এখন ভরা শীত। তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আজকে শীত একটু কমই বলা যায়! জানালার বাইরে প্রায় উলঙ্গ পপলার গাছটার জমানো তুষার টুপটাপ করে গলছে। এই গাছে কতগুলো কালোপাখি এসে বসে নিয়মিতই। ওদের নামই কালোপাখি, ব্লাকবার্ড। পঁচিশ থেকে ত্রিশ টা পাখি একসাথে এসে বসে আবার উড়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একসাথে ডেকে উঠে খুব দ্রুত ঝাঁক সহ উড়ে যায় কে জানে কোথায়। কিছুদিন ধরে দেখছি না ওদের। তবে ফিরে ওরা আসবে কদিন পরেই, জানিতো, এভাবেই দেখছি বহুদিন। হয়তো আসবে আগের দলটা না, অন্য কোনো একটা দল। যখন ওদের চোখের ওপর নিরুত্তাপ আকাশ ইচ্ছেমত ঝরে, ঠান্ডা জলের নিঃশ্বাস থেকে জমে জমে ওঠে মেঘ আর ওদের শীতল সঙ্গীত, তখন চুলোয় যায় ওদের নৈশভোজ। আর জানালার সামনের পপলার গাছটা ডুবন্ত চাঁদের শরীরে হেলান দিয়ে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে।
রবিবারের সকাল। আমার অনেক আশা আকাঙ্খার সময় এটা। প্রাত্যহিক কাজের ফিরিস্তি মাথায় নিয়ে, মেয়ের নাস্তা সারানো পর, রান্নার আয়োজনের মোটামুটি একটা বিহিত করেছি। আপাতত আধাঘণ্টার মতো নিভৃতে একটু জার্নালিং এর সময় পাবো।
এই অমূল্য সময়ে মেসেঞ্জারে কল। উঠতে উঠতে ভাবলাম, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে একমাত্র যে ব্যক্তির কল আমি রিসিভ করব, সে আমার মা। কিন্তু নাহ, মামনী কল দেয়নি। নাম দেখলাম নুশরাত জাহান শিম্মী। ভূ-ভাগে, শিম্মী আমার কল রিসিভের প্রায়োরিটি লিস্টে যুগ্মভাবে ভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছে। অন্য সময় হলে, কাজ শেষে মেসেজ দিতাম, স্যরি মিস্ড ইওর কল, ক্যান ইউ কল নাউ? কিন্তু বেচারি গতকাল মেসেজ দিয়েছিল, করোনা পজিটিভ। কল রিসিভ করলাম না, মরনাপন্ন অবস্থা কিনা, যদি মারা যায়, তখন একটা আক্ষেপ থেকেই যাবে, এই ভেবে কলটা ধরলাম।
একটু একটু গলা ভারি, ম্লান চেহারা, পাংশু চোখ শিম্মীর। বলল এক পর্যায়ে পুরো আনকন্শাস হয়ে গিয়েছিল, হসপিটালাইজ্ড হতে হয়েছিল। প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে একুশ তারিখে বাসায় ফিরেছে। মনে মনে ভাবলাম আমি কী খারাপ, কয় সপ্তাহ হয় শিম্মীর খবরই নিতে পারিনি, ‘ব্যস্ত’ শব্দটা বহু ব্যবহারে নিজের কাছেই এখন জীর্ণ লাগে।
-‘আমি যে কী দূর্বিসহ যন্ত্রনার মধ্যে ছিলাম রে, কিভাবে বোঝাবো’, বলল শিম্মী, ‘চোখ বন্ধ করতে পারি না, চোখ বন্ধ করলেই দেখি, অদ্ভুত কিসব জিনিস… আচ্ছা, আজকে কী বার রে?’
‘কী দেখিস, কী দেখিস? আজকে রবিবার। চোখ বন্ধ করলে কী দেখিস!’
