আরও একটি বছর পার হয়ে গেল।২০১১ এর দ্বারপ্রান্তে আমরা দাঁড়িয়ে। ওয়ান ইলেভেন পার হয়েছে তাও অনেকদিন হয়ে গেল। কিন্তু আমরা, বিশেষ করে আমাদের ভেতর এক শ্রেনীর লোকেরা, খুব সহজেই সব কিছু ভুলে যাই। যদিও আমার স্পষ্ট মনে আছে, দেশের বাইরে থেকেও টের পেয়েছি কি ভয়ানক পরিস্থতির মধ্যে দিয়ে দেশ অতিক্রান্ত হয়েছে। আর দেশের ভেতরে যারা আছেন, তাদের স্মৃতিতে হয়তো সেটা আরো ভালো করে গাথাঁই করা আছে। কিন্তু ভুলেছেন শুধু তারা, যাদের নিয়ে সেজেছিল সেই রংগমঞ্চের নাটক। পরবর্তীতে যাই হোক, শুরুতে সাধারণ জনতা সবাই বেশ উৎফুল্ল হয়েছিল মাইনাস টু এর থিওরিতে।দেশের বয়স তো কম হল না, কাহাতক আর ভাল লাগে পোলাপাইন্না কাদাঁ ছোড়াঁছুড়ি? তবে বাংলাদেশের মানুষের কপাল খারাপ। এদেশে দেশের বয়সই শুধু বাড়ে, নেতাদের বয়স-বুদ্ধি আর বাড়ে না। দুদক আর ত্তত্বাবধায়ক সরকারের ধাতানি খাবার পর, আর সঙ্গে জনগনের বিদ্রুপের বাণে যখন রাজনীতিবিদরা প্রায় অসহায়, তখন দেশের আমজনতার অনেকেই ভেবেছিল, যাক ওয়ান ইলেভেন তাও রাজনীতিবিদদের একটা শিক্ষা দিয়েছে। অন্তত ভবিষ্যতে তারা বুঝে শুনে কাজ করবে আর চুড়ান্ত পর্যায়ের বেহুদা কোলাহল থেকে দূরে থাকবে, এমন আশাই জনগন করেছিল।তত্তত্বাবধায়ক সরকার গেল, ইলেকশন হল, রাজনীতিবিদরা ফিরে পেলেন তাদের গদি। কিন্তু কিসের কি পরিবর্তন, যেই লাউ সেই কদুই রইল। সরকারী দল আর বিরোধী দল যথারীতি তাদের আগের ভুমিকায় অবতীর্ণ হলো। সেই চিরাচরিত দা কুমড়া সম্পর্ক, সেই একই নাটক, একই ডায়ালগ, শুধু মঞ্চের পরিবর্তন। ওয়ান ইলেভেন তাদের কোন শিক্ষাই দেয় নি। যদিও কথায় কথায় ওয়ান ইলেভেন এর রেফারেন্স তারা হরহামেশাই টানেন, তবে তা আরেকটি ওয়ান ইলেভেন ঠেকানোর জন্যে না, আরেকটি ওয়ান ইলেভেন এর আবির্ভাবের বাসনায়। আর নাটকের কাহিনী যেহেতু পুরাতন, অভিনেতা অভিনেত্রীর সেটও যেহেতু একই, আর চর্বিত-চর্চিত ডায়ালগ যেহেতু সবচে' কাঁচা তোতলা অভিনেতা অভিনেত্রীটিরও মুখস্থ, নাটকের পর্বগুলো তাই এগিয়ে চলে সুনিপুণ অভিনয়ের সমৃদ্ধ ধারায় নিশ্চিন্ত অস্কারের প্রত্যাশায়।
ঈশ্বর উপরে বসে সব দেখেন আর মুচকি হাসেন।মুনকার নাকীরের লেখার কষ্ট এবার কমবে। এই লেখক গ্রুপের ফেরেশতারা অনেকবারই ঈশ্বরের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের নেতা নেত্রীরা কাজের চেয়ে কথা বলেন অনেক বেশী।সব কথা লিখতে গিয়ে উনাদের হাত ব্যথা হয়ে যায়। তাছাড়া কিছুদিন পরপর এখানে বিভিন্ন সংস্থার নাম চেঞ্জ হয়। তাই আজকে যা লিখছে, ২ সপ্তাহ পরে দেখা যাবে তার অনেক কন্টেন্ট চেঞ্জ করতে হবে, নাম পাল্টাতে হবে ইত্যাদি। কাজের এখানে শেষ নেই। কারও কারও আবার অধিক সময় ল্যাপটপের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, ঘাড় ব্যথা ইত্যাদি নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আগে মাঝে মাঝে কিছু চামবাজ ফেরেশতা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে বন্দিদের দিয়ে হাত পা ম্যাসাজ করিয়ে আসতেন, এখন আবার তাতেও বিপত্তি হয়েছে। কারাগারের ভেতর আটক এক নেতা কারাবদন্দিদের দিয়ে ম্যাসাজের কাজ শুরু করলেন। মুনকার নাকির দের ম্যাসাজ কর্মী সঙ্কট! অনেক বন্দীও আবার মাটির তৈরী নেতার তেল-ঘুষ-ভালোমন্দ খাওয়া নাদুশ নুদুশ গাত্র টিপে এখন আর নুরের তৈরি ফেরেশতাদের শরীর টিপে কোনও মজা পান না। সঙ্কট তাই দূরিভুত না, আরও ঘনীভুত। হাত পা ব্যথা আর চোখের সমস্যা নিয়ে ফেরেশতারা একবার স্বর্গীয় ডাক্তারের দরবারেও হাজিরা দিয়েছিলেন। স্বর্গীয় ডাক্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকের মতো রোগীর দিকে ঠিকমত না চেয়েই প্যাডে লিখে দিলেন, বেশী করে শাক সবজি, ফলমূল খাবেন, চোখের সমস্যা- এটা ভিটামিনের অভাব, আর বেশী করে মাছ মাংস খাবেন, প্রোটিনের অভাব দূর হলে হাত পা ব্যাথা কমে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের খাওয়া নিয়ে হয়েছে তাদের আরেক ঝামেলা। ফেরেশতারা ফরমালিন দেওয়া সবজি, ফলমুল খেতে পারেন না, গা গুলিয়ে বমি আসে। মাছের ক্ষেত্রেও সেই একই সমস্যা। মাংস খাবেন, তাও আবার এনথ্র্যাক্স বিপত্তি। আর হালাল হারামের সমস্যা তো আছেই। মানুষ তো আর সব দেখতে পায় না, রেস্টুরেন্টে বসে গাটেঁর পয়সা খরচ করে মরা মুরগীর মাংস চিবিয়েও দিব্যি সুখ পায়। কুকুর শেয়ালের মাংসও অবলীলায় খেয়ে ফেলে, মানুষের জিহবার স্বাদ্গ্রন্থীগুলাও ভোঁতা, টেরই পায় না। কিন্তু মুঙ্কার নাকিরেরা তো থাকে সব কসাইয়রের কাধে কাঁধে। উনারা সবই দেখেন।মরা মুরগী আর শেয়াল নাহয় বাদই দিলাম, দোকানে বসে ফারমের মুরগীগুলা যখন জবেহ করার নামে কসাইরা গলা কেটে ঝুরিতে ঢুকায় তখন কয়বার যে ঈশ্বরের নাম নেয় তা তো সব উনাদের ল্যাপ্টপের ফাইলে লেখাই আছে। আর কাজের ফাঁকে যখন তারা জলত্যাগের জন্য চিপায় যান, তখন কতজন যে পানি ব্যবহার করেন, আর ফিরে এসে অম্নি গলাকাটা পর্বে লেগে যান সে কথা মনে করে অনেক ফেরেশ্তা এমনিতেই মাংস খাওয়ার কথা ভুলে যান।আর তাই ঈশ্বর বেচারাদের নিয়ে বেশ ঝামেলাতেই আছেন। আর রাজনীতিবিদদের সাথে থাকতে থাকতে ফেরেশ্তারাও বেশী কথা বলা শিখে ফেলেছে। ঈশ্বরের কাছে নালিশ করতে গিয়ে কোনওরকমে একবার ফ্লোর পেলে মাইক আর ছাড়েই না। শুরু করে সেই দুনিয়াতে চাকরি দিয়ে পাঠানোর প্রথম দিন থেকে।সব মিলিয়ে ঈশ্বরের কান ঝালাপালা। একই নাটক আবার মঞ্চস্থ হচ্ছে দেখে ঈশ্বর তাই একটু খুশীই হন। তাছড়া ওয়ান ইলেভেন এর সময় অনেকেই ঠিকমত রেহারসেল করতে না পারায় নাটকের মান তেমন ভালো হচ্ছিল না। হাহমাদুর বাহমান নামে এক অভিনেতা তো অভিযোগই করে বসলেন যে তার উত্তরার গোপন রিহারসেল এ পাপ্পারাজ্জিরা গিয়ে নাকি পুরা রিহারসেলই মাটি করে দিয়েছিল। চা নাশ্তার ফাঁকে ফাঁকে জ়ীব্রাইল কে নিয়ে নাটক দেখার সময় প্রায়ই জ়ীব্রাইল ঈশ্বরের রুচি নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। এমন ফালতু নাটক ঈশ্বর দেখেন একথা জ়ীব্রাইল বিশ্বাস করতে পারেন না। জ়ীব্রাইল এর মতে এর চেয়ে নাকি আদমের প্রিয় গায়িকা ইভা রহমানের গানের ভিডিও দেখাও ভালো। ঈশ্বর এখন বুঝতে পারছেন, ওয়ান ইলেভেনে আসলে তেমন শিল্পসম্মত কাজ করতে পারে নাই কলাকুশলীরা। ঈশ্বর জানেন, এক ইলেভেনে এদের কিসসু হবে না। এদের দরকার হাজার হাজার ইলেভেন। তাই দুই হাজার ইলেভেন (২০১১) সালের পুরা বছর স্বর্গীয় টিভি চ্যানেলে ঈশ্বর এই নাটকের স্লট বরাদ্দ দিয়ে দিয়েছেন। তাও আবার আডভার্টাইজমেন্ট ছাড়া। পুরো খরচ তোলার দায়িত্ব ঈশ্বর শাহরুখ খানের উপর ছেড়ে দিয়েছেন, বেচারা কন্সার্ট এর পর কন্সার্ট করতে গিয়ে দম ফেলার সুযোগও পাচ্ছে না। তবে ঈশ্বরের অগাধ বিশ্বাস খান সাহেবের উপর। সে ঠিকই ম্যানেজ করে ফেল্বে।ঈশ্বর তাই আজ কিছুটা ভারমুক্ত। একেতো একটা সুন্দর নাটকের প্রত্যাশায় ঈশ্বর অগ্রীম পুলকিত। অন্যদিকে মুঙ্কার নাকীরদের সমস্যা সমাধানেরও একটা উপায় তিনি বের করে ফেলেছেন। ডিজিটাল স্বর্গ ভিশন ২০২০ উপলক্ষে স্বর্গে মাসখানেক আগে চালু হওয়া মাইক্রোসফট ওয়ারডের কোর্স থেকে তিনি ট্রিকস টা শিখেছেন। গতকাল রাতে সব নেতানেত্রীরা ঘুমিয়ে পড়ার পর তাই সকল মুনকার নাকীর দের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আর তখন তাদের হাতে নাতে শিখিয়ে দিলেন মাইক্রোসফট কোর্স এর সেই কপি পেস্ট এর বিদ্যাটা। মুঙ্কার নাকীরেরা এখন ভীষণ খুশী। তাদের লেখালেখির কাজ অনেকটাই কমে গেছে। গত কয়েক বছরের পুরানো ফাইল খুলে ওখান থেকে শুধু কপি পেস্ট মারেন। আর মাঝে মধ্যে নাম আর ভেন্যু চেঞ্জ করেন। ডায়ালগ আর কাহিনি তো প্রায় সেইম। রিনেম ফাংশনটাও খুব ভাল কাজে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে কোন কোন রোল/নায়ক-নায়িকার এর নাম ফাইন্ড আর রিপ্লেইস দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাতার পর পাতা কাহিনি লিখে ফেলেন। আর বছর বছর সরকারের এয়ারপোর্ট, হাস্পাতাল, স্টেশন এসবের নাম পরিবর্তনেও তেমন সমস্যা হচ্ছেনা। ফাইন্ড অল, রিপ্লেস অল। দারুন কাজের এই ডিজিটাল প্রযুক্তি। ঈশ্বর যে কেন ডিজিটাল স্বর্গ বানানোর প্ল্যান্টা এতো দেরিতে নিলেন, মুঙ্কার নাকীরেরা সেটাই বুঝতে পারেন না। যাহোক এখন আর তাদের কোন প্রব্লেম নাই। এইতো আজকে সারাদিনে তাদের তেমন কোন কাজই ছিলো না। ৫-১০ মিনিট কাজ মানে কপি পেস্ট মেরে সবাই সংসদ ভবনের লেকের পাশে গিয়ে বাদাম আর বিড়ি ফুকতে গেল। ঘন্টাখআনেক আড্ডা মারার পর আবার যদি কোন ইভেন্ট ক্রিয়েট হয়, ত আবার ১০-১৫ মিনিট কাজ। আর ফাকে ফাকে কি সুন্দর অবসর। বিকালে তো তেমন কোন কাজই নাই। সব বিশিষ্ট নেতা নেত্রীরাই ঘুমিয়ে গেছেন। আজকে নাকি ৩১ শে ডিসেম্বর। রাত জ়েগে পার্টি করবেন। এখন তারি প্রেপারেশন। ফেরেশ্তারাও খানিকটা ঘুমিয়ে নিবেন কিনা তাই ভাবছেন। রাতে তো অনেক কাজ। নতুন বছর শুরু হচ্ছে, ২০১১। গুলশানের বড় বড় ক্লাবগুলো সব জমে উঠবে নাকি! রাত ১২ টার পর থেকে শুরু হবে ননস্টপ মাস্তি। নেতা নেত্রীরা সব যাবেন। সুদর্শনা, স্বল্পবসনা অনেক নারী আসবে, আর সাথে থাকবে ওয়াইন, বিয়ার, শ্যাম্পেন, আর বিদেশী মদ। সারারাত ধরে নাচ, গান আর বাদ্য বাজনা হবে, আর ভরপুর মদ্যপান। আহা ! পৃথিবীর বুকে যেন নেমে আসবে স্বর্গ। সেই কবে বেহেশ্ত থেকে নেমে এসেছিল চাকুরি নিয়ে দুনিয়াতে।কিন্তু বেহেশ্তের সেই পার্টিগুলার কথা ভুলতে পারে নাই আজও। ফর্সা সুন্দরী সব হুরপরী, পেয়ালাভরা শরাব, পাতলা কোমরের শাকীদের সেই মাতাল করা লাইলা কি জওয়ানি নৃত্য!! নাহ, দুনিয়াতে এসবের দেখা অত হরহামেশা হয় না। তবে নতুন বছরটা যদি সেই স্বর্গীয় উৎসবের মাদকিয়তায় শুরু করা যায়, তাও নেহায়েৎ মন্দ নয়। নাহ বছরটা মনে হয় কারোই খারাপ যাবে না, ঈশ্বরের জন্য রয়েছে সুপারডুপার ধারাবাহিক নাটক, মুঙ্কার নাকীরের সহজ কাজ আর বিশ্রামের অবসর, আর আমাদের প্রিয় নায়ক নায়িকাদের পছন্দসই নাটকের স্ক্রিপ্ট।নতুন বছর আসে তো এমনিভাবেই আসা উচিত। আপনাদের সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। পর্দা সরে যাচ্ছে মঞ্চের, শুরু হবে নাটক। বিড়ি সিগারেটের প্যাকেট, বাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়ি, চকলেট অথবা বিয়ার, ওয়াইন, বা চা, কফি যে যেটায় অভ্যস্ত সঙ্গে নিয়ে জেঁকে বসে পড়ুন আর চোখ রাখুন মঞ্চে। এই তো আতশবাজি ফুটে উঠলো-আর নড়ন চড়ন নয়।
ভেসে আসছে উপস্থাপকের কন্ঠ, স্বাগতম ২০১১ !! Ladies and gentlemen, happy new year and..
Just enjoy the SHOW!!
(কার্টুন্টা Claudio Munoz এর আঁকা আর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল The Economist এ ১০ জুন, ২০১০এ।)
---------------------
শামীম আরমান
মন্তব্য