নগরী ঢাকা - ০৮

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৭/১২/২০২১ - ১২:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকাতে বিভিন্ন সময়ে সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে বেশ কিছু আবাসিক এলাকা ডিভেলপ করা হয়েছে। যেমন ধানমন্ডি , গুলশান, নিকেতন , পল্লবী, বনশ্রী , বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা বা বিভিন্ন ডিওএইচএস। সবগুলোই প্লট ভিত্তিক অর্গানাইজেশন। অর্থাৎ একটা বেসিক রোড নেটওয়ার্কের আওতায় কোনো এলাকাকে প্রথমেই ছোট ছোট ব্লকে ভাগ ক'রে নিয়ে তাতে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকার এবং আয়তনের প্লট তৈরী করা হয়। তারপর সেই প্লটগুলোকে এক বা একাধিক মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়।

প্লট ভিত্তিক এই 'এরিয়া ডিভেলপমেন্টের' ধারণা আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়। কারণ প্লট বুঝে পাওয়ার পর সেখানে ইচ্ছামাফিক বিল্ডিং বানিয়ে নেওয়া যায়। 'ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮' অনুযায়ী যদিও একাধিক প্লট একত্রিত করার সুযোগ আছে তবুও তেমনটা করতে খুব কমই দেখা যায়। ঢাকার বেশিরভাগ ভূমি-মালিক নিজ নিজ প্লটে আলাদা আলাদা বিল্ডিং নিজ উদ্যোগে অথবা বিভিন্ন ডিভেলপার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বানিয়ে নেন। যদিও ২০০৮ এর রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে বিল্ডিং বা ইমারত তৈরী করেন খুব কম লোক/ ডিভেলপার প্রতিষ্ঠান। তারপরও রাজউক আর নানা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্লটভিত্তিক একই ধরণের আরো প্রকল্প শুরু করছে এবং বাস্তবায়ন করছে। নতুন প্রকল্প শুরু করার আগে একই ধরণের পুরোনো প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বললেই চলে।

প্লটভিত্তিক প্রকল্পগুলো মূলত আবাসিক। হয়তো বড় কোনো প্রকল্পে কিছু অনাবাসিক বা অন্যান্য ব্যবহারের জন্য কিছু কিছু প্লট রাখা হচ্ছে। সেও আবাসিক প্লটগুলোকে সার্ভিস দেওয়ার কথা ভেবে নয়তো বিশেষ কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। সামগ্রিক নগর পরিকল্পনাকে মাথায় রেখে সেগুলো করা হচ্ছে ব'লে মনে হয় না।

চাহিদা বিবেচনা করে ঢাকাতে আবাসিক ব্যবহারের জন্য সাধারণত ২.৫, ৩, ৫, ৭.৫, ১০ এবং ২০ কাঠার প্লট তৈরী করা হয়। প্লটগুলো কমপক্ষে ২৫ ফুট চওড়া রাস্তার সাথে সংযুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয় ২০০৪ এর বেসরকারী ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা মোতাবেক। এতে ক'রে ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোতে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য তৈরী হচ্ছে। যেমন -

১. বারবার ফুটপাথ ভেঙে যাচ্ছে। ৩০ থেকে ৭০ ফুট পরপর প্লটে ঢোকার জন্য গেইট বা ফটক বানাতে হচ্ছে। আর প্রতিটা ফটকের সামনে থেকে ভেঙে ফেলতে হচ্ছে ফুটপাথের ধারাবাহিকতা। যার ফলে প্লটে বসবাস করা মানুষগুলোর পক্ষেও ফুটপাথগুলো ব্যবহার করা সুবিধাজনক থাকছে না। আর প্লটগুলোর ধার ঘেষে হাটাহাটি না ক'রতে পারার জন্য দীর্ঘ সময় পাশাপাশি বাস করেও অনেকেই অপরিচিত থাকছেন। আবার হাঁটাহাটির স্বাভাবিক আগ্রহটাও নষ্ট হ'য়ে যাচ্ছে হাঁটাকে উপভোগ করতে না পারার জন্য।

২. ঠিক কতগুলো প্লট বা ফ্লাটের জন্য কী পরিমাণ জমি খেলার মাঠ, পার্ক বা খোলা জায়গা হিসেবে থাকা দরকার, ঢাকা আর অন্য বড় শহরগুলোর জন্য বা নিদেন পক্ষে বাংলাদেশের জন্য, তা নিয়ে বিশেষ ভাবনা-চিন্তা আমাদের হাউজিং কোডগুলোতে নেই। একটা বড় এলাকার জমির পরিমাণের উপর নির্ভর ক'রে মাঠ আর পার্কের ব্যবস্থা করাটা অযৌক্তিক। বরং মাঠের সংস্থানের জন্য মূল বিবেচনা হওয়া দরকার হাউজিঙের ধরণ এবং তার জনঘনত্ব। বাস্তবক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে সেটা একধরণের প্রতারণাও। হয়তো হাউজিঙের লে-আউট পাস করিয়ে আনার জন্য একটা নকশা করা হয়, যে নকশাতে কিছু পরিমাণ জমি মাঠ বা পার্ক হিসেবে দেখানো হয়। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সেগুলোর অনেকগুলোই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে হাউজিংগুলোতে বাস করতে থাকা মানুষগুলোর জন্য খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকছে না যেখানে পরষ্পরের সাথে মেলামেশা করা যায়। এতে মানুষের স্বাভাবিক শেয়ারিঙের আকাঙ্ক্ষাটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আবার মানুষের একটা প্রবণতা হ'লো সে সবাইকে সব কিছু বলে না। একজন মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে বেশ ভাবনা-চিন্তা ক'রে নির্বাচিত কিছু মানুষের কাছেই মাত্র। আর তাই এমন একটা পরিবেশ দরকার যেখানে এই মানুষগুলোকে খুঁজে নেওয়া যবে। দেশের প্লট-কেন্দ্রিক হাউজিংগুলোতে সেই সুযোগ একেবারেই থাকছে না পর্যপ্ত মাঠ, পার্ক বা কমন-স্পেসের অভাবে।

৩. প্লটগুলো ছোট ছোট হওয়ায় তার সংখ্যাও বেশি হচ্ছে। আর প্রতিটা প্লটের জন্য আলাদা আলাদা ক'রে বিভিন্ন সার্ভিসের জন্য আবেদন ক'রতে সামগ্রিকভাবে বেশ বড় একটা সময় আর লোকবলের অপচয়ও হচ্ছে। আবার প্লটগুলোর মালিকেরা সবাই যে একই সাথে ভবন তৈরী করেন বা করতে পারেন তাও নয়। ফলে নানা সময় বিভিন্ন সার্ভিস লাইনের সাথে প্লটগুলোর সংযোগ তৈরী করতে হওয়ায় পানি বা গ্যাসের লাইনের জন্য বারবার হাউজিঙের রাস্তায় কাটাকাটির দরকার পড়ছে। আমাদের সার্ভিস দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষ লোকবল আর পর্যাপ্ত অর্থবল দুইয়েরই কমতি আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে সমন্বয়েরও অভাব আছে। আর তাই একবার কাটাকাটি হ'লে সেই রাস্তা ঠিক হ'তে সময় লেগে যায় অনেক।
অথচ প্লটগুলো যদি বড় বড় ক'রে করা যেতো, ধরা যাক ৫ একর বা ১০ একর, তাহলে বারবার সার্ভিস লাইনের জন্য দৌড়াতেও হ'তো না, বারবার ক'রে রাস্তা কাটাকাটিও করতে হ'তো না। ফুটপাথ বারবার ভেঙে যাওয়ার যে ব্যাপারটা আগে বলা হলো সেটাও কমে আসতো।

৪. বেসরকারী হাউজিঙের কোড বা বিধি ব'লছে প্রতিটা প্লটের সামনে ন্যুনতম ২৫ ফুট চওড়ার রাস্তা থাকতে হবে। এই পরিমাণ চাওড়া একটা রাস্তার সাথে যখন আমরা ৫৪ ফুট বা ৭০ ফুট গভীরতার প্লট বানাচ্ছি তখন ব্যবহৃত জমির অনুপাতে রাস্তার পরিমাণ বেশ বেড়ে যাচ্ছে। অমি অনেকগুলো হাউজিঙে গিয়ে দেখেছি এই ধরণের রাস্তাগুলোতে গাড়ি বা মানুষের ভিড় বেশ কমই থাকে। উত্তরা বা বসুন্ধরা এলাকার মূল রাস্তাগুলো বেশ ব্যস্ত হ'লেও প্লটগুলোর সামনের রাস্তাতে তেমন একটা ভিড় দেখা যায় কমই। এই রাস্তাগুলোকে যদি ৫ একর বা ১০ একরের হাউজিঙের অংশ ক'রে নেওয়া যেতো তাহলেও বেশ একটা সামাজিক-পরিসর গ'ড়ে উঠতো। আবার এমন ধরণের রোড-নেটওয়ার্কের জন্য অনেকগুলো নোডও তৈরী হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ক্রসিঙের সংখ্যা, যা যানজট তৈরীর অন্যতম প্রধান কারণ।

৫. ছোট প্লটে সাধারণত বেশি উঁচু ভবন (৭তলার অধিক) বানানো বেশ কঠিন। আবার বড় প্লটের সাপেক্ষে ছোট প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে বাড়তি খরচ পড়ে যায়। যেমন ৩ কাঠা জমির একটা ৭ তলা ভবনে যার প্রতিতলাতে একটি ক'রে এ্যাপর্টমেন্ট বা মহল আছে তার জন্য ন্যুনতম একটি সিঁড়ি ও একটি লিফ্ট দরকার পড়ে। একই সংখ্যক সিঁড়ি আর লিফ্ট দিয়ে প্রতিতলায় অন্তত ৪ টি মহল আছে এমন ৭ তলা ভবনকে সার্ভিস দেওয়া যায় অনায়াসেই। ৩ কাঠার চারটি প্লটকে একত্রিত ক'রে ১২ কাঠার একটি প্লট বানানো গেলে একই পরিমাণ জমিতে একই সুবিধা সম্বলিত ২৪টি মহল নির্মাণ করা যাবে ৩টি সিঁড়ি আর ৩টি লিফ্ট কম বানিয়েও। অবশ্য চাইলে অধিক উপযোগীতার জন্য একটি লিফ্ট বেশি বানানো যায়। ৩টি সিঁড়ি আর ২/৩টি লিফ্টের জন্য যে জায়গা লাগে সেই পরিমাণ জায়গা জমিতে উন্মুক্ত রেখে দেওয়া যেতে পারে ভবনের ব্যবহারকারীদের খেলার মাঠ হিসেবে। সেখানে কিছু ফলের গাছও লাগানো যেতে পারে। বাড়তি পরিমাণ জমি উন্মুক্ত থাকার কারণে তা বৃষ্টির পানি শোষণের জন্যও অধিক উপযোগী হ'তো।
১০ তলার অধিক উঁচু বিল্ডিঙের জন্য যে ধরণের সেট-ব্যাক বিধিমতে দরকার হয় সেটা ছাড়লে ছোট প্লটের জন্য উঁচু ভবন বানানো আরো কঠিন হ'য়ে পড়ে। আবার ভবনের এরিয়া বেড়ে গেলে বেশি পরিমাণে পার্কিঙের জায়গা লাগে। যান্ত্রিক পার্কিং পাতালঘরে (বেইজমেন্ট) করাটাই নানা বিচারে ভাল আর সুবিধাজনকও। কিন্তু ছোট প্লটের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক পাতালঘর বানিয়ে নেওয়াটা বেশ কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভবও। বেশি পরিমাণ রিটেইনিং-দেয়াল (মাটি আটকে রাখার জন্য পাতালঘরের চারপাশে যে দেয়াল তৈরী করা হয়) দরকার পড়ে ছোট প্লটগুলোতে বেইজমেন্ট বা পাতালঘর তৈরীর জন্য। র‍্যাম্প ব্যবহার ক'রে পার্কিঙের জন্য পাতালঘর তৈরী করতে হ'লে প্লটের আকার ৭.৫ কাঠার কম হ'লে কার্যত কোনো সুবিধাই পাওয়া যায় না।

৬. প্রতিটা প্লটকে আলাদা করা আর সেগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বানাতে হচ্ছে সীমানা-দেয়াল। এই সীমানা-দেয়ালের বৃদ্ধিও কম শংকার নয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খরচের পরিমাণও যায় বেড়ে। প্রয়োজন পড়ে অধিক সংখ্যক নিরাপত্তা-প্রহরী।

আবার বড় আকারের প্লটের সমন্বয়ে হাউজিং বা অন্য কোনো কমপ্লেক্স ক'রলে তার চারপাশে প্রাচীর তুলে দিতে হয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে। এই প্রাচীর পরবর্তীতে হ'য়ে দাঁড়ায় রুচিহীন পুরুষদের প্রস্রাব করার উপযুক্ত স্থান। দেশে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা সরকারী আবাসিক কলোনীগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটা জানি। আমাদের সামাজিক আচরণের পরিবর্তন না হ'লে নিরবচ্ছিন্ন ফুটপাথ তৈরী করা তাই এক রকম অসম্ভব।

সব মিলিয়ে প্লট-কেন্দ্রিক এই ধরণের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলাটা গত কয়েক যুগ ধ'রে অর্থনৈতিক বিবেচনায় বেশ উপযোগী হ'লেও প্রতিবেশ বা পাড়া (কমিউনিটি) তৈরীতে তা যে খুব সফল হয়নি তা বোধহয় এই ২০২১ সালে এসে বলা যায়। এই অবস্থায় আমাদের বর্তমান আবাসিক এলাকাগুলোকে খানিকটা রিএ্যারেঞ্জ বা পুনর্বিন্যাস করা যায় কিনা সেটা আমাদের নগর-পরিকল্পক আর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখতে পারেন। যেহেতু দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য দিনেদিনে বাড়ছে সেইহেতু শুধুমাত্র প্লট-কেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনার দুর্বলতাগুলো নিয়ে এখন আলোচনা করা যায় ব'লেই মনে করি।

পুনশ্চ:
১. 'প্লট ভিত্তিক অর্গানাইজেশন' এই কথাটার বাংলা ক'রতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু প্লট আর অর্গানাইজেশন শব্দদুটো যে অর্থে এখানে ব্যবহার করেছি তার জন্য যথাযত বাংলা শব্দ খুঁজে পাইনি। উৎসাহী পাঠকদের সাহায্য প্রত্যাশা করছি এই শব্দগুলোর বাংলা তৈরীতে।

২. শুধুমাত্র প্লট আর আবাসিক এলাকার ভেতরে আজকের আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি।

(রাজীব রহমান)


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

প্লটের বাংলা 'চক', যদিও শহুরে প্রসঙ্গে তেমন একটা ব্যবহৃত হতে দেখিনি। প্লট ভিত্তিক অর্গানাইজেশনের বাংলা হতে পারে চকবর্গ

জমি ডেভেলপ করাকে কি পরিনির্মাণ বলা যায়? ডেভেলপারকে সেক্ষেত্রে পরিনির্মাতা বলা চলে।

অতিথি লেখক এর ছবি

‌চাঁদনীচক যে চাঁদনীপ্লট মার্কেট হবে এটা একদমই ধারণা করতে পারতাম না। হাহা
নির্মাণের সাথে কন্সট্রাকশনের সম্পর্ক বেশি। ডিভেলপার একধরণের সমন্বয়কারী। কখনো কখনো ওদেরকে যে আবাসন ব্যবসায়ী বলা হয় সেটা খানিকটা যথাযত। তবে তাতে আবার সবটা প্রকাশ হয় না। ডিভেলপারের কাজ বিভিন্ন ধরণের ডিজাইনারদের কাছ থেকে চাহিদা মাফিক ডিজাইন করিয়ে নেওয়া, অথরিটির জন্য দরকারী কাগজপত্রের ব্যবস্থা করা, তারপর প্রকল্পের জন্য অর্থের সংস্থান ক'রে নির্মাণের যোগারযন্ত্র করা, তার জন্য নানা ধরণের নির্মাণকর্মীকে সিডিউল অনুসারে কাজে নিয়োগ করা, এবং এর ভেতরেই বিল্ডিংটাকে বিক্রির ব্যবস্থাও করা। 'পরিনির্মাতা' শব্দটা আমার পছন্দ হলেও এটাতে যেন ডিভেলপারের সবটা প্রকাশ হচ্ছে না ব'লে মনে হচ্ছে। তবু আপাতত কাজ চালিয়ে যাওয়া যাবে আশা করি।
(রাজীব)

হিমু এর ছবি

তবে তাতে আবার সবটা প্রকাশ হয় না।

সবটা প্রকাশ আসলে কোনো শব্দেই হয় না, কারণ শব্দের ঘাড়ে নানা অর্থ আমরা চাপাতেই থাকি। ডেভেলপারের কাজের পুরোটা কি আদৌ 'ডেভেলপার' শব্দটা দিয়ে বোঝায়? এমনকি 'নির্মাণ' শব্দটার মধ্যেও গড়া বোঝানোর মতো কিছু নেই, শুধু মাপার ব্যাপারটা আছে (নিঃ + মান)।

রাজীব রহমান এর ছবি

পুরাপুরিই একমত।

মর্ম এর ছবি

ভাল লেখা। যথেষ্ট নতুন চিন্তার খোরাক আছে।

তবে 'অপরিচিত' থেকে যাওয়াটা ভাবালো বাড়তি করে। আসলে কি আমরা আর পরিচিত হতে চাই, আসলে কি আমরা আস প্রতিবেশি নিয়ে ভাবি? এক একটা এপার্টমেন্টে যারা থাকেন তাঁদের কজনা কজনের সাথে পরিচিত?

নিজের কথাই ভেবে দেখলাম। বাড়ির মালিক ছাড়া কেবল অন্য একজন মালিক এবং ম্যানেজার আর দারোয়ান ছাড়া কাউকেই চিনি না।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

অতিথি লেখক এর ছবি

ইদানিং কালের সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত দেখে তো মনে হয় পরিচিত হ'তে আমরা চাইই। এটা খুব সম্ভবত মানুষের স্বাভাবিক মানবিক প্রবণতা (টেন্ডেনসি)। সেই সাথে মানুষের ভেতরে অন্য প্রবণতাও কাজ করে। যারা কখনো কখনো আপাত সাংঘর্ষিক। যেমন বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস প্রবণতা। নিজের সামাজিক চৌহদ্দির বাইরের কাউকে বিশ্বাস করাটা ঐতিহাসিক কারণে বেশ কঠিন। যদিও আবার মানুষ ব'লে ঠিকই বিশ্বাস করতে চাই। আবার শহুরে জীবন এতটাই ব্যস্ততার যে বাড়ির কাছের আরশিনগরের পড়শির জন্য সময় বের করা হ'য়ে ওঠে কমই। কিন্তু আমরা ঠিকই জানি বিপদে পড়শিই সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু চেনাজানা আর বিশ্বস্ততা গড়ে না ওঠায় হয়তো পড়শির কথা আমাদের মনেই আসে না।
কমিউনিটি ডিভেলপমেন্টের গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা অল্প হ'লেও সবাই বোঝে। বোঝে ব'লেই ওয়ার্কিং কমিউনিটি বা ফ্রাটারনিটি (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান/এ্যালামনাই) ভিত্তিক কমিউনিটি ঠিকই গড়ে উঠছে। ছোট শহরে প্রতিবেশি যেহেতু অনেকদিন পাশাপাশি বাস করে ফলে এক ধরণের জনাশোনা তৈরী হ'য়ে যায়ই। আর বড় শহরে যেহেতু মানুষকে বারবার বাসা বদল করতে হয় তাই প্রতিবেশির সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার ভাবনাটা কমে যায় বেশ। এই জন্য বলা হয় যে বড় শহরের প্রতিবেশি কেন্দ্রিক কমিউনিটি গড়ে ওঠাটা সহজাত নয়। তাকে ডিজাইন করতে হয়। এবং এই কমিউনিটি গড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ ডিজাইন করাটা সহজ কাজ নয়। তার একটা বড় কারণ এর সাথে এত বেশি সংখ্যক মানুষ আর প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকতে হয় যে তা সমন্বয় কারার মতো যোগ্য লোক/প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় না বেশিরভাগ সময়ই।
(রাজীব)

অতিথি লেখক এর ছবি

নগর পরিকল্পনা নিয়ে ভালো লেখা।

Shaid এর ছবি

শহুরে মানুষের মধ্যে কমিউনিটি গড়ে তোলার আধুনিক মাধ্যম হতে পারে "ফ্রেঞ্চ স্কয়ার" এর আদলে তৈরি রাস্তার মোড়।
ক্যাফে,চা টং, ছোটখাটো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান,সাপ্তাহিক হাট এবং পর্যাপ্ত বসার জায়গা এইসব থাকা জরুরি। তাছাড়া যেসব রাস্তাগুলোতে ট্রাফিক কম সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে বিকালে যাতে রাস্তাগুলো খেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার হতে পারে (সাঈদ)

রাজীব রহমান এর ছবি

ঢাকার সাথে ফ্রান্সের শহরগুলোর একটা বড় পার্থক্য হচ্ছে ভবনগুলোর গড় উচ্চতা। ঢাকার বর্তমান গ্রোথ রেট আর প্যাটার্ন যদি আরো কয়েক বছর চলতে থাকে তবে ঢাকার ভবনগুলোর গড় উচ্চতা ফ্রান্সের বড় শহরগুলোর থেকে বেশি হ'য়ে যাবে। হয়তো এখনই হয়ে গিয়েছে। আবার ঢাকার জনঘনত্ব যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৯০০০ এর বেশি, সেখানে প্যারিসের জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২১০০০ এর মতো। এবং ঢাকার জনঘনত্ব অনেক দ্রুত গতিতে বাড়ছে প্যারিসের তুলনায়। ফলে প্যারিসের মতো ক'রে এখানে কমিউনিটি গড়ে তোলা যাবে কিনা তা বলা কঠিন। আবার এই দুই শহরের বাসিন্দাদের নাগরিক-আচরণে বিস্তর পার্থক্যও আছে।
সব শহরের অস্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে কমিউনিটি গড়ে তোলার কৌশলটা চরিত্রগত ভাবে এক রকম হয় খুব কম ক্ষেত্রেই। ঢাকার জন্য কি ধরণের ডিজাইন সল্যিউশন এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে তা নিয়ে অনেক কাঠামোগত ভাবনা আর কাজের দরকার আছে। আমি আপাতত চাই সেই ভাবনা আর কাজের জন্য যোগ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। অন্যকে অনুকরণ ক'রে যেমন ঢাকা শহর গড়ে ওঠেনি, তার বিকাশেও তাই তাকে অনুকরণের পথে হাঁটতে হয়তো হবে না। কিংবা হয়তো ঠিকও হবে না, বিশেষ ক'রে ইউরোপের কোনো শহরের। স্থপতি চার্লস কুরিয়ারের 'ফর্ম ফলোস ক্লাইমেট' কথাটা মাথায় রেখে এটা বলা। ঢাকার ক্লাইমেটের সাথে ইউরোপের শহরগুলোর ক্লাইমেটের মিল পাওয়া যাবে না।

হিমু এর ছবি

আপনার এ মন্তব্যটা পড়ে একটা অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা যোগ করি, সেটা শহরে বৃষ্টির শব্দ নিয়ে। কিছুদিন আগে নজরুলের একটা গান বারবার শুনছিলাম, সেখানে দুটো চরণ এমন: বাদলপরীরা নাচে গগন-আঙিনায়, ঝমাঝম বৃষ্টির নূপুর পা'য়। বৃষ্টির সাথে নূপুরের তুলনা হুমায়ুন আজাদের কবিতায়ও আছে, ...বাজাও শ্রাবণরাত্রি নর্তকীর অজস্র নূপুরে...। আশেপাশে বেশ পত্রবহুল গাছ আর পুকুর (আর টিনের চাল) না থাকলে শহরের নিজস্ব কলরোল ছাপিয়ে বৃষ্টির এই শিঞ্জন শোনা কঠিন, বিশেষ করে ঢাকার মতো কংক্রিট-আক্রান্ত শহরে। ঠিক প্রাবল্য নয়, বরং বৃষ্টির শব্দের ঝমাঝম বৈশিষ্ট্যটা ধরে রাখা চাই। নগরনকশা যারা করেন, তাঁরা কি কোনো সমাধান দিতে পারেন?

প্রশ্ন উঠতে পারে, বৃষ্টির শব্দের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? বৃষ্টির শব্দ অবসাদ আর মানসিক চাপ কমায়। নগরে এর সংরক্ষণ নাগরিক-স্বাস্থ্যের জন্যেও জরুরি। কাক-চড়ুইয়ের ডাকের মতো এটা আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পদও বটে (শীতের দেশে যেমন তুষারপাতের পর চারদিকে শব্দ কমে আসে)।

রাজীব রহমান এর ছবি

শহরের আবাসযোগ্যতা আর ভবিষ্যসহতার জন্য বৃষ্টি আর বৃষ্টির পানির প্রয়োজনীয়তা অনেক। যদি শহরের চাতালে (হর্ড সারফেইস) পড়া বৃষ্টির পানি নালার মাধ্যমে শুধু দূরের নদীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাতে হয়তো রাস্তা-ঘাটের জলাবদ্ধতার ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া যাবে, শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না দীর্ঘ সময় ধ'রে। লেক বা জলাশয়ের উপস্থিতি পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরেই দেখা যায়। ২০/২৫ বছর আগেও ঢাকাতে বেসরকারী মালিকানায় অনেকগুলো পুকুর ছিলো। এখনো বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলা শহরে পুকুর/দীঘির উপস্থিতি দেখা যায়। যদিও তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসতে শুরু করেছে। এই পুকুর বা লেকগুলোকে ঘিরে অবশ্যই নানা ধরণের পরিকল্পনা সাজানো যায়।
বৃষ্টির পানির শব্দ সংক্রান্ত এই ভাবনাগুলো শহরপরিকল্পনার অংশ হ'তেই পারে। বরং বংলাদেশের শহরগুলো জন্য হওয়াটাই উচিত। বাঙালিদের সামাজিক স্মৃতিতে (কালেকটিভ মেমরি) নানা ধরণের পানির ঐকতান থাকাটাই স্বাভাবিক। মেঘের শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, নদীর স্রোতের শব্দ, ঝর্ণার শব্দ, সমুদ্রের শব্দ । জানি না বানের জলের শব্দ কেমন। হয়তো তারও কোনো ধরণ আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের ভেতরে একটা পুকুর আছে। যত দূর জানি পুকুরটা আগে থেকেই ছিলো। মাজহারুল ইসলাম ইন্সটিটিউটের ডিজাইনের সময় পুকুরটা খুব সুন্দর ভাবে রেখে দিয়েছেন। শীতের সময় পুকুরটা শুকিয়ে যায়। তবে কয়েকবার বৃষ্টির সময় ঐখানটাতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। নানা ধরণের গাছের পাতার উপর বৃষ্টির পানি পড়ার শব্দটা শুনতে দারুন লেগেছে। এমনকি ওখানে কিছু কচুপাতাও ছিলো/আছে। তার উপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ আবার অন্য রকম।
বৃষ্টির পানির গন্ধটাও কিন্তু খেয়াল করার মতো। যদিও তা পানিটা কোথায় পড়ছে তার উপর নির্ভর করে মূলত। ইয়োহান পালাসমা তার 'আইজ অব দ্য স্কিন' বইটাতে গন্ধের সাথে বাষ্পের সম্পর্ক নিয়ে মানুষের যে চিরায়ত ধারণা তা নিয়ে দারুণ কিছু কথা লিখে গিয়েছেন। ইউরোপীয়রা সেই কথাগুলোকে খুব আনকোরা বললেও, আমার কাছে তা মনে হয় না। মনে হয় এমন কথা আমি যেন আমার ছোট বেলায় অনেকের কাছেই শুনেছি। যদিও এখন আর মনে করতে পারি না ঠিক কার কাছে শুনেছি।
সব মিলিয়ে শহুরে শব্দ আর শহুরে গন্ধ একবারে হেলাফেলার বিষয় যে নয় তা মানি। হয়তো এগুলোও শহরের 'ইমেজ' তৈরীতে ভূমিকা রাখতে পারে। যে শহরে কারখানা বেশি তার শব্দ, গন্ধ প্রশাসনিক শহরের সাথে মেলে না।
তবে নগর পরিকল্পনাতে বড় জলাধারের বিষয়টা যতটা বিবেচনার সুযোগ থাকে ছোট ছোট জলাধারের ব্যাপারটা ততটা থাকে না। সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ভার কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বোধহয় নিতে রাজিও হবে না, বাস্তব কারণেই। শহরের কেউ যদি নির্দিষ্ট ক'রে বৃষ্টি হ'লেই তার শব্দ উপভোগ করতে চান, তবে তার জন্য স্থপতিদের সাহায্য নিতে হবে। বিশেষ ক'রে যারা ল্যান্ডস্কেইপ (বাংলা কি হ'তে পারে? ভূমিতল?) বিষয়ে দক্ষ।

হিমু এর ছবি

Landscape = ভূপট।

রাজীব রহমান এর ছবি

বাহ! খুবই যথাযত শব্দ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।