স্মৃতির নক্ষত্র ভিড় করা রংধনু বাতাসে কি জানি কি ঢেউ আছড়ে পড়ে প্রায়শই। ফেলে আসা দিনগুলো কে পাখীর ডিমের মত নীল মনে হয়। মনে হয় কোনকালের থরে থরে জমে থাকা জমাট জলের চাদর, কোনও এক শ্রান্ত গোধুলী বেলা, বিহঙ্গিনীর ভেসে যাওয়া, সাথে তার সঙ্গী বিহঙ্গ, মনে পড়ে প্রকৃতির শব্দে ঘেরা ঝিঁঝিঁ ডাকা, ঘুঘু ডাকা কোনও এক গ্রামের কথা, কুয়োতলায় গাছের মাঝ দিয়ে ঝলমল করা সূর্য, কুয়োর কালো জলে আমার আবক্ষ ছায়া, পানের বরজ আর তামাকের ঘ্রাণে আমাদের খুলিবাড়ির ঘন বাতাস, উঠানের নরম ভেজা ভেজা মাটি। ক্লাস ফাইভের পরে সেভাবে আর থাকা হয়নি বাড়িতে। নীল ডিমের মতো কিছু স্মৃতি হঠাৎই মনে পড়ে; গভীর নিদ্রা থেকেও টের পাই আলো-আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে তারায় খচিত রংধনু বাতাস।
আমাদের সেই প্রত্যন্ত বর্ডার এলাকার গ্রামের বাড়িতে আব্বা আম্মার সাথে থেকেছি খুব কম সময়। এই ভূখণ্ড গরীব, এর মানুষেরাও গরীব, শিক্ষার সুযোগ নেই, স্কুল নেই আশে পাশে কোথাও। তাই আম্মা আব্বা আমাদের পড়াশুনার উপযোগী ভাইবোনদের কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়ি। বুঝিনি আর কোনওদিন নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারব না। ভেবেছিলাম এইতো যাচ্ছি স্কুলে পড়তে, আবার আসব কয়দিন পর। কিন্তু না আর সেভাবে বাড়ি ফিরে যাওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছিল তখন খালার বাড়ি থেকে তল্পিতল্পা নিয়ে আমাদের বাড়ি ফিরেছিলাম। তখন বর্ডারের ওপারে আব্বার এক বন্ধু নিজের থেকেই বিশাল জায়গা ছেড়ে দিলেন আমাদের জন্য। আব্বা আমাদেরকে দুটো ঘর তুলে দিলেন ভুপেন কাকার জায়গায়। আমরা সেখানে তল্পিতল্পা নিয়ে উঠে গেলাম। আব্বা সারাদিন রোগী দেখা শেষে রাতে বর্ডার পার হয়ে এসে আমাদের সাথে থাকেন সকালে আবার বের হয়ে যান কাজে।
যুদ্ধ শেষে আমি আবার এসে উঠলাম খালার বাড়ি। আমি খালার কথা কোনও দিন ভুলব না। খালার মতো মানুষের কথা কোনওদিন ভোলা যায় না। খালা আমার ছিলেন অযত্নে অবহেলায় থাকা এক নিরীহ মায়ের মতো মানুষ। খালা আমাকে বুক দিয়ে আগলে রাখতেন। কালিগঞ্জ থেকে স্কুল পাশ করলাম। কলেজে পড়তে হবে।
রংপুরে বেগম রোকেয়া কলেজে ভর্তি হলাম। ১৯৭২ সাল। শালবন রংপুর মূল শহর থেকে কিছুটা নিরিবিলিতে। একান্ন বছর আগে। তখন তো খুবই নিরিবিলি একটা জায়গা ছিল শালবন। গাছগাছালিতে ভরা। কলেজের হোস্টেলে উঠলাম। নতুন বান্ধবী, রুমমেট, নতুন এক জীবন।
কলেজে ভর্তির কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম কলেজের স্যার, আপা, হোস্টেল সুপার আপা সবাই কেমন এক অদ্ভুত স্নেহ মমতায় ভরা। কি ব্যবহার, কি মায়া, কি ক্লাস নেওয়ার স্টাইল, কি মোলায়েম তাদের কথা বলা, মনে হল- এই কি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, এরই নাম কি মধুময় সময়, এই মানুষগুলো কারা, এতদিন কোথায় ছিল তাঁরা। সেই স্যার আপাদের একজনের কথা বলব আজ।
নাম তাঁর বেবুন আপা। কি সুন্দর নাম। মানুষের নাম বেবুন, এটাই তো আমার কাছে এক বিরাট বিস্ময়, তার ওপর তাঁর ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ধরণ সেইসবও বিস্ময়। কখনও কোনও ছাত্রীকে কিছু শাসন করার থাকলে তাকে আলাদা করে ডেকে সবার অলক্ষ্যে শাসন করতেন, অন্য ছাত্রীরা জানতেই পারতাম না কি বিষয়ে কথা হলো, এটাও আমার কাছে আরেক বিস্ময়!
সদ্য স্বাধীন দেশ। মনে অনেক যাতনা, ঘরে ঘরে মানুষের কষ্টের চিহ্ন, তবে কী এক প্রফুল্লতা এই মাটির আকাশে বাতাসে, এ কি স্বাধীনতার প্রফুল্লতা! মনে অনেক আনন্দ, অনেক উত্তেজনা, গল্প, কবিতা, নতুন ক্লাস। ফেব্রুয়ারি মাস এসে পড়ল। ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলা হোস্টেল সুপার বেবুন আপা আমাদের ডেকে বললেন- মেয়েরা আমরা আগামীকাল রংপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রভাতফেরিতে যাব, তোমরা হোস্টেলের বাগান থেকে কিছু ফুল তোল, ফুলের তোড়া বানানোর জন্য।
কলেজের মাঠের মাঝখানে বিশাল ফুল বাগান, যেখানে মালি ছাড়া কারও ঢোকার অনুমতি নেই, সেই বাগানে ঢুকব আমরা, বেবুন আপা আমাদের কে সেই অনুমতি দিলেন! আমি আনন্দে আত্মহারা। যে রঙের বিস্ফোরণ এতদিন বাহির থেকে দেখেছি আজ সেই লাল, কমলা, হলুদ, গোলাপী ফুলের জাদুর বাগানে যাব আমরা, আমি অনেক ফুল তুলব, সব ফুল তুলব। কয়েকজন মেয়ে মিলে অত্যন্ত উত্তেজনা নিয়ে বাগানে ঢুকলাম আমরা।
লাল টকটকে গোলাপের মখমলের পাপড়ি, আরও কত যে ফুল, গোলাপী, জ্বলন্ত লাল, সাদা, তুলতুলে সব ফুল। মনে হল আকাশ থেকে নেমে আসা রং, বাতাসে দুলছে, সূর্যের আলোতে জ্বলজ্বল করছে। কিছু প্রজাপতি, কিছু পাখি এখানে ওখানে টুকুর টুকুর করে এসে বসছে। বিশ্ব-প্রকৃতির এত রূপ এত ঘ্রাণ এত রং এত কাছ থেকে অজপাড়াগাঁয়ের এই আমি আর কখনও দেখিনি আগে। ওই মুহূর্তে আমার মানব মনের সাথে সাথে যে দানব মনটিও জেগে উঠেছিল, তা তখন বুঝিনি। তখন শুধু মনে হয়েছিল এইতো চাই, সব চাই সব, সব ফুল আমার, সব আমি নেব।
বিকেলে কলেজ ক্যাম্পাসে বেবুন আপা এসে বাগানের অবস্থা দেখে অবাক হয়েছিলেন সেদিন। বাগানের এই অবস্থা করা কি কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব, হায় হায় হায়, বাগানের এই অবস্থা! আমাদের ডাক পড়ল।
‘এত ফুল তো তোমাদের তুলতে বলিনি, বাগান তো তছনছ করেছ, কী করে পারলে তোমরা, তোমাদের হৃদয় কি একবারও কেঁপে উঠল না? তোমাদের কি এত ফুল দরকার, আমি তো খুব লজ্জিত হয়ে গেলাম যে আমিই তোমাদের এই বাগান থেকে ফুল তুলতে বলেছিলাম, কে নেতৃত্ব দিয়েছে এই কাজের বলো?’
আরও যারা ফুল তুলেছিল, সবাই আমাকেই ওই মুহূর্তে তাদের নেতা মানল, সব আঙ্গুল আমার দিকে। তারপর যা হবার কথা, আপা সবাইকে চলে যেতে বললেন, সবাই গেলে আপা ধরলেন আমাকে। ‘রেহানা, তোমাকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করতাম, সেই তুমি, আমি ভাবতেও পারিনি এত ফুল অপচয় করার কথা তোমার মাথায় আসতে পারে, তোমার পরান কি একবারও কাঁপল না?’
ফুলের কথা ভাবতে ভাবতে, আপার ভালোবাসা চিরতরে হারালাম এইসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি কাঁদতে কাঁদতে আপার রুম থেকে বের হলাম। বের হয়ে দেখি সবাই চলে গেছে, আমার রুমমেট দুজনও। কি হত আমার দিকে না দেখিয়ে দিলে, সবাই বললেই তো পারত, আপা আমরা সবাই ফুল তুলেছি, আসলেই তো সবাই ফুল তুললাম, আমি না হয় একটু বেশিই তুলেছি, তার জন্যেই আমার দিকে দেখিয়ে দিতে হবে? আসলে আপা আমাকে অনেক স্নেহ করেন, সবার হিংসে হয়, তাই সবাই আজ আমাকেই সব ফুলের দায় দিল। মেয়েরা সবাই এত খারাপ, এদেরকে কত বিশ্বাস করেছিলাম, রুমমেটগুলো কে কত ভালো মনে করেছিলাম, সবাই অবিশ্বাসী, কেউ আমার ভালবাসার যোগ্য না।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল। শালবনের বাতাসে ভাসছিল হয়ত দূরের কোনও বাড়ির বউদের রান্নার সুঘ্রাণ। পাশের ক্ষেতের বিস্তীর্ন দিগন্ত রেখার দিকে সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। গোলাপী গোলাপী আকাশ। বাতাসে তখনও একটু একটু শীত। গ্রামের কোথাও থেকে পোড়া পাতার ধোঁয়াটে ঘ্রাণ আর মাটির ঘ্রাণ মিশে কি এক মায়াবী ঘ্রাণ আসছিল, এখন মনে হয়- সেই ঘ্রাণ শুধু দূর অতীতেরই হয়। বেবুন আপার স্নেহ ভালোবাসা চিরতরে হারিয়ে, বান্ধবীদের নির্মমতার রূপ দেখে, পৃথিবীর সকল বেদনা বুকে নিয়ে আমি ব্যর্থ মনোরথে রুমে ফিরলাম।
অবিশ্বাসী রুমমেট দুটো খাওয়ার সময় ডাকল, বললাম খাব না, যা তোরা। ওরা সুরসুর করে খেয়ে নিল।
আমি আগে আগেই ঘুমাতে চলে গেলাম, বললাম- কালকে সকালে খবরদার আমাকে ডাকবি না। আমি প্রভাতফেরিতে যাব না।
সকালে সবাই উঠল। রেডি হচ্ছে, সবাই সবার আগের রাতের ফুলের তোড়া, মালা সব গুছিয়ে নিচ্ছে, শাড়ি পড়ছে, হুড়োহুড়ি করছে, সব শুনছি। আমি একটা কাঠ হয়ে পাশ ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে পড়ে আছি। রুমমেট দুটোকে বলেছিলাম, সকালে আমাকে ডাকবি না, আমি যাব না, তাই বলে কি ওরা সত্যিই ডাকবে না আমাকে? লজ্জার মাথা খেয়ে এখন তো আর মত বদলাতে পারি না। ইস আমার ফুলগুলো, সব ফুল ট্রাঙ্কের ভেতর, এতক্ষণে সবফুল বোধহয় শুকিয়ে গেছে।
হায়রে দুই বিট্রেয়ার্স রুমমেট, এত স্বার্থপর তোরা, নিজেরা নিজেরা একজোট হয়ে সেজেগুজে বের হয়ে গেলি, একবারও ডাকলি না আমাকে। তোদের রূপ আজকে আমি দেখলাম, আর কোনওদিন না, আর কোনওদিন আমার অন্তরের একবিন্দু ভালোবাসা তোদের জন্য থাকল না, তোরা কী হারালি তোরা নিজেরাও জানলি না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হোস্টেল নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নিস্তব্ধ নিরবতা। আরও মিনিট দশেক পরে, আমি তখন কি করব, সামনের দিনগুলো এই বিবর্ণ অনাত্মীয় স্বার্থপরদের মধ্যে কিভাবে দিন গুজরান করব, কার কার সাথে আর কোনওদিন কথা বলব না ইত্যাদি যখন ভাবছি, তখন শুনি দরজার ঠক ঠক ঠক, শয়তান রুমমেটগুলো এখন আবার আসল কেন। বললাম, ‘কে?’
‘দরজা খোল’
খানিকটা ভয়ে আবার বললাম ‘কে?’ বলেই বুঝলাম কে। ভুল শুনছি না তো! আমি তড়িঘড়ি করে দরজা খুললাম।
বেবুন আপার সেই কথা আমি আজও ভুলিনি, ‘লক্ষী মেয়ের মত তৈরী হয়ে এসো। তোমার জন্য আমরা আরও দশ মিনিটা অপেক্ষা করব। দেড়দুইশ ছাত্রীকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি, তৈরী হয়ে নাও।’
‘জ্বি আপা জ্বি। আপনি যান, আমি এখনই আসছি।’
বেবুন আপা নিজে আসলেন আমার রুমে, উনি কী করে দেখলেন যে মেয়েদের মধ্যে আমি নেই, এইসব ভাবনা তখন আমার মাথায় ঘুরছে, আমার সম্মান বিরাট বেড়ে গেল- উনি আমার জন্য আসলেন, আমাকে রুমে ডাকতে আসলেন, এ আমার জন্য এক অপার বিস্ময়। আমি লাফালাফি করে তৈরি হয়ে এসে যোগ দিলাম স্বাধীনতার পর আমাদের সেই প্রথম প্রভাতফেরিতে, শহিদমিনারের পথে প্রভাতফেরির মৌন মিছিলে।
জানি না খালেদা খানম বেবুন আপা এখনও বেঁচে আছেন কি না। তিনি যেখানেই থাকুক, তাঁর প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা জানাই। অর্ধ শতাব্দী আগের সেই স্নেহমাখা মুখ, আর কন্ঠস্বর আজও মনে পড়ে, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই।
খন্দকার রেহানা সুলতানা
২০২৩
মন্তব্য
এই লেখাটা কয়েক বার পড়েছি। কয়েক বার পড়ার কারণ গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের সমাজ কাঠামো, জীবনযাত্রা, সামাজিক সম্পর্কগুলো, মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলোতে যে বিপুল পরিবর্তন এসেছে সেটা অনুধাবন করার জন্য। পরিবর্তনগুলো বিস্ময়কর, এবং কিছু কিছু বিষয়ে পরিবর্তন না হলেও চলতো।
শ্রদ্ধেয় খন্দকার রেহানা সুলতানা, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। তারায় খচিত রঙধনু বাতাসের গল্প আরও আসুক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন