মানুষ পাহাড়ের ওপরে এতদূর এসে ক্লান্ত হয়ে যায়। তখন দেখে একটা স্ফটিকের দোকানে চা বিক্রি হচ্ছে- চায়ে নাকি এরা আবার পুদিনা পাতাও মেশায়। চা খেতে দোকানে ঢুকে দেখে কী যে সুন্দর সুন্দর স্ফটিকের বাসন কোসনে করে এরা চা দিয়ে যায়!
“ইস আমার বউ ভাবতেও পারবেনা,” বলল কেউ, তারপর কিছু গেলাস কিনে নিল। সে রাতে নাকি মেহমান আসবে তার বাড়িতে, এতো সুন্দর বেলোয়ারি বাসন কোসন দেখে ওরা একেবারে হা হয়ে যাবে। আরেকজন বলল, স্ফটিকের গেলাসে চায়ের স্বাদ একেবারে মধু মধু... কারণ এই গেলাসে চায়ের গন্ধটা বের হয়ে যায়না। তৃতীয়জন বলল, জানেন তো মশাই, প্রাচ্যদেশগুলোতে কিন্তু চা খাওয়ার জন্য স্ফটিকের গেলাসের ব্যবহার করে ওরা, এটা ওদের ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে, কারণ ওই- স্ফটিকের জাদুকরী ক্ষমতা!
চটজলদি খবরটা রটল। কোন সেই দোকান! সেখানে নাকি মান্ধাতার আমলের চা ব্যবসার মধ্যেও ওরা নতুন কিছু একটা করছে - সেটা দেখার জন্য একেবারে হিড়িক। পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ব্যাপক লোক আসা শুরু করল। নতুন নতুন দোকান খুলল শহরের কত জায়গায়, তারাও এখন চা দিচ্ছে স্ফটিকে করে, কিন্তু সেগুলোর কোনটাই পাহাড়চূড়ায় না, তাই বেচা বিক্রিও তেমন একটা হয়না। লোকে কষ্ট করে এই পাহাড়ের উপরে ওঠে তারপর চা খায়, আয়েশ করে স্ফটিকের গেলাসে চা খায়।
দোকানে আরো দুজন কর্মচারী রাখতে হলো। দোকানের জন্য এবার স্ফটিকের বাসনকোসনের পাশাপাশি প্রচুর চা আমদানিও শুরু হলো। মানুষ বরাবর নতুনের পিয়াসী। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এবার পাহাড় চূড়ার এই দোকানের কাঙ্গাল হয়ে উঠল!
তারপর এক মাস দুই মাস করে মাসের পর মাস সেভাবেই কেটে গেল।
***
তারপর একদিন। সেদিন ভোর হবার আগেই সান্টিয়াগোর ঘুম ভাঙ্গল। আজ থেকে এগারোমাস নয়দিন আগে আফ্রিকার মাটিতে প্রথম পা রেখেছিল ও
আজকের এই দিনটার জন্য ও আগে থেকেই তৈরি হয়ে আসছে। পাটের মিহি বুননের সাদা আরব্য পোশাকটা কিনে রেখেছিল সেজন্যেই। ওটা গায়ে চাপাল। উটের চামড়ার রিংটা মাথার কাপড়ের ওপর ঠিকঠাক বসিয়ে নিল। নতুন চটিজোড়ায় পা গলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিঃশ্বব্দে নেমে এল সান্টিয়াগো।
শহর তখনো ঘুমিয়ে। একটা স্যান্ডউইচ বানাল। স্ফটিকের গেলাসের গরম গরম চা দিয়ে খেয়ে নিল। তারপর দরজার সামনের রোদ ঝলমল জায়গাটায় হুঁকা নিয়ে বসল। উষ্ণ মরুর সুবাস বয়ে আনা বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে নীরবে হুঁকা টানছে সান্টিয়াগো, ভাবছেনা কিছুই। হুঁকা টানা শেষে পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করে আনল, তারপর আরো কয়েক মুহূর্ত সেখানেই বসে থাকল। ওর হাতে এক তোড়া টাকা। একশ বিশটা ভেড়া কেনার খরচ, বাড়ি ফেরার টিকেট, আর আফ্রিকা থেকে স্পেনে পণ্যসামগ্রী আমদানি করার অনুমতি পত্র তৈরির জন্য খরচ আছে, এই টাকায় সব হবে।
দোকানি বুড়ো এখনও ওঠেনি। আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করল সান্টিয়াগো।
দোকানি ঘুম থেকে উঠলে দুজনে মিলে আরও একটু চা খেতে বসল।
“আমি আজই যাচ্ছি,” বলল সান্টিয়াগো। “সবই হলো, আমার ভেড়া কেনার টাকা, আপনার মক্কা যাবার টাকা, সব।”
বুড়ো দোকানি কিছু বলছেনা।
“আমি চলে যাচ্ছি, আমাকে দোয়া দেবেন না?” জিজ্ঞেস করল ও। “কত সাহায্য করেছেন আপনি আমাকে।”
দোকানি বুড়ো চা বানাচ্ছে, তখনো নিরুত্তর।
তবে শেষ পর্যন্ত কথা ফুটল বুড়োর মুখে। “তোকে নিয়ে আমার গর্ব হয়,” বলল সে। “আমার কি দোকান তুই কি করলি। তবে তোকে তো বলছি, মক্কায় আমি যাবনা। আর মনে মনে নিজেও জানিস যে আবার সেই ভেড়া টেড়াও আর তুই কিনবি না।”
“আপনাকে একথা কে বলল?” চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো।
“মাক্তুব,” বলল বুড়ো দোকানি।
তারপর সান্টিয়াগোকে আশীর্বাদ করল।
***
ঘরে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। সব মিলে তিনটে বোচকা। বেরোবার পথে দেখল ঘরের এক কোনায় ওর সেই পুরনো পুঁটলিটা পড়ে আছে। গাঁট বোঝাই একটা পুঁটলি ছিল ওটা, অথচ এত দিনে সেটার কথা বলতে গেলে মনেই ছিলনা। পথে কাউকে পেলে দিয়ে দেবে ভেবে শুধু জ্যাকেটটা বের করে নিতেই পাথর দুটো মেঝেতে পড়ল। ইউরিম আর থাম্মীম।
চকিতের মতো বুড়ো রাজার কথা মনে পড়ল সান্টিয়াগোর। সেই কবে তাঁর কথা শেষ ভেবেছিল, আর তারপর আজ, ভাবতেই চমকে উঠল ও। স্পেনে যাতে ঠিকঠাক ফিরতে পারে সেজন্য প্রায় একটা বছর ধরে টানা কাজ করেছে ও।
“শোন, স্বপ্ন দেখা কখনো থামিয়ে দিওনা,” বৃদ্ধ রাজা বলেছিলেন। “বিধাতার ইশারাগুলো চিনে নিও, চিনতে শিখো।”
ইউরিম আর থাম্মীম মেঝে থেকে তুলে নিতেই আবার সেই অদ্ভুত অনুভুতিটা হলো, মনে হলো বুড়ো রাজা যেন কাছে পিঠেই কোথাও। এক বছর ধরে গাধা খাটনি খেটেছে সান্টিয়াগো। তারপর একদিন দৈব ইশারায়ই মনে হলো এবার যেন যাবার সময় হয়ে এসেছে।
আগে যা করতাম তাই করব, ভাবল সান্টিয়াগো। হ্যাঁ আবার সেই রাখাল জীবন।
ভেড়ারা হয়তো আমাকে আরবি শেখায়নি। কিন্তু ভেড়ারা তার থেকেও একটা মূল্যবান জিনিস শিখিয়েছে; সেটা হল এই পৃথিবীতে একটা ভাষা আছে যে ভাষা সবাই বোঝে।
দোকানের যাবতীয় আয় উন্নতির কাজের এই পুরো সময়টা ও সেই ভাষাই ব্যবহার করেছে। এ ভাষা এক প্রবল আগ্রহের ভাষা, কার্যসিদ্ধির ভাষা, যে কাজের জন্য ছিল এক বুক দরদ আর কার্যকারণ। এ ভাষা দৃঢ় বিশ্বাস আর হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে চাওয়া কোনো কিছুর পেছনে ছুটবারই অনুষঙ্গ। তাঞ্জিয়েরকে তাই আজ আর অপরিচিত কোনো শহর বলে মনেই হয়না। আজ মনে হয় সে যদি এই তাঞ্জিয়েরে টিকে থেকে করে খেতে পারে, তবে তো সারা পৃথিবীও জয় করতে পারবে।
“যদি কিছু মন থেকে চাও, দেখবে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই তোমার কার্যসিদ্ধির সাহায্যের জন্য উঠে পড়ে ষড়যন্ত্র করছে,” বুড়ো রাজা বলেছিল।
কিন্তু যাত্রাপথের চুরি ছিনতাই, সীমাহীন ধু ধু মরুভূমির ব্যাপারে কিছু বলেনি। যেসব মানুষ জানে তাদের স্বপ্ন কি অথচ সেটা উপলব্ধিই করতে চায়না সে ব্যাপারেও বুড়ো রাজা কিছুই বলেনি। বুড়ো রাজা বলেনি পিরামিড কেবল পাথরের স্তুপ, যে কেউ তার বাড়ির পেছনের উঠোনেই একটা পিরামিড বানিয়ে নিতে পারে। ঠিক তেমনই হয়তো বুড়ো বলতেই ভুলে গেছে, যদি কখনও আগের ভেড়ার পালের চেয়েও বড় পাল কেনার টাকা হয় তখন সাথে সাথেই সেটা কিনে নিও!
সান্টিয়াগো পোঁটলাটা তুলে নিয়ে অন্য জিনিসগুলোর সাথে রাখল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দেখল দোকানি এক জোড়া বিদেশীর সাথে কথা বলছে। আরো দুজন খদ্দের ঢুকে বসল। স্ফটিকের গেলাসে চা খাচ্ছে। অন্যদিন সকালের তুলনায় আজ এ সময়টায় দোকান বেশ সরগরম।
আজ এখানে দাঁড়িয়ে জীবনে প্রথমবারের মত সান্টিয়াগো যেন দেখতে পেল বুড়ো দোকানির চুলগুলো অনেকটা সেই বুড়ো রাজার চুলের মত দেখতে। তাঞ্জিয়েরে ওর প্রথম দিন টাকার বান্ডিল চুরি হয়ে গেল যখন, তখন একটা দানা-পানি কেনার মতো পয়সা ছিলনা, ছিলনা যাওয়ার কোনো জায়গা। সেদিন যে দোকানদার ওকে মিষ্টি খেতে দিয়েছিল সেই লোকটার হাসিটা মনে পড়ল- সেই হাসিও কি একদম সেই বুড়ো রাজার হাসির মতোই ছিলনা!
যেন সেই রাজা এখানেও এসেছিল, রেখে গেছে তার নজির। অথচ এদের কেউই আজ পর্যন্ত সেই বুড়ো রাজাকে দেখেনি। কি জানি বাপু, বুড়ো এখানে আসতেও পারে, সেতো বলেইছিল, যারা নিজেদের জীবনগল্পের গন্তব্য খোঁজার চেষ্টা করে, তাদেরকে সাহায্যের জন্য সে সেখানে গিয়ে হাজির হয়।
দোকানির কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই বেরিয়ে গেল সান্টিয়াগো। সবার সামনে ওখানে দাঁড়িয়ে মোটেও কাঁদার ইচ্ছে নেই। মনটা খুব খারাপ, এই জায়গাটার জন্য। ভালো ভালো কত কিছু শিখেছে এখানে, সব কিছুর জন্য ভীষন খারাপ লাগবে। যদিও জানে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় এখন সে যেতে পারে, যদিও মনে মনে জানে যেখানেই যাক কাজ করে খেতে পারবে তারপরও এই জায়গাটার জন্য ভীষন মন পুড়বে ওর।
“এবার আমার চিরচেনা সেই মাঠ-প্রান্তরেই ফিরব, আমার ভেড়াগুলোর দেখভাল শুরু করব আবার,” নিশ্চিত হয়ে নিজেকে বলল ও। অথচ কেন যেন মনে কিছু একটা বিঁধছে। মনের কোথাও যেন সিদ্ধান্তটা মানতে পারছেনা। যে স্বপ্ন পূরণের জন্য পুরো একটা বছর গাধার মতো কাজ করল, সময়ের সাথে সাথে সেই স্বপ্নটাই কখন যে গুরুত্বহীন হয়ে গেছে নিজেও জানেনা। কে জানে, হয়ত ওটা কখনও ওর স্বপ্নই ছিলনা।
কে জানে ... হয়ত স্ফটিক ব্যবসায়ীর মত হওয়াই ভালোঃ মক্কায় না যেয়ে, কেবল যেতে চাই যেতে চাই ভেবেই এক জীবন পার করে দেয়া।
ভাবছে আর নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে সান্টিয়াগো। অথচ কিছু একটা সমস্যা টের পাচ্ছে। ইউরিম আর থাম্মীম এর কারণেই কি! তখন মেঝে থেকে পাথরদুটো তুলে হাতে নেয়া মাত্রই ওগুলো মনের মধ্যে যেন সেই বুড়ো রাজার মনোবল আর স্পৃহা ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা সরাইখানায় এসে ঢুকল ও। এটা সেই সরাইখানাটা যেখানে প্রথমদিন এসেছিল। কী জানি- কাকতালীয় ভাবেই কিনা আজও এলো। এটা আবার কোনো দৈব ইশারা নয়তো, ভাবল সান্টিয়াগো। আজ সেই চোরের বালাই নেই। সরাইখানার মালিকটা চা দিয়ে গেল।
মন কে স্থির করার চেষ্টা করছে সান্টিয়াগো। কী করবে বুঝতে পারছেনা। স্পেনে ফিরবে? বিশাল এক ভেড়ার পাল কিনবে। চিরচেনা সেই রাখাল জীবনের হাতছানি। ওই জীবনেইতো ওর স্বস্তি!
হঠাৎ কি খেলে গেল মনের মধ্যে! ভাবল, আচ্ছা আমিতো যখন খুশি তখন ফিরে গিয়ে রাখাল হতে পারি, কে নিষেধ করেছে! আমি জানি কিভাবে ভেড়াদের দেখভাল করতে হয়, সে কাজ আমি ভুলিনি, ভুলবওনা কখনও। কিন্তু এখন যদি এখানকার সুযোগটা কাজে না লাগাই, এর পরেরবার হয়ত আমার আর কোনদিনই মিশরের পিরামিড পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হবেনা। বুড়ো সোনার বর্ম পড়া ছিল। আমার অতীত জানত সেই বুড়ো। সে ছিল সত্যি এক রাজা, এক বিচক্ষণ রাজা। সে নিশ্চয়ই এমনি এমনি সাক্ষাৎ দেয়নি আমাকে। আমি গুপ্তধনের খোঁজ পাব বলেছিল; এমনি এমনি নিশ্চয়ই বলেনি। কারণ আছে জন্যেই হয়ত বলেছে, ভাবল সান্টিয়াগো।
আন্দালুসিয়ার শৈলশ্রেনী এখান থেকে মাত্র দু-ঘন্টার পথ, কিন্তু পিরামিড আর সান্টিয়াগোর মাঝে এক বিস্তর মরুর ব্যবধান। উপরন্তু সান্টিয়াগোর মনে হলো, এই অবস্থাকে আরেকভাবেও দেখা যায়ঃ ধরা যাক, আন্দালুসিয়ায় ফিরে ভেড়ার সংখ্যা দ্বিগুণ করাই ওর সেই গুপ্তধন যেটার জন্য এতো কষ্ট করা। তাই যদি হয় তাহলে তো আর দু ঘন্টার পথ পেরোলেই ওর গুপ্তধন। সেই দু-ঘন্টাকে যদি কেউ একটানে একটা বছরও বানিয়ে দেয়, কিচ্ছু যায় আসেনা।
জানি, কেন আমি কেবলই আমার পশুপালের কাছে ফিরতে চাই, ভাবল সে। কারণ, আমি ওদের বুঝতে পারি; ওদেরকে কোনো সমস্যাই মনে হয়না, বরঞ্চ বন্ধু মনে হয়। ওই রাখালের জীবন আমার স্বস্তির জীবন। অন্যদিকে, মরুভূমি যাত্রা অজানা এক ব্যাপার। অজানাকেই ভয় আমার। আমার জানা নেই মরুভূমি কখনো বন্ধু হতে পারে কিনা। অথচ সেই মরুভূমি পাড়ি দিতে পারলে~ গুপ্তধন! খুঁজে না পেলে না পাব, তখন যখন খুশী বাড়ি ফেরা যাবে। এতদিনে আমার টাকা হয়েছে, হাতে সময় আছে। তাহলে কেন নয়? যেতেই হবে আমাকে।
হঠাৎ অবিশ্বাস্য রকমের আনন্দে ভরে গেল মন। ফিরে গিয়ে রাখাল হওয়া যাবে, কিংবা আবারও স্ফটিকের দোকানি হওয়া যাবে যেকোনো সময়। পৃথিবীতে হয়তো আরো অনেক রকম গুপ্তধন আছে, কিন্তু তার বারবার দেখা সেই স্বপ্ন, তারপর এক রহস্যময় রাজার সাথে দেখা হওয়া, এসবতো আর দশ জনের সাথে হয় না।
সরাইখানা থেকে বেরোতে বেরোতে মনে মনে একটা ছক কেটে নিল সান্টিয়াগো। একটা কথা ওর মনে পড়ল। স্ফটিক দোকানির সরবরাহকারীদের মধ্যে একজন ছিল সে নাকি তার স্ফটিকের বাসনকোসনগুলো মরু-কাফেলার সাথে করে মরুভূমী পার হয়েও দূর-দূরান্তে পাঠায়। হাতের মধ্যে ইউরিম আর থাম্মীম শক্ত করে ধরল সান্টিয়াগো; এই পাথর দুটোর জন্যই এবার আবারও গুপ্তধনের খোঁজে বেরোচ্ছে ও।
“কেউ যখন নিজের জীবনগল্পটাকে উপলব্ধির চেষ্টা করে জেনো তখন আমি কাছে পিঠেই থাকি,” বৃদ্ধ রাজা ওকে বলেছিলেন।
আপাতত একটা কাজ করা যায়। স্ফটিক দোকানির সেই সরবরাহকারীর গুদামে যেয়ে একবার লোকটার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। যতটা ভাবছে পিরামিড এখান থেকে সত্যি সত্যি ততটা দূর কিনা সেটা লোকটাকে জিজ্ঞেস করে দেখলেই হয়!
