প্রবাসে বসে দেশের সিনেমা দেখার সুযোগ সঙ্গত বিভিন্ন কারণে সীমিত। 'হাওয়া' সে সব সীমানা পেরিয়ে আমার নাগালে আসার পর দেখে ফেললাম চটপট।
সিনেমা দেখার পর আমার মনে প্রথম যে চিন্তাটি এল, তা হচ্ছে, আমাদের দেশে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের পদে অবিবেচক ব্যক্তিরা বসে আছেন। বন্য প্রাণীর স্বার্থ রক্ষাকারী আমলারা খাঁচায় বন্দী শালিক নিয়ে মামলা করেছিলেন যাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে, সেই প্রাণী কল্যাণ অ্যাকটিভিস্টদের বিবেচনা ও সততা নিয়েও ঘোর সন্দেহ তৈরি হয়েছে আমার মনে। চলচ্চিত্রের বিকাশের খাতিরে সব বুনো পশুপাখি খাঁচায় ভরে দেখাতেই হবে, এমন কোন কথা নেই। কিন্তু গল্পের খাতিরে যদি সে প্রাণীর ক্ষতি না করে তা দেখানো যায়, সমস্যা কোথায়? "চলচ্চিত্রের দৃশ্য দেখে লোকে শালিক মেরে খাবে", এ যুক্তি দিলে চলচ্চিত্রে চুরি ডাকাতি খুন ধর্ষণ কিছুই দেখাতে পারার কথা না। সমাজে যা ঘটে, যা পত্রিকার পাতায় আসে, তা সিনেমাতেও দেখান যাবে -- এটাই সিনেমা নির্মাতার সমাজ-স্বীকৃত অধিকার হোক।
আমার মনে হাজির দ্বিতীয় চিন্তাটি হচ্ছে, সিনেমা যে 'মোশন পিকচার্স', সেটা 'হাওয়া' বহুদিন পর ভাল করে বুঝিয়ে দিল। ছবির গুণে এর প্রায় প্রতিটি মিনিট উপভোগ্য। সিনেমার গল্প গভীর সাগরে, যদিও ড্রোন থেকে নেওয়া (?) কয়েকটি দৃশ্যে সবুজ সাগর দেখে অগভীর পানি মনে হয়েছে। তারপরও দর্শকের মন ফ্রেমের সৌন্দর্যে ভুলে থাকতে পারে।
'হাওয়া'র শব্দ সম্পাদনা আমার কানে খুব ভাল লেগেছে। থিয়েটারের সাউন্ড সিস্টেমের বামে আর ডানের স্পীকারে মাছধরা নৌকার পোর্ট আর স্টারবোর্ডে জেলেদের বিচ্ছিন্ন হাঁকডাক শুনে মনে হয়েছে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমিও চান মাঝির নৌকায় চলে এসেছি। 'আটটা বাজে দেরি করিস না' গানটা উর্কেস-পার্কেসের সাথে যেভাবে ফ্রেমের সাপেক্ষে কাছে থেকে দূরে চলে গেছে, তা শুনে ইমপ্রেসড হয়েছি। 'সাদা সাদা কালা কালা' গানটার উৎকৃষ্ট কোরিওগ্রাফি গল্পের মেজাজকে খুব সুন্দরভাবে ধরে রেখেছে।
কলাকুশলীদের অভিনয় আগাগোড়া ভাল লেগেছে। তবে চরিত্রগুলো শুরুতে উপকূলীয় বাগেরহাট অঞ্চলের টানে কথা শুরু করে মাঝপথে হঠাৎ হঠাৎ ঢাকাই টানে চলে এসেছে (বিশেষ করে 'ইবা'র চরিত্রে শরীফুল রাজের সংলাপে), যেটা বাংলাদেশের নাটক-সিনেমার নিরাময়-অযোগ্য রোগ। এক্সপ্রেশন বিচারে সব শিল্পীকেই স্যালুট দিতে চাই। চঞ্চল চৌধুরী যেখানে হাজির, সেখানে অন্যদের নিয়ে কথা কম হয়, তাই 'নাগু' চরিত্রে নাসিরউদ্দীন খানের জন্য আরও জোরে হাততালি দিতে চাই। 'উর্কেস' চরিত্রে সোহেল মন্ডলের চড়া তারের হাবাগোবা হাসি (বিশেষ করে বেদেনীর আশেপাশে) আর inconsolable কান্না সিনেমার গল্পের সাথে ভাল মিশেছে বলে মনে হয়েছে। নাজিফা তুষির নির্বাক অবয়বনির্ভর অভিনয় মনোহর ছিল। সব মিলিয়ে কাস্টিং বা শিল্পীবাছাই ভাল হয়েছে।
'হাওয়া'র শিল্প নির্দেশনা আলাদা প্রশংসা আর কড়া কথার দাবীদার। নৌকার অজস্র খুঁটিনাটি সেখানে দক্ষভাবে দেখান হয়েছে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কিন্তু যখন এতবড় মাছধরা নৌকায় ছোট্ট একটা পাল টাঙ্গান হয়, তখন একটু চোখে লেগেছে। ঐ সাইজের পাল ঐ উচ্চতায় খাটালে চান মাঝির নৌকা দিনে এক নট গতিতে সামনে বাড়লেও বাড়তে পারে। এটা যদি জেলেদের সামষ্টিক মানসিক বিকলতা বোঝানর জন্য দেখান হয়, তাহলে হয়ত একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। আমি জানতাম বেদেরা নদীবর্তী গ্রাম ঘিরে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করেন, সমুদ্রে বেদে নৌকার কথা শুনে মনে খটকা লেগেছে যা এখনও দূর হয়নি। কেউ যদি এ ব্যাপারে আলোচনা করেন, তাহলে উপকার পাই।
আলোক সম্পাতের গুণে নৌকায় রাতের দৃশ্যগুলি সিনেমাকে নিয়ে গেছে ভিন্ন উচ্চতায়। 'হাওয়া' কেন ভাল লেগেছে, এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দিতে হলে আমি এটাই বলব, সমুদ্রে নৌকায় কাটান রাত পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য করে দেখানর গুণে। মেকআপ আর্টিস্টদের কাজও ভাল লেগেছে, জেলেদের রোদে পোড়া রুক্ষ চেহারা সুন্দর ফুটেছে। তবে কয়েকটা শটে চান মাঝির পা দেখান হয়েছে, সেটা দেশের সমুদ্রজীবীর কড়াওঠা পা বলে মনে হয়নি, শহুরে চঞ্চল চৌধুরীর জুতা থেকে বের হওয়া পা বলে মনে হয়েছে।
কিন্তু যে ব্যাপারটি ভাল লাগেনি, তা হচ্ছে 'হাওয়া'র গল্পের শেষ অর্ধেক। এর প্রথম অর্ধেকের স্টোরিটেলিং অপূর্ব, ডিটেইলের কাজ অনুকরণীয়। গভীর সমুদ্রে নৌকায় ঘটনার ফেরে এক রহস্যময়ী মূক সুন্দরী এসে উপস্থিত। তার নির্বাক উপস্থিতিই যেন এক জাদুর বলে নৌকা আর জেলেদের ভাগ্যে সূক্ষ সব পরিবর্তন আনে। কী দারুণ আইডিয়া! কিন্তু পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার সুমন যখনই মেয়েটির মুখে শব্দ তুলে দিলেন, তখন থেকেই গল্পের পতন শুরু, আর একেবারে লেজে-গোবরে করে এর শেষ। শুধু অভিনয়ের গুণে শিল্পীরা শেষ অর্ধেকটা কোনমতে ধরে রেখেছিলেন। 'হাওয়া' নামকরণের সার্থকতাও আমার এন্টেনা এড়িয়ে গেছে, কিন্তু সেটা আমার নিজের অজ্ঞতা হতে পারে। সুমন সাহেবের সাথে কখনো দেখা হলে আমি তাঁর হাত ধরে অনুনয় করব, পরের সিনেমায় যেন তিনি এভাবে একটা জাদুবাস্তব গল্পকে চূড়ায় তুলে নিয়ে আছাড় না মারেন।
সিনেমার কথা বলতে গেলে অনিচ্ছায় নানা স্পয়লার চলে আসে। সে কাজ যারা করে তাদের আমি মন থেকে অপছন্দ করি। তাই নিজে এমন কিছু করতে চাই না। যতটুকু বললাম, তা 'হাওয়া'র নানা ট্রেলারে দেখান হয়েছে। যতটা সম্ভব রেখেঢেকে বলি, একটি চরিত্রের অতীত ভূমিকা ভিন্ন ও বিতর্কিত, যার সাথে এই সামুদ্রিক সুন্দরীর যোগ আছে। গল্পের এই ধারাটা যদি মেয়েটিকে মূক রেখে, তার রহস্য অটুট রেখে, তার কার্যকলাপে অলৌকিকের ছোঁয়াচ বিশ্বাসযোগ্য করে ধরে রেখে বাকি চরিত্রদের টুকটাক কথোপকথন বা খোদ সেই চরিত্রের মৃদু স্মৃতিচারণ দিয়ে দর্শকের কাছে তুলে ধরা হতো, আমরা একটি দশে দশ (বা দশে বারো) সিনেমা পেতাম। তার পরিবর্তে 'হাওয়া'কে দশে সাত দিতে হচ্ছে। আলমগীর কবীরের 'সীমানা পেরিয়ে' যারা দেখেছেন, তারা হয়তো আমার কষ্ট বুঝবেন।
আরেকটা কথা, শুরুতে পর্দায় 'হাওয়া' নামটার টাইপোগ্রাফি আমার খুব ভাল লেগেছে।
সব শেষে 'হাওয়া' সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই তাঁদের স্পর্ধার জন্য। একটা গল্পকে আগাগোড়া সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে পর্দায় দেখানর সাহস এতদিনে আর কারো হয়নি। আশা করি সিনেমাটি তুমুল ব্যবসায়িক সাফল্য পাবে, আর নির্মাতারা এমন আরো স্পর্ধার সুষমা মাখা কাজ আমাদের জন্য করবেন। অনন্ত জলিল আর ফারুকী মার্কা নির্মাতাদের একঘেয়ে আবোলতাবোল কাজের ভিড়ে 'হাওয়া' এক দারুণ রিফ্রেশিং এক্সপিরিয়েন্স এনে দিল। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
----- (আসিফ)
মন্তব্য
হাওয়া দেখে একটা কথেই মনে হয়েছে
আগে গল্প কী, তার প্রথম পাঠটাই আমাদের নেয়া আগে জরুরি।
কী বলবো না জানলে
কীভাবে বলবো তা তালগোল পাকিয়ে যাবে।
কয়েকটা ভাল দৃশ্য দেখতে গেলে
সিনেমার বদলে মিউজিক ভিডিও দেখা ভাল।
ওখানে অনেক ম্যাজিক রিয়েলিজমের কারিশমা দেখা যায়-
অযৌক্তিতার যৌক্তিক সম্পর্ক খুঁজে বের করা যায়।
‘আয়নাবাজি’র পরে ‘হাওয়া’র সাফল্য
সিনেমা কতটুকু এগোলো সেটা নয়-
এটাই প্রমাণ করে
আমাদের দেশের বিজ্ঞাপন এগিয়েছে।
একটা শূন্যতার গোলকের মধ্যে
সাত-সমুদ্র পুরে দেয়া দিয়ে
একটা হাওয়াই সাম্পানে পাপিয়ে
সেই সমুদ্র জয়ের আনন্দ
আমাদের জন্য তৈরি করতে পারে
মোহনীয় এক ঐন্দ্রজালিক দক্ষতায়-
সেই উলঙ্গ রাজার গায়ে পড়িয়ে দিতে পারে
ঝলমলে আলোয়ান-
এই মন্তব্যটা করার সময় মনে পড়ছিল
আয়নাবাজি নিয়ে এই তুখোড় সমালোচনাটা-
আয়নাবাজি: অতীত বদলাবে, ভবিষ্যৎ বদলাবে না
আসলেই, অর্ধযুগ কাটিয়া গেল, ভবিষ্যৎ বদলাইলো না-
Inconsolable এর বাংলা দুঃশমনীয়।
নতুন মন্তব্য করুন