্যতে আরো অজানা কথা আমাদের সামনে আনবেন. #বিরিঞ্চি বেগ
লেখাটি ভাল লেগেছে। পড়ে ঋদ্ধ হলাম।
রবীন্দ্রনাথ নজরুলের হাবিলদার পরিচয় পেয়ে শরীরচর্চা শিক্ষক হবার প্রস্তাব দিলেন। আবার যখন তাঁকে কবি হিসেবে জানলেন তখন তাঁকে মঞ্চে ডাকলেন। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথ কোন অবিচার করেছেন বলে আমার মনেহয় না।
তারা দুজনেই তাদের সময় কে নিজের মতো করে মুঠো বন্দি করেছেন. #বিরিঞ্চি বেগ
আরো লিখুন বিরিঞ্চিবাবা!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ সাক্ষী সত্যানন্দ ভায়া.
আসলে আমি 'বাবা' নোই 'বেগ'. সাধু নোই, সম্বল কিঞ্চিৎ আবেগ. #বিরিঞ্চি বেগ
নতুন মন্তব্য করুন