নগরী ঢাকা ৬

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৭/০২/২০২১ - ২:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রসঙ্গ ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি:
প্রতিদিন ঢাকাবাসীরা যে পরিমাণ পানি মাটির নিচ থেকে তুলে এনে ব্যবহার করছে সেই পরিমাণ পানি মাটিতে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতি বছরই তাই একটু একটু ক’রে মাটির নিচের পানির-স্তর নেমে যাচ্ছে। যার ফলে বছরান্তে পানি উত্তোলনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত তৈরী হচ্ছে পানি-পরিশোধনাগার তৈরীর চাহিদা, যেখানে সারফেইস ওয়াটার (স্বাদুপানি বলা যায় হয়তো) বা নদী, খাল কিংবা বড় কোনো জলাধারের পানিকে ব্যবহার উপযোগী করা হবে। কিন্তু মাটির উপরের এইসব পানিতে যদি দূষণের পরিমাণ বেশি হ’য়ে যায় তবে তাকে পরিশোধনের খরচ লাগে অনেক বেশি। অনেক সময় তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও পাওয়া যায় না। আবার যদিও বা পাওয়া যায়, অনেক সময়ই দেখা যায় যে সেই প্রযুক্তি অর্থাৎ যন্ত্রপাতি ব্যবহার আর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযত লোকবল নেই শহরে।
ফলে সহজ সমাধান হিসেবে বারবার ভূগর্ভস্থ পানি তোলার জন্য নলকূপ বসানোর পরিকল্পনা হাতে নিতে হয়। আবার ১৯৯৩ সালের দিকে যখন দেশব্যাপী অগভীর-নলকূপের পানি পরীক্ষা করা হ’লো তখন জানা গেলো প্রায় ২৯ শতাংশ অগভীর নল-কূপের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় আর্সেনিক আছে। দেশের পার্বত্য তিনটি জেলা ছাড়া বাকি সবগুলো জেলার ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা গেলো। সেই সাথে আরো দেখা গেলো মাটির একটু গভীরের স্তরের পানি আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য নিরাপদ। দ্বিতীয় স্তরের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি নেই। এটাতে সারা দেশব্যপী গভীর-নলকূপ বসানোর প্রয়োজন পড়লো আরো বেশি ক’রে। (১)
অর্থনীতির পরিসংখ্যান ব’লছে ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বেশ তরান্বিত হ’য়েছে। আর অর্থনৈতিক অগ্রগতি সমসময়ই নগরায়নকে তরান্বিত করে। এই সময় নানা কারণে খুলনা পিছিয়ে পড়তে থাকে। ফলে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহরের লোক-সংখ্যা কমতে শুরু করে। বন্ধ হ’তে শুরু করে এই শহরের অনেকগুলো কারখানা। তার বেশ খানিকটা প্রভাব শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে ঢাকা আর তার আশপাশের শহরতলীগুলোর উপর, যেখানে পুরোনো কিছু কারখানা আগে থেকেই আছে আর নতুন নতুন পোশাক-কারখানা গ’ড়ে উঠছে।
মনে রাখা দরকার পোশাক-কারখানাতে প্রচুর পরিমাণে পানযোগ্য পানির প্রয়োজন হয়। আর এই কারখানাগুলো উপজাত হিসেবে সমপরিমাণে দূষিত পানি উৎপাদন করে। বিলেতের ম্যানচেস্টার যখন পৃথিবীর কাপড়-তৈরীর কারখানা আর বাজারের সিংহভাগ দখল নিয়েছিলো তখন সেখানকার প্রায় সবগুলো খাল-নদীর পানি এমনই দূষণের শিকার হ’য়েছিলো যে সেখানকার নদীগুলো থেকে প্রায় সব ধরণের মাছ আর জলজ প্রাণী হারিয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে য়ুরোপের বেশির ভাগ বড় শহরকেও শিল্পায়নের এই ধরণের ক্ষতিকর প্রভাবের ভেতর দিয়ে যেতে হ’য়েছে। স্বাদুপানি বা মিঠাপানির মাছ যে কি জিনিস তা যুরোপ এখন আর জানে না ব’ললেই চলে।
ঢাকার সীমান্তবর্তী তুরাগ আর বুড়িগঙ্গার পনি এখন এমনই দূষিত যে সেখানে আর তেমন কোনো জলজ-প্রাণী নেই ব’ললেই চলে। অনেক বিশেষজ্ঞ ব’লছেন এই পানি এখন আর শোধনের উপযোগীও নেই। জানি না সাইদাবাদ কিংবা পাগলার শোধনাগারের ঠিত কতটা পানি এখনো বুড়িগঙ্গা থেকে জোগাড় করা হয়। শোনা যাচ্ছে, পদ্মা নদী থেকে পানি তুলে সেই পানি শোধন ক’রে ঢাকার বাসা বাড়িতে সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছে সরকার।(২) এই পরিকল্পনা যে একেবারে বাধ্য হ’য়েই করতে হচ্ছে তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ঢাকার আশেপাশের নদীগুলোর পানি এরই ভেতরে এতটাই দূষিত হ’য়ে গিয়েছে যে তাকে শোধন ক’রে পানযোগ্য করা অর্থনৈতিক বিচারে আর লাভজনক নেই। উপরন্তু বুড়িগঙ্গা, বালু আর তুরাগ নদীতে পানির পরিমাণও অনেক কমে গিয়েছে। তার পরিণতিতে প্রতিদিনই ঢাকার পানির-স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে ঢাকা-ওয়াসার তখনকার ব্যবস্থাপনা-পরিচালক জনাব রায়হানুল আবেদিন বলেছিলেন, ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির-স্তর বছরে ৩ মিটার ক’রে নিচে নেমে যাচ্ছে।(৩) এ সম্পর্কিত ২০২১ সালের তথ্য এখনো যোগাড় ক’রতে পারিনি, তবে ধারণা করি পানির-স্তর নেমে যাওয়ার হার আরো বেড়েছে।
ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে একটা সাধারণ রেখাচিত্র দেখা নেওয়া যাক। এটি নেওয়া হ’য়েছে https://wtamu.edu/~cbaird/sq/2013/07/16/how-do-wells-get-their-water-from-underground-rivers/ ওয়েবপেইজ থেকে।

কনফাইন্ড আর আনকনফাইন্ড এ্যাকুইফারকে যথাক্রমে সদা-পরিবর্তনশীল আর তুলনামূলক ভাবে কম-পরিবর্তনশীল ভূ-গর্ভস্থ জলাধার বলা যায়। সদা-পরিবর্তনশীল ভূগর্ভস্থ জলাধার সাধারণত মাটির কম গভীরতাতে অবস্থিত হয় আর এর উপরে থাকা মাটি এমন বৈশিষ্ট্যের হয় যে তার ভেতরে বৃষ্টি কিংবা নদীর পানি সহজে ঢুকতে পারে। এই ভূগর্ভস্থ জলাধারের পানির একদম উপরের তলকে ‘ওয়াটার-টেবল’ বা পানির-স্তর বলা হয়। পানির এই স্তর বর্ষাকালে উপরে উঠে আসে আর শীতকালে নিচে নেমে যায়। এই ধরণের ভূ-গর্ভস্থ জলাধারের নিচে যাদি এমন একটা মাটির স্তর থাকে যার ভেতরে সহজে পানি ঢুকতে পারে না তবে সেই মাটির স্তরের নিচে কম-পরিবর্তনশীল ভূগর্ভস্থ জলাধার গড়ে উঠতে পারে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে। এমন ধরণের ভূগর্ভস্থ জলাধার কয়েক স্তরের হ’তে পারে, কখনো কখনো তা মাটির উপরের দিকেও থাকতে পারে, তবে সাধারণত মাটির বেশ নিচেই এদেরকে পাওয়া যায়।
অগভীর নলকূপ দিয়ে খুব সহজেই মাটির উপরের দিকের জলাধারের পানি তুলে আনা যায়। আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গাতেই আমরা এটা করছি বেশ অনেক বছর ধ’রেই। যেহেতু বাংলাদেশে নদী-নালার পরিমাণ বেশ বেশি তাই এই তুলে আনা পানির কতটা আমরা আবার মাটিতে ফিরিয়ে দিচ্ছি তা নিয়ে আমাদের খুব একটা ভাবতে হয়নি এতদিন। সে যেমন গ্রামীন প্রেক্ষাপটে, একই সাথে শহুরে প্রেক্ষাপটেও। কিন্তু দুষ্টুলোকেরা যে বলে, সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, তা এই ক্ষেত্রে পুরো খেটে গেছে।
অধিক জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা বৃদ্ধির প্রয়োজনে আমাদেরকে বাড়াতে হ’য়েছে আবাদি জমির পরিমাণ, সেই সাথে সেচের ব্যবস্থা। ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশের অনেকগুলো জায়গাতে সেচের প্রয়োজনে গভীর নলকূপ বসানোর কার্যক্রম শুরু হয়। (৪) এর সাথে পরবর্তীতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নদী থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের গ্রামাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যেতে শুরু করে। ফলে দেশের কৃষি-ব্যবস্থাতে গভীর নলকূপের ব্যবহার বাড়ানোর আপাত প্রয়োজন বেড়ে যায়।
আর শহরের গুরুত্ব বাড়ার সাথে সাথে শহরে বাড়তে থাকে জন-ঘনত্ব। তাতে পানযোগ্য পানির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। তার সাথে শহরে যদি এমন ধরণের শিল্প-কারখানা গ’ড়ে তোলা হয় যার জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন পড়ে তবে সেই পানির চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থাপনা খুব গুরুত্বপূর্ণ হ’য়ে দাঁড়ায়; আজ ঢাকার জন্য যেমনটা হ’য়ে উঠেছে।
ইন্দোনেশিয়ার কুয়ালালাম্পুরের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে বেশ বড়সড় একটা জটিলতা দেখা দিয়েছে কয়েক বছর আগে। কুয়ালালাম্পুর শহরের আয়তন আর গড়পড়তা ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খুব দ্রুত শহরের পানির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই চাহিদা পূরণের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে নিতে হয়েছে কুয়ালালাম্পুরবাসীদেরকে। তাতে এই শহর যে মাটির উপর দাড়িয়ে আছে তার বৈশিষ্ট্য গিয়েছে পালটে। মাটির সদা-পরিবর্তনশীল ভূগর্ভস্থ জলাধারে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় এই অংশের মাটির চাপ ধারণ ক্ষমতাও গিয়েছে কমে। আবার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ইমারত তৈরী হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে। যার ফলে মাটির উপর যতটা ভর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ততটা ভর এখানকার মাটি নিতে পারছে না। প্রতিবছরই তাই একটু একটু ক’রে কুয়ালালাম্পুর শহর বসে যাচ্ছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির স্তর যাচ্ছে বেড়ে। সব মিলিয়ে কুয়ালালাম্পুর শহর তলিয়ে যেতে শুরু ক’রেছে। এখন বাধ্য হ’য়ে ইন্দোনেশিয়াকে তার রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হচ্ছে।
ঢাকার জন্যও একই ধরণের ভয় বাড়ছে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানি অতিরিক্ত মাত্রায় দূষণের কবলে পড়েছে মূলত পোশাক আর চামড়া শিল্পের জন্য। সেই সাথে আমরা এত বেশি পলিথিন বর্জ্য নদীতে ফেলেছি যে নদীর নীচের মাটি আর পার্মিয়েবল বা পানি-শোষণক্ষম নেই ব’ললেই চলে।
শোনা যায় রাজা বল্লাল সেনের রাজধানী পদ্মার ভাঙনে খুব অল্প কিছু দিনে বা বছরের ভেতরে হারিয়ে গিয়েছিলো। তার রাজবাড়ির কিছুই এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার নতুন ক’রে বল্লাল সেন আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য গ’ড়ে তুলতে পরেছিলেন কিনা তা জানতে পারিনি এখনো।
ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য একে আর কত দিন রাজধানী হিসেবে টিকিয়ে রাখা যাবে তা এক গুরুতর প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহলে উচ্চারিত হয় কিনা সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই ব’লে দুঃখ প্রকাশ ক’রে নিচ্ছি। তবে এটা ব’লতে পারি সে ধারণা তৈরীর চেষ্টা করছি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার ভাবনা সরকারের আছে কিনা জানি না। তবে ঢাকার পানি-ব্যবস্থাপনা আর দেশে আরো কিছু বড় শহর গ’ড়ে তোলা নিয়ে কার্যকর ভাবনা খুব দ্রুত বিকাশ করা প্রয়োজন। আর তা করা না গেলে রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার মতো ভয়ানক ভাবনা ভাবারও প্রয়োজন পড়তে পারে অদূর ভবিষ্যতে।
সূত্র :
১. https://old.dphe.gov.bd/index.php?option=com_content&view=article&id=96&Itemid=104
২. https://www.prothomalo.com/bangladesh/%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%B6%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%A2%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A6%A8
৩. https://www.thedailystar.net/news-detail-83387
৪. এই ব্যাপারে কিছু চিত্তাকর্ষক তথ্য পাওয়ার জন্য যৌথভাবে লেখা বেটসি হার্টম্যান এবং জেমস্ কে. বয়সি এর A QUIET VIOLENCE _ View from a Bangladesh Village বইয়ের Tubewells for the Rich অংশটি পড়া যেতে পারে।

