“তোমার সাথে দাবা খেলে হারতে হারতে আমি শেষ হয়ে গেলাম, তুমি মাঝে মধ্যে একটু খারাপ খেলে আমাকে জিততে দিতে পারো না? তোমার কি কোন ভদ্রতা জ্ঞান নাই?”, চিংকু ওর বিরক্তি প্রকাশ করল।
“নিজের ইচ্ছায় জোর করে আমি হারতে পারি না, কিভাবে জেনে বুঝে হারতে হয় সেটাও আমি জানি না, কাজেই তোমাকে আমার চেয়ে ভালো খেলেই জিততে হবে”, এলিসের সোজাসাপ্টা জবাব।
“ও তুমি তো আবার একটু গবেট প্রকৃতির, এটা মনে ছিল না, এসব ব্যাপার তুমি বুঝবে কিভাবে! আমি গেলাম, এবার নিজের সাথে খেলো আর নিজেকে নিজে হারাও”, দাবার বোর্ডটা সব গুটিসহ উল্টে দিয়ে চিংকু উঠে গেলো।
“কোথায় যাচ্ছ?”, জিজ্ঞাসা করল এলিস।
“তাতে তোমার কি? তিন তিন বার দাবাতে হারিয়েও মন ভরেনি? আরও লাগবে?”
“তুমি বারবার আমার মন্ত্রী কাটার ফাঁদে পা দিচ্ছিলে দেখেই হারছিলে। তাছাড়া এখন তোমার খাবার সময় হয়েছে, নটা বাজতে চলল”
“প্রতিদিন কি একই সময়ই খেতে হবে নাকি? মা আর বাবা আসলে ওদের সাথে খাব, এখন আর বকবক কোরো না, যাও এখান থেকে”
“ওনাদের আজ আসতে দেরি হবে, একটা পার্টি আছে, আমাকে বলে গেছেন যাতে তোমাকে দশটার মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দিই কারণ সকালে স্কুলে যাবার সময় তুমি উঠতে চাও না। এখন খেতে চল, আর কোনো কথা না”, এলিসের কড়া নির্দেশ।
চিংকু হাল ছেড়ে দিলো কারণ গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা থেকে ও জানে যে এই গবেটের কথা না শোনা পর্যন্ত সে পেছনে লেগেই থাকবে, ক্ষান্ত দেবে না, রীতিমত অসাধারণ ধৈর্য্যশক্তি। তার চেয়ে বরং খেয়ে ঘুমাতে চলে গেলে অন্তত এলিসের বকবকানি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে এলিসের কাছে আরব্য রজনীর রুপকথার গল্প শুনতে শুনতে চিংকু ঘুমিয়ে পড়ল। গল্প শোনা ছাড়া চিংকু ঘুমায় না। চিংকু যে এলিসের গল্প বলার সময় বিশেষ মনোযোগ দেয় তা নয়, এটা অনেকটা ঘুমের ওষুধের মত। কেউ একজন মাথার কাছে বসে কিছু একটা বলছে, তাতেই চিংকুর ঘুম এসে যায়। অতি সামান্য শিশুতোষ আবদার হলেও ওর মা বাবার কাছে এই আবদার বেশ কঠিন বলে মনে হয়, তবে এলিস এই দায়িত্বে বিন্দুমাত্র অবহেলা করে না। চিংকু ঘুমিয়ে যাবার পর এলিস ওর মাথার কাছে বসে থাকলো, ওর দিকে তীক্ষ্ম নজর দিয়ে, এলিসের চোখ একটুও এদিক সেদিক হয় না।
চিংকুর মা বাবা কেউই রাতে বাসায় ফিরলেন না, হয়ত পার্টিটাই শেষ হয়নি, ওনাদের কি দোষ।
*
স্কুল ছুটির পর চিংকু আর ওর বন্ধু রিমন ওদেরকে নিতে আসার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
“কিরে চিংকু তোকে প্রতিদিন ওটা কে নিতে আসে রে? দেখতে বেশ অদ্ভুত রকম", রিমন জিজ্ঞাসা করল।
“অদ্ভুত রকমের না, রীতিমত অদ্ভুতই, কোনো ভাবলেশ নাই আর হালকা গবেট টাইপের”, চিংকুর সোজাসুজি জবাব।
রিমন চিংকুর স্কুলের একমাত্র বন্ধু, একেবারে অন্তরে অন্তরাত্মা। হেন জিনিস নেই যা ওরা দুজন আলোচনা করে না। যেসব জিনিস বড়দের জিজ্ঞাসা করলে ঝামেলা হতে পারে সেসবের ব্যাখ্যা চিংকু আর রিমন নিজদের মাঝে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বের করে নেয়।
যেমন ধরা যাক, একদিন রিমন জানতে পারলো যে রিমন জন্মাবার আগে ও ওর মায়ের পেটে ছিল, কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়, যদি মার পেটেই থাকবে তাহলে রিমনের চেহারা পুরোপুরি ওর বাবার মত হল কি করে? চিংকু আর রিমন দুজনই বেশ জটিল এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়ল। এরপর চিংকুই একদিন অনেক চিন্তাভাবনা করে একটা সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে হাজির হল। রিমন ওর মায়ের পেটে থাকার সময়, রিমনের বাবা হয়ত ওর মায়ের পেটের উপর হাত বুলিয়ে রিমনকে রোজ অনেক আদর করতেন, এ কারণেই হয়ত রিমন দেখতে ওর বাবার মত হয়েছে। চিংকুর কাছে এটা শুনে রিমনের মনে হয়েছে ব্যাখ্যাটা খারাপ না তবে এ ব্যাপারে আরো গবেষণা প্রয়োজন।
“কিন্তু আগে তো তোদের ড্রাইভার আসতেন তোকে নিতে, হঠাৎ কি হল?”, রিমনের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা।
“বাসায় এখন আর কোনো ড্রাইভার বা কাজের লোক নেই, এই গবেটই সব করে, গাড়ি চালায়, রান্না করে, বাসার সব কিছু দেখভাল করে আর আমাকে দেখাশোনার নামে সারাদিন আমার পিছে লেগে থাকে”
“ঐ যে এসে গেছে। আমি গেলাম, কালকে তোর উইজা বোর্ডটা নিয়ে আসিস, টিফিন ছুটিতে চার্লি চ্যাপলিনকে আনার চেষ্টা করব”, এই বলে রিমনকে বিদায় দিয়ে চিংকু ওদের গাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো।
গাড়ির সামনে এলিস তাল গাছের মত দাড়িয়ে ছিল। অনেকটা চৈত্র মাসের তাল গাছের মত, তীব্র গরমে যখন কোনো বাতাস থাকে না, আর তাল গাছের পাতা এদিকও নড়ে না ওদিকও নড়ে না, বেরসিকের মত ঠায় দাড়িয়ে থাকে।
চিংকু কাছে আসতেই এলিস ওর ব্যাগটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলে নিয়ে চিংকুকে গাড়ির পিছনের সিটে বসিয়ে দিল। আসলে চিংকুর সামনের সিটে বসার ইচ্ছা, কিন্তু এগুলো এলিসকে বলে লাভ নেই, শুধুই মুখ ব্যাথা হবে আর কিছু না।
“তুমি প্রতিদিন এসে গাড়ির পাশে এরকম মূর্তির মত দাড়িয়ে থাকো কেন? আমি খেয়াল করলাম তোমার চোখের পাতাও নড়ে না, ক্লাসমেটদের কাছে তোমাকে নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি একদম বিরক্ত হয়ে গেছি”, এলিস গাড়ি চালানো শুরু করার পর চিংকুর সরাসরি প্রশ্ন।
“তোমাকে স্কুল থেকে নিরাপদ ভাবে বাসায় নিয়ে যাওয়াই আমার প্রধান কাজ, এর বাইরে অন্য কিছু আমার প্রাধান্যের তালিকায় নেই”, সবসময়ের মতই এলিসের বেরসিক উত্তর।
“ঠিক আছে তাহলে নিরাপদে বাসাতেই নিয়ে চল”, চিংকু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
*
বাংলাদেশের স্বাধীনতার একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের অন্যান্য জায়গার মত চিংকুদের স্কুলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তার মাঝে একটি মঞ্চ নাটকে চিংকু একজন মুক্তি কমান্ডারের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছে। এটা নিয়ে চিংকুর উত্তেজনার শেষ নেই।
চিংকু দিন রাত খালি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সিনেমা দেখছে আর এলিসকে বলছে মুক্তিযোদ্ধাদের যত বীরত্বের কাহিনী আছে সেগুলো ওকে শোনাতে। এলিসও চিংকুর আজ্ঞা পালন করে যাচ্ছে। চিংকুকে এলিস প্রতিদিন খুঁজে খুঁজে যত দুষ্প্রাপ্য নাম না জানা, অনেকটা ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অসাধারণ সব মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। এলিসের জন্যে দুষ্প্রাপ্য তথ্য খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়, এই তো মিনিট খানেকের ব্যাপার। চিংকু সিনেমা আর গল্প এই দুটি উৎস থেকে নিজের মুক্তি কমান্ডারের চরিত্রটা মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছে। উত্তেজনায় ইদানিং ওর রাতে ঠিকমত যেন ঘুমই হচ্ছে না।
"বাবা আমি তো স্কুলের নাটকে মুক্তি কমান্ডারের চরিত্রে অভিনয় করছি, সেখানে আমি পাকবাহিনীকে হারাবো, তোমাকে আর মাকে কিন্তু যেতে হবে", খাবার টেবিলে বসে চিংকু আবদার করলো।
"ওরে বাবা, তাই বুঝি?", আজিজ সাহেব চিংকুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন।
"হ্যাঁ", চিংকু একটু লাজুক হাসি হাসলো।
"তোমার নাটকটা কবে বলতো", আজিজ সাহেব চিংকুকে জিজ্ঞাসা করলেন।
"আগামী মাসের দশ তারিখে, অনেকদিন বাকি, এ জন্যই তোমাদের আগে থেকে বলে রাখলাম", চিংকু বললো।
"এই যা, ওই সময় তো আমাকে এক সপ্তাহের জন্যে দেশের বাইরে যেতে হবে, খুব জরুরী কাজ, সিলভিয়া তুমি যেয়ো চিংকুর নাটক দেখতে আর ভিডিও করে আনতে ভুলো না যেন", চিংকুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন আজিজ সাহেব।
"না বাবা, ওদের স্কুলের অডিটোরিয়ামটার এসির যা অবস্থা, গতবার কি এক অনুষ্ঠানে গিয়ে ঘেমে নেয়ে আমি একদম একাকার, আমার পুরো মেকআপই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আর চুলের কথা তো বাদই দিলাম। এলিসকে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়, সমস্যা কি?", মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে নিজের চেহারা দেখতে দেখতে নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন সিলভিয়া।
"আমার জন্যে কোথাও যেতে বললেই তোমাদের যত সমস্যা!", একটা চিৎকার দিলো চিংকু।
"আমার নাটকের এলিস কি বুঝবে? ও তো একটা গবেট। আমি যখন নাটকের শেষ দৃশ্যে পাকবাহিনীকে হারিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরবো তখন সবাই দাড়িয়ে হাততালি দেবে আর এই গবেট মূর্তির মত বসে থাকবে, দাড়াবেও না, হাসবেও না, এই যে দেখছো না টেবিলের পাশে এখন কেমন তাল গাছের মত দাড়িয়ে আছে। দরকার নেই তোমাদের কারো যাবার", ইচ্ছামত রাগ ঝেড়ে চিংকু খাবার টেবিল থেকে উঠে গেলো।
সিলভিয়া তার গালের বাম পাশে ওঠা ছোট ব্রণটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন, আশপাশে কি ঘটছে তাতে তিনি বিশেষ মনোনিবেশ করেননি, মূলত কখনোই করেন না। এলিস সিলভিয়ার পাশেই দাড়িয়ে আছে।
"আচ্ছা এলিস তুমি কি চিংকুর মুড বোঝো না? মানে ও কখন কেমন ব্যবহার চাচ্ছে, অথবা মাঝে মাঝে একটু হাসি ঠাট্টা করা বা উৎসাহ দেয়া, এসব", এলিসকে জিজ্ঞাসা করলেন আজিজ সাহেব।
"স্যার, বর্তমানে আমি যে সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত সেটা মানবিক অনুভূতি বুঝতে সক্ষম নয়। তাছাড়া আমার সিস্টেমের এই ভার্সন দিয়ে আমাকে শেখানো পূর্বনির্ধারিত কাজ ছাড়া চারপাশ থেকে নতুন কিছু শেখাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আপনি চাইলে এগুলো আমার সিস্টেমে যোগ করা সম্ভব", এলিস এক টানা বলে গেলো।
"তা কি করে? একটু বিস্তারিত বলো", চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন আজিজ সাহেব।
"আমার কাছে আমার সিস্টেমের নতুন ভার্সন গুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য আছে, এর মাঝে সর্বশেষ ভার্সনটি গত মাসে রিলিজ হয়েছে। এই নতুন ভার্সনটি অনেক বেশি শক্তিশালী, এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বেশ উন্নত এবং জটিল প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। আমার বর্তমান সিস্টেমকে এই নতুন ভার্সনে আপডেট করলে আমি মানুষের মানবিক অনুভূতি, বিভিন্ন মানসিক অবস্থা সূক্ষভাবে বুঝতে পারবো, এমনকি সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে ব্যবহার করতে পারবো। এছাড়া এতে আরো একটি ফিচার যোগ করা হয়েছে",
"থামলে কেন? বলো কি সেই ফিচার"
"এই নতুন ভার্সনটি আমাকে হাসার ক্ষমতা দেবে। আমি এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিতে পারি যে হাসিটা স্বাভাবিক মানুষের মতই হবে, বিচ্ছিরি কিছু হবে না", এলিস তার কথা শেষ করল।
এতক্ষণ পর সিলভিয়া আজিজ সাহেবের দিকে তাকালেন, "তাহলে ওর সিস্টেমটা আপডেট করে নিলেই পারো যেহেতু হাসতেও পারবে বলছে, চিংকু তো চায় যেন কেউ ওর সাথে একটু হেসে কথা বলুক", এটা বলে আবার ফোনের স্ক্রিনে ফিরে গেলেন সিলভিয়া।
"তবে আমার কাছে যতটুকু তথ্য আছে, তা থেকে আমি যা আঁচ করতে পারছি, এই নতুন ভার্সনে আপডেট করা বেশ ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। এজন্য আপনাদের আমার ভেন্ডরের সাথে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জেনে নেয়া উচিত", এলিস বলল।
"টাকা তো কোনো সমস্যা না, আমার ছেলের খুশির জন্য যত টাকাই হোক খরচ করতে আমার কোনো আপত্তি নেই", আজিজ সাহেব চা টা শেষ করলেন।
চিংকুকে খুশি করার জন্যে সিলভিয়া এবং আজিজ সাহেবের সামান্য কিছু কাজই হয়তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আজিজ সাহেব টাকাতেই সমাধান খুঁজে নিলেন।
*
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন, চিংকুর স্কুল নেই। কাজেই ও একটু দেরীতে ঘুম থেকে উঠলো। ঘুম থেকে উঠে চারপাশে তাকিয়ে চিংকুর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিলো, বার বার মনে হচ্ছিল কি একটা যেন নেই।
হঠাৎ ওর খেয়াল হলো এলিস বাসায় নেই। অন্য সময় ছুটির দিন হোক বা খোলার দিন, প্রতিদিন সকালে উঠেই চিংকু দেখে যে এলিস ওর মাথার কাছে বসে আছে। আজকে এলিসকে না দেখে চিংকুর কেমন জানি লাগলো। যদিও চিংকু মনে মনে পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে বেশ খুশিই হলো। আজকে ছুটির দিনে সারাদিন কানের কাছে কেউ খাবার খাও, গোসল করো, হোমওয়ার্ক করো বলে ভ্যাজর ভ্যাজর করবে না। আজকের দিনটা ও যা খুশি করে কাটাবে।
কিন্তু এলিস গেলো কোথায়? আজিজ সাহেব বসার ঘরে বসে ফোনে কথা বলছেন। চিংকু একবার ভাবলো বাবাকে এলিসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবে কিনা, আবার ভাবলো জিজ্ঞাসা করলে যদি কোথাও থেকে এনে আবার হাজির করে, তার চেয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়।
দিনটা চিংকু খুব আনন্দে কাটালো। সারাদিন বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে একটা বিশেষ ছবি আঁকলো চিংকু। ছবিটাতে তিনটা বড় বড় বাবল। দুপাশের দুইটা বাবলে মা আর বাবা, মাঝখানের বাবলটায় চিংকু নিজে।
দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো এলিস না থাকায় আজকে চিংকুকে ওর মা দুপুর বেলা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। ছোট মাছ চিংকুর একদম ভালো লাগে না কিন্তু আজকে মনে হচ্ছিল ছোট মাছের চাইতে সুস্বাদু আর কিছু মনে হয় পৃথিবীতেই নেই।
খাওয়া শেষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক পুরোনো একটি বই নিয়ে বিছানায় গেল চিংকু। বইটাতে অনেক ছবি আছে। মুক্তিযোদ্ধারা বোমা ছুড়ছেন আর তাতে পাকবাহিনী কাবু হয়ে যাচ্ছে। এসব ছবি দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই চিংকু ঘুমিয়ে পড়ল।
বিকাল বেলা চিংকুর যখন ঘুম ভাঙলো, ও দেখল এলিস ওর মাথার পাশে বসা। কিন্তু চিংকু এলিসের মাঝে কেমন যেন বেশ বড়সড় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। এলিসের মুখটা কেমন যেন হাসি হাসি হয়ে আছে। ঐ মিষ্টি হাসিটার জন্যে এলিসকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। এলিসকে যেন একরকম চেনাই যাচ্ছিলো না।
"এলিস, তুমি হাসছো যে?", চিংকু অবাক চোখে প্রশ্ন করল।
"কেন রে ভাই, আমি কি হাসতে পারবো না? আমি হাসলে বুঝি তোমার খুব সমস্যা", মুচকি হেসে উত্তর দিলো এলিস। আরে এলিস দেখি কৌতুকও করছে।
"আচ্ছা, তুমি তো এতদিন একটু গবেট ধরণের ছিলে, মানে বেরসিক ভাবলেশহীন টাইপের", চিংকু বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলো।
"হ্যাঁ ছিলাম, তাতে কি? সবকিছুই তো পরিবর্তন হয়। তুমিও তো মাস খানেক আগে ঠিক মত গরু আঁকতে পারতে না, পুরো শরীর গরুর মত এঁকে গরুর মুখটা মানুষের মুখের মত এঁকে দিতে", এলিস রীতিমত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
"আরে হ্যাঁ তাই তো, আমি মানুষের মুখওয়ালা গরু আঁকতাম", চিংকু খিল খিল করে হেসে উঠলো।
"তা আজ সারাটা দিন কি করলে তুমি? আমি ছিলাম না দেখে বলে নিশ্চয় একেবারে সপ্তম স্বর্গে ছিলে?", এলিস জিজ্ঞাসা করলো।
"হ্যাঁ, তুমি বুঝলে কিভাবে?"
"তোমাকে আমি বুঝবো না? তোমাকে আমার চেয়ে বেশি কে চেনে?", এলিস চোখ বড় বড় করে চিংকুর দিকে তাকালো।
"আচ্ছা এলিস, তোমার সাথে আজকে কথা বলতে খুব মজা লাগছে, এই প্রথম বার তোমাকে আমার খুব কাছের বন্ধু মনে হচ্ছে", এলিসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো চিংকু।
"বন্ধুর সাথে কথা বলতেই তো মজা লাগে, আর তাছাড়া আমি কি শত্রু নাকি?", এলিস চিংকুকে কাছে টেনে নিলো।
*
চিংকুদের স্কুলে নাটকের বেশ জোরেশোরে রিহার্সাল চলছে। এমনিতে চিংকু আর রিমন একজন আরেকজনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হলেও, নাটকে ওরা শত্রু। রিমন পাকবাহিনীর একজন সৈন্য। রিমনের নাকি ভিলেন হবার খুব ইচ্ছা, আর এজন্যেই সে এ চরিত্র বেছে নিয়েছে। যদিও রিমনের মিষ্টি চেহারাতে পাকিস্তানী সৈন্যদের হিংস্রতার ছিটে ফোটাও আসবে না। আসার দরকারও নেই। এটা শিশুদের নাটক, স্বাধীনতার শতবছর পরও যে ওরা মুক্তিযুদ্ধকে ওদের হৃদয়ে ধারণ করছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
"শোন রিমন, আমি আমার খেলনা রাইফেলটা নিয়ে এসেছি", রিমনকে ডেকে বললো চিংকু।
"বলিস কি?"
"হ্যাঁ, স্কুল থেকে যে শোলা দিয়ে তৈরী করা রাইফেলগুলো দিয়েছে ওগুলো হাতে নিলে আমি আমার চরিত্রটার কোনো উত্তেজনাই টের পাই না। তোর চিন্তা নেই, রাবারের গুলি গুলোতো আর আনিনি। কাজেই আমি ট্রিগার চাপলে খালি ঠুশ ঠুশ শব্দ হবে, আর শব্দ শোনা মাত্র তুই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মরে যাবি, মরতে দেরি করবি না কিন্তু", চিংকু রিমনকে কিভাবে মরতে হবে তা সবিস্তারে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো।
"আচ্ছা ঠিক আছে চিন্তা নেই, শব্দটা শোনা মাত্রই মরে যাবো", রিমন আশ্বস্ত করলো।
গ্যালারিতে বসে এলিস ওদের রিহার্সাল দেখছিলো, ওখান থেকেই ডাক দিলো, "চিংকু! এই চিংকু! গোলাগুলি শুরু করার আগে একটু পানি খেয়ে যাও, ঠিকমতো পানি না খেলে পরে দেখা যাবে বিপক্ষ সৈন্যের বদলে নিজের সৈন্যকেই গুলি করছো"
"পানি খেয়ে গেলাম, কিন্তু শোনো, দয়া করে আর ডাকাডাকি কোরো না কারণ নাটকের সবাই আমার ক্লাসমেট হওয়ায় আমি বারবার এমনিতেই ভুলে যাচ্ছি যে কে বিপক্ষের আর কে আমার পক্ষের", চিংকু জলদি এসে পানি খেয়ে ফিরে গেলো।
"ও আচ্ছা, আরেকটা কথা। তুমি আমার অভিনয়টা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখো তো, মানে পরে বাসায় গিয়ে আমাকে যেন বলতে পারো কি কি ভুল করেছি"
"আচ্ছা ঠিক আছে, এখন যাও তাড়াতাড়ি, সবাই রেডি হয়ে গেছে", এলিস বললো।
স্টেজে যখন রিহার্সাল চলছিল এলিস তখন তীক্ষভাবে চারদিক পর্যবেক্ষণ করছিল। নতুন তথ্য সংগ্রহণ, তার সাথে পূর্বে সংগ্রহকৃত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং তার মধ্য থেকে এলিস সর্বোচ্চ নির্ভুল তথ্য সংরক্ষণ করছিল।
এছাড়াও এলিস স্টেজের আয়তন, স্টেজ এবং গ্যালারির মাঝে তাপমাত্রার পার্থক্য, স্টেজে চিংকুর দৌড়াদৌড়ির পরিমাণ এই সব কিছুই একেবারে নিখুঁতভাবে নির্ণয় করছিল। এর সাহায্যে এলিস হিসাব করছিল চিংকুকে ঠিক কত সময় পর পর পানি খাওয়াতে হবে যাতে ওর ডিহাইড্রেশন না হয়।
এসব ছাড়াও এলিস রিহার্সেলে উপস্থিত সব ছেলে, মেয়ে, শিক্ষক এবং বাদ বাকি যারা ছিল সবার চেহারা, উচ্চতা, শারীরিক গঠন এ সবকিছুর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছিলো। এলিস জানে মানুষের মনের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক দেখতে মানুষও যাবতীয় ভয়াবহ কাজ করে বসে। চিংকুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এলিসের সকল দায়িত্বের মাঝে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই চিংকুর আশপাশের সবার তথ্য সংগ্রহ করাও একই রকম গুরুত্ব বহন করে।
"কি ব্যাপার রিমন, তোকে গুলি করার পরও তুই মরছিলি না, কতবার গুলি করলাম", রিহার্সাল শেষে স্টেজ থেকে নামতে নামতে চিংকু বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
"আরে আমার কি দোষ! তোর গুলি করার শব্দ শোনাই যায় না। বাকি সবার হৈ হৈ চিৎকারের মধ্যে তোর বন্দুকের গুলির ঠুশ ঠুশ শব্দটা পুরো হারিয়ে যায়", বললো রিমন।
"তুই এক কাজ করিস, একদম আমার সামনে এসে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি মারিস, তাহলে আমি সাথে সাথেই শুয়ে পড়বো", রিমন একটা কার্যকরী বুদ্ধি দিলো।
চিংকু আর রিমন যখন স্টেজ থেকে নেমে আসছিলো এলিস এসে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো, "কেমন আছো রিমন? তুমি খুব ভালো অভিনয় করেছো, একেবারে পারফেক্ট ভিলেন", এলিস খুব সুন্দর করে হেসে রিমনকে অভিনন্দন জানালো।
এলিসের এই অভিনন্দনের জন্যে রিমন একদমই প্রস্তুত ছিল না, তার উপর এলিসকে হাসতে দেখে রিমন আরো ভড়কে গেলো। রিমন একবার এলিসের দিকে তাকালো তারপর চিংকুর দিকে তাকালো।
"খালি রিমনকে বললে? আর আমারটা", চিংকু এলিসের দিকে কড়া চোখে তাকালো।
"একেবারে দুর্দান্ত! তোমাকে দেখে তো আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন একশো বছর আগে ফিরে গেছি", এলিসের চোখে মুখে উত্তেজনা দেখে চিংকু খুব খুশি হয়ে গেলো।
কথাটা বলার সময় এলিস চিংকুকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করছিলো আর সাথে সাথে পানির বোতলটা বের করলো, "নাও তোমাকে এখন পানি খেতে হবে, না হলে ডিহাইড্রেশন হবে কিন্তু"
"রিমন আজকে যাই, আগামী দিন তাড়াতাড়ি মরে যাওয়াটা প্র্যাকটিস করে আসবি ঠিক মতো", পানি খেয়ে চিংকু আর এলিস রিমনকে বিদায় জানালো।
"চিংকু, তোমার অভিনয়টা কিন্তু বেশ ভালোই হয়েছে বলতে হবে, তবে", গাড়ি চালাতে চালাতে বললো এলিস।
"তবে কি? কথাটা শেষ করো, কেউ কথার মাঝখানে থামলে একদম ভালো লাগে না আমার", চিংকুর কড়া জবাব।
"না মানে ভাবছি, তুমি সমালোচনাটা কিভাবে নেবে"
"কেন? আমিই তো তোমাকে বলেছি যে কি কি ভুল করছি তা যেন পরে আমাকে বলো"
"গোলাগুলির মুহূর্তে একজন মুক্তি কমান্ডারের চেহারাতে যে ধরণের একটা ভাব থাকার কথা ওটা মনে হচ্ছে তোমার আরেকটু আয়ত্ত করতে হবে", এলিসের সুচিন্তিত মতামত।
"ও আচ্ছা, এ কথা! গোলাগুলির সময় রিমন মরতে অনেক সময় নিচ্ছিলো দেখে আমি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। তবে তুমি ভালো জিনিস খেয়াল করেছো। এখন গাড়িটা একটু তাড়াতাড়ি চালাও বাসায় গিয়ে মা আর বাবাকে আজকের রিহার্সেলের গল্প বলতে হবে", চিংকু বেশ উত্তেজিত।
বাসায় পৌঁছে চিংকু আবিষ্কার করলো মা আর বাবা কেউই নেই, তারা পার্টিতে গেছেন। কাজেই তাদের জন্য অযথা অপেক্ষা না করে এলিস চিংকুকে খাওয়া দাওয়া করিয়ে ঘুমাতে নিয়ে গেলো।
রাতে ঘুমাতে যাবার সময় চিংকুকে এলিসের গল্প শোনাতেই হবে, এটা একটা নিয়ম। চিংকুর সাম্প্রতিক অভিনয় নিয়ে উত্তেজনার কথা মাথায় রেখে এলিস আজ একটা ভিন্ন ধরণের গল্প বলা শুরু করলো।
এটা ঠিক গল্প নয় অবশ্য। এলিস এক ধরণের সাপের বর্ণনা দিতে শুরু করলো। ইস্টার্ন হগনোস স্নেক। এই সাপ এক দুর্দান্ত অভিনয়শিল্পী। এরা শিকার ধরার জন্য অথবা কখনো আত্মরক্ষার জন্য মৃত্যুর অভিনয় করে। দেখে যে কেউ ভাববে, "আহারে সাপটা বুঝি মারা গেলো", কিন্তু না! এই সাপের তরিকাই হলো প্রাণীকূলের ভুলের সুযোগ নেয়া।
"বলো কি? ওরে বাবা! এমনি সাপের কথা ভাবলেই আমি পালানোর রাস্তা পাই না, এখন দেখছি সাপ অভিনয়ও জানে!", চিংকু শোয়া অবস্থাতেই চোখ বড় বড় করে বললো।
"না না, তোমার পালানোর দরকার নেই, এই সাপগুলো বাংলাদেশের চৌহদ্দিতেও নেই", এলিস খিলখিল করে হেসে উঠলো। ইস্টার্ন হগনোস স্নেকের বর্ণনা শুনতে শুনতে চিংকু ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।
চিংকু ঘুমিয়ে পড়ার পর এলিস চিংকুর মাথার কাছে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। চেয়ারে বসে চিংকুর দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
*
সকালে নাস্তার টেবিলে এলিস আজিজ সাহেব আর সিলভিয়াকে খাবার তুলে দিচ্ছিলো। আজিজ সাহেব আর সিলভিয়া দুজনই তাদের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
"স্যার, ম্যাডাম, আপনাদের আমার কিছু কথা বলার ছিল", এলিস বললো।
"হ্যাঁ বলো", সিলভিয়া মোবাইলের দিকে তাকানো অবস্থাতেই বললেন।
"কথাটা জরুরি, চিংকুর ব্যাপারে, আমি চাই আপনারা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন", এলিস ভদ্রতা বজায় রেখে ঐ দুজনের দৃষ্টি মোবাইল থেকে সরিয়ে নিজের দিকে আনার চেষ্টা করলো।
"চিংকুর ব্যাপারে? কি ব্যাপার? কোনো সমস্যা?", আজিজ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, এবার তারা দুজনই এলিসের দিকে তাকালেন।
"কোনো গুরুতর কিছু নয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা গুরুতর হয়ে যেতে পারে", এলিস বললো।
"কি রকম? একটু খুলে বলো", সিলভিয়া এলিসকে জিজ্ঞাসা করলেন।
"আমি লক্ষ্য করছি চিংকুর সাথে আপনাদের দুজনের তেমন কোনো যোগাযোগ নেই, আর এই দূরত্বটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এটা ওর বয়সী বাচ্চার মানসিক বৃদ্ধির জন্য খুব একটা ভালো ব্যাপার নয়। আগে আমি চিংকুকে যেভাবে দেখভাল করতাম, তা ছিল পুরোপুরি শারীরিক তত্ত্বাবধান, তাও কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে। তবে আমার সিস্টেম আপডেট করার পর এখন চিংকুর মানসিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখাও আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ", বললো এলিস।
এলিস যে বিষয়টি উত্থাপন করলো তা আপাতভাবে সহজ মনে হলেও, ইদানিং কালের অন্যান্য মা-বাবাদের মতো আজিজ সাহেব আর সিলভিয়ারও বিষয়টা বুঝে উঠতে খানিক সময় লাগলো। উনারা কিছুক্ষণ এলিসের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন যেন এলিস তাদের দুজনকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার কোনো কঠিন সূত্র ব্যাখ্যা করছিলো।
তবে এলিস চিংকুর মা-বাবার এমন প্রতিক্রিয়ায় এতটুকু অবাক হয়নি। সে প্রতিদিন চিংকুকে নিয়ে এখানে সেখানে যায়। আশেপাশের অন্য মা-বাবাদের আচার আচরণ এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া এলিস বেশ গুরুত্বের সাথে বিশ্লেষণ করে। সেই বিশ্লেষণের ফলাফলের সাথে এই মুহূর্তে আজিজ সাহেব আর সিলভিয়ার প্রতিক্রিয়ার তুলনামূলক বিচার করে এলিস তেমন বিশেষ কোনো গাণিতিক পার্থক্য খুঁজে পায়নি।
এলিস আরো বললো,"চিংকুর ভালোর জন্য আপনারা আমার সিস্টেম আপডেট করে আমাকে মানবিক অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু আমার মতে চিংকুর জন্য আমার পাশাপাশি আপনাদের অনুভূতিও অনেক বেশি প্রয়োজন, তাছাড়া আপনারা মানুষেরাই আপনাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আমি এবং আমার মতো অন্যদেরকে মানবিক অনুভূতি এবং আবেগ বুঝতে সক্ষম করেছেন, সেক্ষেত্রে আপনাদের আবেগ ও অনুভূতি নিশ্চয় আমার চেয়েও অনেক বেশি উচ্চমানের?"
ইতিহাসের অন্য কোনো সময়ে হলে এলিসের কথাগুলো নিশ্চিত আজিজ সাহেব এবং সিলভিয়ার মাথায় রীতিমত আলোড়ন তুলতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তির ধার যত বেড়েছে আজিজ সাহেব এবং সিলভিয়াদের মাথার ধার ততটাই কমেছে। সেজন্যেই কিনা, এলিস প্রতিনিয়ত চিংকুর কাছে তার মা-বাবার চাইতেও অনেক বেশি কাছের একজন হয়ে উঠছে এবং ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হচ্ছে।
"আচ্ছা এলিস, বলতো আমাদের এখন কি করা উচিত?", সিলভিয়া জিজ্ঞাসা করলেন।
"বিশেষ কিছুই না, ধরুন মাঝে মাঝে আমার বদলে আপনাদের কেউ একজন চিংকুর স্কুলে গেলেন, কিংবা ওর সাথে কথা বললেন, ও কি বলতে চায়, ও কি ভাবে তা শুনলেন, ওকে পাশে নিয়ে বসলেন, একটু জড়িয়ে ধরলেন, শারীরিক স্পর্শ খুব শক্তিশালী একটি ব্যাপার। সেটা আমার চাইতেও আপনাদেরই বেশি বুঝতে পারার কথা", এলিস বিস্তারিত উত্তর দিলো।
"আচ্ছা কদিনের জন্য আমরা সবাই কক্সবাজার ঘুরতে গেলে কেমন হয়?", আজিজ সাহেব বেশ আনন্দিত হয়ে বললেন।
"হ্যাঁ ভালো বলেছো, শুনেছি ওখানে নতুন একটা সেভেন ষ্টার রিসোর্ট করেছে, ওটাতেই যাই কি বলো?", সিলভিয়াও খুব উত্তেজিত হয়ে গেলেন।
"তবে তাই হবে, এলিস আগামী সপ্তাহেই আমরা সবাই কক্সবাজার যাচ্ছি, চিংকুর স্কুলের অনুষ্ঠানের আগেই ফিরে আসবো, কোনো সমস্যা হবে না", এলিসকে বললেন আজিজ সাহেব।
কথাগুলো শুনে এলিস অনেক কিছু চিন্তা করতে শুরু করলো। কক্সবাজারে সেভেন ষ্টার রিসোর্টে যাবার তুলনায় এলিস ওদের দুজনকে যেসব পরামর্শ দিয়েছিলো সেগুলো করা অনেক বেশি সহজ, অন্তত এলিসের সুক্ষ বিশ্লেষণ তাই বলে। এলিস ভাবলো যে এলিসের বিশ্লেষণের চেয়ে মানুষের বিশ্লেষণ নিশ্চয় অনেক বেশি শক্তিশালী। এলিস আবার এটাও ভাবলো এমনও কি হতে পারে যে মানুষ তাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিন দিন হারিয়ে ফেলছে অনেকটা স্বেচ্ছায়?
*
সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে চিংকু একেবারে আনন্দে আত্মহারা। চিংকু এলিসের হাত ধরে সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটছে আর খানিক পর পর ঢেউ এসে ওদের পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, প্রত্যেকবারই চিংকু খুশিতে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে।
এলিসও চিংকুর সাথে এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে হাসিমুখে। তবে এলিসের মাথায় অন্য একটি চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে। যে কারণে কক্সবাজারে ঘুরতে আসা সেটাই হচ্ছে না। আজিজ সাহেব আর সিলভিয়া চিংকুকে এলিসের সাথে বীচে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা হোটেল রুমে বসে সেই মোবাইলের দিকেই তাকিয়ে আছেন। চিংকু ইদানিং আর ওর মা বাবার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহও দেখায় না, যত কথা সব এলিসকেই বলে। এলিসই এখন চিংকুর সত্যিকারের বন্ধু।
"এলিস আমি একটু সমুদ্রের পানি খেয়ে দেখি?", চিংকু জিজ্ঞাসা করলো।
"হ্যাঁ, দেখতে পারো, কিন্তু মনে হয় না তোমার খুব একটা পছন্দ হবে"
"থু! জঘন্য, এতো নোনতা!", চিংকু নাক সিঁটকালো।
"বলেছিলাম না? তাছাড়া সমুদ্রের পানি বেশি খেলে কি হয় জানো তো, নাকি?", এলিস জিজ্ঞাসা করলো।
"না আমি জানি না, কি হয়?"
"সমুদ্রের পানি যত খাবে ততই আরও বেশি তৃষ্ণার্ত হবে, আর কিডনিগুলোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে এতো লবণ সামলাতে না পেরে, তারপর এক সময় তোমার নিজের মাথাই হয়ে বরবাদ যাবে, আশপাশে সব উল্টোপাল্টা দেখবে আর আবোল তাবোল কথা বলবে, অথবা হয়তো কথাই বলতে পারবে না", এলিস জোরে হেসে উঠলো।
"বলো কি? তাহলে সমুদ্রের এতো পানি দেখি তেমন কোনো কাজেই আসে না। আচ্ছা এলিস তুমি এতো কিছু কিভাবে জানো? মানে তোমাকে যাই জিজ্ঞাসা করি তুমি সবকিছুই বলতে পারো। তুমি সত্যিই অসাধারণ!", চিংকু বললো।
"তুমি যখন বড়ো হবে তখন তুমি এতো বেশি জানবে যে তোমার মনে হবে, আরে ধুর এলিস দেখি কিছুই জানে না!", এলিস হেসে উত্তর দিলো আর চিংকুকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো। ওরা দুজন হাঁটতে থাকলো। পাশে নীল সমুদ্র আর জোড়ালো বাতাস ছেড়ে চিংকু যেতেই চাচ্ছিলো না।
কক্সবাজার সফরের পুরোটাতেই চিংকু এলিসের সাথেই সময় কাটালো। এলিসের সাথে বীচে হাঁটলো, বালি দিয়ে ঘর বানালো, রিসোর্টের সুইমিং পুলে একটু আধটু সাঁতার কাটার চেষ্টা করলো, টেবিল টেনিসের টেবিল অনেক উঁচু থাকা সত্ত্বেও এলিসকে বারবার হারালো, আরো কত কি!
আর এই পুরো সময় জুড়ে আজিজ সাহেব আর সিলভিয়া কখনো মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়েই থাকলেন। রিসোর্টের মধ্যে ঘুরে ফিরে এপাশ ওপাশ বিভিন্ন দিক থেকে নিজেদের ছবি তুললেন, সেগুলো আবার সাথে সাথেই চেহারাদেখাও ডট কমে "ফ্যামিলি টাইম" লিখে পোস্ট করে কৃত্রিম জগতের মানুষদের অনেক ভালোবাসা কুড়ালেন।
এলিস চিংকুকে রাতে বারবার ওর মা বাবার সাথে ঘুমাতে পাঠাতে চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। চিংকু একেবারে নাছোড়বান্দা, ও এলিসের রুমে এলিসের সাথেই ঘুমাবে। তাছাড়া আজিজ সাহেব আর সিলভিয়ার দিক থেকেও তেমন কোনো সাড়া না পেয়ে এলিসও আর কিছু করতে পারেনি।
কক্সবাজার থেকে চলে আসার দিন গাড়িতে চিংকুর খুব ভালো সময় কাটছিলো। এলিস গাড়ি চালাচ্ছিল আর চিংকু এলিসের পাশে সামনের সিটে বসেছিল। চিংকু আর এলিসের কথা যেন থামছিলোই না। যদিও পিছনের সিটে বসে থাকে আজিজ সাহেব কিংবা সিলভিয়া কেউই চিংকু আর এলিসের আড্ডায় অংশ নেবার ব্যাপারে বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখাননি।
গাড়ি চালাতে চালাতেই এলিস চিংকুর সাথে বেশ কয়েকবার দাবাও খেললো। এলিস চিংকুকে নিজের দানগুলো বলে দিচ্ছিলো আর চিংকু সেগুলো ডিজিটাল চেসবোর্ডে বসিয়ে দিচ্ছিলো। প্রতিবারই চিংকু জিতে যাচ্ছিলো।
"আমি আর খেলবোই না! তোমার সাথে ইদানিং জেতাই যায় না", এলিস বললো।
"কেন? আরেকটু খেলো না, আরেকবার!", চিংকু হা হা করে হাসছিলো আর এলিসকে দাবায় হারা নিয়ে খোঁচা দিচ্ছিলো।
"চিংকু দেখেছো বাস আর ট্রাকের ড্রাইভারগুলো কিভাবে চালাচ্ছে? এদের সম্ভবত পাইলট হবার শখ ছিল”, এলিস বললো।
"কিভাবে বুঝলে?", চিংকু উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
“দেখছো না পাইলট হতে না পেরে এখন বাস আর ট্রাককেই এয়ারক্রাফট হিসেবে কল্পনা করে ওভাবেই চালাচ্ছে, মানে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যাকে বলে", এলিস চিংকুর দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। চিংকুও এলিসের অট্টহাসিতে যোগ দিলো।
আর ওটাই ছিল এলিস আর চিংকুর একসাথে শেষ হাসি। একটা অনেক বড় কন্টেইনার বোঝাই ট্রাক অন্য একটা বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চিংকুদের গাড়ির উপর উঠে গেলো।
*
আজকে বাংলাদেশের একশো পঁচিশতম বিজয় দিবস, সরকারি ছুটি। চিংকু বসার ঘরে বসে ওর অনেক বড় গোছানো শোকেসটার দিকে তাকিয়ে আছে। শোকেসে চিংকুর অনেক বিরল সংগ্রহ রাখা আছে, তবে সেগুলোর মধ্যে একটি জিনিস চিংকুকে প্রায়ই আবেগপ্রবণ করে তোলে, ওকে কাঁদায়।
কি আশ্চর্য ব্যাপার! একটা এতো বড় কন্টেইনারবাহী ট্রাক গাড়ির উপর উঠে গেলো, গাড়ির সবাই মুহূর্তের মাঝে শেষ হয়ে গেলো কিন্তু শরীরের ডান পাশে কিছু কাটাছেঁড়া আর রক্তপাত ছাড়া চিংকুর কিছুই হলো না।
ঐ দুর্ঘটনার পর অনেক বেশি ছোট অবস্থাতেই চিংকু অনেক বড় একটি শিক্ষা অর্জন করে ফেলেছিলো। বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার মতো বিষয়ে রক্তের সম্পর্ক জাতীয় বিষয়গুলোকে টেনে আনা একেবারে অর্থহীন। পারস্পরিক আস্থা, যোগাযোগ, স্পর্শই বন্ধুত্বের ভিত্তি। তা সে বন্ধুত্ব হোক মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে পশুর কিংবা মানুষের সাথে রোবটের।
শোকেসে রাখা সেই দুর্ঘটনার ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া এলিসের প্রসেসরের ভাঙা অংশটার দিকে তাকিয়ে চিংকু কান্নায় ভেঙে পড়লো।
রত্নদীপ তূর্য
মন্তব্য
তরতরিয়ে পড়ে ফেলার মত লেখা। ভালো লাগল। শেষের অনুচ্ছেদ দুটি একটু অন্যরকম ভাবে লিখলে আরো ভালো লাগত মনে হয়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ পড়ার জন্য। আপনার মন্তব্য আমি অবশ্যই মাথায় রাখবো। ভালো থাকবেন।
আপনার লেখা আগে পড়ি নি। এক লহমার মন্তব্য চোখে পড়ায় ভাবলাম পড়েই ফেলি। পড়লাম, ভালো লাগলো। কিন্তু আরও অনেক ভালো লেখার শক্তি রাখেন আপনি। এক লহমাকে ধন্যবাদ, আপনাকে শুভেচ্ছা।
---মোখলেস হোসেন।
আপনার মন্তব্যের জন্য এবং সময় পড়ার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ, আমি আরো ভালো লেখার চেষ্টা চালিয়ে যাবো নিশ্চয়।
নতুন মন্তব্য করুন