উত্তর আমেরিকায় গ্রেট লেকস অঞ্চলে এক আপাত অখ্যাতনামা শহরতলিতে আমার বাসা। বাসার পেছনে আমার ছোট্ট মেয়ের শখের সব্জি বাগানের পাশে, প্রতি বছর অযত্নে একটা ঝাড় জাতীয় লতা বেড়ে উঠে। বহুবর্ষজীবী (পেরেনিয়াল) বলে শীতেও শেকড় নষ্ট হয় না। ডাঁটা গুলোর সুন্দর লালাভ রং দেখে আমার ওগুলো রহুবার্ব ( বাংলায় রেউচিনি) বলে সন্দেহ হয়, কিন্তু চেখে দেখার সাহস হয় নি।
সম্ভবত অতিমারীর প্রকোপে দীর্ঘ দিন লকডাউনে বাড়িতে বসে তিতিবিরক্ত হয়ে সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, আর একদিন মচাৎ করে একটা ডাঁটা ভেঙে নিয়ে কচাৎ করে চিবিয়ে ফেলি আর মনে মনে সার্স কভিডের গুষ্টি কিলাই। রোজার মাস, কিন্তু মাগরেবের পরে বলে, বোধ হয় গালিটা রেকর্ড হবে না..যথারীতি আমার বউ আমার এ জাতীয় অনুসন্ধান পরবর্তী তাৎক্ষণিক পার্শপ্রতিক্রিয়ার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে, এবং অবশেষে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আমাকে আর ঘাঁটায় না।
রেউচিনির (রুহবার্ব) স্বাদ অনেকটা খাট্টামিঠা হওয়ার কথা। সেরকমই ঠাওর হওয়ায় আমি উৎফুল্ল বোধ করি। সহধর্মিণী দেখেও না দেখার ভান করে। নির্লিপ্ত ভাব ধরে আমাকে বোঝাতে চায় এসব অনুসন্ধান বাদ দিয়ে মেয়েটাকে একটু বাংলা শেখালেই তো পারো? যাই হোক, উত্তর আমেরিকায় আর ইউরোপে রেউচিনিকে পাই প্ল্যান্ট ও বলে, এটা দিয়ে মজার পাই বানানো যায় তাই। আবার শুনেছি তিব্বতে রেউচিনির শেকড় বল্ব দিয়ে জোলাপ(রেচক পদার্থ, ল্যাক্সেটিভ) তৈরির রেওয়াজ আছে! জোলাপ গিলতে হবে শুনলে এমনিতেই তো বাপ বাপ করে কোষ্ঠকাঠিন্য জলবৎ তরলং হওয়া উচিত? আমাদের বাসার কাছেই য়েটস সাইডার মিলে প্রতি সামারে খুব মজার রুহবার্ব স্ট্রবেরি য্যাম বিক্রি হয়। আমি মিলের পাশে চঞ্চল বালিকার মত বয়ে চলা ক্লিনটন রিভারের বাঁধের ওপর থেকে ছিপ ফেলি ট্রাউটের আশায়, বউ আর খুকি মিলে আপেলের সাইডার আর য্যাম জেলি কিনে আনে। মাছ না পেলেও পাউরুটি আর য্যাম দিয়ে মিশিগানের ক্ষণকালীন গ্রীষ্ম উদযাপন করি আর সবাই মিলে পিঠে রোদ মাখি।
আমি দেশ থেকে এসে সরাসরি আমেরিকার সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে (ভূমিস্ঠ) হওয়ার পর মাছ মাংস, তরিতরকারি রেঁধে হাত পাকালেও, এখনও মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরির ব্যাপারে শিক্ষানবিস। মাছ মাংস রেঁধে হাত পাকাতে গিয়ে অবশ্য আগে হাত পুড়াতে হয়েছে। একবার আমার সাউথ কোরিয়ান রুমমেটকে বাঁধাকপি আর গরুর মাংসের ঝোল খাওয়ানোর সাধ হলো কোন এক অলুক্ষণে সন্ধ্যায়। প্রেসার কুকারে ওস্তাদি করতে গিয়ে গরম ঝোল ছিটকে কেলেঙ্কারি অবস্থা। ৯১১ ডেকে হাত ব্যান্ডেজ করে হাতে সিল নিলাম। "হুঁ হুঁ বাবা হাম কেয়া এইসেয়ি অনুভাবি বাওয়ারচি নিকলে?" এই বলে বউয়ের সাথে মাঝে মাঝে পাট নেই।
যাক গে, এই রোজার মাসে রেউচিনি যখন পাওয়াই গেল--ভাবলাম তাহলে বাপ বেটি মিলে ইফতারে মিষ্টি পাই বানাই। ইন্টারনেটে রেসিপি দেখলাম। রুহবার্বের পাতা খাওয়ার উপযোগী না। বেশ বিশাক্ত। খেলে ডায়রিয়ার সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া পালং শাক, রেউচিনি, বিট এসবে অতিমাত্রায় অক্সেলেট থাকে যা প্রতিদিন খেলে কিডনি স্টোন হতে পারে। আল্লাহর দুনিয়ায় পরিমাণ মতো আহার করলে নিয়ামতের অন্ত নাই। কোনকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করলেই বিপদ। প্রয়াত স্টিভ জবস এর খাবারজনিত সীমাবদ্ধ ঘোর (রেসট্রিকটিভ অবসেশন) কে কি এর উদাহরণ ধরা যায়? হয়তো!
পাই বানানো খুব সোজা। আমার মত আনাড়িও, মেয়ের সাহাজ্যে বানিয়ে ফেললাম। সেই পাই আমার বউয়ের কাছে পাশ মার্ক পেলো কি পেলো না সেটা বলে এ-ই পাই সমাচার দীর্ঘায়িত করা সমীচীন হবে না। তবে আমি আর আমার মেয়ে ইফতারিতে তা আয়েশ করে চেখে দেখলে। আর আমার বিশ্বাস স্থানীয় ক্রিকেট আর সকার টিমের সদস্যদের বিলোতে পারলে প্রচুর বাহবা পেতাম। আমরা খেলার পরে সবকিছু খেতে পারি। কিন্তু এই অতিমারী গেঁড়াকলে তো ঈদের পর মাঠে ফিরে যাবার ও জো নেই। খেলাধুলা ও শিকেয় তুলে রাখতে হবে। তাহলে বরং পাঠকদের থেকে রেউচিনির পাইয়ের আগাম অর্ডার নিয়ে বেকারি খোলার পাঁয়তারা করি..
(বিরিঞ্চি বেগ)
মন্তব্য
রুবার্ব পাই আমার বড্ড প্রিয়, ফিনল্যান্ডে খেতাম প্রায়ই, নিজে বানাতে হতো না অবশ্য, সিনিয়র বন্ধুর বাসায় বানাতো। অন্য যে কোন পাইয়ের চেয়ে আলাদা স্বাদের! কালো কফির সাথে সেই মজা! লেখার জন্য ধন্যবাদ
facebook
এ মুল্লুকে আসলে আওয়াজ দিয়েন। আমাদের রেউচিনির পাই মন্দ লাগবে না আশা করি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন