সন্ধি
সময়টা ১ম বিশ্বযুদ্ধের । কানাডা থেকে সামরিক বাহিনীর চিকিৎসক কর্ণেল ম্যাকক্রের পোস্টিং হলো বেলজিয়ামের ফ্যালান্ডারস নামের এক জায়গায়। উত্তর আমেরিকা ছেড়ে পুরো কনকনে শীতের ইউরোপে। পরিচ্ছেদে সামরিক বাহিনীর উর্দি থাকলে কি হবে, মনে কিন্তু এখনো কবিতার লাইনগুলো ভেসে বেড়ায়। বেলজিয়ামে তখনো মৃত্যুর এক দেশ, চারিদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। এরই মাঝে লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে কিছু ছোট ছোট গাছ ।,থোকা থোকা রক্ত রঙ্গা ফুল, গাছের কাছে তো আর যুদ্ধের কোন আলাদা রুপ নেই। কর্ণেলের মনের কবিতার কথাগলো চটজলদি লিখে ফেলেন পেনসিলের খসখসে আওয়াজ তুলে ডেসপ্যাচ কাগজে। লেখা হয়েছিল সেখানটায়,
In Flanders fields the poppies blow
Between the crosses, row on row
That mark our place; and in the sky
The larks, still bravely singing, fly
Scarce heard amid the guns below.
We are the Dead. Short days ago
We lived, felt dawn, saw sunset glow,
Loved and were loved, and now we lie
In Flanders fields.
Take up our quarrel with the foe:
To you from failing hands we throw
The torch; be yours to hold it high.
If ye break faith with us who die
We shall not sleep, though poppies grow
In Flanders fields.
এই কবিতাটি ছাপা হয় ১৯১৫ সালের এক বিট্রিশ ম্যাগাজিন পাঞ্চ । পুরো কবিতা দেখুন কি আবেগ আর আকুতিতের ভরা যুদ্ধে শহীদ সেই বীর সেনানীদের কথা। ’ইন ফ্যালান্ডার ফিল্ডস’ বাংলায় যা অর্থ করলে দাড়াঁয় ফ্যালান্ডারের প্রান্তরে। কবিতাটি কারোর নজরে পরে আরো তিন বছর পরে। ওয়েব ঘেটে দেখতে পাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ময়িনা মাইকেল আর ফ্রান্সের আন্না ই গুয়েরিন। ময়িনা তখন কাজ করতেন আটলান্টার জর্জিয়া বিশ্ববদ্যালযের YMCA ( ইয়ুথ ম্যানস ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশন ) এর একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তারপর দায়িত্ব বদলি হয়ে চলে আসেন, এর সদর দফতর নিউইর্য়ক শহরের কলাম্বিয়া বিম্ববিদ্যালয়ে। কাজটা তখনো বিদেশীদের ( মার্কিনি বাদে অন্যরা) যুদ্ধ কর্মীদের সাথে।
তারপর নভেম্বরের এক মিঠেকড়া রোদেলা সকালে, এক তরুন যুদ্ধফেরত সেনা একটা পত্রিকা রেখে যায় ময়িনার এর টেবিলে। এদিকে তখন ২৫ তম বার্ষিক তরুণ সন্মেলনের কাজ দ্রুততালে এগিয়ে চলছে। ময়িনার হাতে তেমন ফুরসত নেই পত্রিকা পড়ার কিন্তু তারপরেও চোখ আটকে যায় বর্ণীল ইলাস্ট্রেশনের কল্যাণে একটি কবিতায় পাতায়। কবিতাটির নাম ছিল We shall not sleep ( যা পরবর্তীতে ’ইন ফ্যালান্ডার ফিল্ডস’ নামে পরিচিত হয়)। ময়িনার মাথায় তখন শুধু শেষ লাইনগুলো আটকে যায়To you from failing hands we throw the Torch; be yours to hold it high. If ye break faith with us who die, we shall not sleep, though poppies grow in Flanders Fields
বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় একটি আইডিয়া চলে আস ময়িনায় মাথায়। দেরি না করে একটা বাতিল চিঠির খামের কাগজের মধ্যে লিখে ফেলেন শেষ লাইনগুলো আর ছিল একটি আর্জি সবার কাছে, ফ্যালান্ডারস এর নিহত সেনানীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সেখানকার একট রক্তিম পপির ফুল বুকপকেটে আটকে রাখা।
১৯১৮ সালের ৯ই নভেম্বর সেই কলাম্বিয়া ভার্সিটির সন্মেলনের তিনজন অতিথি আসের ময়িনার টেবিলে । অভিনন্দন জানান ময়িনাকে আর হাতে তুলে দেন ১০ ডলারের একটি চেক । তাদের একটা অনুরোধ ময়িনা কি দয়া করে সন্মেলনের অভ্যাগতদেr জন্য সেই পপি ফুল কিনতে পারবেন।ময়িনা তাদেরকে সেই পত্রিকার পাতটা খুলে দেখান আরেকবার। ঘটনাটা এখানে শেষ হতে পারতো। কিন্তু ময়িনা শহরের ওয়ানামায়ার স্টোর খুঁজে বের করেন একটি বড় আর ২৫টি ছোট সিল্কের তৈরী কৃত্রিম পপি ফুল। সেই সন্ধ্যায় সন্মেলনের সবার কোটের বাটনহোলে একটি করে কৃত্রিম পপি হয়ে উঠলো শহীদ বীর সেনানীদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক।
১৯১৯ সালের দিকে ময়িনা আবার জর্জিয়াতে ফিরে আসেন এবং কাজ শুরু করেন যুদ্ধাহত সেনাদের নিয়ে । সেই সব যুদ্ধজয়ী মানুষরা তখন জীবন যুদ্ধের সংগ্রামে টাকা নামের এক আজন্ম শত্র“র কাছে মাথা নত। কিন্তু ময়িনা তো আছেন। পপির আইডিয়া কিন্ত বাসী হয়নি। তাই সেই সব মানুষগুলো নিয়ে শুরু করলেন কৃত্রিম পপি ফুল বাননোর কাজ। আর সেটা থেকে আয় করা টাকা তো তাদের কাজে লাগানো, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখেনা। তারপর ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এক সন্মেলনে ঘোষনা দেয়া হলো , এখন থেকে আমেরিকার বিক্রিত সব রেশমী পপি ফুল বানানো হবে যুদ্ধ ফেরত সেনানীদের দিয়ে। আর বিক্রিকৃত টাকা তাদের জন্য পুরো ব্যয় করা হবে।
তারপর থেকে পপি ফুলে চাহিদা আরো বেড়ে যাচ্ছে দেখে ১৯২৪ সালের দিকে পিটসবার্গে একটি গোটা কারখানা খুলে ফেলা হলো পপি ফুল বানানোর জন্য আর চাকরি দেয়া হলো সেইসব বেকার সেনানীদের যাদের আর কোন উপার্জনের পথ খোলা ছিল ন্ া। এর এই টাকাটা থেকে সুবিধা দেয়া শুরু হলো বীর সেনানীদের বিধবা পতœী, আর অনাথ শিশুদের। গোটা ব্যাপারটা ছড়িয়ে পরলো সারা আমেরিকা জুড়ে। আর পপি ফুল হয়ো উঠলো মেমোরিয়াল ডে এর প্রতীক। এখনও প্রতিবছর গোটা মার্কিন মুল্লুকে মে মাসের শেষ সোমবার স্মরণ করা হয় সেইসব সেনাদের যার বিদেশে যুদ্ধ করতে যেয়ে আর ফিরে আসেনি।
এবার আসি আমাদেও গৌরবময় সেই যুদ্ধের কথা। কদিন আগে একটি ব্লগে পড়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে এক কনিষ্ঠ বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধা শহীদুল ইসলাম লালু মারা গেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বারান্দায়, দুটো কিডনি অকেজো হয়ে, ধুকে ধুকে। ১২ বছর বয়সী সেই মুক্তিযোদ্ধার সেই গ্রেনেড ছোড়া হাতগুলো যখন আমাদের দিকে একটু সাহায্যর জন্য হাত বাড়ায় আর তার একসময়ের শাণিত চোখ দেখে আমাদের ভাবলেশহীন নিরুত্তাপ অভিব্যক্তি, তখন এই প্রজন্মের একজন মানুষ হিসেবে খুব গ্লানিকর মনে হয়। কেন একজন মুক্তিযোদ্ধার এরকম মৃত্যু হবে? কেন আমরা বিনোদনের নামে হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারি আর একজন মুক্তযোদ্ধার একটু চিকিৎসা সেবা দিতে পারিনা? এসব কেনর উত্তর আমাদের সবার কাছেই জানা। জাতি হিসিবে আমরা খুব আতœবিস্মৃতির জাতি। আমরা খুব আবেগ নিয়ে কোন জিনিস চিন্তা করতে পারি বড়জোড় মাসখানেক। কিছু লেখালেখি আর ব্লগের পাতায় মন্তব্যের ঝড় কিন্ত তারপর?
এবার আসুন আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করি। সরকারী কিংবা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠানকে কোন অনুদান দিযে নয় । আমরা অন্তত এমন একটা দোকান বানাতে পারি যেখানে সব কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হবে কর্মক্ষম বেকার মুক্তিযোদ্ধা (যাদের অন্য কোন আয়ের উৎস আছে, তাদেরকে এই তালিকা থেকে বাদ হবে) দের নিয়ে। দোকানের পন্যগুলোতে থাকুক আমাদের প্রতীক কাপড়ের শাপলা এর শাপলার মনোগ্রাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই উদ্যোকতা আছেন যারা সেই দোকানটা গড়ে তুলতে পারবেন। আর আমরা কিনতে তো পারবো, এতটুকু নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমতা আছে। আমরা দেশে বিদেশে সেই পণ্য ব্যহার করে অন্তত আর পাচঁটা মানুষকে জানাতে পারি, আমরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভুলিনি। আমাদের প্রতিদিনের পরিচ্ছেদে, কলমে, পেনসিলে, রোজনামচায় থাকুক তাদের প্রতীক, আমার ল্যাপটপে থাকুক একটা স্টিকার। আমরা বিজয়ের মাসগুলোতে আমাদেও জামার, কোটপিনগুলোতে থাকুক একটি করে শাপলা। আর এই টাকাগুলো যাক সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদেও কাছে, যারা একনও পঙ্গু হয়ে মেহনতি রিকসা চালায় , দিনমজুরি করে,তবু মাথা নত করেনি । আমরা পারি তাদের সেই পেশাটি পরিবর্তন করতে। আমাদের বছরের বিশেষ মাসগুলোতে শুধু খোমাখাতায় প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন না করে আসুন একটা করে কাপড়ের শাপলা কিনি। আর সেই টাকাগুলো যাক আমাদের সেই সূর্য সন্তানদের কাছে।যাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি একটি পতাকা, একটি মানচিত্র
আমার জামায় ফুটে উঠুক আমার পূর্বপুরুষের বীরত্বের প্রতি আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালবাসা ।
পুনশ্চ: আমার লেখার গতি এবং মান দুটোই ভয়াবহ রকম খারাপ। এখনও অভ্রতে খরগোশ হতে পারিনি।আর লেখার মধ্যে আবেগের কোন বালাই নাই। পুরোমাত্রায় কনফারেন্স প্রসেডিং
তবে লেখার কপিরাইট আমার। খোমাখাতায় শেয়ার করা যাবে।কিন্তু কোন পত্রিকা কিংবা ব্লগে আংশিক কিংবা সর্ম্পূণ প্রকাশ আমার লিখিত অনুমতি ছাড়া নিষেধ।
আরিফিন সন্ধি
ইমেইল:
স্টকহোম, সুইডেন
মন্তব্য
আপনার লেখা ভালো লেগেছে। তবে লেখার মাঝে হঠাৎ ছবি একটু চোখে লেগেছে। -রু
মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ। আমি এখনও ইউনিকোড এ পটু হতে পারিনি।আর ছবিগুলো Flicker দিয়ে যোগ করলে মনে হয় ভাল হতো।
সন্ধি
আমাকে কি কেউ বলতে পারেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্টের ডজন ডজন প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কিনা। এবং এখন সেখানে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে কিনা। এবং গত চল্লিশ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কী কী কল্যানে ব্যয় করা হয়েছে। এবং গত চল্লিশ বছরের জাতীয় বাজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যানের জন্য কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যান ও উন্নয়নের জন্য মূল করণীয় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সেটা যথাযথভাবে না করে থাকলে সেটার জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগে এক-আধজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য সামান্য কিছু হয়তো করা সম্ভব, তবে সেটা করে আত্মপ্রসাদ পাবার কিছু নেই। রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটের আগে এই প্রশ্নের মুখোমুখি করতে হবে এই ব্যাপারে তারা এ'পর্যন্ত কী কী করেছেন, এবং এ'ব্যাপারে তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? কোনভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোন করুণা বা ভিক্ষা নয়; তাঁদের ন্যায্য পাওনা তাদেরকেই ফিরিয়ে দিতে হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পুরোপুরি একমত।
'মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !'
তোমাদের আত্মদান 'হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই'
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নতুন মন্তব্য করুন