এই আপাতঃ প্রবন্ধটা ২০১৮ সালের কয়েক ঋতু জুড়ে শেষ করেছিলাম।
১
যেকোনো শহরে গেলে স্থানীয় ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা আমার অবশ্য কর্তব্যের একটা অংশ। বস্টন বা অন্যান্য বড় শহরে গিয়ে এম আই টি, হারভার্ড এর মত ক্যাম্পাস দেখতে তো অনুপ্রেরণার দরকার হয় না আর তা আমি দেখেছিও। ডিসেম্বর এর হাড় কাঁপা শীতে জন হারভার্ড এর স্ট্যাচুর বাম পদ স্পর্শ করে ভাল ভাগ্যের প্রত্যাশার কথিত রগড়ে বেশ মজা পেয়েছিলাম। তবে ছোটখাটো শহরে ছোট্ট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে গাড়ি পার্ক করে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেও আমার খুবই ভাল লাগে। আসলে আমি ছোঁয়া নিতে চাই ক্যাম্পাস এ উচ্ছল তরুণ তরুণীদের আগামী দিনের স্বপ্নের যেটা আমার কর্মচঞ্চলতাকে উজ্জিবিত করতে টনিকের কাজ দেয়।
ক'মাস আগে যাবার সু্যোগ হয়েছিল কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরান্টো তে। ইন্ডাস্ট্রি তে কাজ করার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগটাও অনেকটাই কমে গিয়েছিল। আমি মিশিগান এ থাকি আর ডেট্রয়েট নদীর ওপারে কানাডার অন্টারিও অঙ্গরাজ্য। ওখানের ইউনিভার্সিটি অফ উইন্ডসরের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের এক বন্ধু প্রতিম প্রফেসর কে মিশিগানের অল্টেয়ার প্রডাক্ট ডিজাইন সংস্থার সাথে জয়েন্ট ভেঞারে কানাডার প্রেস্টিজিয়াস এন এস ই আর সি গ্রান্ট পেতে কিছু সাহাজ্য করেছিলাম। প্রফেসর এর মাইক্রো ন্যানো মেকাট্রনিক্স অ্যান্ড মাইক্রফ্লুইডিক্স ল্যাব টি খুব সুনামের অধিকারী হয়েছে এই ক'বছর এর মধ্যেই। আমারও এসব দিকে কিছু আগ্রহ থাকার দরুণ যখন মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে ভিসিটিং পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসাবে ওই ল্যাবে কাজ করার অফার দিলো তখন বেশ সাবধানে চিন্তাভাবনা করে কিন্ত অত্যন্ত আগ্রহের সাথে ওটাতে মত দিলাম।
আমরা যারা ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত তারা ফাঁকা সময় খুব কম পাই অন্য কিছু প্রফেশনালি করার। কিছুতে জড়ানো মানেই বউ বাচ্চা থেকে তাদের প্রাপ্য সময় ধার করা। আর দেশে বাবা মা ভাইবোন দের দেবার মত সময় তো আমরা আগেই এই পৃথিবীর (উন্নয়নের?) জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে বন্টন করেছি যখন সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিলাম।তাই ও নিয়ে কথা না বাড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। যা হোক অন্টারিয়ানদের গবেষণার কাজে সাহাজ্য করতে চাই শুনে স্থানীয় বর্ডার অফিস বেশ প্রসন্ন চিত্তে ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে দিল। উইক এন্ডে মাইক্রফ্লুইডিক্স লাবে অল্প সল্প কাজ করে ইউনিভার্সিটি অফ টরান্টো ক্যাম্পাসে আয়োজিত 'অন্টারিও অন আ চিপ' কনফারেন্সে গবেষণা প্রেসেন্টেসন করতে গাড়ি হাঁকালাম অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। এসব দেশে 'কনফ্লিক্ট অফ ইনটারেস্ট' বেশ সাবধানে হ্যান্ডল করতে হয়।কারণ যেহেতু আমি ফুল টাইম কাজ করি ফ্লুইড ডাইনামিক্স সংক্রান্ত। মাইক্রফ্লুইডিক্স একটি চমকপ্রদ বিষয়; যা বিজ্ঞানের অনেক গুলো শাখা কে একত্রিত করেছে।বিশেষ করে পয়েন্ট অফ কেয়ার চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর অবদান হতে চলেছে অভূতপূর্ব। আর গাড়ি তৈরিতে এর ব্যাবহারের প্রয়োজনীয়তা এখনও সেভাবে উপলব্ধ হয়নি। তাই এ যাত্রা রক্ষে।
২
এই পর্ব যখন লিখছি তখন নীচে অতলান্তিক মহাসাগরের অতল জল।গভীর রাত।আইলের ওপাশে বসা হিপ্পি চ্যাংড়া সাহেব বোইং এ সিট বেল্ট বাঁধার পরপরই জিজ্ঞেস করেছিলঃ য়হের টু? আমি খাঁটি বাঙাল ভাষায় ওকে বলিঃ দ্যাশে যামু. তর লাইগা গাঞ্জা আনুম? আমার পাশে বসা কন্যা এসব কিছু না বুঝলেও চাপা গলায় বলেঃ পাপা ডোন্ট মেক ফান অফ হিম। মেয়ে আমাকে আজকাল চোখে চোখে রাখে; কখন কি বেকায়দা বলে ফেলি? আমি বলেছিলামঃ ওরে কাপকেক, লেট মী টার্ন মাই আটেনশন টু য়র আম্মু দেন? এবার বিবিজীর মুখ খুলেঃ আঃ আদেখলেপনা কোরো না তো! সিট বেল্ট ঠিক মত বেঁধেছো কিনা দেখো? তবে মেয়ে খুশি হয়; মা'কে খাতির করলে সব বিটিয়াই খুশি! আমি মনে মনে বলিঃ বাহুডোরে যদি বাঁধা যায় প্রিয়ে, তবে সিটের বাঁধনে মন মানা দায়। কিন্তু শরৎচন্দ্রের লোক লজ্জার ভয়ে বলতে পারিনা..
যা হোক এখন হাওয়াই-জাহাজের সব যাত্রী এক সুখী পরিবারের মত এল ই ডি এয়াম্বিএন্ট আলোর ঘোরে ঘুমাচ্ছে। নীচে মহাসাগরে নীল তিমির রাজত্ব। তিমির ১৮০ ডেসিবেল নিনাদ শোনার জন্য আমি জেট প্লেনের ভেতর থেকে আপ্রাণ হাস্যকর চেষ্টা করি। শুনেছি নীল তিমির ডাক অন্য তিমিরা জলের নীচে ৫০০ মাইল দূর থেকে পর্যন্ত শুনতে পায়! আমার লেখার নেশা উঠে।। মাতৃদুগ্ধের নেশা উঠলে শিশু যেমন মায়ের বুকে মুখ ঘসতে ঘসতে মাথা ঠুকতে থাকে, আমার আঙ্গুল গুলোও তেমনি স্মার্টফোনের ভারচুয়াল নোট প্যাডে ইতঃস্তত ঠোক্কর খায়। আমি ভুলে যাই আমি ব্লগের পাতি লেখক। অতলান্তিক যেন আমাকে স্বীকৃতি দেয় তার ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে নীল তিমির শ্বাস-ফোয়ারায়।
যা বলছিলাম আগের পর্বে-- আবার বাস্তব কাজের জগতে ফিরে আসি। গাড়ি নিয়ে টরান্টো যেতে আমার অফিস থেকে ৫ ঘন্টার মত লাগে। পথে বেশ কিছু উইন্ডমিল পড়ে। আজকাল কম ক্ষমতার এক ধরণের উইন্ডমিল হয়েছে যার কোনো পাখা নেই! খালি বাতাসে খাড়া দণ্ডের অনুরনণের উপর নির্ভরশীল। তবে পথের এগুলো সাধারণ উইন্ডমিল। টরান্টো পঁওছুতে রাত হয়ে যায়।
আমার হোটেল ইউনিভার্সিটি অফ টরান্টোর সেইন্ট জর্জ ক্যাম্পাসে অবঃস্থিত ইগ্নিয়েফ থিয়েটার কনফারেন্স সেন্টারের কাছে হওয়ায় সকালে উঠে পথে হেঁটেই রওয়ানা দিই। গ্রীষ্মের সূচনা মাত্র।ড্যাভেনপর্ট রাস্তার ধারে ফুটফুটে সাদা 'স্নো ইন সামার' আর অনেকটা সামুদ্রিক রঙিন কোরালের মত দেখতে ফক্সগ্লোভ ফুল বিছিয়ে আছে। স্টুডেন্টরা চপ্পল পায়ে প্রায় চোখ মুদে সকালের প্রথম পাঠে যাচ্ছে। সেদিন ছিল আবার টরান্টো ওপেন ডোর ডে। ১৫৫টা স্থাপত্য,ক্রীড়া আর বিনোদনে উল্লেখযোগ্য সেন্টার জনতার জন্য অবারিত দার ছিল। পথে গোল্ডরিং হাই পারফরমেন্স স্পোর্টস সেন্টারে হাল্কা ঢুঁ মেরে কানাডার সেরা এথলেটদের অনুশীলন দেখে নিলাম। কনফারেন্সে পঁউছুতেও বেশীক্ষণ লাগলো না।
সারাদিন পোস্টার, প্রেসেন্টেসন ইত্যাদি দেখে আর দিয়ে খুব ভাল লাগলো। 'অরগ্যান অন আ চিপ' এর উপর ভাল একটা প্রেসেন্টেসন দেখলাম যেখানে মানুষের শারীরবৃত্তীয় আন্তঃসম্বন্ধিয় পদ্ধতি মাইক্রফ্লুইডিক্স চিপে বসানো মানব কোষ দিয়ে করার চেষ্টা চলছে। এর ফলে অষুধ পরীক্ষণে প্রাণীর ব্যবহার অনেক কমে যাবে। বিকেলে সব কিছু শেষে লবীতে বেরিয়ে দেখি কনফারেন্সের কী-নোট স্পীকার প্রফেসর হাওয়ার্ড স্টোন দাঁড়িয়ে ওনার ছাত্র, এই কনফারেন্সের আয়োজক ডঃ স্কট সাই এর জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রফেসর স্টোন এসব বিষয়ের একজন দিকপাল। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময়টাই হারভার্ডে কাটিয়েছেন। এখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন। বয়স ৫৫ হবে। একটু ভরাট মুখের উপর বসানো ঈষৎ খাড়া নাক। পাঁচ আট হবে উচ্চতা।মাথায় বুদ্ধির চর্চায় অর্জিত কেশের অনুপস্থিতি; নাকি বংশগত?পরণে কারুকাজ করা ফুল স্লীভ সয়েটার; গাড়ী কম্পানি ক্রাইস্লারের প্রয়াত সি ই ও সার্জিও মারকিওনি যে রকম পরতেন সবসময়।
মানুষের ব্রেইন ১০০ মিলিসেকেন্ড দেখেই কারো চরিত্র সম্বন্ধে একটা ধারণা আঁকার চেষ্টা করে। চেহারা আপনভোলা হলেও বেশ পারিপার্শ্বিকতা সচেতন মনে হলো প্রফেসরকে সকালে প্রথম যখন দেখলাম। কেন তা নাই বা বললাম। তবে খারাপ অর্থে নয়। তখন কথা বলার সুযোগ হয়নি। এখন আবার কোনো কারণ ছাড়াই ওনাকে অবসার্ভ করতে করতে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে মন চাইলো।
৩
**শেষ কিস্তি**
লেখাটা ভেবেছিলাম আগের পর্বেই শেষ করবো। কিন্তু কখন যে প্লেনে ঘুমিয়ে গেছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ একটু টারবিউলেন্স হওয়ায় আর মধ্যবয়সী বিমানবালার বালিকাসুলভ গলা ভেসে আসায় আচমকা ঘুম ভেঙে দেখি নীচে আলোক উদ্ভাসিত দুবাই! পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্চ্যে চলে এলুম। রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে ১৯১২ সালের ১০ জুলাই ইন্ডিয়ান সোসাইটি আয়োজিত সম্বর্ধনা সভায় (কবি ইয়েটস ছিলেন সভাপতি) বলেছিলেনঃ "প্রাচ্য প্রাচ্যই আর পাশ্চাত্য পাশ্চাত্যই, দোহাই ঈশ্বরের, অন্যরকম যেন না ঘটে। কিন্ত হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের সম্প্রীতি ঘটে মৈত্রী, শান্তি ও সমঝোতায়; আর তাদের মিলন আরও বেশি ফলপ্রসূ হয় পার্থক্যের কারণেই।" (গ্রন্থসূত্রঃ 'কালের সাক্ষী', সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০১৪)।
কিন্তু আজকাল বড় বড় শহরের মাল্টিকালচারাল সমাজ গুলো 'মেল্টিং পট' না হয়ে যেন বিস্ফোরণ্মুখ বোমা হয়ে যাচ্ছে।চিন্তায় ছেদ পড়ে হাসি পায় যখন ছোট বেলায় দেখা আমজাদ হোসেনের ঈদের নাটকের জনৈক অভিনেতা ফরিদ আলীর তৎকালীন সুপারহিট ডায়ালগ 'দুবাই যামু, ট্যাকা দেন..' হঠাৎ মগজের ধুলো পড়া শেল্ফ থেকে ছিটকে পড়ে দুবাইয়ে অবতরণের আন্দোলনে। দুবাইয়ে প্লেন ল্যান্ড করে। আমি মনে মনে ফরিদ আলীর প্রক্সি দেই। অনেকবার আরব দুনিয়া দিয়ে ট্রানজিট নিলেও এই প্রথম আমার এয়ারপোর্টের বাইরে পদার্পণ টুরিস্ট হিসাবে। একটু হলেও বাপ দাদার জাতধর্মের টান আমাকে কাজী নজরুলের 'মোসলেম ভারত' এ প্রকাশিত আরব মেসপটেমিয়ার গৌরবান্বিত অতীতচারণ করায়ঃ
"শাতিল আরব! শাতিল আরব! পূত যুগে যুগে তোমার তীর
শহিদের লোহু, দিলীরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব বীর।
যুঝেছে এখানে তুর্ক-সেনানী
য়ুনানি মিসরি আরবি কেনানী
লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ বেদুইনের চাঙ্গা শির
নাঙ্গা শির--"
দুবাইয়ের গরমে তিন দিন আলু সিদ্ধ হয়ে, বাংলাদেশী ট্যাক্সিক্যাব ড্রাইভারদের কাছে দুবাইয়ে খেটে খাওয়া বাংলাদেশীদের অবর্ণনীয় কষ্টার্জিত উপার্যনের বর্ণনা শুনে, আর আরব শেখদের কীর্তিকলাপ পুনরায় প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে কর্ণগোচর করে সেই গৌরবান্বিত অতীত কেমন পিচ্ছিল পথে বর্তমানের কাঁচুমাচু ভূ-রাজনৈতিক আর জাতি-ধার্মিক মুখচোরা চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয় আর এই লেখাটা শেষ করার ইচ্ছাকে বাষ্পীভূত করে। এবার আবার কবি নজরুলের 'খালেদ' (খলিফাদের আমলের বীর সেনাপতি) কবিতার আক্ষেপ মনে পড়ে যায়ঃ
" খালেদ! খালেদ! ফজর হলো যে, আজান দিতেছে কৌম্
ঐ শোন শোন-'আসসালাতু
খায়র মিনান্নৌম।..
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে
আমরা তখনো বসে?
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি
ফেকা ও হাদিস চষে।"
রবিঠাকুর আর কবি বুলবুল আমাদের এই আধুনিক উপলব্ধি গুলো একশ বছর আগেই প্রকাশ করে গিয়েছেন! এতদিন পরেও ভাব প্রকাশে তাঁরা অপরিহার্য। তারপরও বেদুইন সম্পর্কে রোমান্টিকতা থেকে যায়.. কারণ ওরা আরবের শেখ নয়; বেদুয়িনদের চোখে আরব আমিরাত এখনো মরুভূমির বোগেনভিলিয়া, প্রিয়ার গ্রীবার সুগন্ধি আতর। আর শেখ, অভিবাসী গুজরাতী, মাড়য়ারী ব্যবসায়ীদের কাছে আরব আমিরাত ক্রুড অয়েলের অফুরন্ত আধার, ২৪ ক্যারেট সোনা কারবারের সুউক। যে যেই চোখে হেরিবে ধরা, ধরা সে রুপেই তারে দেবে ধরা। বুঝছাইন?
ভরদুপুরে দুবাই এ জায়েদ ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে ড্রাইভ করে গেলেও এই লেখার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণে ব্যর্থ হই (!) সময় স্বল্পতায় পায়ে হেঁটে ক্যাম্পাসে ঘুরতে না পেরে। তবে এর পিছনে কি অবচেতন মনে এই ধারনাও কাজ করে যে বেশ কিছু শতাব্দী ধরে জ্ঞ্যান-বিজ্ঞ্যানে এ অঞ্চলের (জন স্বিকৃত) অনগ্রসরতা বিশ্বের চোখে এদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে খাটো করেছে?
সে যাই হোক, খেজুর-বীথির দেশ থেকে শাপলা-শালুকের দেশে গিয়ে আম কাঁঠাল খেয়ে ফের শ্যাম চাচার দেশে ফিরে টিম হর্টনের পাম্পকিন ফ্লেভার কফি খাই। মাঝে বেশ ক'মাস অতিবাহিত হয়; রুটি রুজির তাগিদে লেখাতে হাত দেওয়ার অবসর মিলে না - নানান ব্যস্ততায় সুরটাও কেমন কেটে যায়। বাড়ির পাশে ক্লিনটন নদীর ঢেউ গুনি আর মেয়েকে ক্রিকেট খেলার নিয়ম-কানুন বুঝাই। বারান্দার সামনে 'মেইডেন-হেয়ার' গাছ থেকে হেমন্তকালে ঝরে পড়া উজ্বল হলুদ পাতা মাড়িয়ে স্কুলের শিশুদের হেঁটে যেতে দেখে লেখার আবার ইচ্ছা জাগে। আমার অগণিত (গলা খাঁকরে) পাঠকদের কথা ভেবে ভার্চুয়াল নোট প্যাড ওপেন করি।
যা বলছিলাম- ইউনিভার্সিটি অফ টরান্টোতে মাইক্রফ্লুইডিক্স কনফারেন্স শেষে লবিতে দাঁড়িয়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, এই কনফারেন্সের কী-নোট স্পীকার হাওয়ার্ড স্টোনকে লক্ষ্য করছিলাম। এগিয়ে গিয়ে ওনাকে পরিচয় দিলাম। আমার প্রাক্তন সুপারভাইসিং প্রফেসরের সাথে ওনার মৃদু সখ্যতা থাকাতে আলাপ বেশ জমে উঠলো। এর মধ্যে প্রফেসর স্টোনের ছাত্র এই কনফারেন্সের অর্গানাইজার ডঃ স্কট সাই কাজ গুছিয়ে এসে পড়ায় আমরা তিনজন ক্যাম্পাসের অ্যান্টিক ব্রিক বিছানো ছিমছাম পথে নেমে হোটেলের দিকে রওনা দেই। ওঁদের গন্তব্যও একই পথে।
