কিছুদিন আগে আল জাজিরার একটা পুরনো ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম - 'I Knew Saddam'। বুঝতেই পারছেন সাবেক ইরাকি একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের উপর বানানো সেটা। থাম্বনেইলে খাকি পোশাকে সাদ্দাম, মোটামুটি অল্পবয়স্ক তখনো, চোখমুখে ভাঁজ পড়েনি, কিন্তু চেহারার ক্রুর ভাবটা ঠিকই আছে। যে চেহারা অহর্নিশ টানা চব্বিশ বছর ধরে দেখতে হয়েছিল ইরাকের মানুষকে।
সাদ্দামের আরেকটি ছবিও আমার মনে দাগ কেটে আছে। কালো স্যুট, মাথায় কালো হ্যাট, হাতে বন্দুক নিয়ে সাদ্দাম হাসিমুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে গুলি ছুঁড়ছেন, সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন। চোখেমুখে সে কি আত্মবিশ্বাস, পুরো ইরাক যে তার হাতের মুঠোয়!
ইউটিউবে সাদ্দামের একটা ভিডিও পাওয়া যায়, ১৯৭৯ সালে বাথ পার্টি কনভেনশনের, সাদ্দাম নিজেই সেটা ভিডিও করানোর ব্যাবস্থা করেছিলেন। সেখানে শুরুতে দেখা যায় য্র খুব শান্ত ভংগীতে তিনি জানাচ্ছন যে বাথ পার্টির ভেতর কিছু বিশ্বাসঘাতক আছে এবং এখন তাদের নাম পড়ে শোনানো হবে। তাদের পরিনতি কি হতে যাচ্ছে সেটা বুঝতে কারো খুব একটা অসুবিধা হবার কথা না।আমি নিশ্চিত সেই অডিটোরিয়ামের ভেতরে যারা সেদিন ছিলেন তারা নিজের হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছিলেন। একটা একটা করে নাম পড়া হচ্ছিল আর একজন একজন করে তাদের রুম থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল। একজন হাত জোড় করে অনেক অনুনয় বিনয় করলেন, লাভ হলনা, নির্বিকার সাদ্দাম আয়েশ করে হাভানা চুরুটে টান দিয়ে তখন ভাবনায় মশগুল, এসব নাকি কান্না শোনার তার সময় কই?
২০০৩ এর ডিসেম্বরে যখন আমেরিকানরা গর্ত থেকে সেই সাদ্দামকেই বের করল, তাকে চেনাই যাচ্ছিল না। ময়লা দাঁড়িগোঁফভর্তি মুখ আর শরীর দেখে হাসিই পাচ্ছিল আমার, সেই ছবিটিও তাই মনে দাগ কেটে আছে। সাদ্দামের শেষ ভিডিওটাও মনে রাখার মত, তার ফাঁসীতে ঝোলানোর ঠিক আগে আগে, মোবাইল ক্যামেরায় তোলা বলে বেশ অস্পষ্ট যদিও। তুমুল হট্টগোল, চারপাশে ঘিরে থাকা ইরাকি রক্ষীরা তাকে গালাগাল করছে, তুলনায় সাদ্দাম অনেকটা শান্ত, সমাহিত। মৃত্যুর ঠিক আগে এরকম শান্ত থাকতে পারাটা অবশ্য কৃতিত্বের। কিন্তু শেষবারের মত কালেমা পড়ার সময় তার কি একটু হলেও অনুশোচনা হয়েছিল? ভেসে উঠেছিল কি অসংখ্য কুর্দি, শিয়া এমনকি সুন্নির মুখ? তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের, বা তার দুই জামাতাদের যাদের তিনি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইরাকে ফিরিয়ে এনে তারপর হত্যা করিয়েছিলেন?
সাদ্দামের লিবিয়ান কাউন্টারপার্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুও একইরকম শোচনীয়, যদিও গাদ্দাফি শেষ পর্যন্ত সাদ্দামের মত শান্ত থাকতে পারেননি। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে গাদ্দাফি লিবিয়ার ক্ষমতায় বসেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতারও আগে, সেই ১৯৬৯ সালে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের জোয়ারে যখন লিবিয়া টালমাটাল, তখন ক্ষমতা ছেড়ে দিলে আমার ধারনা তিনি বেঁচেও যেতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি শেষ পর্যন্ত জোর খাটাতে গিয়েছেন। কে জানে সাদ্দামের অন্তিম পরিনতি দেখেই হয়তোবা সেই সিদ্ধান্ত নেয়া।
লাভ হয়নি, পালিয়ে যাবার সময় লিবিয়ান বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়েন। গাদ্দাফির শেষ ভিডিওটাও সম্ভবত মোবাইল ফোনেই করা, সেখানেও তুমুল হট্টগোল, আরবিতে চিৎকার চ্যাঁচামেচি, সাথে গাদ্দাফির রক্তাক্ত মুখ। সেই দৃশ্য দেখে ঘোর শত্রুরও তার প্রতি খানিকটা মায়া অনুভব করা অসম্ভব না। কিন্তু সবচেয়ে অবাক হয়েছি মার খাবার সময় বিদ্রোহীদের কাছে করা তার প্রশ্ন শুনে। তার জীবনের শেষ প্রশ্ন ছিল - "আমি তোমাদের কি ক্ষতি করেছি"? সিরিয়াসলি? বিয়াল্লিশ বছর ধরে আঁকড়ে রাখা ক্ষমতা কি মানুষকে এতটাই বোধহীন করে দিতে পারে? এতটাই বাস্তবতা থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে?
"One death is a tragedy, a million deaths a statistics" - সত্যাসত্য জানিনা তবে এ কথাটা জোসেফ স্তালিনের বলে বাজারে চালু আছে। উনত্রিশ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীশ্বর বনে থাকা স্তালিন কথাটা যদি নাও বলে থাকেন, বিশ্বাস করতেন বলে আমার ধারনা। অন্তত " a million deaths a statistics" অংশটুকু। ঠিক কত লোক যে তার শাসনামলে মারা গেছে সেটার ইয়ত্তা নেই। তার মধ্যে আছে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, ভিন্ন মতালম্বী বা সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর সিনিয়র সদস্যরা যাদের স্তালিন নিজের জন্য হুমকি মনে করতেন। এমনকি নিজের চিকিৎসকদের ও তিনি সন্দেহের চোখে দেখতেন। স্বাস্থ্যগত দিক চিন্তা করে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়ায় তিনি কয়েকজন চিকিৎসককেও জেলে পুরেছিলেন।
প্রায় কাউকেই বিশ্বাস না করা স্তালিনের শেষ দিনগুলোর নিত্যকার রুটিন ছিল তার বিশ্বস্ত চার সাংঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে, সিনেমা দেখা আর ভোর পর্যন্ত গল্পগুজব করে তারপর ঘুমাতে যাওয়া। ১৯৫৩ এর ২৮ ফেব্রুয়ারী একইভাবে সারারাত আড্ডাবাজি করে ভোরবেলাতে চার সংগীকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তাকে সজ্ঞানে সেই শেষবার দেখা গিয়েছিল। সারাদিন তার কোন সাড়াশব্দ না পেলেও কারো সাহস হয়নি স্তালিনের রুমে ঢোকার। শেষে রাত সাড়ে দশটায় বাড়ির প্রহরী (কেউ কেউ বলেন যে গৃহপরিচারিকা) রুমে ঢুকে দেখেন স্তালিন মেঝেতে নিশ্চল পড়ে আছেন। মেঝে মুত্রে একেবারে ভেসে যাচ্ছে। সম্ভবত স্তালিন পানি খেতে উঠেছিলেন, তখন স্ট্রোক করেন। পরে ডাক্তাররা দেখেন শরীরের ডানপাশ অচল, ব্লাড প্রেশার ১৯০/১১০। এর পাঁচদিন পর ৫ মার্চ রাত দশটার দিকে মারা যান প্রায় ত্রিশ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে থাকা স্তালিন।
ঠিক কখন স্ট্রোক করেছিলেন সেটা জানা যায়নি কিন্তু আমার এটা ভাবতে ভালো লাগে যে স্তালিন সাথে সাথে অচেতন হন নি। জ্ঞান হারানোর আগে নিজের মুত্রের উপর শুয়ে একপাশ অচল অবস্থায় নিজের অসহায় অবস্থাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও হয়তো অনুভব করেছিলেন, খানিকটা অনুতাপে পুড়েছিলেন, খানিকটা অনুশোচনায় ভুগেছিলেন। এ পৃথিবীতে বেশিরভাগ সময়ই ন্যায়বিচার মেলেনা, খানিকটা 'পোয়েটিক জাস্টিস' তো আমি তাই চাইতেই পারি!
গত শতাব্দীর সবচেয়ে কুখ্যাত একনায়ক অবশ্য উপরের তিনজনের মত এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকেন নি। তার 'থার্ড রাইখ' হাজার বছর পৃথিবী শাসন করবে এমন স্বপ্ন দেখলেও সেটা বারো বছরের বেশি টেকেনি। কিন্তু এই বারো বছরেই যে হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসলীলা এডল্ফ হিটলার চালিয়েছেন, সেটা তাকে হাজার বছর মনে রাখার জন্য যথেষ্ট। বাকি তিনজনের থেকে তার মৃত্যুও আলাদা, আত্মহত্যা হবার কারনে নিজের মৃত্যুক্ষনটুকু নিজের ঠিক করা ছিল। তবে সেটা কি অন্য মৃত্যুর চেয়ে সহজ কিনা সেটা অবশ্য আমি নিশ্চিত নই।
১৯৪৫ এর ৩০ এপ্রিল বিকেলে নিজের খুলির দিকে বন্দুক তাক করে ট্রিগার চাপার আগে তার কেমন লেগেছিল সেটা কখনো আমরা জানতে পারব না। রাইখ চ্যান্সেলারির নীচে নিজের জন্য বানানো দূর্ভেদ্য বাংকারে টিমটিমে আলোয় সোফার অন্যপাশে দীর্ঘদিনের সংগীনি এবং সদ্য স্ত্রী ইভা ব্রাউন ততক্ষণে সায়ানাইড মুখে দিয়ে এলিয়ে পড়েছেন। বাংকারের ভেতর থেকে গোলার শব্দ শোনা না গেলেও তিনি ততক্ষণে জানেন সোভিয়েত রেড আর্মি আর মাত্র পাঁচশ মিটার দূরে। শেষ জার্মান বুলেটটা খরচ হতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি। তাকে জ্যান্ত পেলে সোভিয়েতরা কি করবে সেটা বুঝতে তার কষ্ট হবার কোন কারন নেই। তখন কি ক্ষনিকের জন্যও তার মনে হয়েছিল খামাখা এই বিশাল হুলস্থুল যুদ্ধটা না বাধালেও হত? ছবি আঁকা আঁকি করে (হিটলার ভাল ছবি আঁকতেন বলে পড়েছি কোথাও) ভিয়েনা শহরে(হিটলার কিন্তু জন্মসূত্রে জার্মান নন, অস্ট্রিয়ান) ঝামেলাহীন জীবন পার করে দিলে আজ আর এই মুহূর্তটি জীবনে আসত না?
যে চারজনকে নিয়ে এই লেখা ফাঁদলাম এরা রুই কাতলা লেভেলের (বা হাঙর তিমি), এর বাইরেও এ পৃথিবী বহু পরাক্রমশালী ব্যাক্তিত্ব দেখেছে। এবং এদের পৃথিবী দেখে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। ইংরেজ কবি শেলির একটা বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে Ozymandias। ওযিম্যান্ডিয়াস হচ্ছে প্রাচীন মিশরের ফারাও র্যামেসিস-২ এর গ্রিক রুপান্তরিত নাম। কবিতায় দূরদেশ থেকে ফেরা এক পর্যটক কবিকে দূরদেশে (মিশর) এক মরুভূমিতে পড়ে থাকা দুটো বড় পাথরের টুকরোর গল্প বলেন। মনে হচ্ছিল টুকরো দুটো বিশাল কোন মূর্তির অংশ, সম্ভবত কোন প্রভাবশালী সম্রাটের (ওযিম্যান্ডিয়াস)। একটা টুকরো হচ্ছে মূর্তির দুটো পা, খানিক দূরে পড়ে থাকা আরেকটি টুকরো হচ্ছে মূর্তির মাথা। বালিতে অর্ধেক দেবে থাকা সেই মাথা আর দুটো পা ছাড়া বাকি অংশ কালের স্রোতে কোথায় হারিয়ে গেছে! চারিদিক জুড়ে শুধু ধুধু বালি আর বালিয়াড়ি! বেদীতে খোদাই করে লেখা ওযিম্যান্ডিয়াসের সদম্ভ উচ্চারণ অবশ্য তখনও টিকে আছে, খালি ওযিম্যান্ডিয়াস আর নেই! কারন পৃথিবীর কোন ওযিম্যান্ডিয়াসই অনন্তকাল টিকে থাকতে পারবেন না।
'And on the pedestal these words appear:
“My name is Ozymandias, king of kings:
Look on my works, ye Mighty, and despair!”
Nothing beside remains. Round the decay
Of that colossal wreck, boundless and bare
The lone and level sands stretch far away. '
- Percy Bysshe Shelley (Ozymandias, 1818)
- গগন শিরীষ
মন্তব্য
ভালো লেগেছে।
পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ!
মুল বক্তব্যটি জার্মান সাংবাদিক ও লেখক কুর্ট টুকোলস্কির লেখায় প্রথম পাওয়া যায় (“ The death of one man: this is a catastrophe. Hundreds of thousands of deaths: that is a statistic!”)
ধন্যবাদ পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য। এটা জানা ছিল না।
পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ!
শেলির কবিতা থেকে আমাদের হরিদাস পাল কবিতাটা ভালো।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
কেন ভাই, আমার তো কবিতাটা বেশ ভালই লাগল!
নতুন মন্তব্য করুন