-‘তুই ভাবতে পারবি না। দেখি, সব মেয়েদের বড় বড় দাড়ি, এক জাতীয় মানুষ, মনে হলো পুরুষ মানুষ, সেগুলো আবার দেখি খুব বামন আকৃতির। আর মনে কর এই দেখাটা স্বপ্ন যেমন, সেইরকম না। মানে, স্বপ্ন তো আমরা একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দেখি, কিন্তু এই অদ্ভুত ক্রিয়েচারগুলো কেমন যেন একদম চোখের এই এক ইঞ্চি সামনে, এমন ভাবে দেখছিলাম। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করতে পারি না, আবার ওর মধ্যে আমার ল্যজিকাল ব্রেইন এটাও বুঝতে পারছিল যে ডি এন এ লেভেলে একটা কোনও গোলমাল থেকেই মনে হয় এমন হচ্ছে বা অক্সিজেনের শর্টেজের কারণে ব্রেইন কাজ করছে না।’
মজা করা ঠিক হবে না এটা নিয়ে, তবু বললাম, ‘তোর ওই অবস্থায় পৌঁছতে শিল্পসাহিত্যের লোকজনকে অনেক চেষ্টা করতে হয়। তুই তো করোনা প্যাকেজের মধ্যেই সেটা পেলি।’
-‘শোন তুই একমাত্র মানুষ যে আমার এই কথাগুলো শুনবি, সেজন্যই ফোন করা।’
‘স্যরি। আর কী দেখলি বল, মনে আছে?’
-‘ভুলতে সময় লাগবে, তবে সব মনে নেই। ওই কয়দিন শব্দ খুব কানে বাজত, এখনও বাজে, অল্প শব্দেই যন্ত্রনা হচ্ছে। হসপিটালে একদিন শুনি, আমার পাশের বেডের মহিলা মারা গেছে, আমি আধো আধো ঘুমে, ইচ্ছা করেনি জেগে উঠতে। মহিলার মেয়ে মাতৃশোকে অনবরত কাঁদছে, খুব কাঁদছে। পরদিন নার্স কে জিজ্ঞেস করলাম। নার্স কিছু বলতে পারে না। পরে খোঁজ নিয়ে জানালো পাশের বিল্ডিংয়ের ঘটনা। কি লেভেলের শ্রবণ শক্তি হয়ে গিয়েছিল বলতে পারিস!'
‘বাব্বাহ!’
-‘আচ্ছা বাদ দে। তো, হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলাম পরশু। দেখি কাজী আনোয়ার হোসেন আর নেই। আমার তো এই শোক পালন করতে হবে, কিছুই ভালো লাগছে না, যে আমাকে এত দিল তাকে আমি কী দিলাম- এই রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে।’
‘কি করা যাবে বল, ওনার তো বয়সও হয়েছিল, মানুষ তো চিরদিন থাকে না।’
-‘এই মানুষটার যে বয়স হবে, সে যে একদিন থাকবে না এটা না মাথাতেই ছিল না।’
‘শোন, উনি যে মাপের মানুষ ছিলেন, বহু মানুষের মনের অবচেতন অর্ধচেতনে ওনার মারাত্মক ইমপ্যাক্ট! ওনার কাজ তো উনি করে রেখে গেছেন, জাগতিক মৃত্যুতে আর কী যায় আসে বল?’
-‘কি বলিস, আসে যায় না! আমার কত সময়, কত কষ্ট, কত অপেক্ষা, অনেককিছুর সাথে এই কাজী আনোয়ার হোসেন নামটা। স্কুলে যখন পড়তাম বৃত্তির টাকা দিয়ে কী কিনতাম? ওই বইগুলো। সিটি কলেজে যাবার সময় সায়েন্স ল্যাবের মোড় পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে যেতাম, ভাবতাম, আচ্ছা থাক এতোদূর যখন আসছি বাকিটাও হাঁটি, কয়টা টাকা বাঁচে, সেটা দিয়ে সেবা'র আরও বই পাওয়া যাবে। তখন ওখানে বাহার বুক হাউস না কী নামে যেন একটা বইয়ের দোকান ছিল, পুরাতন বই। সেই লোক পঞ্চাশ টাকায় সাত আটটা করে সেবা’র বই দিত। পড়ে ফেরত দিলে, তারপর আরও কতগুলো বই দিত, কী যে সময় সেটা। পাগলের মতো ডুবে থাকতাম...মাসুদ রানা, ওয়েস্টার্ন… তারপর এরিক মারিয়া রেমার্ক, হেনরী রাইডার হ্যাগার্ড, মার্ক টোয়েন, চার্লস ডিকেন্স, ড্যানিয়েল ডিফো এদের বই পড়ার সুযোগ ওই সময়ে আমাদের কিভাবে হতো! এখন মনে হচ্ছে সব এম্পটি।’
‘হ্যাঁ আমারও। কবে নতুন বই আসবে, কী যে অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষা, একটা ভয়- পড়ার বইয়ের ভেতর মাসুদ রানা, প্রিয় একটা সময়ের অপেক্ষা, কখন বাসার সবাই ঘুমাবে, এইসব স্মৃতি শুধু সুখের, আনন্দের না, তার চেয়েও বড় কোনও আবিষ্টতা। আমার এখনও মজা লাগে রবিনহুড এর কথা ভেবে। আমরা তখন দিনাজপুজে, এস এস সি- কেমিস্ট্রি পরীক্ষার আগে নয়দিন বন্ধ ছিল, সেই বন্ধে প্রথমে অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট পড়লাম (জাহিদ হাসান এর অনুবাদ), ওই দৃশ্যটা- পল বোমারের মৃত্যু দৃশ্য- মাথা থেকে যাচ্ছিল না, আর ওই শেষের দুটো লাইন ~ সম্ভবত এমন ছিলঃ “প্রজাপতি দুটো... (মনে আসছেনা) ...সূর্যের শেষ আলোয় জ্বলছে গীর্জার চূড়া, অপুর্ব সুন্দর পরিবেশ”। মাথা থেকে সেই লাইন বের করার জন্য, আমার সেই অপ্রকৃতস্থ ভাব দূর করার জন্য আবার রবিনহুড দ্বিতীয়বারের মতো পড়লাম, কানতে কানতে হতভাগ্য পাঠকের চোখ গেল। শেরউড জঙ্গল আঁকলাম রাত জেগে, রবিনহুডকে আঁকলাম…এরকম আরো কত স্মৃতি...
‘কিন্তু শিম্মী, এখন এমন কেন হচ্ছে? কাজী আনোয়ার হোসেন যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তো জানতেও পারিনি উনি অসুস্থ। অনেক দিন তো কোনও খবরই জানতাম না, যখন দেশে ছিলাম কই কোনও তো ক্রেজ ছিল না আমার যে একবার ওনাকে দেখতে যাই, দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে নাকি একদিন ওনাকে চোখের দেখা দেখা যায়। এখন কেন ওনার মৃত্যু তে আমার বা তোর এই অস্বাভাবিক খারাপ লাগা, কেন প্রাত্যহিক কাজে মনে দিতে পারছি না? মানুষতো চলেই যায় একদিন… বইগুলো তো আছে। মাসুদ রানা তো থাকবেই, তিন গোয়েন্দাও থাকবে, শাহনুর হোসেন, মায়মুর হোসেন ওনারা এখন যেমন লিখছেন তেমনই লিখবেন…’
-‘আসলে কি জানিস, এই যে সেবা, কাজী আনোয়ার হোসেন, এই শব্দগুলো না আমাদের কানে, মননে মগজে শ্রদ্ধাপূর্ণ কিছু শব্দ। কারণ এই শব্দগুলোর সাথেই জড়িয়ে আছে বিভোর হয়ে থাকা কোন এক সময়ের ভাবনাগুলো। সেই ভাবনা যে কত দূরে নিয়ে যায়… দূরের অতীত…যে অতীতে স্বপ্ন দেখতাম দূরাগত এক পৃথিবীর, অনেক কিছু না জেনে, না বুঝেও মনে হত কোন এক অদৃশ্য পথপ্রদর্শক আছে হয়তো অচেনা পৃথিবীর মানচিত্র হাতে ধরিয়ে দেবার জন্য। তারপরে আরো কত বই, আরও কত বিদেশী লেখকের নাম জানতে পেরেছি, লেখা পড়েছি, কিন্তু সেই যে কৈশোর তারুন্যের আমরা, আমরা সেইসব গল্প, অনুবাদের প্রাণবন্ত প্লটে, ভাষার মাধুর্য্যে ডুবে যেতে যেতে বাংলা ভাষাটাও কি বুঝে উঠিনি? মাতৃভাষা জানা আর বোঝা কি এক? কোন সময়ে বসে উনি কিভাবে ভাবতে পেরেছিলেন। একেই বলে মেগা ব্রেইন!...
আলাপ হয়তো আরও চলত, কিন্তু ওপাশে মনে হয় শিম্মীর বাসায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে।
আমি শিম্মী কে “পারলে ওই অল্টার্ড স্টেটের ব্যাপারে পরে আরেকটু জানাস” - মেসেজ পাঠিয়ে কাজে মন দিলাম।
যে মানুষের স্বপ্ন থেকেই তরতর করে এক প্রানবন্ত বাংলা ভাষার রূপে অতি অল্প দামে আমাদের হাতে এসেছে বিশ্বসাহিত্যের চুনিপান্নাগুলো, যে মানুষের প্যীয়ার মেন্টরিং এ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের অসাধারণ সব অনুবাদকেরা, যে তাঁর পাঠককূলকে বাটুলের মতো ছুঁড়ে দিয়েছে এক ভিন্ন ভুবনের আনাচে কানাচে, যে মানুষ বহু মানুষের চেতনার, নৈতিক বিকাশের অদৃশ্য পথপ্রদর্শক, যে মানুষ একাধিক প্রজন্মের পরম্পরায় কিশোর-তরুণ-যুবা মনগুলোকে একেবারে যাকে বলে নিগূঢ়, সূক্ষ্ম উপায়ে সাইজ করে দিয়েছে, তাঁর অবদানোপযোগী মানানসই কোনও অ্যাওয়ার্ড কি কোনও প্রতিষ্ঠান তাকে আদৌ দিতে পারত? মনে তো হয় না। পুরষ্কারের গৌরবের মোহ যাঁর ছিল না, যে শুধু আড়ালে আড়ালে পাঠককূলের হৃদয়নিঙড়ানো ভালোবাসা পেয়েই মজে থেকেছে, তাঁর সম্মানের মানানসই স্বীকৃতি সেবা’র দেশে এবং বিদেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জোটবদ্ধ পাঠককূলই কেবল দিতে পারে, অন্য কেউ নয়।
কাজী আনোয়ার হোসেন এর মৃত্যুতে এই যে আমাদের অস্পষ্ট বিষাদময়, অশরীরী শোক, শোকতাপ তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে কাজে মন দেয়া, আর এই অপূর্ণতাকে ঘিরে যে গুমোট মনোভাব ইত্যাদির পুরোটাই কী এক্সপ্রেস করা সম্ভব? নাকি আমাদের মনোজগতে দীর্ঘকালব্যাপি তাঁর অবদানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের যে যোগফল, সেটা নিরূপণযোগ্য? নাকি দুখানুভুতির লিখিত রূপদানের অতসব ভাষা আমার জানা আছে? কিছু মানুষ, মানে কাজী আনোয়ার হোসেনের মতো স্বপ্নাদ্যোপান্ত-কর্মী মানুষ হয়তো যাবার আগে একটা জনগোষ্ঠী তৈরি করেই যান, যারা তাঁর অনুপস্থিতির এবং অবদানের মানানসই পুরষ্কারের দুষ্প্রাপ্যতার যে মনঃকষ্ট সেটার একটা আনট্রান্সলেট্যাব্ল অংশ মনে মনে বয়েই বেড়াবে।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন