বর্ষায় এপার হতে ওপার পারাপারের টাকা দিয়ে কদবেল কিনে খেয়ে ফেলতাম। মাঝি মাস শেষে আম্মার কাছে যেতো টাকা আনতে। ক্লাস ফোর এর বর্ষায় আমাকে আর ছোট ভাইকে একটা নৌকা বানায় দেয়া হলো। সেকি অপার আনন্দ আমার। বিশাল ধনী মনে হচ্ছিলো নিজেকে। অবশ্য তার আগেই আমরা সাতারে মোটামোটি পাকা। স্কুল থেকে বাসার দুরত্ব সব মিলিয়ে মিনিট তিনেকের একটু বেশী। একদিন নৌকার পানি সেচঁতে অস্বীকার করায় ছোটো ভাইকে সেচুনী (কলা গাছের খোসা দিয়ে বানানো পানি সেঁচার জিনিষ) ছুড়ে মারার প্রতিদানে সে আমাকে অনেকটা ভিজেয়ে দেয়। আমি টুপ করে গেলাম পানিতে নেমে, নৌকার আগা এক হাত দিয়ে ধরে ঘাটে ফিরলাম। ওকে নামায় দিয়ে আমি আবার মাঝখালে। এরপর থেকে শুরু প্রতিদিন নৌকা নিয়ে গোসল। সাথী যোগাড় করলাম আরো তিন জন। সন্গে নিতাম লাল পেয়ারা (ভিতরে লাল)। গঙা মা (কবে ,কার থেকে যেনো শুনেছি যে পানির মালিক হচ্ছেন "গঙা মা") কে ভাগ দিতে কখনোই ভুলতাম না কেউ। প্রতিটা পেয়ারার প্রথম কামড় পানিতে ফেলে দিতাম। গোসল চলতো যে পর্যন্ত আম্মার চিল্লাচিল্লির শব্দ না পাওয়া যেত। উঠতাম সারা গায়ে বিস্তর পলি মাটির দাড়ি-গোফ নিয়ে।
পানি বেশী উঠাতে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। আমার নৌকাকে ঘষা মাঝা করে আলকাতরা লাগানো হবে বলে ডাঙায় উঠায় নেয়া হলো। এদিকে নৌকা খুব মিস করছইলাম গোসলে। এলিজা কে পটালাম ওদের নৌকাটা কটা দিনের জন্য আনতে। ভীষন ভীতু মেয়েটাকে অনেক পটিয়ে রাজী করানো গেলেও চুপে চুপে ওদের ঘাটের নৌকা দেখে চার বার লুকিয়ে ঢোক গিলছি। দামী কাঠের পনেরো ফুটের নৌকা। সবাইকে সাহস দিয়ে উঠলাম। বৌঠা দিয়ে চারজন মিলে নিয়ে এলাম যায়গা মত। আগেরদিনের বৃষ্টিতে খানিকটা পানি ছিলো নৌকায়। আমাদের প্রায় দেড় ঘন্টা লাফালাফিতে নৌকা তখন ডুবু ডুবু। এর মধ্যে এলিজা কয়েকবার বলেছিলো দামি নৌকা নাকি ডুবেনা। তিন জন মিলে একসাথে পানি থেকে নৌকায় উঠতে গিয়ে যা ঘটলো তাতে আমার ছোট আত্তায় যেনো বজ্রাঘাট। হাতের সামনে দিয়ে নৌকাটা নিচে চলে যাচ্ছে। চার জোড়া ছোট হাত পা খালে মাঝখানে ভয়ে বুঝতে পাচ্ছেনা কোন দিকে পাড়। গ্রামের মেয়ে বলেই হয়তো শেষ পর্যন্ত পাড়ে পৌছলাম আমরা। হাটু পানিতে দাড়িয়ে ভাবছি এখন কি হবে। রোজিনা মনে করলো গঙা মাকে বলতে হবে। গলা পানিতে নেমে চার জন একসাথে ডুব দিলাম। গল গল করে বললাম "গঙা মা, গঙা মা নৌকাটা ফিরায় দাও, তোমাকে এক পলিথিন পেয়ারা দিব ( ), আর শুক্রবারে এক রাকাত নামাজ পরে দিবো।") বার তিনেক বলে উঠে প্রমিজ করলাম এ কথা কাউকে বলবোনা।
বাড়ি ভদ্র মেয়ের মত খাওয়া-পড়া করলাম।ঘন্টা তিনেক পরে কে যেনো বললো ,এলিজাদের নৌকা পাওয়া গেছে। আহ শান্তি! দুই পোলিথিন পেয়ারা দিবো গন্ঙা মা কে, ভাবলাম। আমাদের চারটা পেয়ারা গাছ ছইলো,তআই এতো দাপট;)
এর পর বিদেশী স্কার্ট পড়ে, ঝুটি করে ,গলায় পাওডার মেখে গেলাম তিনজন মিলে এলিজাদের বাড়ি। ঘরের সামনের পাকা সিড়িতে ফরসা মুখ লাল করে বসে আছে। আনন্দচিত্তে, ধমকের সুরে বললাম ,"শুক্রবারের নামাজ টা ফাকি দিসনা,তুই যে আইলসা"। দেখলিতো গন্ঙা মা কত ভালো" । পেছন থেকে বেরুলো এগারো ফুটের এলিজার মা। গর্জে উঠে "এই মেয়েগুলোর সাথে মিশবিনা" বলে চলে গেলো। হেভী প্রেজটিজে লাগলো। এলিজা কান্না গলায় শোনালো ,"মামা আর আব্বা তিন ঘন্টা পর নৌকা উঠায়তে পারছে খাল থিকা। তোরা এখন যা গা"।
ওদের নিয়া চলে আসতে আসতে ওর চাচাতো বোনের কাছ থেকে শুনলাম, ও তখনি কাদতে কাদতে এসে বলে দিছে নৌকা ডুবার কথা। ওর মা আর কখনই মিশতে দিবেনা আমাদের সাথে। তা হতে দিবো কেন! রোজিনা আর শহীদাকে বললাম "এলিজা এখনও বেবিতে(ওয়ান এর আগের ক্লাস, যাকে এখন "প্লে" বলা হয়) পড়া বাচ্চা, ওর সাথে আমরা মিশবোনা আর"। গলার স্বরের ভারিক্কতে দুজনই এই সিদ্ধান্তে রাজী হয়ে গেলো।
এরপর আর ক খনও গঙা মায়রে পেয়ারা দেইনাই। ভাবতাম গঙা মা আমার পা ধরে টানার সময় তো দেখা হবে, তখন বলবো "আমার কথা রাখনাই ,আমি রাখবো কেন"? নৌকা এলিজার বাবা আর মামা মিলে উঠাতে হলেও গঙা মায়রে এতটা খারাপ মনে হয়নি যে আমার দোষ ছাড়াই নিচ থেকে পা টেনে নিয়ে যাবে। তক্কে ছিলাম, দেখা একদিন হবেই।
--------------------------
সচলে কিছু লিখবো বলে ভাবছিলাম। লিখে দিলাম পেছনের একটু রং।
ধ্রুবক
মন্তব্য
বাহ চমৎকার লেগেছে লেখাটা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
চমৎকার।
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই এবং শ্যাজা।
বাহ, বেশ লাগলো! কি সুন্দর ছেলেবেলা।
--তিথি
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
তিথি, বলতে গেলে কিছু কেবল ছেলেবেলার কথাই বেশী মনে পড়ে।:)
নতুন মন্তব্য করুন