নোট : প্রথম বারের মতো ছবি যুক্ত করার চেষ্ট করলাম। ঠিক মতো যুক্ত হ'লো কিনা বুঝতে পারছি না।
(রাজীব রহমান)


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সারফেইস ওয়াটারকে ভূউপরিস্থ পানি লেখা হয়, সংক্ষেপে খোলাপানি বলা যায়। ভূগর্ভস্থ পানিকে ভূতত্ত্ববিদ পতাকী চট্টোপাধ্যায় ভূজল লিখেছেন, অ‍্যাকুইফারকে সংক্ষেপে ভূজলবাহ বলা যায়। ওয়াটার-টেবলকে জলশীর্ষ পড়েছিলাম কোথায় যেন, মনে পড়ছে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

খোলাপানি আর জলশীর্ষ শব্দগুলো পছন্দ হয়েছে। আর ভূজল দিয়ে আপাতত কাজ চালানো যাবে মনে হয়। ধন্যবাদ।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

চিহুয়াহুয়া এর ছবি

কুয়ালালাম্পুর না জাকার্তা?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভয়াবহ একটা ভুল ক'রে ফেলেছি দেখি। ঠিক ধরেছেন জাকার্তা হবে। ধন্যবাদ, ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। এডিট করার সুযোগ থাকলে ভাল হ'তো মনে হচ্ছে। কিন্তু কি আর করা।
(রাজীব)

হিমু এর ছবি

আমাদের দেশে বর্ষাকালে যে বিপুল পরিমাণ পানি বয়ে যায়, তার খানিকটা পরিশোধন করে কি মাটির নিচে ত্বরান্বিত হারে জমানো সম্ভব?

অতিথি লেখক এর ছবি

অবশ্যই সম্ভব। বৃষ্টির পানি দ্রুত মাটিতে রিচার্জ করার বেশ কিছু উপায় আছে। এরই ভেতরে দেশের বেশ কিছু কারখানাতে এধরণের কিছু ব্যবস্থা তৈরী করা হয়েছে। এটা মূলত একধরণের নলকূপই। তবে খেয়াল রাখতে হয় মাটিতে ত্বরান্বিত হারে পৌঁছে দেওয়া এই পানিতে যেন ক্ষতিকর উপাদান না থাকে। প্রাকৃতিক ভাবে শোষপুকুর (রিটেইনশন পুকুর) কিংবা খাল-বিল আর নদীর পানি মাটির উপরের স্তরের ভেতর দিয়ে একপ্রকার শোধনের পথ পেরিয়েই ভূজলের (এ্যাকুইফার) স্তরে গিয়ে পৌঁছায়।
যেখানে উন্মুক্ত মাটি থাকে সেখানে নলের মাধ্যমে মাটির গভীরে পানি পাঠানোর খুব একটা দরকার পড়ে না। দরকার পড়ে মূলত সেই সব জায়গাতে যেখানে হার্ড-সারফেইস বা শান-বাঁধানো তলের পরিমান বেশি। অর্থাৎ শহুরে এলাকাতে। শান-বাঁধানো তলের উপর সাধারণত নানা ধরণের ময়লা জমতে থাকে। ভবনের ছাদ, পেভমেন্ট বা রাস্তার উপর প্রতিনিয়ত জমতে থাকা ময়লাগুলো যেন ভূজলের সাথে সরাসরি মিশতে না পারে সেটা খেয়াল রাখা খুবই জরুরী।
কারখানার যেসব ভবনগুলো তুলনামূলকভাবে একটু বেশি রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় থাকে অর্থাৎ নিয়মিত পরিস্কার করা হয় যে ভবনগুলো তার ছাদে পড়া বৃষ্টির পানির প্রথম ৮/১০ মিনিট মাটির উপর কিংবা পৌরসভার ড্রেনে ছেড়ে দিয়ে বাকিটা নলের মাধ্যমে ভূজলের স্তরে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে ব'লে অনেক বিশেষজ্ঞই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাতে কারখানা এলাকাতে বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হওয়া হঠাৎ জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা কমে যায়। আমাদের দেশে বর্ষাকালে ৩০ মিনিটের ভারী বৃষ্টিতেই রাস্তা কিংবা কারখানা এলাকাতে পানি জমে যেতে দেখা যায়। এই জমে যাওয়া পানিটাকে ভূজলে পৌছে দেওয়াটা কঠিন কাজ নয়। কঠিন কাজ হ'লো পানিটা শোধন করা, নিদেন পক্ষে বৃষ্টির পানিটাকে দূষিত না করার উপায় বের করা।
(রাজীব)

হিমু এর ছবি

যদি পড়ে না থাকেন, জ্যারেড ডায়মণ্ডের কোলাপ্স বইটা আপনাকে পড়তে অনুরোধ করি। আপনার নগরভাবনায় সেটা কিছু খোরাক যোগাবে। ওখানে পড়েছিলাম, আইসল্যাণ্ডে বহু সহস্রক ধরে জমে ওঠা মাটির পাতলা স্তর কীভাবে ভাইকিং বসতিয়া (সেটলার) লোকজন শতকের মধ্যে ক্ষয় করে পুরো দ্বীপটাকে চাষের প্রায় অযোগ্য বানিয়ে ফেলে। ঢাকার ভূজলের সমস্যাটাও কাছাকাছি মনে হচ্ছে।

বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহারে নগরবাসীকে কীভাবে উৎসাহ দেওয়া যায়, সে বুদ্ধি কর্তৃপক্ষকে বাতলে দিতে হবে। সেইসাথে এর সাশ্রয়ী প্রযুক্তিও যাতে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিতে পারেন, সেটাও নিশ্চিত করা জরুরি। নানা বিদ্যাশাখার চিন্তকরা এ নিয়ে একটা বার্ষিক যূথচিন্তনের আয়োজন করতে পারেন কিন্তু।

(অ্যাকুইফার বোধহয় ভূজলবাহ)

অতিথি লেখক এর ছবি

পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিক হওয়ার সাথে সাথে সভ্যতাই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। এর একটা বড় উপকরণ সেপ্টিক ট্যাংক (জানি না বাংলাতে এটাকে কি বলা যেতে পারে)। আর একটা উপকরণ ট্রাপ বা ফাঁদ, যেটা ব্যবহার করে খুব সহজেই গন্ধযুক্ত বাতাসতে আটকে দেওয়া যায়। পরীক্ষণ-ফাঁদ বা ইনস্পেকশন-পিট আর ট্রাপের মূলনীতিতে বেশ মিল আছে। এই সরল কিছু প্রযুক্তি শহরের আয়তন বাড়িয়ে দিতে আমাদেরকে দারুনভাবে সহায়তা করেছে গত কয়েক শতক।
তবে ইদানিং কালে এসে বোধহয় আমরা এই ফাঁদ বা ট্রাপের ফাঁদে পড়ে গেছি সবচেয়ে বেশি। তার কারণ আমাদের ব্যবহার করা কমোডগুলো। এটা যে আমাদের নাগরিক জীবনকে অনেক সুবিধাজনক করেছে তা মানতেই হবে, তবে সেই সাথে বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের পানির ব্যবহার। পরিশোধন করা পানির ঠিক কত শতাংশ এখন আমরা কমোডে ফ্লাশ ক'রে খরচ করছি তার হিসাব জানি না। তবে সেটা বোধহয় খুব কম নয়। মাঝেমাঝে খুব ক'রে মনে হয়, আমাদের টয়লেট আর কমোডগুলো একেবারেই নতুন ক'রে ডিজাইন করা দরকার, যেন পানির খরচ অনেকটা কমিয়ে আনা যায়। অন্তত যদি সাধারণ ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে টয়লেটের সংখ্যা তিন/চারটা থেকে কমিয়ে এক/দুইটাতে আনা যেতো! তাতে হয়তো টয়লেট পরিস্কার করার জন্য প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ বেশ কমিয়ে আনা যেতো। কিন্তু তার সাথে তো জীবনাচরণের সম্পর্ক। বাড়িতে বেশি টয়লেট থাকলে বেশি শুল্ক দিতে হবে নগর-কর্তৃপক্ষকে এমন নীতি প্রণয়ন ক'রে দেখা যেতে পারে হয়তো। একটু বোধহয় বেশিই উদ্ভট প্রস্তাব হ'য়ে গেলো।
(রাজীব)

হিমু এর ছবি

শৌচাগারে হাগুমুতু করে একবার পানি ঢাললে জলাধার থেকে বেশ অনেকখানি পানি বেরিয়ে যায়। ব্রিটিশ/পাকিস্তান আমলের শৌচাগারগুলোতে এই জলাধার থাকতো ঘরের টাকরার (সিলিং) কাছাকাছি, ফলে যে পানি প্যান/কমোডে (বাংলায় কী বলা যায়? মলপাত?) নেমে আসতো, উচ্চতাজনিত চাপের কারণে তার বেগ হতো বেশি। হালের শৌচাগারে কমোডের পেছনে সামান্য উঁচুতে এই জলাধার থাকে, ফলে পানিটা বেরোয় তুলনামূলকভাবে কম চাপে। এখন দবিরের অবদান হয়তো একবার পানি ঢাললেই যথাস্থানে চলে যায়, কবিরের জন্যে হয়তো দু'বার ঢালতে হয়। যদি এই হাগুতাড়ানো পানির আধারটাকে আবার ঘরের টাকরা ঘেঁষে বসানো যায়, সেই হারানো দিনের আমেজ হয়তো ফিরে আসবে পানি বাঁচানোর সুবিধাসহ।

একটা প্রামাণ্যচিত্রে দেখেছিলাম, যেসব শহরে পানি আক্রা, সেখানে শৌচাগারের জলাধারের ভেতরে একটা দুধ বা তেলের গ্যালনে পানি ভরে রেখে দিলে জলাধারের ধারণক্ষমতা এক গ্যালন কমে আসে, ফলে প্রতিবার পানি ঢাললে ঐ এক গ্যালন বাঁচে। আমাদের দেশে যদি জলাধারগুলো শুরুতেই ছোট করে বানানো হয়, তাহলে হয়তো অপচয়ও কমবে (তবে কবির রাগারাগি করতে পারে)।

শৌচাগারের জন্যে শুল্ক বাড়ালে সরকার পড়ে যাবে। তারচে যতটুকু জায়গা শানবাঁধানো, সেটার ওপর বর্গমিটার ধরে মাশুল আদায় করা যেতে পারে। বৃষ্টির পানি পাতালে পাঠানোর খরচ সে মাশুল থেকে খানিকটা উঠতে পারে।

মন মাঝি এর ছবি

সেইসাথে এর সাশ্রয়ী প্রযুক্তিও যাতে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিতে পারেন, সেটাও নিশ্চিত করা জরুরি।

বাসাবাড়ির ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি দিয়ে কম খরচে দ্রুত ভূগর্ভস্থ জলস্তর রিচার্জ করা নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বা নিউজ রিপোর্ট দেখেছিলাম একবার টিভিতে। কখন কোন চ্যানেলে এবং কোথায় এখন আর মনে নেই। সম্ভবত বিবিসির রিপোর্ট, ইন্ডিয়ার ঘটনা। তবে ভুলও হতে পারে। তখন খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল।

****************************************

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

উত্তরের দিকে আক্ষরিক অর্থে খাল কেটে বর্ষার পানি (সম্ভবত তিস্তা বেয়ে আসা) ধরে রেখে খরার সময় সেচের একটা আয়োজন আছে। এর কারনে একদা নিস্ফলা উত্তরে আগেরচেয়ে বেশ চাষবাস হচ্ছে শুনেছি। অনুরূপ ব্যবস্থা অন্য অঞ্চলেও নেয়া যায় কি না জানি না। ভাটি অঞ্চলে না হোক, উজানের দিকে আসলেই প্রয়োজন।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

দেখি বইটা যোগাড় করতে পারি কিনা। আগে পড়া নেই। আর যদিও বাহুল্য তবুও ভূজলবাহ এর ব্যাপারটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
(রাজীব)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।