হাঁটতে হাঁটতে আমার বর্তমান কাজের জায়গা অটোমটিভ ইন্ডাস্ট্রির হাল-হকিকত জানতে চান দুই প্রফেসর। আমি ওনাদের আমার গত কয়েক বছরের পর্যবেক্ষণের কথা বলিঃ ডেট্রয়েট এ যেসব নতুন 'জেনারেশন ওয়াই' (মিল্যেনিয়াল) ছেলেপিলেরা আসছে, তারা গাড়ি ইন্ডাস্ট্রিতে ডিসরাপটিভ টেকনলজি (বাংলায় বলা যায় পর্যাসী প্রযুক্তি) আনতে নাছোড়বান্দা, বড় বড় অটোমটিভ কম্প্যানি গুলো এদেরকে কাজ দিচ্ছে অটোনমাস গাড়িতে জেনারেশন 'ওয়াই' এবং 'যি' যেই ফাংশনালিটি চায় তা উদ্ভাবন করতে। প্রফেসররা মাথা নাড়েন। এখানকার নামকরা ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের এই একটা গুণ। তারা খালি ক্লাসে লেকচার দেন না; নিজেদের ল্যাবে উদ্ভাবিত জ্ঞ্যান দিয়ে স্টার্ট আপ কম্পানি খুলে বসেন। তাই উঠতি প্রযুক্তিবিদদের এহেন প্রতিজ্ঞায় তাঁদের প্রীত হওয়াই স্বাভাবিক। তিন জোড়া পায়ে আমরা ততক্ষণে থমাস ফিশার 'রেয়ার বুক' লাইব্রেরীর কাছে চলে এসেছি। এই লাইব্রেরীর ছয় তলা জুড়ে আছে মধ্যযুগের বিভিন্ন বই, আছে শেক্সপিয়রের পান্ডুলিপি। কমবয়সী ছটফটে প্রফেসর সাই এসব বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
আমি ফাঁক বুঝে কথা পাড়ি। জিজ্ঞেস করি ড. স্টোনের কোন বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রী আছে কিনা। উনি বললেন ছিল, কিন্তু ছেলেটার কাজে উদ্ভাবনী শক্তির অভাব ছিল। আমার ডিঙগী নৌকা চরে আটকে যাবার দশা হয়। কিন্তু প্রফেসর সাই মনে করিয়ে দেন হার্ভার্ডের আর দুজন জমজ বাংলাদেশী ভাই বোনের কথা; যারা প্রফেসর স্টোনের সাথে কাজ করতো। ওদের কথা উঠতেই ড. স্টোনের প্রশংসা থামতেই চায় না! বলেন যে ওরা বুঝত গবেষণা কেন এবং কিভাবে করতে হয়। আমার দেশি ভাই বোনের সাফল্যে আমি আবার বৈঠায় খোলা ফারাক্কার বর্ষা মৌসুমের জল পাই। সাথে সাথে আমার দেখা দুঃখজনক 'প্রফেসর-ছাত্র' তিক্ততার কথা মনে পড়ে যা ঘটেছে এই উত্তর আমেরিকায় পরিচিতদের মাঝে। অনেক নাটক আর তিক্ততার পর অবধারিত ভাবে যা এনেছে শিক্ষানবিশটির মানসিক অবসাদ আর ধরিয়েছে আত্মবিশ্বাসে চিড়।
আমি প্রফেসর কে এসব হতাশা নিয়ে আক্ষেপ করি। প্রফেসর থমকে দাঁড়ান। রাস্তার ক্যাফের পিছনে একটা রাকুন মা (উত্তর আমেরিকার রিং টেইল এবং কোয়াটিস প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী) তখন তার দুটো পশমি বলের মত শাবকের জন্য খাবার খুঁজছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে ড. স্টোন কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক এবং অন্যমনস্ক ভাবে বলেনঃ 'সবকিছুর উপরে ওই একটাই সত্য, যা হল সন্তানের দেখভালের জন্য তার মায়ের প্রেষণা। আমি যতদূর জানি তোমাদের দেশে তো এখনো অনেক শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয় নি; কিন্তু দুর্নীতিহীন ও উন্নত জীবন ধারণের অভিপ্রায়ে উচ্চশিক্ষার্থীদের ঢল নামছে বিশ্বের প্রথম সারির গণতান্ত্রিক দেশ গুলোতে। তবে হ্যাঁ, এটাও সত্য যে তোমাকে সব রণক্ষেত্রেই লড়াই এক সাথেই করতে হবে। নাহলে পিছিয়ে পড়বে তোমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে। যারা বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে উচ্চশিক্ষা নিয়েছো, তারাই উদ্যোগ নিতে পারো নতুনদের দিক নির্দেশনা দিতে।'
আমি প্রফেসরের মুখে বাংলাদেশ থেকে আসা উচ্চ শিক্ষিত অভিবাসীদের দায়িত্ব সম্পর্কে এমন চাঁছাছোলা কিন্তু অব্যর্থ ইঙ্গিত শুনে অপ্রস্তুত বোধ করি আর সামষ্টিক গা বাঁচানো মনোবৃত্তি থেকে গাত্রোত্থানের উপায় খুঁজি মনে মনে। এবং তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দেই। আমরাও আসলে ততক্ষণে ক্যাম্পাসের সীমানায় চলে এসেছি। ছোট ছোট বিস্ট্রো আর পাব গুলো সন্ধ্যা আহ্নিকের(?) প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারাদিন মাথা খাটানোর পর মনে হলো ড. সাই ঐদিকেই ঢুঁ মারতে চাচ্ছেন। আর কথা না বাড়িয়ে ওনাদের থেকে বিদায় নেই। হালকা উত্তরে হাওয়ায় সামার সীরসাকার স্যুট কাঁধে ফেলে হোটেলের দিকে রওনা দিই। সি. এন. টাওয়ারের নেপালি জপযন্ত্রের মত গলা বেয়ে নীচে নেমে সূজ্জিমামা তখন অস্ত যাচ্ছে।
(সমাপ্ত)
#বিরিঞ্চি বেগ
মন্তব্য
ভাল লাগল কানাডিয় প্রফেসররের ভ্রমণমুখর জীবনের খন্ডচিত্র । আরও লিখুন। অণু জীববিজ্ঞান সাথে সম্পর্কিত বেশ ভাল ভালো লেখা সচলে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। আপনার কাছ থেকেও আশা করছি। ধন্যবাদ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
ধন্যবাদ. হ্যা এখানে লেখা গুলো দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা ভাষায় ক্ষুদ্রানু তরল বিদ্যা (মাইক্রোফ্লুইডিক্স) নিয়ে সহজবোধ্য কিছু লেখার ইচ্ছা আছে. নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে হলে, অপটু হাতে অনেক সময় নিজেকে জাহির করছি বলে মনে হতে পারে. হয়তো 'ক্যাম্পাসে পথে হেঁটে' লেখা টি তে ও তা তা হয়েছে. তাই কুন্ঠা বোধ হয় ছাপতে. সেখানেই একটু বাধে. তারপর ও বিষয়টির উপর ভালোবাসা থেকে অবশ্য ই লিখবো.
আরও লিখুন বিরিঞ্চি বেগ!
আপনার নিকটা কি বিরিঞ্চিবাবা আর জেফ্রিবেগের বহুব্রীহি সমাস?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বেশ ভালো লাগলো লেখাটি,আরো লিখবেন আশা করি, আমার নিজেরো যে কোনো শহরে গেলে, সেখানে কোনো ইউনিভার্সিটি থাকলে, তার ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে ভালো লাগে।
নতুন মন্তব্য করুন