***
বেড়া দেয়া জায়গায় একটা বেঞ্চিতে এক ইংরেজ লোক বসে আছে। পশুপাখীর গন্ধ, ঘাম, ধুলোবালি সব মিলে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা; জায়গাটা অনেকটা গুদামের মতো আবার অনেকটা খোঁয়াড়ও। হায় কপাল, এমন একটা জায়গায় যে আমার গতি হবে কখনও ভাবিনি, রসায়ন পত্রিকাটা এপাতা-ওপাতা উল্টোতে উল্টোতে ভাবল ইংরেজ। দশ-দশটা বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে এসে জায়গা পেলাম এই খোঁয়াড়ে।
কিন্তু ইংরেজ থেমে থাকার পাত্র না, সামনে এগোতে হয়েছে। দৈব ইশারায় বিশ্বাসী লোক সে। তার এতদিনের জীবন, এত বিদ্যা-শিক্ষা, সব কিছুর উদ্দেশ্যই ছিল জগতের এক সত্য ভাষার সন্ধান পাওয়া। কত কি করল; প্রথমে শিখল এস্প্যরান্তো, তারপর পৃথিবীর যাবতীয় ধর্ম নিয়ে লেখাপড়া করল, আর এখন চলছে মধ্যযুগীয় রসায়ন। এখন সে এস্প্যরান্তো বলতে পারে, জগতের সব প্রধান প্রধান ধর্ম সম্পর্কে খুব ভালোই জানে, কিন্তু এখনও তার অ্যালকেমিস্ট টা হওয়া হলোনা। অবশ্য এই সময়ের মধ্যে অনেক মূল্যবান প্রশ্নের জট খুলতে পেরেছে সে। কিন্তু এতসব পড়াশুনা আজ এমন একটা পর্যায়ে এনে তাকে দাঁড় করিয়েছে যে সেখান থেকে সে আর একটুও এগোতে পারছেনা। একবার কি করল; এক অ্যালকেমিস্টের সাথে জোট পাকানোর চেষ্টা করল, আখেরে অবশ্য কোনো লাভ হয়নি। কিভাবে হবে? অ্যালকেমিস্ট গুলো আজব কিসিমের, শুধু নিজেরটা বোঝে। প্রত্যেকবারই ওকে ওরা ফিরিয়ে দিয়েছে, তিল পরিমান সাহায্য করেনি। কে জানে, অ্যালকেমিস্টরা নিজেরাও হয়তো আজও সেই মহাকর্মের- মানে পরশ পাথরের গূঢ় রহস্য ভেদ করে উঠতে পারেনি। শেষে ওদের ভেতরের খবর বাইরের লোক জেনে যায়, জেনে গিয়ে ওদের আগেই পরশ পাথরের রহস্যভেদ করে এই ভয়ে নিজেদের জ্ঞান-গরিমা শুধু নিজেদের মধ্যেই রেখেছে, বাইরের কাউকে কিচ্ছু শেখায়না।
পরশ পাথর খুঁজতে বেরিয়ে বাবার রেখে যাওয়া অগাধ সম্পত্তির অনেকটাই এর মধ্যে খরচ করেছে ইংরেজ। কত যে সময় কাটিয়েছে পৃথিবীর বড় বড় লাইব্রেরীতে, কিনেছে অ্যালকেমি মানে অপরসায়নের দুষ্প্রাপ্য আর মহামূল্যবান সব বই। একবার এক বইয়ে পড়েছিল, অনেক বছর আগে আরবের এক অ্যালকেমিস্ট একবার ইউরোপে এসেছিলেন। বলা হত যে তাঁর বয়স নাকি দুশো বছরেরও বেশি, সে নাকি পরশ পাথর আর জীবনের পরশমণি আবিষ্কার করতে পেরেছে। ইংরেজ লোকটার মনে সেই গল্প কী এক গভীর ছাপ ফেলেছে। কিন্তু তারপরও সেটাকে বানোয়াট গাল গল্পই মনে হতো। তারপর একবার এক বন্ধু মরুভূমির একটা প্রত্নতত্ত্ব অভিযান শেষ সবে ফিরেছে, তার মুখেই আবার শুনল এক আরব এক লোকের কথা। সেই লোকের নাকি অলৌকিক সব ক্ষমতা।
বন্ধু বলল, “আরে, আল-ফাইউম নামের এক মরুদ্যানে তাঁর বাস। লোকে আরও বলে তাঁর বয়স নাকি দুশো’র বেশি। আর সে কী কান্ড বাব্বাহ, লোহা কে একেবারে সোনা বানিয়ে ফেলে সেই বুড়ো!”
এই কথা শোনার পর ইংরেজ আর হুজুগ আটকে রাখতে পারেনি। সব ছেড়ে ছুড়ে, সব প্রতিশ্রুতি বাতিল করে, কেবল মূল্যবান বইগুলো নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিল। আর এখন ধুলোমাখা, দুর্গন্ধওয়ালা এই গুদাম ঘরটায় বসে সেই ঠেলা সামলাচ্ছে।
ধুলোমাখা, ভ্যাঁপসা, পূতিগন্ধময় গুদামের বাইরে তখন সাহারা মরুভূমি পাড়ি দেবার জন্য এক বিশাল কাফেলা দলের প্রস্তুতি চলছিল। যাওয়ার পথে এই কাফেলাই আল-ফাইউম হয়ে যাবে।
ব্যাটা অ্যালকেমিস্ট, তোমাকে আমি ধরেই ছাড়ব, ভাবল ইংরেজ লোকটা। পশু-প্রাণীর গন্ধটা এখন মোটামুটি অনেকটাই সহ্য করা যাচ্ছে।
এমন সময় অল্পবয়স্ক এক আরব পোশাকধারী ছোকরা তল্পি তল্পা সহ গুদামে ঢুকল। ইংরেজ লোকটা কে সালাম দিল।
“কোনদিকে যাচ্ছেন আপনি?” জিজ্ঞেস করল অল্পবয়সী আরব।
“মরুভূমি,” নিজের পড়ায় ফিরতে ফিরতে জানাল ইংরেজ। এই মুহূর্তে সে কোনো খাজুরে আলাপে যেতে চাচ্ছেনা। কত বছরের কত শিক্ষা দীক্ষা, বইপত্র, সেসবে এক পলক করে চোখ বুলানো দরকার। অ্যালকেমিস্ট বুড়োটাকে যদি খুঁজেও পায়, ব্যাটা নিশ্চয়ই ওর কোনোনা কোনো পরীক্ষা নেবে।
ইংরেজ দেখল একদিকে জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে একটা বই বের করে পড়া শুরু করেছে আগন্তুক ছোকরাটা। বইটা স্প্যানিশে লেখা। ভালোই হল, ভাবল ইংরেজ। সে নিজে আরবির থেকে স্প্যানিশটাই ভালো বলে। এ যদি আমাদের সাথে আল-ফাইউম এর দিকে যায় তো ভালোই হয়, হাতে যখন তেমন কিছু করার থাকবেনা ছোকরার সাথে তখন গপসপ করা যাবে।
***
“অদ্ভুত ব্যাপার,” বিড়বিড়িয়ে বলল সান্টিয়াগো। আবার নিয়ে বসেছে সেই বইটা, শুরুতে সেইযে কবর দেয়ার দৃশ্য- সেই বইটা। “দু-বছর ধরে এই বই পড়ার চেষ্টা করছি, প্রথম কয়েকটা পাতার পর আর বেশি দূর এগোতে পারলামনা কোনোদিন।” প্রথমদিন বুড়ো রাজা এসে কথা বলে বাধ সেঁধেছিল। তারপর কই কেউ তো আর পড়ায় বিঘ্ন ঘটায়নি, তবু এই বইয়ে কখনোই মনোযোগ দিতে পারেনি সান্টিয়াগো।
যে সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে তাতে এখনও দোনমনো ভাবটা যাচ্ছেনা। যা করছে ঠিক করছে তো?
তবে তার কাছে মনে হয়ঃ সিদ্ধান্ত নেয়ার থেকেই শুরু হয় ঘটনার সূত্রপাত। কেউ যখন কোনো একটা কিছু মনস্থির করে, তখন এক বিপুল জল-স্রোতের মধ্যে সে একটু একটু করে ডুবে যায়, আর সেই জল-রাশিই তাকে ভাসিয়ে নেয় একখান থেকে আরেকখানে, এক প্রেক্ষাপট থেকে আরেক প্রেক্ষাপটে। শুরুতে যা স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ।
যখন গুপ্তধনের খোঁজে বেরোবো ভেবেছিলাম, তখন কল্পনাও করিনি ঘুরতে ঘুরতে স্ফটিকের দোকানে গিয়ে কাজ জুটাবো, ভাবল সান্টিয়াগো। এখানকার কাফেলাটার সাথে যদি যোগ দেই আবার নতুন এক যাত্রা শুরু হবে। হতে পারে আমার নতুন এই যাত্রা আমারই সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই যাত্রা কোথায় নিয়ে ফেলবে আমাকে সেটা এখনই ভাবার দরকার কী, আপাতত সেটা এক রহস্য হয়েই থাকনা।
কাছেপিঠেই ইংরেজ লোকটা একটা বই পড়ছিল। লোকটা মনে হয় অবন্ধুসুলভ, সান্টিয়াগোকে দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিল মনে হলো। দুজনে একটু বন্ধুভাবাপন্ন হলেও হতে পারত, কিন্তু ইংরেজটাই আলাপ বেশিদূর এগোতে দেয়নি, থামিয়ে দিয়েছে।
সান্টিয়াগোর এমন কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা যাতে দেখে মনে হয় দুজনই একই কাজ করছে। বইটা বন্ধ করল ও। পকেট থেকে ইউরিম আর থাম্মীম বের করে খেলতে শুরু করল।
ইংরেজ লোকটার নজর এড়ালো না সেটা। চোখে পড়তেই ইংরেজ সজোরে চেঁচিয়ে উঠল, “ইউরিম-থাম্মীম!”
শোনা মাত্রই চোখের পলকে সান্টিয়াগো পাথর দুটো পকেটে পুরে ফেলল।
“এগুলো বিক্রির জন্য না,” বলল ও।
“ধুর... ওগুলোর দামও বেশি না,” ইংরেজের জবাব। “খনিজ শিলা পাথরের স্ফটিক থেকে এগুলো বানানো হয়, আর দুনিয়ায় এরকম লাখ লাখ শিলা স্ফটিক আছে। তবে এসব ব্যাপারে যাদের কিছুটা জানাশোনা আছে, তারা দেখেই বুঝতে পারে যে এগুলো ইউরিম আর থাম্মীম। আমি অবশ্য জানতামনা যে এদিকেও এসব পাথর পাওয়া যায়।”
“আমাকে এক রাজা উপহার হিসেবে এই পাথর দুটো দিয়েছিলেন,” বলল সান্টিয়াগো।
ইংরেজ লোকটা কিছু বললনা; পকেটে হাত ঢুকিয়ে অবিকল ওর পাথর দুটোর মত দুটো পাথর বের করে আনল।
“কি বললে, রাজা?”
“হ্যাঁ। আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা যে আমার মত একটা সাধারণ রাখালের সাথে একজন রাজা কথা বলতে পারেন, তাইনা?” বলল সান্টিয়াগো, আলাপ সংক্ষিপ্ত করতে চাচ্ছিল যদিও।
“না না, মোটেও তা না,” বলল ইংরেজ। “মানুষ যখন মানব মুক্তিদায়ী এক মহান রাজার জন্মলগ্নে একটু আশ্রয়ের জন্য এগিয়ে আসেনি, তখন মাঠে ভেড়া চরাচ্ছিল যে রাখালের দল তারাই তো স্বর্গ দূতদের কাছ থেকে খবর পেয়ে সবার আগে ছুটে গিয়েছিল এক পরিত্যক্ত গোয়ালঘরে। সদ্যজাত শিশুকে দেখে রাখালরাই তো চিনতে পেরেছিল মানব মনের রাজাকে। তাই রাজা রাজরা রা যে রাখালদের সাথে কথা বলবে তাতে আমি অবাক হইনা।”
জানে ছোকরা তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবেনা, তারপরও বলল, “বাইবেলে আছে। ঐ বই থেকে আমি ইউরিম-থাম্মীম সম্পর্কেও জেনেছি। ইউরিম-থাম্মীম হলো ঈশ্বর-প্রদত্ত অলৌকিক পাথর। যাজকরা তাঁদের সোনার বক্ষ-বর্মে পড়েন এগুলো।”
এই ধুলোমাখা, ভ্যাঁপসা, গন্ধময় গুদামে এসে পড়ায় এতক্ষণে সান্টিয়াগোর মন হঠাৎ আনন্দে ছলকে উঠল।
“হবে হয়তো এটা কোনো দৈব ইশারা,” আধোস্বরে বলল ইংরেজ।
“আপনাকে দৈব ইশারার কথা কে বলল?” সান্টিয়াগোর আগ্রহ বেড়েই যাচ্ছে।
“আমার তো মনে হয় গোটা জীবনটাই দৈব ইশারায় ভরা,” রসায়নের পত্রিকাটা বন্ধ করতে করতে বলল ইংরেজ। “বিশ্বজনীন একটা ভাষা আছে, জানোতো? সবাই বুঝত এককালে, এখন ভুলে গেছে। আমি সেই ভাষাটাকে খুঁজে বেড়াই। বলতে পারো একরকম সেই সুবাদেই আমার এখানে আসা। সেই ভাষা জানে এমন এক লোকের কথা শুনেছি, তাঁকেই খুঁজতে যাচ্ছি। লোকটা একজন অ্যালকেমিস্ট।”
নেতা গোছের একজন গাট্টাগোট্টা আরব লোক ঢুকল গুদামে। আলোচনায় ছেদ পড়ল।
“এইযে শুনতাছেন, আপনেরা দুইজন, আপনেগো ভাইগ্য ভালা,” বলল লোকটা। “আইজ একটা কাফেলা আল-ফাইউম এর দিকে রওনা হইবো।”
“কিন্তু আমি তো যাব মিশরে,” বলল সান্টিয়াগো।
“আরে আল-ফাইউম তো মিশরেই,” জানাল গুদাম মালিক। “কেমন আরব আপনে কন দেহি, আল-ফাইউম কই হেইডাও জানেননা?”
“বাহ, দেখলে আল-ফাইউমগামী কাফেলা পেয়ে গেলাম! এটা মনে হচ্ছে দৈবযোগ,” লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর বলল ইংরেজ।
“যদি কখনও সুযোগ হয় আমি দৈবযোগ আর কাকতালীয়যোগ এই দুটো শব্দের উপরই পুরো একটা বিশ্বকোষ লিখে ফেলব। বিশ্বজনীন যে ভাষাটার কথা তখন তোমাকে বললাম, সেই ভাষা এই দুটো শব্দ কে কেন্দ্র করেই লেখা।”
ইংরেজ বলল, ইউরিম-থাম্মীম হাতে এইযে তার সাথে সান্টিয়াগোর দেখা হল এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা না। এটা নির্ঘাৎ দৈবযোগ। জিজ্ঞেস করল, ও ও কি সেই রসায়নবিদের খোঁজেই যাচ্ছে কিনা।
“নাহ। আসলে, আমি যাচ্ছি গুপ্তধনের খোঁজে,” একটু ইতস্তত করে বলল সান্টিয়াগো। বলেই সাথে সাথে আফসোস হলো, ইস, কেন বলে দিল কথাটা। অবশ্য ইংরেজটাকে দেখে সে ব্যাপারে ভাবলেশহীনই মনে হল।
“একভাবে না একভাবে বলতে পারো আমিও গুপ্তধনই খুঁজছি,” বলল ইংরেজ।
নেতা গোছের গাট্টাগোট্টা আরব লোকটা এসে ওদের আবার ডেকে গেল। বাইরে বেরোতে বলছে।
“আপনি বললেন আপনি একজন অ্যালকেমিস্টের খোঁজে বেরিয়েছেন। এই অ্যালকেমি টা কি জিনিস?” বেরোবার প্রস্তুতি নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো।
***
“উপস্থিত জনতা, এই কাফেলার সর্দার আমি,” দাড়ি ওয়ালা, কালো চোখের এক লোক নিজের পরিচয় দিল। “আপনাদের এই যাত্রাপথে...” টেনে টেনে উচ্চস্বরে বলতে লাগল সর্দার লোকটা। “আপনাদের প্রত্যেকের জীবন-মরণ আমার উপর নির্ভর করছে। মনে রাখবেন, এই যাত্রা যে সে যাত্রা নয়। এই যাত্রা মরুযাত্রা। আপনাদের মনে রাখতে হবে, মরুভূমি একটা রিনিক ঝিনিক চপলা রুপসী নারীর মতই চঞ্চল। আর এই প্রকারের চপলা নারী পুরুষের মাথা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।”
প্রায় দুশোর মত লোক জড়ো হয়েছে, উট, ঘোড়া, খচ্চর, পাখ-পাখালী সব সহ চারশোর মত পশু-পাখী হবে। নারী, শিশু, পুরুষ মিলে জায়গাটা একেবারে গমগম করছে। পুরুষদের কারো কোমরের খাপ থেকে তলোয়ার ঝুলছে, কারো কাঁধে রাইফেল।
আর ইংরেজ লোকটা নিয়েছে বেশ কয়েক বাক্স ভর্তি বই। সবার কথাবার্তা চেঁচামেচি মিলে হড়বড় শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা, তার উপর সর্দার লোকটা সবার কানে কথা ঢুকানোর জন্য বারবার একই কথা বকেই যাচ্ছে বকেই যাচ্ছে।
“উপস্থিত জনতা, এখানে আপনারা অনেক ধরনের মানুষ। একেক জনের খোদা একেকটা। আমি মহান আল্লাহ পাকের বান্দা। আমার আল্লাহ পাকের কসম, এই মরুযাত্রা জয়ে আমার পক্ষে যা করা সম্ভব তার সব কিছুই আমি করব। তবে আমি আপনাদের নিকট থেকে একটা জিনিসই চাই। সেটা হল, এখন আপনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ খোদার নামে শপথ নিয়ে বলবেন যে যত যাইহোক আপনারা আমার আদেশ-নিষেধ মেনে চলবেন। ভ্রমণে সর্দারের কথাই শেষ কথা। সর্দারের সঙ্গে আলোচনা, পরামর্শ এবং সর্দারের প্রতি অনুবর্তী থাকা একান্ত আবশ্যক। মনে রাখবেন, মরুভ্রমণে সর্দারের কথার অবাধ্যতা মানেই এই দীর্ঘ বিপদ সঙ্কুল পথে অপঘাতে মৃত্যু।”
ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল। সবাই নিজ নিজ খোদার নামে বিড়বিড় করে শপথ নিল। সান্টিয়াগো যীশুর নামে প্রতিজ্ঞা করল। ইংরেজ নির্বিকার। সবার এতো সময় লাগছে কেন কে জানে। এদেরকে একটা শপথ নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সবাই যে যার মত দোয়া দরূদ পড়া শুরু করল। সেই গুঞ্জন থামল বেশ দেরিতে।
শিঙ্গায় টানা একটা সুরেলা ধ্বনি বেজে উঠতেই সবাই উঠে পড়ল। এর মধ্যে সান্টিয়াগো আর ইংরেজ দুজনই উট কিনে নিয়েছে। যে যার মত কায়দা কসরত করে ওরা উটের পিঠে সওয়ার হলো। ইংরেজের উটটার জন্য সান্টিয়াগোর মায়াই হচ্ছে। ইংরেজের বইয়ের যত বাক্স-প্যাটরা, উট বেচারার একেবারে বোঁচকা বোঝাই অবস্থা।
“আসলে কাকতালীয় ব্যাপার বলতে কিছু নেই বুঝলে,” গুদাম ঘরের আলোচনাটা যেখানে থেমে গেছিল সেখান থেকেই আবার শুরু করল ইংরেজ। “আমি এক বন্ধুর মুখে একটা গল্প শুনে আজ এখানে এসে উপস্থিত। আমার সেই বন্ধু এক আরব লোকের কথা শুনেছে, সে নাকি...”
কাফেলা চলতে শুরু করল, এ অবস্থায় লোকটা কি বলছে শোনার কোনো উপায়ই নেই। সান্টিয়াগো অবশ্য জানত লোকটা কি বলতে পারেঃ একটা ঘটনা আরেক ঘটনার সাথে রহস্যময় এক বিনি সুতোয় গাঁথা। সেই একই সুতো ওকে রাখাল বানিয়েছিল, রাতের পর রাত একই স্বপ্ন দেখিয়েছিল, আফ্রিকার কাছে এক শহরে এনে ফেলেছে, তারপর সেই রাজার সাথে দেখা, টাকা পয়সা লুট হয়ে নিঃস্ব হওয়া, তাতে করে এক স্ফটিক দোকানির সাথে দেখা হওয়া, আর তারপর...
নিজের গন্তব্য মানুষ যতই উপলব্ধি করতে পারে ততই সেই পথে আগাতে থাকে, আর ততোই সেটা তার কাছে একটা প্রকৃত কার্যকারণ হয়ে ওঠে, ভাবল সান্টিয়াগো।
কাফেলাটা পূব দিকে এগোচ্ছে। সকাল বেলায় চলতে থাকে, সূর্যের প্রখর তাপ শুরু হলে যাত্রা-বিরতি নেয়, তারপর বেলা পড়ে এলে আবার শুরু হয় চলা। ইংরেজ অধিকাংশ সময় বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। সান্টিয়াগোর সাথে ইংরেজের কথা হয় খুব সামান্যই।
শুনশান নীরবতার মধ্যে সান্টিয়াগো পশু-পাখি আর ওদের কাফেলা দলের এগিয়ে যাওয়া দেখে। প্রথম যেদিন যাত্রা শুরু করেছিল সেদিন থেকে এখনকার সময়টা অনেক আলাদাঃ প্রথমটায় সবার অবস্থা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল; মানুষের চিৎকার-চেচামেচি, শিশুদের কান্না, প্রাণীগুলোর হাঁকডাক মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত গাইড আর কারবারি লোকদের ভীত-সন্ত্রস্ত হুকুম-নিষেধের সাথে।
কিন্তু এখন, মরুভূমিতে শুধু এক আদি-অন্তহীন বাতাসের শব্দ শুনতে পায় সান্টিয়াগো। আর সেইসাথে পশুদের খুরের শব্দ। আর কোনো শব্দ নেই। এমনকি গাইড লোকগুলোও নিজেদের মধ্যে খুবই টুকটাক কথা বলে।
“আমি এই বিস্তীর্ন বালুভূমি বহুবার পাড় দিছি,” এক রাতে এক উট চালক বলল। “এ্যারপরেও, এই মরুভূমি আমার কাছে বিরাট ব্যাপার। আর আকাশের সীমা এত এত দূরে যে কী বলব, একেবারে চক্ষের বাইরের ব্যাপার স্যাপার। এই বিরাট মরূভূমি আর আকাশের কাছে মানুষ অতি ক্ষুদ্র জীব, মানুষের চুপ থাকাই ভালা।”
অতীতে কখনও কোনোদিন মরুভুমির বুকে পা না রাখলেও একথার সহজাত মর্ম বোঝে সান্টিয়াগো। সমুদ্রের ব্যাপ্তি দেখেছে, আগুনের অসীম বিপুলতা দেখেছে, সমুদ্র আর আগুনের আধি-ভৌতিক শক্তির সামনে ও নিজেও স্তব্ধ হয়ে গেছে বহুবার।
ভেড়াদের কাছ থেকে অনেক শিখেছি, স্ফটিক থেকে কত কিছু শিখলাম, মরুভূমির কাছ থেকেও তো শিখতে পারি। সান্টিয়াগো দু চোখ মেলে দেখছে এই বড্ড প্রাচীন, প্রসারিত আর বিচক্ষণ মরু অঞ্চল।
বিরতিহীন এই মরু-বাতাস। একদিনের কথা মনে হলো ওর, যেদিন তারিফার দূর্গের একেবারে চুড়ায় বসে ছিল আর এই একই উষর মরুর বাতাস এসে লাগছিল ওর চোখে-মুখে। এই বাতাসের স্পর্শ কোনো এক অজানা কারণে ওকে ভেড়ার গায়ের উলের কথা মনে করিয়ে দিল। ওর ভেড়াগুলো নিশ্চয়ই এখন খাবার-পানির জন্য আন্দালুসিয়ার উন্মুক্ত চারণভূমি চষে বেড়াচ্ছে, সবসময়তো তাইই করেছে।
“ওরা এখন আর আমার না,” কোনো অতীত-কাতরতা ছাড়াই স্বগোতক্তি করল সান্টিয়াগো। “আর এতোদিনে হয়ত ওরা ওদের নতুন রাখালের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এর মধ্যে আমাকে ভুলেও গেছে। সেই ভালো। ভেড়ার মত পশুরা একখান থেকে আরেকখানে চরে বেড়াতে জানে বলেই ওরা মানিয়ে নিতে জানে।”
আর সেই যে বনিকের মেয়ে... সেই মেয়েটার কথাও ভাবল সান্টিয়াগো। ও নিশ্চিত এতদিনে সে বিবাহিত। হয়ত বিয়ে করেছে কোনো সফল রুটির দোকানিকে, অথবা কে জানে, হয়ত রোমাঞ্চকর, মজার মজার সব গল্প শোনানো অন্য কোনো এক শিক্ষিত রাখালকে বিয়ে করেছে। যত যাইহোক, ওই তো আর সেই বণিক কন্যার জীবনের একমাত্র পুরুষ ছিলনা; ওর সাথে ক্ষণিকের আলাপ হয়েছিল মাত্র।
যাইহোক, উট চালকের কথাটার মর্ম নিজের জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছে আপাতত সেটা নিয়েই সান্টিয়াগো বেশ পুলকিতঃ হয়ত সে নিজেও বিশ্বজনীন ভাষাটা শিখতে আরম্ভ করেছে এর মধ্যেই। এই ভাষা কি সবার অতীত-বর্তমানের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করে দেয়! মা সবসময় একটা কথা বলত, “মন বলছে মন বলছে”। সান্টিয়াগো সবে মাত্র বুঝতে শুরু করেছে - মন বলছে মন বলছে ব্যাপারটা মনে হয় তখনই হয় যখন, বিশ্বজনীন জীবন স্রোতে মানবাত্মার এক অকস্মাৎ অবগাহন ঘটে। সেই বিশ্বজনীন জীবন স্রোতে আমাদের ইতিহাসগুলো কোথাও না কোথাও একই সুতোয় গাঁথা, আমরা চাইলেই সেটা জেনে নিতে পারি, কারণ সেটা সেখানেই লেখা রয়ে গেছে।
“মাক্তুব,” বিড়বিড় করল সান্টিয়াগো, স্ফটিকের দোকানি বুড়োর বলা কথাটা মনে পড়ল।
দিগন্ত-বিস্তীর্ণ মরুভূমির কিছু জায়গা বালি আর বালি, আবার কিছু কিছু এলাকা পাথুরে। কাফেলার যাত্রা পথে মাঝে মাঝে শৈল-প্রাচীর পড়ছে, সেটাকে পাশ কাটানোর জন্য কাফেলাকে আরেক দিক দিয়ে ঘুরে যেতে হচ্ছে। আর বিশাল পাথুরে অঞ্চল আসলে আরও সমস্যা, তখন বড়সড় ঘুরপথ নিতে হয়। তারওপর, বালির প্রকার ভেদেও যাত্রার গতি নির্ভর করছে। মিহি বালি হলে মহা ঝামেলা, প্রানীগুলোর খুর আটকে আর এগোবার উপায় থাকেনা, তখন আবার মোটা বালির খোঁজ। অন্য রাস্তা দেখতে হয়। কোথাও আবার শুকিয়ে যাওয়া হ্রদের লবনে ঢাকা মরু-বালিয়াড়ি। সেটার ওপর দিয়ে হাঁটতে নিলে পশুগুলোর গোয়ার্তুমি শুরু হয়। তখন বাধ্য হয়ে উটচালকরা নেমে গিয়ে উটের পিঠ থেকে মালপত্র যতটা স্বম্ভব কমিয়ে নিজেরাই বয়ে নিয়ে যায়। পথের কষ্টকর অংশটা শেষ হলে পরে আবার মালের বোঝা উটের পিঠে চাপিয়ে দেয়া হয়। গাইড লোকগুলোর কেউ যদি অসুস্থ হয় বা তাদের কারো যদি মৃত্যু হয়, উটচালকরা তখন লোকবলের মধ্যে থেকে নতুন কাউকে বেছে নিয়ে গাইডের দ্বায়িত্ব দেয়।
এই সবকিছু করার উদ্দেশ্য একটাইঃ যত ঘুর পথই নিতে হোক, যাত্রা পথে যত পরিবর্তন-পরিমার্জন-সংশোধনই আসুক, কাফেলাকে কম্পাসের একটা নির্দিষ্ট দিক বরাবর চলতে হবে। পথ চেনার জন্য একটা তারাকে চিহ্ন করে মরুদ্যানটার অবস্থান ঠিক করে সর্দার। চলতি পথের বাধা কাটিয়ে ওঠা মাত্রই সেই তারাটা দেখেই কাফেলার চলার দিক ঠিক হয়। আর সকালের আকাশেও যখন সেই তারাটাকে জ্বলজ্বল করতে দেখা যেত, সর্দার বুঝে নিত দল ঠিক পথে এগোচ্ছে। এ পথে গেলেই দেখা মিলবে পানি, পাম গাছ, আশ্রয় আর ওদেরই মত আরও মানুষ।
এত সব কিছু্র কোনোটাই ইংরেজ লোকটার চোখে ধরা পড়েনা; বলতে গেলে পুরো পথই সে বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে পড়ে থাকে।
সান্টিয়াগোর নিজেরও একটা বই আছে, যাত্রার শুরুর দিকের কয়েকটা দিন ও চেষ্টাও করেছিল বইটা পড়তে পড়তে যাবার। কিন্তু পরে দেখল, কাফেলার চলা দেখতে দেখতে আর মরু-বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে যাওয়া কি যে এক চমৎকার ব্যাপার! যবে থেকে ওর উটের মতি-গতি ভালোমত বুঝতে শুরু করেছে, আর ওটার সাথে একটা সুসম্পর্ক তৈরি করে নিতে পেরেছে, তখনই বইটা ফেলে দিয়েছে। অবশ্য সান্টিয়াগোর মনে একটা ভ্রান্ত-বিশ্বাস জন্মেছিল; যতবার ও বইটা খুলবে, প্রত্যেকবারই নতুন কিছুনা কিছু শিখতে পারবে। কিন্তু এই যাত্রায় বইটা কে অনর্থক একটা বোঝা মনে হয়েছিল তাই ফেলে দিয়েছে।
সান্টিয়াগোর উটচালককে ওর পাশে পাশে চলতে হয়। লোকটার সাথে মোটামুটি বন্ধুত্ব হয়ে গেল। রাতে আগুন ঘিরে আলাপ করতে বসলে, লোকটার মুখে মরুভূমির নানা গল্প শুনতে শুনতে ওর নিজের রাখাল জীবনের কত গল্পইতো মনে পড়ে।
একদিন কথা প্রসঙ্গে চালক লোকটা তার নিজের জীবনের কথা বলা শুরু করল।
“জানেন ভাইসাব, আমি এল-কায়রামের কাছাকাছি থাকতাম,' লোকটা বলল। “বাগান ছিল, পোলাপান ছিল, এমন একটা নিশ্চিত জীবন ছিল যে আমার মনে হইত যতদিন আছি এভাবেই থাকব। পরিবার পরিজন নিয়ে এই রকম আরামেই থাকব। একবার সবের থেকে সেরা ফসল ঘরে তুললাম। সেই খুশীতে পরিবার নিয়া গেলাম মক্কায়। মক্কা ঘুরে আসলাম। ওই একটা কাজই বাকি ছিল, সেইটাও শেষ। এবার শান্তিতে চোখ বুঝতে পারব এর থেকে বড় আনন্দ কি আর আছে!
“কিন্তু সময় বড় অবাক কইরা দেয়। একদিন পায়ের নিচের মাটি সইরা গেল। সেইবার নীল এর দূই-তীরে বান ডাকল, বিরাট বান। কখনও ভাবিনাই আমার কপালেও এমন দুর্ভোগ লেখা আছে। ভাবতাম অন্য মানুষের বেলায়ই এইসব হয়, আমার বেলায় কখনও হইতনা। আশে-পাশের লোক ভয় পাইতেছিল এই বন্যায় তাদের জলপাই গাছ গুলি সব মরবে, তখন আমার বউ ভয় পাইতেছিল এই বন্যায় আমাদের পোলাপান গুলি সব মরবে। বউ বাচ্চা নিয়া পথের ফকির হওয়ার মতো অবস্থা।
“জমির অবস্থা আর কী বলব, আবাদ করার কোনো উপায় নাই। খাওয়া-পরার উপায় হবে! হায় রে শান্তির এক জীবন, সব শেষ। উটের চালকের কাজ নিলাম। কিন্তু, বুঝলেন ভাইসাব, জীবনে সেই অবস্থায় পরছিলাম জন্যই আজকে বুঝি আল্লাহ পাকের বাণী: জীবনের জন্য মানুষের কোনটা প্রয়োজন আর জীবনে মানুষ কোনটা চায়, এই দুই জিনিস যদি কেউ করে নিতে পারে, তাহলে তার আর বিপদের ভয় নাই।
“মানুষের অনেক ভয়। হারানোর ভয়- ধন সম্পদ, জীবন, জমি জমা। কিন্তু ভাইসাব, এই ভয় তুরীর মত উইড়া যায় যখন বুঝি আমাদের জীবনের কেচ্ছা কাহিনী আর জগত-সংসারের ইতিহাস ওই একই হাতে ল্যাখা।”
কখনো কখনো ওদের কাফেলা দলের সাথে অন্য কাফেলার দেখা হয়ে যায়। একদলের কি লাগবে না লাগবে সব সময়ই সেটা আরেকদলের কাছে পাওয়া যায়- আসলেই, সবই যেন একজনের হাত দিয়েই লেখা।
আগুন ঘিরে বসে গল্প করার সময় উট চালকরা ধূলিঝড়, আর মরুভূমির কত খবরাখবর দেয়।
তারপর হঠাৎ হঠাৎ মরুর বুকে ধুলির লহর উড়িয়ে আসে রহস্যময় সেই মানুষগুলো; মাথা ঢাকা লোকগুলো হুট করে কোত্থেকে যে উদয় হয়; ওরা নাকি বেদুইন, ঈগলের মত চোখ ওদের। কাফেলার চলার রাস্তায় কড়া নজরদারি করে বেদুইনরা। চোর-ডাকাত, মরুসমাজের অসভ্য কোনো নিষ্ঠুর গোষ্ঠী পথের মাঝে পরতে পারে কিনা সেসব নিয়ে সতর্ক করতে আসে বেদুইনরা। কালো কাপড়ে ঢাকা ওদের শরীর, মাথা, শুধু চোখ দুটো দেখা যায়। হুট করে যেভাবে আসে সেভাবেই কিভাবে যেন আবার মিলিয়ে যায় মরুর বুকে ধুলির লহর তুলে।
একদিন রাত্রে, ইংরেজ লোকটা আর সান্টিয়াগো আগুনের পাশে বসে তাপ পোহাচ্ছে তখন এক উট চালক এসে বসল। “শুনছেন নাকি কিছু, গুজব রটছে, মরুভূমির কিছু জাতিগোত্রের মইধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হইতে পারে,” বলল সে।
তিনজনই চুপচাপ আগুন তাপাচ্ছে। কেউ কিছু বলছেনা তবুও ভয়ের একটা হাওয়া আঁচ করতে পারছে সান্টিয়াগো। আরেকবার শব্দহীণ একটা ভাষার অস্তিত্ব টের পেল ও... সেই বিশ্বজনীন ভাষাটা।
ইংরেজ জিজ্ঞেস করল গোষ্ঠীদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হলে তাদেরও বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে কিনা।
“একবার মরুর পথ মাড়াইতে নামলে, আর ফেরার উপায় থাকেনা বুঝলেন,” বলল চালক লোকটা। “আর যখন ফেরারই উপায় নাই, তখন কিভাবে সহী-সালামতে সামনে আগানো যায় সেই চিন্তা করেন। বাকিটা আল্লাহ পাকের হাতে। বিপদ হইলে হবে, সেইটাও আল্লাহ পাকের হাতে।”
তারপর শেষে সে সেই রহস্যময় শব্দটা বললঃ “মাক্তুব।”
“কাফেলায় কি ঘটছে না ঘটছে আপনার আরেকটু খেয়াল করা দরকার,” উটচালক লোকটা চলে যাওয়ার পর ইংরেজকে বলল সান্টিয়াগো। “কত দিকে যে রাস্তা অদল বদল করলাম আমরা, তবু গন্তব্যের দিকে কিন্তু আমরা একদম ঠিকঠাক আগাচ্ছি।”
“আর তোমারও জগৎ-জীবন সম্পর্কে আরেকটু পড়াশুনা করা দরকার,” জবাবে বলল ইংরেজ। “সেদিক থেকে বলতে গেলে বইপত্তরের বিকল্প কোনো নেই ভায়া, বই হল তোমার কাফেলার মত।”
মরুগোষ্ঠীর দাঙ্গা হাঙ্গামার গুজবে মানুষ আর জীব-জন্তুর বিরাট সমাগম নিয়ে কাফেলা এখন জোরেশোরে চলা শুরু করেছে। আগে দিনেরবেলায় সবাই বরাবরই চুপচাপ থাকত, কিন্তু এখন রাতগুলোও কেমন সুনসান হয়ে গেছে। রাত্রে আগে আগুন ঘিরে বসে যাত্রীরা সুখ-দুখের গল্প করত, আর এখন সব কেমন যেন শান্ত। তারপর একদিন, কাফেলার সর্দার সিদ্ধান্ত দিল, যাতে ডাকাতদের দৃষ্টি না পড়ে সেজন্য রাতে আর আগুন জ্বালানো যাবেনা।
ইদানিং রাতে যাত্রীরা সব পশু-পাখীগুলো জড়ো করে একটা গোল চক্রের মত তৈরি করে, তারপর সেটার মাঝখানে ঘুমায়, মরুভূমির রাতের ঠান্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা আরকি। সর্দার অবশ্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দলের কিনারার দিকে কিছু পাহারা বসিয়ে রাখছে।
একরাতে ইংরেজের ঘুম আসছিলনা। সান্টিয়াগোকে ডেকে তুলল। দুজনে মিলে ক্যাম্পের চারপাশের বালুর ঢিবিগুলোর আশেপাশে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। নিস্তব্ধ মরু চরাচর, আকাশে রুপার থালার মত মস্ত এক চাঁদ। স্মৃতি জাগানিয়া বিস্তীর্ণ বিশাল প্রকৃতির ব্যাপকতার কাছাকাছি এলে মানুষের নিজস্ব অনুভূতির জাল খুলে যেতে থাকে। টুকটাক কথা থেকেই কি মনে করে সান্টিয়াগো ইংরেজকে ওর জীবনের গল্প বলা শুরু করল।
স্ফটিকের দোকানে ওর কাজ শুরু করার পর দোকানের অত আয়-উন্নতির কথা শুনেতো ইংরেজ যারপরনাই অবাক।
“আসলে কি জানো, এটা হচ্ছে একটা মূলনীতিটা যেটা সব কিছুকে চালিয়ে নিচ্ছে,” বলল সে। “অ্যালকেমিতে এটাকে বলে পৃথিবীর অন্তরাত্মা। কেউ যখন কায়মনোবাক্যে কিছু চায়, সে তখন পৃথিবীর অন্তরাত্মার সবচেয়ে কাছাকাছি চলে যায়। এ এমনই এক তুমুল টান।”
ইংরেজ আরও বলল, এটা যে শুধু মানুষের জন্য তুলে রাখা আশীর্বাদ তা কিন্তু না, চরাচরের সব কিছুরই একটা অন্তরাত্মা থাকে, তা সেটা খনিজ পদার্থ হোক, শাকসবজি, পশু-পাখি হোক, আর তুচ্ছ একটা চিন্তাই হোক। সবকিছুই ক্রমাগত বদলাচ্ছে, কারণ পৃথিবী একটা জীবন্ত জিনিস... পৃথিবীর হৃদয় আছে। আমরা সবাই সেই হৃদয়েরই অংশ বিশেষ, তাই সেটা যে আমাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে সে কথা আমরা কালেভাদ্রে টের পাই। এই দেখনা, তুমি বললে তুমি স্ফটিকের দোকানে কাজ করেছ। তাহলে এটা নিশ্চয়ই বুঝেছ যে তোমার আজকের এই সফলতার পেছনে সেই স্ফটিকের গেলাস গুলোরও অবদান আছে।”
চাঁদ আর ধুসর বালুভূমির দিকে দিকে তাকাতে তাকাতে খনিকের জন্য হলেও সেকথা সান্টিয়াগোর ভাবনায় উঁকি দিল। বলল, “আমরা যত মরুভূমি পাড়ি দিচ্ছি ততই কাফেলাকে নতুন ভাবে দেখছি। কাফেলা আর মরুভূমি; দুটোই যেন একই ভাষায় কথা বলে, একারণেই হয়ত মরুভূমিও তার বুকে কাফেলাকে চিরন্তন বয়ে যেতে দেয়। কাফেলার প্রতি পদে পদেই যেন মরুর ছড়ি ঘুরানি, বুঝি দেখছে কতটা দোসর হয়ে, কতটা একাত্ম হয়ে সময় বুঝে চলছে কাফেলা। মরুর যদি সন্তুষ্টি মেলে, তবেই আমরা পৌঁছে যাবো মরুদ্যানে।”
“সেটাই," ইংরেজ সায় দিল। "শুধু বুকে সাহস থাকলেই হয়না, ভাষাটাও বুঝতে হয়। আমাদের কেউ একজন যদি ভাষার এই তাৎপর্যটা না বুঝেই শুধু সাহসকে সাথী করেই কাফেলায় এসে জুটতাম তবে এই যাত্রাপথ আরো বেশি কঠিন হয়ে উঠত।”
চাঁদের দিকে তাকিয়ে ওরা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
“সেখানেইতো দৈব ইশারার জাদু,” বলল সান্টিয়াগো। “কাফেলাকে যে লোকগুলো পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় আমি দেখেছি কিভাবে ওরা মরুর বুকে চিহ্ন দেখে দেখে এগোয়, আর কি আশ্চর্য মনে হয় জানেন, কাফেলা আর মরুভূমির যেন কথা বলে। ওদের কথা হয় অন্তরে অন্তরে!”
“তো, তুমি বলছ কাফেলার দিকে আমার আরেকটু নজর দেয়া দরকার? ঠিকই বলেছ, আমি বরঞ্চ কাফেলায় কি ঘটছে না ঘটছে সেদিকে একটু মনোযোগ দেই,” বলল ইংরেজ।
“আর আমি বরঞ্চ আপনার বই-পত্তর গুলো একটু নাড়াচড়া করে দেখি,” সান্টিয়াগোর জবাব।
***
অদ্ভুত অদ্ভুত সব বই। কোনোটার বিষয় পারদ, কোনোটার লবণ, কোনোটা আবার ড্র্যাগনের ওপর লেখা বই। কোনো কোনো বই রাজা-রাজরাদের নিয়ে লেখা, সান্টিয়াগোর মাথায় সেসব কিছুই ঢোকেনা। তবে সব বইয়ে প্রায় একটা ব্যাপারই বারবার ঘুরে ফিরে আসে; কোনো একটা কিছু থেকে এই সব কিছুর আবির্ভাব, এই ব্যাপারটা।
একটা বই পড়ে সান্টিয়াগো জানল, অ্যালকেমি সাহিত্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ন বিষয়বস্তু নাকি ধারণ করে আছে কেবল কয়েকটা লাইন, আর সেই লাইন কটা খোদাই করা আছে কোনো এক পান্নার ওপর।
“পান্নার ওপর না, পান্না-ফলকের ওপর,” বুক ফুলিয়ে বলল ইংরেজ, একটু জ্ঞান গর্ভ কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
“কটা লাইনেই যদি আলকেমির সব রহস্য খোদাই করা থাকে, তাহলে অ্যালকেমির এতোসব বইয়ের কি দরকার ছিল?” জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো।
“দরকার আছে, দরকার আছে; যাতে আমরা সেই লাইন কয়টি বোঝার মত বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে পারি,” ইংরেজের ভাবলেশহীন উত্তর।
সব বইয়ের মধ্যে একটা বই সান্টিয়াগোর বেশি মনে ধরল। খ্যাতিমান সব অ্যালকেমিস্টদের গল্পে ঠাঁসা বইটা। কত লোক যে গবেষণাগারে ধাতু পরিশোধন করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছে; তারা মনে করত বহু বছর ধরে কোনো একটা ধাতুকে যদি তাপানো হয় তাহলে সেটা এক সময় ওর যাবতীয় সব মৌলিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। তবে শুধু একটা শক্তি অবশিষ্ট থাকে, সেটা হল পৃথিবীর অন্তরাত্মা। সেটা দিয়ে তারা পৃথিবীর বুকের সব কিছু বুঝে নিয়েছিল, কারণ পৃথিবীর অন্তরাত্মা হলো সেই ভাষা যার মাধ্যমেই সবকিছুই যোগাযোগ। সেই অ্যালকেমিস্টরা তাদের এই আবিষ্কারের নাম দিয়েছিল সময়ের শ্রেষ্ঠ কাজ। সেই কাজের আবার দুটো অংশ; অর্ধেক অংশ তরল আর অর্ধেক কঠিন।
“সেই ভাষাটা বোঝার জন্য মানুষ আর দৈব ইশারা এই দুটো জিনিস একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই তো হয়, না?” জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো।
“তোমার একটা বাতিক আছে জানো? সব কিছুকেই তোমার সোজা সাপ্টা মনে হয়,” একরকম বিরক্ত হয়েই জবাব দিল ইংরেজ। “অ্যালকেমির মতো একটা গুরু গম্ভীর বিষয়কে তুমি সহজ ভাবে নিচ্ছ। অ্যালকেমির প্রতিটা স্তর গুরুরা ঠিক যেভাবে মেনে চলেছিলেন সেভাবেই মেনে চলতে হবে।”
সান্টিয়াগো সেই বইটা পড়ে যা বুঝল তা হলো, ওই যে সময়ের শ্রেষ্ঠ কাজ যেটাকে বলত তারা সে কাজের তরল অংশটা হলো ‘জীবনের পরশমণি’, জীবনের অমরত্ব সুধাও বলা হয়, সব অসুখ বিসুখ থেকে রোগমুক্তি দিতে পারে সেটা; আর ওই কারনেই অ্যালকেমিস্ট লোকগুলো কোনও দিন বুড়িয়ে যেতনা। আর কঠিন অংশ টা হলো ‘পরশ পাথর’।
“পরশ পাথর খুঁজে পাওয়া এত সহজ কর্ম নয়,” বলল ইংরেজ। “ধাতু শোধনের এক আগুন পর্যবেক্ষন করেই অ্যালকেমিস্টরা বছরের পর বছর তাদের গবেষণাগারে কাটিয়ে দিয়েছে। এত সময় ধরে তারা আগুনের পাশে বসে থাকত যে ধীরে ধীরে দিন-দুনিয়ার দম্ভ- গর্ব সব ঝেড়ে ঝুরে ফেলেছিল। এক সময় ওরা আবিষ্কার করল যে ধাতু পরিশোধন করতে গিয়ে নিজেরাই পরিশোধিত হয়ে গেছে।”
সান্টিয়াগো স্ফটিক দোকানির কথা ভাবল। সেই প্রথম দিন ওর দোকানে যখন সান্টিয়াগো স্ফটিকগুলো ঝাড়ামোছা করে দিয়েছিল, তখন পাশের এক রেস্তোরাঁয় ওকে খেতে নিয়ে গিয়ে লোকটা, বলেছিল স্ফটিক ঝাড়পোছ করে সান্টিয়াগো এক হিসেবে ভালোই করেছে। ওই সময়টুকুতে তার মনে সান্টিয়াগোকে নিয়ে স্বভাবসুলভ সন্দেহ মুছে ফেলার সুযোগ পাওয়া গেছে। সান্টিয়াগোর আজকাল কেবলই মনে হয় মানুষের প্রতিদিনের জীবন থেকেও অ্যালকেমি ব্যাপারটা বোধগম্য হয়।
“আরেকটা বিষয় হলো,” বলল ইংরেজ। “পরশ পাথরের একটা আকর্ষণীয় ক্ষমতা আছে। পাথরের ছোট্ট একটা ফালিই পারে ধাতু্র বিপুল পরিমান অংশকে সোনা বানিয়ে ফেলতে।”
একথা শুনে সান্টিয়াগোর অ্যালকেমির প্রতি আগ্রহ ব্যাপক বেড়ে গেল। ভাবল একটু ধৈর্য ধরে থাকলেই সবকিছুকে একদিন সোনা বানিয়ে ফেলবে। যারা যারা একাজ করতে পেরেছিলঃ হেল্ভিশিয়াস, এলাইয়াস, ফুল্কানেলী, আর জিবার, সবার জীবন সম্পর্কে ও পড়ে ফেলেছে। চমৎকার সব গল্পঃ প্রত্যেকেই তাদের জীবন গল্পের একেবারে শেষ দেখে ছেড়েছে। কত যে জায়গায় ঘুরেছে, জ্ঞানী জ্ঞানী সব লোকদের সাথে কথা বলেছে, অবিশ্বাস্য অলৌকিক সব কাজ করেছে, পরশ পাথর আর জীবনের পরশমণির নাগাল পেয়েছে।
কিন্তু সেই শ্রেষ্ঠ কাজ কিভাবে সাধন করা যায় সেই খতিয়ান পড়তে গিয়ে সান্টিয়াগোর দিশেহারা অবস্থা হলো। শুধু আঁকিবুঁকি, সাঙ্কেতিক ইশারা-ইঙ্গিত, আর হেঁয়ালিতে ঠাঁসা সব লেখা।
***
“এরা সব কিছু এতো কঠিন করে রেখেছে কেন বলেন তো?” এক রাতে ইংরেজকে জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো। ওর মনে হয়েছিল ইংরেজ মনে হয় খামখেয়ালীপনার কারনে খেয়ালই করেনি ব্যাপারটা।
“কঠিন করে রেখেছে, যাতে যাদের বোঝার কথা তারাই যেন শুধু বুঝতে পারে,” বলল ইংরেজ। “একবার ভেবে দেখোতো সবাই দুমদাম করে সীসা কে সোনা বানিয়ে ফেলল। সোনার মূল্য তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
“ওসব জটিল কথা তারাই বুঝবে, যারা লেগে থাকবে, গভীরে পড়াশোনা করার স্বদিচ্ছা যাদের আছে, তারাই সেই শ্রেষ্ঠ কাজ বোঝার দাবি রাখে। দেখনা, আমি কি এমনি এমনি লেগে আছি? কত বিদ্যা বুদ্ধি অর্জন, কত অপেক্ষা, কত দেশ ঘুরে আজকে এই বিরান মরুভূমি মাঝে এসে পড়েছি, তা কি এমনি এমনি? আমি খাঁটি এক অ্যালকেমিস্টের খোঁজে বেড়িয়েছি। আমাকে অ্যালকেমির বইগুলোর জটিল সেই সাঙ্কেতিক ইশারা-ইঙ্গিত আর হেঁয়ালির রহস্যোদ্ধার করতে সাহায্য করতে পারবে সেই লোক।”
“আচ্ছা কবে লেখা হয়েছিল এই বই গুলো?”
“অনেক শতাব্দী আগে।”
“ওদের তখন ছাপাখানা ছিলনা,” যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করল সান্টিয়াগো। “অ্যালকেমি সম্পর্কে অন্য মানুষের কোনোভাবেই জানতে পারার কথা ছিলনা, তাহলে এতো কায়দা কসরত করে অদভুত একটা ভাষায় এতোসব আঁকিবুঁকি করতে হলো কেন ওদের?”
ইংরেজ সরাসরি কিছু বললনা। অন্য প্রসঙ্গে চলে এলো, বলল- গত কয়েকদিন ধরে সে কাফেলার চলা দেখছে। নতুন কিছু চোখে পড়েনি। যত দিন যাচ্ছে ততই শুধু যুদ্ধের ব্যাপারে কথা হচ্ছে।
***
একদিন সান্টিয়াগো ইংরেজের বইগুলো ফেরত দিতে গেল।
“কি, কিছু বুঝলে?” আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করল ইংরেজ। আর তাছাড়া যুদ্ধের খবরের এই গুমোট ব্যাপারটা ভুলে থাকার জন্য কারো সাথে তার কথা বলাও দরকার ছিল।
“হুম। জানলাম যে পৃথিবীর একটা হৃদয় আছে, যারা সেই হৃদয়কে বুঝতে পারে তারা সবকিছুর ভাষাও বুঝতে পারে। পড়ে যা বুঝলাম, বহু অ্যালকেমিস্ট তাদের গন্তব্য চিনতে পেরেছিল, পৃথিবীর অন্তরাত্মার সন্ধান পেয়ে খুঁজে পেয়েছে পরশ পাথর, আর জীবনের পরশমণি মানে অমরত্বের এক মহৌষধ।
“সবচেয়ে বড় কথা হল, যেটা বুঝলাম, এই এত সব কিছু কোনো জটিল বিষয় না, বরঞ্চ এতোই সহজ যে পান্না ফলকের উপরেও এসব লিখে ফেলা যায়।”
সান্টিয়াগোর কথা শুনে ইংরেজ মনে মনে আক্ষেপ করল। কত কত বছরের গবেষণা, জাদুর মত সাংকেতিক ইশারা-ইঙ্গিত, আজব সব শব্দ, গবেষণাগার, যন্ত্র-পাতি, এসব কিছু পড়েও কি এই ছেলের মনে কোনো কিছুর ছাপ পড়লনা! আসলে ছোকরার চিন্তা-ভাবনাই সেকেলে। এসবের ও কি বুঝবে, ভাবল ইংরেজ।
বই ফেরত নিয়ে সুন্দর করে মুড়ে আবার তার থলেতে পুরে রাখল ইংরেজ।
“যাও যাও, গিয়ে বরঞ্চ কাফেলা দেখ,” বলল সে। “কাফেলা দেখেতো আমি কিছু শিখতে পারলামনা, তুমি গিয়ে যদি কিছু শিখতে পারো।”
অগত্যা ফিরে গিয়ে মরুভূমির নৈঃশব্দ্য আর পশুগুলির খুরের ধাক্কায় উড়তে থাকা বালির দিকেই মন ফেরাল সান্টিয়াগো।
“একেকজনের শেখার নিজস্ব কায়দা থাকে” বিড়বিড় করল ও। “ওই লোকের শেখার উপায় যেমন আমার শেখার উপায়ের মতো না, তেমন আমার শেখার ধরনও তার মতো না। কিন্তু, একটা জায়গায় অবশ্য আমাদের মিল আছে, আমরা দুজনেই যার যার গন্তব্যের খোঁজে ছুটছি। সেজন্যেই অবশ্য লোকটাকে শ্রদ্ধা করি।”
***
এখন রাত-দিন চলতে শুরু করেছে কাফেলা। এর মধ্যে মাথা ঢাকা বেদুইনরা অনেক ক-বার এসেছিল। যে উট-চালক লোকটার সাথে সান্টিয়াগোর বন্ধুত্ব হয়েছিল একদিন সে খবর দিল, গোষ্ঠীদের মধ্যে দাঙ্গা নাকি শুরু হয়ে গেছে কোথায়। কাফেলা যদি কোনোভাবে মরুদ্যান অব্দি পৌছাতে পারে তো লাখ লাখ শুকরিয়া।
চলতে চলতে পশুগুলোর একেবারে কাহিল অবস্থা। কাফেলার লোকেরা একে অন্যের সাথে খুবই কম কথা বলে। সারাদিন কোনোভাবে কাটানো যায়। কিন্তু রাতের বেলা এই শুনশান নিরবতা অসহ্য হয়ে ওঠে। রাতে উটের ঘোঁৎ ঘোঁৎ আগে কিছুই মনে হতোনা, আর এখন উটের সামান্য ডাকেই সবাই ভীষণ ভয় পায়, ভাবে, কে জানে, হামলার কোনো লক্ষণ কিনা।
তবে দাঙ্গা হাঙ্গামার খবর আনছে যে উট-চালক লোকটা, যুদ্ধের চিন্তায় সে যে খুব একটা উদ্বিগ্ন তাও না।
একদিন রাতে। আকাশে চাঁদ নেই সেদিন, সর্দারের কথা মেনে আগুনও জালেনি কেউ। এক মুঠো খেজুর নিয়ে খেতে বসেছে ওরা। “বাইচা আছি এইটাইবা কম কী,” বলল উট-চালক লোকটা। “আমি যখন খাই, তখন খালি খাওয়ার চিন্তা করি, যখন উট নিয়া আগাই, তখন শুধু সেই চিন্তা। যুদ্ধ যদি করতে হয় করব, যেদিন করব সেদিন দেখা যাবে। মরতে হইলে মরব। মৃত্যুর সব দিনই আমার কাছে সমান।
“যা গেছে গেছে, যা আসবে আসবে, অতীত ভবিষ্যত এইসব নিয়া আর মাথা ঘামাইনা। এখন কি হইতাসে সেইটাতেই আমার অতিশয় আগ্রহ। শোনেন ভাইসাব, সবসময় যদি বর্তমানে মন দেন সুখী হইবেন। দেখবেন, এই মরুর জীবন আছে, আকাশের দিকে চাইলে ব্যাহেশতী তারার ঝলক দেখবেন। আদিবাসী জাতির লোকেরা যে যুদ্ধ করতেছে ক্যান করতেছে, কারণ তারাও মানুষ। তাদেরও যুদ্ধ বিগ্রহ কইরা বাইচা থাকতে হয়। ভাইসাব, জীবনটা বড়ই আনন্দের বিষয়। বিচিত্র আনন্দ। জীবন তো আলদা কিছু না, এই যে এখন - এই এখনটাই জীবন।”
দুই রাত পরে, লোকটা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় সান্টিয়াগো পথ চিহ্নের তারাগুলো দেখার চেষ্টা করছে, প্রতিদিন রাতে ওগুলো দেখেই কাফেলা এগোয়। সেই রাতে মনে হলো দূর দিগন্তের আকাশ যেন অনেকটা নিচে নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে তারাগুলো মরুভূমির দিগন্তে মিটমিট করে দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
“ভাইসাব কী দ্যাখেন, ওইটাই মরুদ্যান,” বলল উট-চালক।
“তাই! তো আমরা এখনই ওইদিকে রওনা হচ্ছিনা কেন?” জিজ্ঞেস করলো সান্টিয়াগো।
“কারণ আমরা এখন ঘুমাব, আমাদের এখন ঘুমানো দরকার।”
(চলবে)
অনুবাদ- জে এফ নুশান
অণুকাহিনী ৫ ও ৬
অণুকাহিনী ৪
অণুকাহিনী ৩
অণুকাহিনী ২
অণুকাহিনী ১
মন্তব্য
কঠিন কাজ করে চলেছেন আপনি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অনুপ্রেরণা পেলাম।
নুশান
নতুন মন্তব্য করুন