পরদিন শুক্রবার হওয়ায় আকরাম সাহেবকে অফিসে যেতে হলনা। এমনিতেও উনি অফিসে যেতে পারতেন না। কারন আঙ্গুল বিশ্রীভাবে ফুলে গেছে, সাথে প্রচন্ড ব্যাথা। মেসের যেই ছেলেটা সকালে চা দিয়ে যায়, তাকে তিনি এক মগ কুসুম গরম পানি আনতে পাঠালেন। কুসুম গরম পানিতে আঙ্গুল ডুবিয়ে রাখলে যদি কিছু উপকার হয়। ছেলেটা কুসুম গরম পানির পরিবর্তে টগবগে গরম পানি দিয়ে গেছে। আকরাম সাহেব বামহাতে ঠান্ডা পানির মগ নিয়ে গরম পানির সাথে মেশানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ঠিকমত পানির তাপমাত্রা ঠাহর করতে পারেননি। ডানহাতের ব্যাথায় ফুলে যাওয়া আঙ্গুলে ঠিকমত অনুভূতিও নেই। ফলে আঙ্গুল পুড়ে গিয়ে চামড়া উঠে গেল। ব্যাথা যেমন আছে তেমনি রইলো, কাজের কাজ কিছু হলনা।
চা আর এনার্জি বিস্কুট দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে, বেলা এগারোটার দিকে আকরাম সাহেব মেসের পাশের রাস্তার বেলাল ফার্মেসিতে গেলেন। ফার্মেসির মালিক বেলাল হোসেন আকরাম সাহেবের পরিচিত। ছোটখাট জ্বর, সর্দি-কাশিতে বেলাল সাহেব-ই উনাকে ঔষধ-পত্র দিয়ে থাকেন, ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হয়না।
উনাকে দেখে বেলাল সাহেব হাসিমুখে বললেনঃ আসেন আসেন, শুক্রবার না হলে তো আপনার দেখাই পাওয়া যায়না! চা দিতে বলি?
না, চা খাবোনা, মানে আঙ্গুলটা একটু ফুলে গেছে।
বলেন কি! কিভাবে?
আকরাম সাহেব শুকনো মুখে বললেনঃ মাছের কাঁটা ফুটেছে বোধহয়।
তিনি তো গতকাল রাতে ভাত-ই খাননি। কাঁটা আর ফুটবে কোথা থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্বপ্নের ব্যাপারটা ব্যাখা করতে ইচ্ছা করছে না।
বেলাল সাহেব আঙ্গুল দেখে চিন্তিত মুখে বললেন, আপনি একটু বসেন। ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ নিয়ে যান।
বেলাল ফার্মেসিতে সবসময়-ই সদ্য পাশ করা একজন ডাক্তার দুবেলা বসেন। সকাল ১০:৩০ থেকে ১২:৩০ আবার বিকাল ৫ টা থেকে ৭ টা। এরা ভালো চাকরি-বাকরির ব্যাবস্থা হওয়ার আগ পর্যন্ত বাসার কাছের ফার্মেসিতে বসে। ভালো চাকরির সুযোগ হলে উধাও হয়ে যায়।
শুক্রবার জুম্মার নামাজের আগে বলেই বোধহয় বেশি রোগী ছিলোনা। বিশ মিনিটের মাঝেই আকরাম সাহেবের ডাক পড়লো। যা ভেবেছিলেন তাই, অল্পবয়সী ডাক্তার, ডাঃ ফাহিমুজ্জামান খান । আকরাম সাহেব অস্বস্তি বোধ করছেন। স্বপ্নের ব্যাপারটা বলবেন কিনা তিনি ঠিক করে উঠতে পারলেন না। তবে ডাক্তারকে বেশ করিৎকর্মা বলেই মনে হলো। প্রথমে সে আঙ্গুল ফোলার কারণ-ই জানতে চাইলোনা। টর্চ দিয়ে আঙ্গুল পরীক্ষা করে বললো মনে হচ্ছে চামড়ার নিচে কিছু একটা আঁটকে আছে, কেটে বের করা প্রয়োজন।
দশ মিনিটের মাথায় ডা. ফাহিম স্কালপেল দিয়ে কেটে, ফোরসেপে টেনে যেই বস্তু বের করে আনলেন সেটা রুই মাছের কাঁটার সাইজেরই বটে, কিন্তু কাঁটার মত ফকফকে সাদা না। হালকা ধূসর বর্ণের, প্লাস্টিকের মত, কিন্তু আবার পরিচিত কোন প্লাস্টিক-ও না,জৈব পদার্থ বলেই মনে হচ্ছে। ফোরসেপে ধরে ফাহিম কাঁটাটা একটা প্যাথোলোজি স্পেসিমেনের কৌটায় রাখলেন।
ক্ষতটা ড্রেসিং করতে করতে ডাক্তার বললেন এবার বলুন, কাঁটা কখন ঢুকলো? গতকাল রাতে খাওয়ার সময়?
আমি গতকাল রাতে ভাত-ই খাইনি। মাছ-কাটা এসব তো অনেক দূরের ব্যাপার।
তাহলে? অবাক হয়ে তাকালেন ডাঃ ফাহিম।
আকরাম সাহেব ইতস্তত অগোছালো ভাবে স্বপ্নের ব্যাপারটা বর্ণনা করলেন। তিনি ভেবেছিলেন ডাক্তার তাঁর কথা শুনতে শুনতে হেসে ফেলবে।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন তার মানে আপনার ধারণা স্বপ্নের জগত থেকে এই জিনিস আপনার হাতে বিঁধে গেছে?
আকরাম সাহেব চুপ করে রইলেন।
আপনি কি বুঝতে পারছেন যে আপনি যা বলছেন তা অসম্ভব একটা ব্যাপার?
জ্বী বুঝতে পারছি। কিন্তু আর কোন ব্যাখাও তো নেই।
কে বলেছে আর কোন ব্যাখা নেই?
আকরাম সাহেব উৎসাহী গলায় বললেনঃ ব্যাখাটা কি?
ডাঃ ফাহিম খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললোঃ আপনি সন্ধ্যায় একবার আসতে পারবেন? সন্ধ্যায় আপনার ঘটনার ব্যাখা দেয়া হবে।
আকরাম সাহেব অবাক হয়ে বললেনঃ কেন? এখনই বলে দিন।
ফাহিম বললঃ আরে আমি জানলে তো বলবো। বিকালবেলা আমি আপনাকে আমার স্যার ডাঃ হারুন মুনশির কাছে নিয়ে যাবো। উনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। স্যারের অনেক বুদ্ধি। উনাকে পুরো বিষয়টা বললে আমি নিশ্চিত উনি একটা গ্রহনযোগ্য ব্যাখা দিতে পারবেন। আর আপনি কি গত দশ বছরে কখনও টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়েছেন?
ঠিক জানিনা।
তাহলে যাওয়ার সময় বেলাল সাহেবের কাছ থেকে একটা টিটেনাস ইঞ্জেকশান দিয়ে যাবেন। একবার দিলে পরবর্তী দশ বছরে আর না দিলেও চলে। যেহেতু আপনার মনে নেই আপনি আগে কখনও দিয়েছেন কিনা, তাই এখন একটা নিয়ে নিন। কোন ক্ষতি নেই। আর ৭ টার দিকে চলে আসুন। দেখি আপনার রহস্যের সমাধান করা যায় কিনা।
আকরাম সাহেব চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফাহিম কাঁটাটার দিকে তাকিয়ে রইলো। আকরাম সাহেবকে স্যারের কাছে নিয়ে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো উনার মন থেকে এই অর্থহীন ভয়টা দূর করা। শরীরের অসুখ দূর করা প্রায় ক্ষেত্রেই সহজ, মনের অসুখ দূর করা সহজ নয়। ডাঃ ফাহিম তার রোগীর রোগ সমূলে বিনাশ করতে চায়, আধাআধি কাজ করা তার পছন্দ না।
ডাঃ হারুন মুনশি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। এই বিষয়টা ফাহিম গোপন করেছে। বাংলাদেশের মানুষ বদ্ধ উন্মাদ না হওয়া পর্যন্ত মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যেতে চায়না। কিন্তু এই ঘটনাটা স্যার কিভাবে ব্যাখা করেন তা জানতে ফাহিমের খুব ইচ্ছা করছে। ব্যাপারটা আকরাম সাহেবের জন্যও জরুরি। তাই সে আকরাম সাহেবকে স্যারের চেম্বারে না নিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে। আকরাম সাহেব বুঝতেই পারবেন না যে তিনি মনোরোগ চিকিৎসক। তবে ভদ্রলোক বিকালে আসবেন কিনা কে জানে! কাঁটা বের করে ফেলা হয়েছে, ল্যাটা চুকে গেছে। মানসিক সন্দেহ নিয়ে কে অত মাথা ঘামায়?
ফাহিমের সন্দেহ ভুল প্রমাণিত করে আকরাম সাহেব সময়মতই বেলাল ফার্মেসিতে উপস্থিত হলেন। ফার্মেসিতে অপেক্ষারত রোগীদের জন্য কাঠের বেঞ্চে বসার ব্যাবস্থা। তিনি সুস্থমত বসতে পারছেন না, বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। কারণ কোমরে নেয়া টিটেনাস ইঞ্জেকশন। ইঞ্জেকশন নেয়ার সময় ফারমাসিস্ট বেলাল সাহেব বলেছিলেন আপনি বুঝতেই পারবেন না কখন ইঞ্জেকশন দিলাম! পিপড়ার কামড়ের মত একটু লাগতে পারে। পিপড়ার কামরের এখন এই অবস্থা! কুকুরের কামড়ের মত ব্যাথা হচ্ছে। তিনি অবশ্য কুকুরের কামড় কখনো খাননি। খেলে নাকি নাভিতে ১৩ টা ইঞ্জেকশান দিতে হয়। সেই ইঞ্জেকশান যদি বেলাল ফার্মেসি থেকে নিতে হয় তাহলে ইঞ্জেকশনের ব্যাথাতেই রোগী কুকুরের কামড়ের ব্যাথা ভুলে যাবে বলে আকরাম সাহেবের ধারণা।
ফাহিম রোগী দেখা শেষ করে আকরাম সাহেবকে নিয়ে ডাঃ হারুন মুনশীর বাসার উদ্দেশ্যে রিকশা নিল। ফাহিম টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছে। বিশেষ সুবিধা হচ্ছেনা। আকরাম সাহেবকে তার কাছে বেশ চাপা স্বভাবের বলে মনে হচ্ছে। পেটে এটম বোমা মেরে মেরে কথা বের করতে হচ্ছে। সব কথার জবাব এই লোক হু-হা এর মাঝে দেয়ার চেষ্টা করে।
ডাঃ হারুন মুনশীর বসার ঘরের সোফায় বসে আকরাম সাহেব কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন। কোমরের ব্যাথা বেশ কমেছে। কাজের ছেলে চা আর কেক দিয়ে গেছে। ফাহিম আরাম করে খাচ্ছে, আহা বেচারা, রোগী দেখার ফাঁকে সম্ভবত বিকালের নাস্তা করারও ফুরসত হয়নি।
ডাঃ মুনশী বললেন- আপনি পুরো ব্যাপারটা শুরু থেকে পুরোটা বলুন। কিছু বাদ দেবেন না।
আকরাম সাহেব স্বপ্নের ব্যাপারটা পুরোটা খুলে বললেন। সাথে এ-ও বললেন যে তিনি গতকাল রাতে ভাত খান নি। মাছ খাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
ডাঃ মুনশী বললেন – মাছের কাঁটাটা একটু দেখি।
ফাহিম পকেট থেকে কাঁটার কৌটাটা বের করে দিল।
হুম, মাছের কাঁটার মত আকৃতি-ই বটে। কিন্তু রংটা ঠিক মাছের কাঁটার মত নয়। আচ্ছা আকরাম সাহেব, আপনি গতকাল অফিস করেছেন?
জ্বী, গিয়েছিলাম।
অফিস থেকে কিভাবে ফিরেছেন?
বাসে করে।
এমন কি হতে পারে যে বাসের দরজার হাতল ধরে উঠা কিংবা নামার সময়, কিংবা বাসের পুরাতন সীট থেকে কোন পাতলা ধাতুর টুকরা হাতে ঢুকে গেছে? যেটা আপনি তখন খেয়াল করেন নি। পরে যখন আঙ্গুল ফুলে উঠলো তখন টের পেলেন।
জ্বী হতে পারে। কিন্তু বস্তুটার আকৃতি তো মাছের কাঁটার মত সরু।
ডাঃ মুনশী চশমার উপর দিয়ে আকরাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন- এইটা ঠিক, বাস থেকে হাতে ঢুকে যাওয়া ধাতব টুকরার আকারের বিবেচনায় এই কৌটার ভিতরের জিনিসটার আকৃতি একটু খাপছাড়া, কিন্তু স্বপ্নের জগত থেকে কোন কিছু আপনি আঙ্গুলে করে আমাদের পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন এই ধারণাটাও তো আরও বেশী খাপছাড়া, তাইনা?
আকরাম সাহেব মাথা নিচু করে বললেন- জ্বী
যখন দুইটা খাপছাড়া বিষয় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন যেই ব্যাখ্যাটা অধিকতর কম খাপছাড়া সেটাকে মেনে নিতে হয়।
আকরাম সাহেব চুপ করে রইলেন।
ডাঃ মুনশী বললেন- সত্যি কথা বলতে কি, আপনি এই পৃথিবীতে প্রথম লোক নন যে দাবী করেছে স্বপ্নের জগত থেকে কোন কিছু আপনার কাছে চলে এসেছে। প্যারালাল ইউনিভার্সের ধারণা বিজ্ঞানে আছে। কিন্তু সেগুলি সবই হাইপোথিসিস, ফ্যাক্ট না। তবে আমি এটাও বলছিনা যে কাঁটা-টা আপনার স্বপ্নের জগত থেকে আসেনি। কিন্তু আমি বলতে চাইছি এই ধারণাটা আপনার মনে বদ্ধমুল হতে দেয়াটা ঠিক হবেনা। মানে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপারটা বিপদজনক হতে পারে। আপনি কি জানেন মানুষ কখন স্বপ্ন দেখে।
জ্বী -না।
যখন মানুষের ঘুম ভালো হয়না, কোন কারনে হালকা হয়, তখন। তাই আমরা সবসময় স্বপ্ন দেখি ঘুম ভাঙ্গার আগে আগে। যখন চোখের পাতা কাপতে থাকে, যাকে বলে র্যাপিড আই মুভমেন্ট। এমনো তো হতে পারে আপনার আঙ্গুলে আগে থেকেই এই জিনিসটা ফুটে ছিলো বলে আপনার ঘুম ভালো হয়নি। কিংবা আপনি যেই মেসে থাকেন সেই মেসের অন্যান্য বোর্ডাররা রাতে গল্পগুজব করছিলো, যেই শব্দের কারনে ঘুম ভালো হয়নি।
জ্বী গতকাল রাতে অবশ্য পাশের রুমে অনেকেই কার্ড খেলছিলো। অবশ্য তাতে আমার ঘুমের কোন সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয়না।
রিসেন্টলি আপনার ঘুমের অভ্যাসে কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? এমন কোন পরিবর্তন যেটা আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
আকরাম সাহেব কিছুক্ষন ভেবে বললেন- আমি গতকাল একটা নতুন বালিশ কিনেছি।
ডাঃ মুনশী বললেন- আপনি বালিশটা ব্যাবহার করা বাদ দিন, আগের বালিশটা-ই ব্যাবহার করুন। নতুন বিছানা-বালিশে অনেক সময় ঘুম ভালো হয়না।
ফাহিম বলল স্যার উনিতো কখনো গ্রামে থাকেন নি, মাছ ধরার প্রশ্নই আসেনা। তাহলে এমন স্বপ্ন দেখার কি কারণ থাকতে পারে?
ডাঃ মুনশী বললেন- উনি নিজে মাছ ধরেননি, কিন্তু টিভিতে তো দেখেছেন কখনো না কখনো, যে গ্রাম দেখতে কেমন, মাছ কিভাবে ধরতে হয় ইত্যাদি। মস্তিষ্ক খুবই জটিল জিনিস, কখন যে কিসের সাথে কি জোড়া দিয়ে কি দেখায় সেটা বলা মুশকিল। ইনফ্যাক্ট স্বপ্ন ব্যাপারটাও রহস্যময়। ধারণা করা হয় মানুষ যা কিছু দেখে তার পুরোটা সাথে সাথে স্মৃতিতে জমা হয়না। মস্তিষ্ক কিছু অংশ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রাখে, পরে গুছিয়ে রাখবে বলে। ঘুম হল সেই গুছিয়ে রাখার সময়। মানুষ যখন ঘুমায় তখন মস্তিষ্ক স্মৃতিগুলিকে বিভিন্ন সেলে সাজিয়ে রাখে। তাই আমরা আশেপাশে যা দেখি সেগুলো-ই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্বপ্নে ফিরে আসে। এই হচ্ছে মোটামুটিভাবে স্বপ্নের প্রচলিত বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা। তবে তারপরেও কিছু কিছু স্বপ্ন মানুষ কেন দেখছে সেটা ঠিক করে বলা যাচ্ছেনা, একদম-ই ব্যাখ্যাতীত।
ডাঃ মুনশী কৌটোটা হাতে নিয়ে ভিতরের কাঁটার মত জিনিসটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হচ্ছে উনার নিজের ব্যাখ্যায় উনি নিজেই সন্তুষ্ট নন।
রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ ফাহিম আকরাম সাহেবকে নিয়ে ডাঃ মুনশীর বাসা থেকে বের হয়ে এলো। আকরাম সাহেবকে রিকশায় তুলে দেবার সময় ফাহিম বললো- বলছিলাম যে আপনি কি কাঁটাটা আপনার কাছে রেখে দিতে চান, যদি চান তাহলে আমি আপনাকে দিতে পারি কিন্তু তার আগে আমি কিছুদিন সেটা আমার কাছে রাখতে চাই।
আকরাম সাহেব বললেন- আপনি ওটা একেবারেই রেখে দিন। ওটার আর আমার প্রয়োজন কি? আর আপনি আমার জন্য অনেক করলেন, আজকাল এতটা কেউ করেনা। যদি আপনার জন্য কখনও কিছু করতে পারি, খুব ভালো লাগবে।
মেসে ফিরে এসে আকরাম সাহেব ডাইনিঙে বসে আরাম করে রাতের খাবার খেলেন। খিদেও পেয়েছে খুব। রুই মাছের মুড়িঘণ্ট আর গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত। মেসের বাবুর্চি সাধারণত ভালো রাঁধেনা। তবে আজকের রান্নাটা ভালো হয়েছে। আকরাম সাহেবের কৌতুহল সাধারণ পর্যায়ের চেয়েও একটু কম। সবকিছু জানতে হবে, কিংবা সব রহস্যের কিনারা থাকবে এটা তিনি মনেই করেন না। তাঁর মতে সব কিছু জেনে গেলে বেঁচে থাকাতে ইন্টারেস্টিং কিছু থাকেনা। ডাঃ মুনশীর কাছে যাওয়াটাই তাঁর জন্য বেশি, আঙ্গুল থেকে আপদ বের হয়েছে, টিটেনাস দেয়া হয়েছে, যথেষ্ট! তবে ডাঃ মুনশীর কাছে যাওয়াটা একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। উনি এই বিড়ম্বনা উনার জীবনে আর চান না। ডাঃ মুনশীর নতুন বালিশ পরিত্যাগ করার পরামর্শটা হয়ত কাজে লাগবে। ঘুমের আর ব্যাঘাত হবেনা। উনার ভালো একটা ঘুম দরকার, গভীর ঘুম। রাতে শুয়ে তিনি নতুন বালিশটা পায়ের কাছে সরিয়ে রাখলেন, কালকেই এই আপদ বিদায় করতে হবে। কিছুক্ষণের মাঝে গাঢ় ঘুম তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো।
পরদিন সকালে বেশ দেরীতে আকরাম সাহেবের ঘুম ভাংলো। রাতে মোবাইলে এলার্ম দিতে ভুলে গেছেন। তিনি আর সেদিন অফিস গেলেন না। হাত মুখ ধুয়ে নাশতা করে বালিশটা সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। নীলক্ষেতে যে দোকান থেকে তিনি বালিশ কিনেছেন সেই দোকানটা খুঁজে বের করলেন। দোকানে ছোকরামত একজন বসে আছে। গত পরশু যেই দুইজন জোয়ান ছেলে দোকানের সামনে কাপড় বিছিয়ে তুলো ফেলে বড় বড় লাঠি দিয়ে ধুনছিলো, তারা আজও ধুনছে। মালিক ছোকরা তাদের কাজ বিনা কারণে তদারক করছে।
আকরাম সাহেব বললেন- আচ্ছা এই দোকানে একজন বুড়োমত লোক বসেন না?
ছোকরা বলল- কে বুড়া?
যার কাছ থেকে আমি এই বালিশটা গত পরশু কিনেছি।
এরকম কেউ এখানে নাই। থাকলেও লাভ নাই।
লাভ নাই কেন?
আমরা বেচা মাল ফেরত নেই না।
আকরাম সাহেব বললেন- টাকা ফেরত দিতে হবেনা, বালিশটা এমনিতেই রেখে দেন।
আপনের ব্যাবহার করা বালিশ দিয়া কি করুম।
দেখেন, যদি কোন কাজে লাগে।
ছেলেটা কি যেন ভেবে বলল- চা খাইবেন? এক কাপ চা খান।
ছেলেটা বালিশটাকে ছুঁড়ে দিল বাইরে যেই দুইজন তুলো ধুনছিলো তাদের দিকে। তারা কিছুক্ষণের মাঝে বালিশের কাভার খুলে ভেতর থেকে তুলা বের করে আগের তুলার পাহাড়ে মিশিয়ে ফেলল। আকরাম সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। ঐ বুড়ো লোকটার কথা তিনি আর তুললেন না। শীতকালের মিঠে রোদে তুলার আঁশ উড়ছে, বেশ লাগছে দেখতে, তুলার আঁশের সাথে বালিশের রহস্য যেন উড়ে যেতে চাইছে অসীমের পানে, যেই অসীমে সব রহস্যের শুরু হয়, আবার সেই অসীমে সব রহস্যের শেষও হয়!
গতকাল রাতে ডাঃ ফাহিম ভালোমত ঘুমাতে পারেনি। কাঁটার বিষয়টা নিয়ে মনটা খচখচ করছে। কিছুতেই চিন্তাটা দূর করা যাচ্ছেনা। জিনিসটা মাছের কাঁটা হলে মিটেই যেত, কিন্তু জিনিসটা ঠিক কাঁটা নয়। জিনিসটা যে কি জানা গেলে একটু শান্তি পাওয়া যেত। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে। তার কলেজের বন্ধু আশিসের সাথে আলোচনা করতে হবে। আশিস তার ফেসবুকে আছে, কিন্তু অনেকদিন যোগাযোগ নেই। আশিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে পরাশুনা করেছে, তারপর চার বছর আগে পলিমার কেমিস্ট্রির কোন একটা টপিকের উপর পি এইচ ডি করতে আমেরিকা গিয়েছে, বিষয়টা এখন আর ঠিক মনে নেই। ফাহিম ফেসবুকে একটা নক দিয়ে রাখলো, পি এইচ ডির শেষের দিকে ছাত্রদের “মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল” অবস্থা থাকে, দেখা যাক কবে উত্তর দেয়।
বালিশ প্রথম পর্ব পড়তে হলে এই লিংকে ক্লিক করুন।
মন্তব্য
প্রথম পর্ব থেকে দ্বিতীয় পর্বের দূরত্ব মাত্র পাঁচ মাস! তৃতীয় পর্ব তাহলে কবে নাগাদ আশা করা যেতে পারে? এত লম্বা লম্বা বিরতি হলে প্রতি দফা পাঠককে আগের পর্বগুলো পড়ে আসতে হবে। নয়তো নতুন পর্ব তার যথাযথ আবেদন রাখতে পারবে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সত্যি কথা। দ্বিতীয় পর্ব দিতে বড় দেরি হয়ে গেছে। তবে তৃতীয় পর্ব লিখে জমা দিয়ে দিয়েছি ৪-৫ দিন হয়ে গেছে। এখনও কেন যেন প্রকাশ হয়নি।
সচলায়তনের বিধি অনুযায়ী নীড়পাতাতে একজন লেখকের একটির বেশি লেখা থাকবে না। সুতরাং নীড়পাতা থেকে এই লেখাটি দ্বিতীয় পাতায় না যাওয়া পর্যন্ত তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হবার উপায় নেই। এই বিধিটি অনুসরণ না করলে দেখা যাবে নীড়পাতার দশটি লেখাই একজন লেখকের। তখন এটি কি অনলাইন রাইটার্স ফোরাম নাকি কারো ব্যক্তিগত ব্লগ সেটা বোঝা যাবে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দ্বিতীয় পর্ব থেকে প্রথম পর্বে পড়ে এলাম। এত দীর্ঘ বিরতি দিলে কেমনে কী!
নেক্সট অংশ জলদি পড়তে চাই, বেশ ভাল্লেগেছে!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অনেক ধন্যবাদ । শীঘ্রি আসছে।
নতুন মন্তব্য করুন