সেবা প্রকাশনীর সাথে পরিচয় তিন গোয়েন্দা’র ‘সবুজ ভূত’ বইখানা দিয়ে। তখনও বুঝতে পারিনি ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে একদিনে পড়ে শেষ করা এই বইটি টেনে নিয়ে যাবে কতদূর। তখনও বুঝতে পারিনি বিদেশি সাহিত্যের অচেনা ভাষার জগতে ঢুকে যাবো মায়ের ভাষায়।
আর তখনও জানতাম না, জীবনে আসতে চলেছে ‘মাসুদ রানা’।
বড়ভাইয়েরা পড়তেন মলাট লাগিয়ে। নাম-ধাম দেখার উপায় নেই। মুখের ভাব দেখে বুঝতাম, পুস্তিকাখানা উপাদেয়। কিন্তু আমরা পড়তে চাইলেই তাড়িয়ে দিতেন। কানমলা-নাকটানার ভয়ে কিছুদিন দূরে রইলাম। কিন্তু শেষে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি দুর্বার আকর্ষণ জয়ী হলো। তিন গোয়েন্দা’য় সওয়ার হয়ে ‘কুয়াশা’ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। এবং একসময় জোগাড় করে ফেললাম, সিরিজের প্রথম কাহিনী - ‘ধ্বংসপাহাড়’।
ভাষার গুণে, কাহিনীর বিন্যাসে আর বর্ণিল চরিত্রচিত্রণ দিয়ে পাঠক হিসেবে সেদিন থেকেই সাবালকত্বের শুরু।
### ‘রোল মডেল’ অথবা মানবিকতার নিভৃত বয়ান
নেহায়েত অ্যাকশন-এডভেঞ্চার ছিলো না মাসুদ রানা। লুবনার সাথে আমরা কেঁদেছি, গিলটি মিয়া’র সাথে হেসেছি, রাঙার মায়ের রান্নার স্বাদ কল্পনা করে জিভে পানি অনুভব করেছি, উ সেনের মতো শক্ত প্রতিপক্ষের দেখা পেয়ে শিহরিত হয়েছি।
আর সেই কবীর চৌধুরী! রানা’র সাথে একেবারে ‘রাশিতে পা দিয়ে শত্রুতা’ সত্ত্বেও কোথায় যেন একটু একটু মায়াও লেগেছে এই বিপথগামী প্রতিভার প্রতি। সেজন্যেই কি বারবার এই চরিত্র ঘুরেফিরে এসেছে সিরিজে? রানা-কবীর চৌধুরি’র পারস্পরিক রসায়নের এই দিকগুলো আমাদের অবচেতনে জায়গা করে নিয়েছে।
বড় হয়ে বুঝেছি, মানুষের হাজারদুয়ারি মন বিচিত্র সব মানবিক সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে সক্ষম। পাঠক হিসেবে এই সিরিজ কি আমার মধ্যে সেটার ছাপ রেখে গিয়েছিলো? যে চরিত্র ‘টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না’, সে কি আমাকে জড়িয়ে নিলো দেশপ্রেম আর মানবিকতার নিভৃত পাঠে? কে জানে!
অনেকের মতে, জীবনব্যাপী বহুবিচিত্র সম্পর্কের মাঝেও মানুষ আসলে একাই থেকে যায়। বিভিন্ন কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে মাসুদ রানা’র সেই একাকীত্বও আমাদের ছুঁয়ে গেছে। দেশপ্রেম, বন্ধুত্ব, সাহসিকতা আর অকুতোভয় স্বভাবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই একাকীত্ব এবং সেইসময়ের একান্ত ভাবনাগুলো নাড়া দিয়েছে পাঠক-মনন। কিন্তু সবার ওপরে, সব ছাপিয়ে সেই মানবিকতার পাঠই চূড়ান্ত।
মাসুদ রানা নিয়ে বিতর্ক ছিলো এবং আছে। মৌলিক বই নয়, বিদেশি সাহিত্যের আক্ষরিক অনুবাদ থেকে শুরু করে ইদানিংকালের শেখ আব্দুল হাকিম বনাম কাজী আনোয়ার হোসেন। কিন্তু খুন সংক্ষেপে কয়েকটা জিনিস ভেবে দেখলে, এসব বিতর্কগুলো অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
প্রথমতঃ সচেতন পাঠক মানেই জানেন যে, বাংলা সাহিত্যে সহজ পাঠের ব্যাপারটা ঠিক সহজ না। সত্যিকারের সহজ ভাষার মাধ্যমে ভবিষ্যতের অগণিত পাঠক তৈরিতে মাসুদ রানা তথা সেবা’র ভূমিকা অনস্বীকার্য। গতিশীল ভাষায় বইপাঠের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাবালক পাঠক তৈরি করায় সেবা’র ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। জোড়াসাঁকোর বুড়ো বলে গেছেন, প্রদীপ জ্বালানোর আগে ‘সলতে পাকানোর পর্ব’ থাকে। বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয়-নামী লেখক যে পরিণত পাঠককূলকে পেয়ে ধন্য হয়েছেন, ‘সেবা প্রকাশনী’ যে আগেই নেপথ্যে তাদের ভিত বেঁধে দিয়েছে - সেটা তলিয়ে না ভাবলে বোঝা যায় না।
দ্বিতীয়তঃ অত্যন্ত উঁচু মানের অনুবাদে বিদেশি সাহিত্যের সমৃদ্ধ জগতটাকে আমাদের সামনে খুলে ধরা। কি অসাধারণ সব কাজ হয়েছে! জুল ভার্ন, ওয়াল্টার স্কট, আলেক্সান্ডার দ্যুমা, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, মারিও পুজো আরও কত বিখ্যাত সব নাম! কাজীদা না থাকলে এসব নাম শুনতে বহুবছর লেগে যেত। আমার মতো অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো আদৌ শোনাই হতো না।
তৃতীয়তঃ প্রকাশনার ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশের আর কোন প্রকাশনী এমন ধারাবাহিকভাবে বই প্রকাশ করে যেতে পেরেছে, একবার ভেবে দেখি তো! মোটামুটি নব্বই শতক থেকেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প মূলতঃ ফেব্রুয়ারীর বইমেলা-কেন্দ্রিক। কারণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, সেটার উপযুক্ত জায়গাও এটা নয়। যা ঘটছে শুধু সেটার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। সেই জায়গায়, সেবা ক্রমাগত বই প্রকাশ করে গেছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটা যে কত দুরূহ কাজ তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আত্মনির্মাণ-লেখনীর বিদ্যুৎ-পুরুষ
হাল আমলে আন্তর্জাতিক বইবাজারে আত্মনির্মাণ সাহিত্যের জোয়ার চলছে। ‘হাউ টু’ বইগুলোর জন্যে লাইব্রেরীতে আলাদা সেকশন বরাদ্দ থাকে। অথচ সেই কোন যুগে আমরা পেয়েছি ‘সুখ-সমৃদ্ধি’, ‘জনপ্রিয়তা’, ‘আত্মনির্মাণ’, ‘ধূমপান ত্যাগে আত্মসম্মোহন’, ‘নিজেকে জানো’র মতো অসাধারণ সব বই।
কাজীদা নিজের নামে লিখতেন না। ছদ্মনামে লিখতেন - ‘বিদ্যুৎ মিত্র’। মিত্রই বটে। এখনও মনে আছে ‘সঠিক নিয়মে লেখাপড়া’ বইটাই ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার ‘সিক্রেট ওয়েপন’। ‘বিজ্ঞ’ সহপাঠীদের কাছ থেকে পাওয়া অনেক অবিদ্যা ঘুচেছিলো ‘যৌনবিষয়ে সাধারণ জ্ঞান’ বইটা পড়ে। বিপদজনক রকমের অসামাজিক আমার কিছুটা হলেও ‘আইস ব্রেকিং’ হয়েছে ‘জনপ্রিয়তা’র পাতায় ডুব দিয়ে।
আর শুধু নিজে লিখেছেন তাই না। লিখিয়েছেনও। মনে আছে, বিশু চৌধুরী’র ‘স্বর্ণশিখর’ বইটির কথা!
আর এ শুধু আমার না, হাজারো-লাখো মানুষের অভিজ্ঞতা।
রানা’র কোডনেম এমআর-নাইন। মাসুদ রানার দুই আদ্যাক্ষর আর অক্ষগুলোর সংখ্যা মিলিয়ে এই কোডনেম। কিন্তু ওই উঠতি বয়সে এর একটা ভিন্ন মানে ছিলো আমাদের কাছে।
আমাদের কাছে এমআর-নাইন মানে ছিলোঃ “মাস্ট রিড আফটার নাইন”।
কারণ সেসময়ের মফস্বল এলাকায়, রাত নয়টার দিকে অভিভাবকেরা ঘুমিয়ে যেতেন। আর তখনই রাত-জেগে-পড়াশুনোর আড়ালে শুরু হতো আমাদের ‘রানা-অভিযান’। নিশীথের এই ‘রিচুয়াল’ সুসম্পন্ন না করে ঘুমাতে যাওয়াটাকে আমরা প্রায় গুনাহ-এ-আজিম মনে করতাম।
কাজীদা, আপনি আজ চলে গেলেন!
সৃষ্টি তারুণ্যে জীবিত, আর স্বয়ং স্রষ্টা মৃত্যুর ওপারে! এটা কি এন্টি-ক্লাইম্যাক্স না!!
আপনাকে নিয়ে দু’ছত্র লিখবো, সে যোগ্যতা আমার একেবারেই নেই। এলোমেলো লেখাজুড়ে তাই রয়ে গেল ব্যক্তিগত বয়ানের অযোগ্যতার ছাপ। তবু না লিখে পারলাম না। ঋণ স্বীকারের এর চেয়ে ভালো উপায় এই অক্ষমের জানা নেই যে। শুধু ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ‘চলে যেতে দিতে হয়’।
‘অগ্নিপুরুষ’, আপনাকে বিদায়।
উই লাভ ইউ, ম্যান।
অলওয়েজ উইল।
--------------------------------
অন্ধকারে সবচেয়ে সে শরণ ভালো,
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
মন্তব্য
আশির দশকে শিশুর জগৎ পাঁচিলঘেরা উঠানের মতো। তার বিচরণ বাড়ি থেকে স্কুলে, খেলার মাঠে, কদাচিৎ এর-ওর বাড়িতে নিরানন্দ দায়সারা দাওয়াতে... আর হয়তো বছরে দু'তিনবার রেলভ্রমণ, চিড়িয়াখানা বা বিপণিতে ইতস্তত ঘুরপাক?
কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন সেই পাঁচিলের ওপর পা-ঝুলিয়ে-বসা বন্ধু প্রেত। প্রায় প্রতিদিন তিনি বিনা তর্কে একটা হাত বাড়িয়ে দিতেন, সেটা ধরে হাঁচড়েপাঁচড়ে ঐ পাঁচিলের ওপর উঠে ওপারে এক বিরাট বিশাল অচেনা পৃথিবী দেখতে পেতাম। নিরাপদে, নিশ্চিন্তে।
বিদায়, কাজীদা। আপনি আমাদের শৈশবের প্রমিথিউস।
এই এক লাইনই আবগের ক্যালেইডোস্কোপ।
হিমু, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
স্বরূপ-সন্ধানী
--------------------------------
অন্ধকারে সবচেয়ে সে শরণ ভালো,
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
আবেগের
স্যাম,
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
নতুন মন্তব্য করুন