থ্রিলার/বড় গল্প
আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হানত্
সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান্ত
আসবে তখন পান্থ।
১.
৮ই মে, ভোর ৬ঃ৩০। লন্ডন, কানাডার পশ্চিম ওন্টারিওর এক ছোট্ট শহর।
ভোরবেলাতেই নদীর পাড়ে বেশ কর্মচাঞ্চল্য দৃশ্যমান। "লাইন অতিক্রম করবেন না", হলুদ ফিতার এই ঘেরাটোপের ভেতরে শশব্যস্ত পুলিশের ফরেনসিক টিম। একটু দূরে গুটি কয়েক উৎসাহী মানুষ মর্নিংওয়াক থামিয়ে উঁকি দেয় এদিকে।
স্প্রিংব্যাংক পার্কের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতে একটু আগে ভেসে উঠেছে একটি লাশ। নীল শাড়ী পড়া, ভেজা শরীর নীলাভ নাকি চুয়ানো রং, ঠিক বুঝা মুশকিল। সামনে বিয়ে চলা নদীতে স্রোত নেই, হালকা বাতাস বইছে। জগিং করতে আসা দুই প্রৌঢ় একটি লাশ ভেসে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেয়। যেখানে লাশ ভেসে উঠেছে তার আশে পাশে নেক খোঁজাখুঁজি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিশেষ কিছু মেলেনি।
গভীর মনোযোগ দিয়ে ডেডবডি পর্যবেক্ষণ করছেন মেডিক্যাল এক্সামিনার, পাশেই তার সহকারী দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন।
"কি মনে হয়: খুন না আত্মহত্যা?" ডিটেকটিভ আর্থার জিজ্ঞেস করলেন।
একাকী জীবনে হতাশার সাগরে ডুবে হঠাৎ আত্মহত্যার ঘটনা কম নয়। প্রতি বছর প্রায় ছয় হাজার লোক এই দেশে নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটায়।
ডিটেক্টিভের প্রশ্নের উত্তরে মেডিক্যাল এক্সামিনার জবাব দেয়, "তেমন বড় কোন আঘাতের চিহ্ন তো দেখছি না, তবে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে নাকি নিজেই ঝাঁপ দিয়েছে সেটা চট করে বলা মুশকিল।"
হোমিসাইড ডিটেকটিভ আর্থার সতের বছর ধরে এই লাইনে আছেন। নিজেও ডেডবডির পাশে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন, কেন জানি তার মনে হচ্ছে কোথাও যেন একটা খটকা আছে, কিন্তু সেটা ঠিক ধরতে না পারায় নিজের উপর কিছুটা বিরক্ত।
"ফরসা চেহারা, চামড়া কিছুটা ট্যান্ড, দেখে মনে হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় মহিলা", সুরতহাল প্রতিবেদন লিখছেন ফরেনসিক এনালিস্ট। "গলায় কোন দাগ নেই, তার মানে স্ট্র্যাংগুলেশন কেস নয়। দেখে মনে হচ্ছে বয়েস ৩৫-৪০ এর কোঠায়, লম্বায় ৫ ফুট ২ ইঞ্চি, পায়ে হিল পরা, গোড়ালিটা একটু কালচে হয়ে আছে।"
"ঝাঁপ দিতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিল নাকি?", জিজ্ঞেস করে তার সিনিয়রকে।
“উহু”, মাথা নাড়েন তিনি, “সেটি এখুনি বলা মুশকিল”। বাহু আর হাতের কব্জি ভাল করে পরখ করা শেষ করলেন তিনি। এখন তার হাতের আতশী কাঁচ কপালের ওপর ধরা, নিচু হয়ে মুখটা পরীক্ষা করছেন। এক ফাঁকে তিনি খাতায় চট করে কিছু পয়েন্ট টুকে নিলেন।
এম্বুলেন্স চলে এসেছে। দুজন প্যারামেডিক লাশ স্ট্রেচারে টেনে তোলে। কী মায়াবী চেহারা, লাশ বহনকারী ব্যাগের জিপার টেনে দিতে গিয়ে তাদের চোখ এক পলক আটকে যায়। ঠোঁটে লিপস্টিক পুরোপুরি মুছেনি এখনো।
আপনমনেই বিড়বিড় করে, "আহারে, কি এত কষ্ট তোমাদের বাছা যে বাঁচার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেল?"
পেছনের দরজাটা লাগিয়ে ড্রাইভিং কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। গন্তব্য ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল।
২.
নদীর ধারে যেখানে লাশ পাওয়া গেছে, ডিটেকটিভ আর্থারের নির্দেশে তার আশে পাশে পাঁচ মাইল এলাকা জুড়ে ব্যাপক তল্লাশী চালাচ্ছে পুলিশ।
প্রায় তিনশ একর জায়গা জুড়ে আছে এই স্প্রিংব্যাংক পার্ক। ভেতরে বয়ে চলা নদীর নাম টেমস, নামটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে এখানে ব্রিটিশ কলোনী ছিল এক কালে। অদূরে রিজার্ভয়ার হিল। উনিশ মাইল লম্বা স্টোরিবুক গার্ডেন ট্রেইল ধরে হাঁটছে দুজন পুলিশ। কোভ ব্রিজের কাছে আসতেই তাদের চোখে পড়ে ভিক্টোরিয়া ডিজাস্টার সাইনবোর্ড। ১৮৮১ সালের মে মাসে এই টেমস নদীতে বয়লার বিস্ফোরণে ডুবে যায় এস এস ভিক্টোরিয়া, যাতে প্রায় দু'শ জনের প্রানহানি ঘটে। একটু সামনে এগুলেই চোখে পড়বে ছোট্ট ব্রিজ আর পাটাতন। পাশেই নদীর ধারে কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতেই তাদের একজনের চোখে কী যেন ধরা পড়ল, কোন একটা কিছুর উপর রোদ পড়ে ঝিলিক মেরে উঠে।
সামনে গিয়ে ভাল করে তাকাতেই দেখা গেল বেঞ্চের ওপরে অর্ধ-গোলাকার আকৃতির ভাঙা নীল রঙের কাঁচের কিছু টুকরো। বেঞ্চের নিচে পড়ে আছে বেশ বড় ফুলের তোড়া। তবে তা একদম চিড়ে চ্যাপ্টা, মনে হয় কেউ পা দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টি হয়েছিল। বেঞ্চের আশে পাশে তিন জোড়া জুতোর ছাপ। এক জোড়া ছাপ চলে গেছে বের হবার গেটের দিকে। অন্য এক জোড়া ছাপ অনুসরণ করে একজন ঝোঁপের দিকে এগিয়ে যায়।
"এই জলদি এস এদিকে", পার্টনারকে হাঁক দিয়ে ডাকে সে।
কিছুক্ষণ খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যান ডিটেকটিভ আর্থার। তার হাতে ছোট্ট একটি বাক্স।
একটু আগেই বাক্সটি পাশের ঝোঁপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এটি কোন আংটির বাক্স, উপরে গর্ডন জুয়েলার্সের নাম লেখা। বাক্সের ভেতরটা খালি, আশে পাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন আংটি পাওয়া যায়নি। বেঞ্চের উপরে পাওয়া ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলোকে ফরেনসিক টেস্টের জন্য পাঠাতে বলে দেন আর্থার। তার অনুসন্ধানী চোখ ইতিউতি খুঁজছে যদি আর কোন ক্লু মিলে। সামনে এগিয়ে ডান দিকে আরেকটি ঝোঁপের ভেতরে উঁকি দিলেন তিনি। পড়ে আছে কয়েকটি সিগারেটের ফিল্টার, মনে হয় কেউ এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
৩.
নভেম্বর, ২০০২। টোকিও, জাপান।
ভার্সিটি থেকে হন্তদন্ত হয়ে মাত্রই বাসায় ফিরেছে নোভা। ফার্মেসিতে পড়ছে সে, সেকেন্ড ইয়ারে। বিকেল ৪টায় ক্লাস শেষ হতেই ছুটে চলে এসেছে, লাইব্রেরীতে আজ আর যেতে ইচ্ছে করেনি। যাওয়া দরকার ছিল যদিও, সামনের শুক্রবারে ক্লাস টেস্ট আছে। রুমে ঢুকে কাপড় ছেড়ে শাওয়ারে গেল। সিল্কি চুল ছেড়ে দিতেই ঘাড়ের একটু নিচে ছড়িয়ে পড়ে, মাথায় শ্যাম্পু দেয় । গুনগুনিয়ে গান গায়, নাচের মুদ্রার ভঙ্গিতে আলতো চক্কর দেয়, ঘুরে আয়নায় নিজের ওপর চোখ পড়তেই কি ভেবে আনমনে হেসে ওঠে, ফরসা গালে ভর করে একরাশ লজ্জা।
"এই নোভা খেতে আয়", মায়ের ডাক শুনে হুঁশ ফিরে।
ভেজা চুল মুছতে মুছতে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। মায়ের আঁচল ধরে কানে কানে কি যেন বলে।
মা ধমক দিতে গিয়েও মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন।
তার অতি আদরের মেয়েটি অনেক দিন ধরেই কেমন মনমরা থাকেত। কোথাও যেতে চায় না, কারো সাথে খুব একটা মেশেও না। তবে ইদানিং তিনি দেখছেন মেয়েটা কেমন যেন চঞ্চল। আবার বায়না ধরেছে শাড়ি কিনে দিতে হবে। ওর বাবা আসলে টাকা চেয়ে নিতে হবে, অনেকদিন পর কিছু চাইল মেয়েটা।
নোভার বাবা ফিরেন সেই রাত ৮ টায়। ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করেন, আগে বাংলাদেশ বিমানে চাকরি করতেন। কিন্তু বদলী ঠেকাতে না পেরে বছর দুয়েক আগে চাকুরী ছেড়ে দেন। কারণ টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবুশো স্কলারশিপ পেয়েছে নোভা, এখন তারা আর ওকে জাপানে একা ছেড়ে যেতে রাজী নন।
একমাত্র মেয়েটিকে নিয়ে মিসেস নাসরিনের নিজের ভেতরে খুব ভয় কাজ করে, অনেক কষ্ট পেয়েছে তার অতি আদরের কন্যা নোভা। আর যা যা ঘটেছে তার জন্য তিনি নিজেকে আজো ক্ষমা করতে পারেননি। সম্বিত ফিরে তাকিয়ে দেখেন, হাতে প্লেট নিয়ে গোগ্রাসে গিলছে নোভা।
"কিরে এত তাড়া কিসের? আস্তে খা না, ট্রেন ছুটে যাচ্ছে নাকি?", মায়ের বকুনি।
"ইস, মা কি বুঝে ফেলল নাকি?", ধরা পরে যাবার ভয়ে কি জানি বলতে গিয়ে বিষম খেল নোভা।
"আল্লাহ, এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারিনা", মা পানি এগিয়ে দেন।
কোন মতে খাওয়া শেষ করে এসেই ঝটপট কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়ে।
"জান, কেমন আছ?", ইয়াহু ম্যাসেঞ্জার টুং করে সেন্ড প্রসে করে নিজের আগমণ বার্তা জানান দেয় নোভা।
"কি ব্যাপার, আজ দেরী হল যে?"
"আরে মা ছাড়ছিল না"।
"আমিও ছাড়ছি না, তোমার হাত ধরে থাকতে চাই সারাজীবন "
"উহু, যদি এমন হয় কোন একদিন ভোরের আলোয় আসবে রাঙা প্রভাত, সেই প্রভাতে থাকব না আমি"।
"উফ, কতবার না মানা করেছি, এসব কথা না বলতে!"
কিছুদিন আগে এক চ্যাটরুমে পরিচয় তাদের, প্রথম দিনেই ছেলেটির হিউমার ভরা দুষ্টু কথায় মনে দাগ কেটে যায়। এরপর থেকে রোজ কয়েক ঘন্টা কথা হয় তাদের, কত দূরে তবু যেন কত কাছে। শনি আর রবিবার অবশ্য তাদের কথা হয় না, বাবা থাকে বাসায়, সেদিন তারা ইমেইল চালাচালি করে। আর সময় পেলেই নিজের জমানো টাকা থেকে মাঝে মাঝে কার্ড কিনে কল দেয় বাংলাদেশে, কোন ফাঁকে যে এক ঘন্টার কার্ড শেষ হয়ে যায় টেরই পায়না। সত্যি সত্যি এত ভালো লাগবে কাউকে কল্পনাও করতে পারেনি।
মাঝে মাঝে তবু খুব ভয় ভয় লাগে নোভার, কিভাবে বলবে, যদি ...।
৪.
জানুয়ারি, ২০০৪।
ঢাকায় এখনো শীতের আমেজ, ঝিরিঝিরি বাতাস ।
হালকা নীল শাড়ী পড়েছে নোভা, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, খোপায় দিল বেলী ফুলের মালা। মন জুড়ে চাপা উত্তেজনা, দুরু দুরু কাঁপে বুক।
"এই রওয়ানা দিয়েছ?", মোবাইলে মেসেজ আসে।
"এইতো আর আধ ঘন্টা", উত্তর পাঠিয়ে দেয় সে।
বার বার আয়নায় তাকায়," মা আমাকে কেমন লাগছে?"
নাসরিন চুমু দেন কপালে, "তুই আমার জলপরী।"
ঘড়ি দেখে নোভা, ইশ, দেরী হয়ে গেছে। "মা, আমি গেলাম"।
বনশ্রী থেকে গাড়ি বের হল, গন্তব্য ধানমণ্ডির এক রেস্টুরেন্ট।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে চারপাশে তাকায়, ভীড় নেই তেমন। কর্নারে এক টেবিলে বসা, হ্যাংলা পাতলা ছেলে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, রিমলেস ফ্রেম, প্রথম দর্শনে তেমন স্মার্ট মনে হয় না। মাথা ভর্তি চুল, হালকা কোঁকড়ানো। বাইরে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে, খুব উৎসাহ নিয়ে রাস্তার জটলা দেখছে।
আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় নোভা, খুক করে কাশে। "সরি, অনেক দেরী করে ফেল্লাম"।
ছেলেটা হাসে, মুখচোরা লাজুক হাসি । অসম্ভব সুন্দর এই হাসি কেমন যেন পাগল করে দেয়। মায়াবী চোখে চোখ রাখতে পারে না, লাজুক মুখে বসে থাকে দুজনে। কি অদ্ভুত! এত দিন দুজনেই ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাট করেছে, অথচ আজ সামনে এসে কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ, নীরবতা ভেঙে তিতাস বলে উঠে, "কি খাবে বল? ফুচকা ছাড়া"।
হেসে ফেলে নোভা। আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসে, চামচের টুংটাং, খাওয়ার ফাঁকে কত কী যে বলে। ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর দুজনেই।
"এই, তোমার চোখে এত কি কথা লুকোনো? আমি তোমার সব কথা জানতে চাই, সব! আর বলতে চাই এই মায়াবতী শুধুই আমার!"
লাজে রাঙা হয়ে উঠে নোভা।
৫.
ঢাকায় যে চার সপ্তাহ ছিল, সে সময় তারা দুজন বলতে গেলে প্রতিদিন দেখা করত। এক সাথে লাঞ্চ করতে গিয়ে অনেক কথা হত, বিয়ের প্রসঙ্গটাও ওঠে আসে বেশ কয়েক বার।
"বাবা মা আমাকে সেটল করার কথা বলছেন, জানো?" নোভার মুখে একথা শুনেই তিতাসের মন খারাপ হয়ে যায়।
সে মাত্র পাশ করে বেরিয়েছে, এখনো ভালো কোন চাকরি হয়নি। পার্ট টাইম একটা কলেজে পড়াচ্ছে।
"আমি অবশ্য বলেছি মাস্টার্স শেষ না করে বিয়ে করব না", তিতাসের মুখ দেখে খুব মায়া হয় নোভার। ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে! "তুমি অত ভেবো না তো জান, মা'কে বলেছি তোমার কথা! তোমার একটা চাকরি হোক, তখন বাবাকে জানাবে মা"
"ও তাই বল, আমি তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম", স্বস্তি পেল তিতাস।
" কেন আমাকে না পেলে কি করবে তুমি?"
"তোমাকে ছাড়া কাউকেই ভাবতে পারি না আমি। তুমি আমাকে কোনদিন ছেড়ে যাবে না কিন্তু… ", নোভার দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে।
" কিন্তু কি?"
"যদি ছেড়ে চলে যাও, যেখানেই যাও তুমি, পৃথিবীর যে প্রান্তে তোমাকে খুঁজে বের করব। আর আমার হতে না পারলে খুন করে ফেলব! আমার না হলে অন্য কারো হতে পারবে না তুমি!"
"আস্ত পাগল একটা! ", আকাশ ভাঙা বৃষ্টির আবেগে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে।
৬.
৮ই মে বিকেল ৩টা, ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ফরেনসিক মর্গ। দায়িত্বপ্রাপ্ত করোনার শেলবি উয়িংস, বয়সে প্রবীণ না হলেও নিজের কাজে দক্ষ। এই শান্ত শহরে খুনের ঘটনা খুব একটা না ঘটলেও আত্মহত্যার সংখ্যা নিতান্তই কম নয়। ফুসফুসের ভেতরে বাতাস ধরে রাখার নালি পরীক্ষা করছেন। তারপর ভাবলেন, ডায়াটম টেস্ট করতে হবে। শেষে দাঁতের এক্সরে করে নিলেন তিনি যা পুলিশকে আগে দিতে হবে।
হাতের কব্জির চামড়া থেকে কাচের ক্ষুদ্র কয়েকটি কনা টেনে বের করলেন। বেশ কয়েক জায়গায় কেটে গেছে, বাহু আর কপালে কোন দাগ আছে কিনা বিশেষ মন দিয়ে দেখলেন।
"নাহ, কোন স্ট্রাগল সাইন নেই!”, রেকর্ডার কাছে নিয়ে বলে গেলেন। দেখলেন মৃত মেয়েটির মসৃণ চুলে হালকা পাক ধরেছে, তার এক কানে দুল নেই। হাতের কব্জির চামড়া থেকে কাচের ক্ষুদ্র কয়েকটি কনা টেনে বের করলেন। বেশ কয়েক জায়গায় কেটে গেছে, বাহু আর কপালে কোন দাগ আছে কিনা বিশেষ মন দিয়ে দেখলেন।
হাত দিয়ে মৃতদেহ উল্টে দিলেন। দেখা গেল পিঠে বেশ বড় কালসিটে দাগ। চুল সরিয়ে মাথার খুলি ভাল করে পরীক্ষা করলেন, কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। ঘাড়ের চারপাশ পরীক্ষা করার পর তার মুখে চিন্তার ছাপ।
“আচ্ছা, কেউ কি ইয়ারিং খুলে নিয়েছে? নাকি নদীতে ভেসে গেছে? গলায় কি নেকলেস ছিল?”
এসব ভেবে আরো কয়েকটি টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
৭.
লাশের সাথে কোন হ্যান্ড ব্যাগ ছিল না, মোবাইল ফোনটাও পাওয়া যায়নি। নদীতে ভেসে গিয়ে থাকতে পারে অবশ্য। শেষমেষ দাঁতের এক্সরে মিলিয়ে লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। ড. নাতাশা হক। এখানকারই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তিনি। থাকতেন সামারসাইডে, মিডোগেট পার্কে।
পরিচয় পেয়ে ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়, ফার্মেসী বিভাগে নাতাশার অফিস সার্চ করছে পুলিশ। ডিপার্টমেন্টে অন্যদের সাথে কথা বলে জানা গেল ড. নাতাশা ২০০৭ সালে এখানেই পিএইচডি করতে আসেন আমেরিকা থেকে। পাঁচ বছর পরে এখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বন্ধু নেই তেমন, কলিগ হিসেবে একমাত্র ড. হেনা প্যাটেলের সাথেই যা একটু খাতির।
ছোট অফিস রুম পরিপাটি করে সাজানো, খুব গোছানো! পেছনে র্যাকে অনেক গুলো বই, ডেস্কের উপর রাখা বইটি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছেন আর্থার। ডেস্কের উপরে কম্পিউটার, অন করলেন তিনি। আইটি এক্সপার্ট ডেকে আনতে বললেন, পাসওয়ার্ড ভাঙতে হবে।
ডেস্কের ড্রয়ারের তালা ভেঙে পাওয়া গেল একটি খাম। নাতাশা হক আর রাজীবুল ইসলামের ডিভোর্স সার্টিফিকেট, তাতে গত বছরের মাঝামাঝি একটি তারিখ দেয়া।
"ড. নাতাশা বিবাহিত ছিলেন?", সহকারী পিটারের চোখে বিস্ময়। অন্যমনস্ক আর্থার সেকথা শুনতে পেলেন বলে মনে হয় না। অন্য আরেকটা খাম থেকে বের করলেন টাইপ করা চিঠি, এক নজর চোখ বুলিয়েই পকেটে পুরে নিলেন।
"আসতে পারি?", দরজা ঠেলে ঢুকলেন মহিলা, "আমি হেনা, ড. হেনা"।
বসতে বলা হল তাকে।
"আপনি কতদিন ধরে চেনেন নাতাশাকে? ", তার দিকে কয়েকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ডিটেকটিভ।
“তার কোন বয়ফ্রেন্ড আছে এখানে?”
নাতাশার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিশেষ কিছু জানা গেল না। বয়ফ্রেন্ড ছিল এমন তথ্য কেউ জানে না।
এমনিতে চুপচাপ স্বভাবের হলেও, তার গলার স্বরে ছিল অদ্ভুত মাদকতা। ছাত্ররা তন্ময় হয়ে লেকচার শুনত, বেশ জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন । বছর খানেক ধরে রিসার্চ করছিলেন বায়ো-ফার্মেসি নিয়ে, নতুন পদ্ধতিতে একটা যৌগ তৈরীর প্যাটেন্ট চেয়ে আবেদন করেছিলেন। ক্লাস শেষে সাধারণত জিমে যেতেন, বাকি বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই কাটাতেন।
"নাতাশার নিকটাত্মীয় কেউ আছে?", আর্থার জানতে চান।
“এখানে তো কেউ নেই”, হেনা জানালেন, “নাতাশার বাবা মা থাকেন ঢাকায়। আপন বলতে নাতাশার এক খালা আছেন, ইন্ডিয়ানাতে থাকেন। তাকে খবর দেয়া হয়েছে, আজ সকালের ফ্লাইটেই তার পৌঁছানোর কথা।”
ডিপার্টমেন্ট হেডের কাছ থেকে জানা গেল, ৭ই মে ছিল তার জন্মদিন, ছুটি নিয়েছিলেন।
তবে সেদিন তিনি কেন স্প্রিংব্যাংক পার্কে গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না।
৮.
জুলাই ২০০৪। আজ চার মাস হয়ে গেল নোভার কোন পাত্তা নেই। ঢাকা থেকে ফেরার বেশ কিছুদিন আগের মতন কথা হচ্ছিল। ততদিনে দুজনেরই গ্রাজুয়েশন শেষ, তিতাস চাকুরী খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ওদিকে নোভা মাস্টার্সের জন্য অনেক দেশে আবেদন পাঠাতে শুরু করে। প্রথমে ওর বাবা মা তাকে একা বিদেশে ছাড়তে চাননি। তবে এর কিছদিন পরে একটি ইমেইলে জানায় বাবা মা নাকি এখন রাজী হয়েছেন। কাজেই সামনের কিছুদিন এডমিশন কনফার্ম করার কাজে কাগজ পত্র পাঠানোর জন্য দৌড় ঝাঁপ করতে অনেক ব্যস্ত থাকবে, সেপ্টেম্বর সেশন ধরতে হবে ওকে ।
তারপর থেকে যোগাযোগ অনিয়মিত হয়ে গেছে। প্রায় দু’মাস তিতাস ইমেইল করে চলেছে একের পর এক, কিন্তু একটারও উত্তর নেই। নোভা আজকাল ইয়াহু আর এমএসএন ম্যাসেঞ্জারে অনলাইন হয় না।
"আচ্ছা, মেয়েটার অসুখ করেনি তো বা কোন এক্সিডেন্ট হয়নি তো?", তিতাস ভাবে।
সারাটা দিন খুব মন খারাপ থাকে, ভেতরটা চরম অস্থির লাগছে। যেদিন কোন ইন্টারভিউ থাকে সেদিন একটু নিজেকে গুছিয়ে নেয়, নইলে এই কদিন তার খাওয়া ঘুমের কোন ঠিক নেই। বন্ধুরা সান্ত্বনা দেয়, "অনলাইনে পরিচয় হওয়া এক মেয়ে নিয়ে এত সিরিয়াস হওয়ার কি আছে রে? দেশে কি মেয়ের অভাব? চিল ম্যান!"
তবু মন মানে না, রোজ বিকেলে সাইবার ক্যাফে গিয়ে ইয়াহু মেইল আর ম্যাসেঞ্জারে লগ ইন করে বার বার রিফ্রেশ বাটন চাপে।
দিন যায়, মাস গড়ায়, নিরুত্তর সব।
অবশেষে কয়েক মাস পর নীরবতার অবসান, ইমেইল পেল, নোভার নতুন এড্রেস থেকে।
জান,
এক বিশেষ কারণে আমাকে তোমার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে সরে যেতে হচ্ছে। তুমি আমাকে একদম ভুলে যেও জান। তোমাকে খুব ভালবাসি কিন্তু আমি অনেক দূর্ভাগা তাই তোমার হতে পারলাম না। যদি পার তো আমাকে ক্ষমা করে দিও। তুমি যেখানেই থাক খুব সুখী হও।
আর কোনদিন আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না, প্লিজ।
শেষবারের মতন,
তোমারই মায়াবতী
কেন জানি তিতাসের একদমই মন খারাপ হল না, বরং এক সুতীব্র রাগে ভেতরটা পাথরের মতন শক্ত হয়ে গেল। যেন সে এরকম এক ইমেইলের প্রতীক্ষাতেই ছিল এতদিন। বন্ধুরা ঠিকই বলেছিল, বিদেশে থাকা মেয়েটি শুধু টাইম পাস করছিল। তার মতো বেকারের আশায় কোন দুঃখে অপেক্ষা করে বসে থাকবে?
সত্যিই কি বোকা আমি, চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, হাতের মুঠোয় শক্ত করে নিজের আঙুল চেপে ধরে। তার চোখ জ্বালা করতে থাকে, সাদা স্ক্রিনে কালো এরিয়েল ফন্টের তিন লাইনের লেখায় এক মুহূর্তে তিন বছরের সমস্ত বিশ্বাস তছনছ হয়ে গেল।
চলবে
লেখক: Rubaiyyaat Aakbar
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন