ইলা মিত্রকে নাচোলের সাঁওতালরা এখন আর চেনেন না। অভাবের করাল গ্রাসই এখন বর্গাচাষীদের কাছে পরম বাস্তব। তাই অধিকার আদায়ের ইতিহাস এখন ধূসর অতীত। ব্রিটিশ আমলের সাঁওতাল বিদ্রোহ (সান্তাল হুল) তো না শোনা আরেক উপকথা মাত্র।
এই প্রজন্মের সাঁওতালরা অবশ্য কেউ কেউ ইলা মিত্রকে সামান্য চিনতে পারেন অহিদুজ্জামান ডায়মন্ডের 'নাচোলের রাণী' সিনেমার মূল চরিত্র হিসেবে!
নাচোল বিদ্রোহ কী? কেনো হয়েছিলো? এই সব প্রশ্ন নিয়ে হাতড়ে বেড়ানো হয় নাচোলের সাঁওতাল পাড়ায়।
কুসমাডাঙা গ্রামের গণেশ সরেণের কন্ঠে এখন শুধুই আহাজারী, “হামাদের লোকই নাই দিদি!”
তার কাছ থেকেই জানা গেলো, জমি - জমার নানান মিথ্যে মামলায় এবং পুলিশি নির্যাতনে সর্বস্বান্ত হয়ে অনেক সাঁওতালই দেশান্তরী হয়েছেন। দুমুঠো ভাত আর নিরাপত্তার সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে।
সাওতাঁলদের নিজেদের বলতে কোনো জমি নেই, নেই কোনো দালানকোঠা। পরের জমিতে বর্গা খেটে দিন এনে দিন খেয়ে চলছে তাদের জীবন। তেভাগা যেনো এই সব আদিবাসীর কোনো গৌরব গাঁথা নয়, এ যেনো আজ এক বিরাট প্রহসন!
লক্ষ্মী রায়ের বালিকা বধূ ষষ্ঠী কোনোদিন ইলা মিত্রের নামই শোনেনি। ১৪ বছরের মেয়েটির স্ফীত পেট এরই মধ্যে জানান দিচ্ছে অনাগত সন্তানের আগমন বার্তা। ডাক্তার দেখানো হয়েছে? এই প্রশ্নে ষষ্ঠী জানায়, ডাক্তার আছে সেই নাচোলে, নয়তো তানোরের ধরমপুরায়। পুরো তিন - চার কিলোমিটার পথ ভেঙে যেতে হবে পাঁয়ে হেটে, নয়তো খাটিয়ায় চড়ে। নেই কোনো রিকশা বা রিকশা ভ্যান। গ্রামে কোনো পল্লী চিকিৎসক বা সরকারি স্বাস্থ্য কর্মী আসেন না।
বাচ্চারা স্কুলে যায় না? এ প্রশ্নের জবাব শুধু মায়েদের মুখের ম্লান একটি হাসি, স্কুলে গিয়ে কি হবে? উল্টো মুখ কালো করে ফিরে আসবে তারা সহপাঠীদের হাসি মশকরা শুনে। 'সাঁওতাল' যে এক নীচু জাতের নাম!
ধরমপুরা আর কুসমাডাঙার মাঝে তিনটি বিশাল তেপান্তরের মাঠ। সেই মাঠ পেরুলে তবেই কুসমাডাঙা। সেখানের সাঁওতালরা বছর দুয়েক আগে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে খ্রিস্টান হয়েছেন।
কেনো তারা ধর্ম ত্যাগ খ্রিস্টান হয়েছেন, এই গুরুতর প্রশ্নের জবাবে ধরমপুরার কেউই মুখ খুলতে চাননি।
জানা গেলো, প্রতি রোববার প্রার্থণাসভা বসে রহনপুরের গির্জায়। কিন্তু এখনো কুসমাডাঙার খ্রিস্টান সাঁওতাল পাড়ায় ঘরে ঘরে রয়েছে যতœ করে তোলা তুলসীতলা। বউ - ঝি'রা যথারীতি আগের মতোই শাঁখা - সিঁদুর পরছেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহের জাঁকজমকপূর্ণ দেড়শ বছর পূর্তি উৎসব, কিংবা এতো বছর ধরে চলে আসা সেমিনার - সিম্পোজিয়াম, জনসভা, সিনেমা, নাটক, সংবাদ - প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় - উপ সম্পাদকীয় বা টিভি রিপোর্টিং এর সূত্র ধরে নাচোলের রুক্ষ লাল মাটিতে উন্নয়ন বলতে শুধুই বরেন্দ্র সেচ প্রকল্পের কয়েকটি পানির পাইপ!
ফিরে আসার সময় চোখে পড়ে সেই নিসঙ্গ রেলপথ, যে পথটি ধরে আদিবাসী রমনীর ছদ্মবেশে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার শেষ চেষ্টা করেছিলেন রাণী মা। মনে পড়ে যায় -- ধরমপুরা, রামচন্দ্রপুর, কুসমাডাঙা, শিংরুল, সাহাপুর, আহাড়া, রহনপুর, আমনুরার সাঁওতালদের গ্রামের প্রতি বৃহস্পতিবার কুপির আলোয় লক্ষী দেবীর আরাধনার কথা। কিন্তু আদিবাসী পল্লীগুলো জানে না, রাণী মা'র মতোই মা লক্ষ্মীও তাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে, ফিরে আসার সব আশাকে কেবলই স্বপ্ন করে দিয়ে ।...
মন্তব্য
বেশ লাগল আপনার লেখাটি। খারাপ লাগলো সাঁওতালদের দুর্দশার কথা জেনে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
সবই ইতিহাস। দুদর্শাই সাঁওতালদের সঙ্গী এখন!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
সহকর্মী অপর্ণার এই লেখাটির কথা আগেই শুনেছিলাম। আর এখন এই অসাধারণ লেখাটি পড়লাম।
পাহাড় কি সমতলে আদিবাসী জীবনের এইসব দুঃস্বপ্ন-উপাখ্যানের শেষ কোথায়?
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
ভালো লেখা। নিউ মিডিয়ার অপর্ণা নাকি? ছুপা রুস্তম নিকলা ইয়ার। নিয়মিত লিখবেন প্লিজ। আনিসুল হকের মুক্তিযু্দ্ধ ভিত্তিক একটা উপন্যাস আছে, সেটাতেও সাওতালদের মাইগ্রেশনের অনেক ঐতিহাসিক উপাত্ত পাওযা যাবে
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
"চিয়ারি বা বুদু ওরাওঁ কেন দেশত্যাগ করেছিলো?" পিয়াল ভাইয়ের বলা আনিসুল হক এর উপন্যাসটার নাম।
পড়লাম।
দীর্ঘশ্বাস।
এই ভূ-খন্ডে উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষদের বংশধরেরা, মানে আমরা মাঝেমাঝে এইসব ভুলে বসে থাকি।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
নেত্রকোনায় সংঘটিত কৃষক আন্দোলন, যেটি টংক আন্দোলন নামে পরিচিত, তাতে অনেক হাজং নারী অংশ নিয়েছিলেন, ওই নারীদের কেউ কেউ এখনো জীবিত, যেমন রাশমণি। সাঁওতালদের তুলনায় এদের দুরবস্থারও কোনো কমতি নেই।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, এত নামডাকওয়ালা আমাদের সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি পর্যন্ত নেই। খালেদা জিয়া তো উঁচু গলায় বলতেন, এদেশে কোনো আদিবাসীই নেই। জোট সরকারের একাংশের রাজাকাররা এখন দাবি করছেন এদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই।
এত বড়ো বড়ো মিথ্যাচারের সাথে আমাদের নিত্য বসবাস।
লেখাটা পড়ে ভালো লাগল । ব্যবহৃত ছবির উতস কি জানতে পারি ??
..হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দার জলে...
বোধকরি বিখ্যাত মার্কসবাদী চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোরের গ্রন্থ 'তেভাগার ডায়েরি'র কভার থেকে ছবিটি নেয়া।
স্মৃতি আমার সঙ্গে প্রতারণা করল না তো!
আর আলফ্রেড সরেন কে পুড়িয়ে মারা হয় ।
অপর্ণা নিয়মিত লিখুন ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
বিডিসিরিতে গিয়ে দেখে এসেছিলাম টংক বিদ্রোহের স্মৃতি স্তম্ভ। পরিসংখ্যান বলছে মু্ক্তিযুদ্ধে আদিবাসী অংশগ্রহনে গারোদের পর শতকরা হারে এগিয়ে ছিল সাওতালরাই।
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
........................................................................
অপর্ণা, লিখবেন নিয়মিত।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
গত বছর ২৬ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির কয়লা খনি বিরোধী সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে দেখি সেই সমাবেশের লাখ খানেকের ১০/১৫ ভাগই এসেছেন সাঁওতাল গ্রাম থেকে। তীর ধনুক ও ঢোল মাদলে সজ্জিত হয়ে, আর মাথায় ছিল শস্যের শীষ। হাতে ছিল লাঠি। আমরা কেবল ইতিহাসই জানতাম। কিন্তু ওখানে এই বর্তমানেও ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
পরে সাঁওতাল গ্রাম বুকচি-তে গিয়ে দেখি মুমূর্ষু সাঁওতাল সমাজ। দুপুর বেলা মাইকেল মারাণ্ডীর আঙ্গিনায় অনেক কথা হয়। ছিলেন গামছা পড়া এক শতবর্ষী বৃদ্ধ। ওরা রাণী মা'র কথা স্মরণে রাখে নাই কিন্তু তেভাগার লড়াই মনে রেখেছে। আর মনে রেখেছে জমিগুলো সব ওদেরই ছিল। এখন নাই। ওরাও কি আছে? ওদেরকে কি আমরা এনজিওদের কাছে বেচে দিই নাই?
অপর্ণা সান্যালকে ধন্যবাদ, পুরান ঘা-য়ে ব্যথা দেয়ার জন্য।
;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;
বহুদিন হলো নিকষ কুঠার ফেলে এসে ভুলে
দাঁড়িয়েছি আজ মেঘের কিনারে এসে
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
নতুন মন্তব্য করুন