১
ক্লাস এইট অথবা নাইনে পড়তাম তখন,জেমসের একটা গান বাজারে আসল।স্কুলে যাবার পথে দোকানে, পাশের বাড়ির বড় ভাই,সহপাঠী সবার মুখে একই গান শুনি। “লিখতে পারিনা কোনো গান,আজ তুমি ছাড়া”।সুপার ডুপার হিট গান।বলাবাহুল্য গানটা আমারও ব্যাপক পছন্দের একটা গান ছিল।ছিল বললাম, কারণ আগে ছিল।এখন গানটা শুনলে আগের মতো সে অনুভূতি আর পাইনা। শুধু এই গানটাই না। আইয়ুব বাচ্চুর “নীলাঞ্জনা” গানটাও আমার খুবই পছন্দের একটা গান। স্কুলে পড়ার সময় তখনো সিডি বা ডিভিডি প্লেয়ার হাতে আসেনি। ভরসা ছিল একটা সিঙ্গার টুইনওয়ান।
পছন্দের গানগুলোকে কত বার রিওয়াইন্ড করে বাজিয়েছি হিসাব নেই।“লিখতে পারিনা” আর “নীলাঞ্জনা” এদের মধ্যে অন্যতম। এই গান দুটোর জন্য বাসায় বকাঝকাও কম খাইনি। মা বাবার কথা ,কি এমন গান যে এতো বার শুনতে হবে?প্রশ্নটা আমারও।'কি এমন গান। কিন্তু সেসময় ওই গানগুলো না শুনলে কেমন জানি অস্থির লাগতো। “নীলাঞ্জনা” গানটা শোনার সময় বুকের কাছে কি জানি একটা দলা পাকিয়ে উঠতে চাইতো।জীবনে তখন কোনো নীলাঞ্জনার আগমন হবার কোনো সম্ভাবনাই ছিলোনা। তারপরও অজানা নীলাঞ্জনার জন্য বুকের বামপাশটাতে একটু ব্যথা কেন যে লাগতো। স্কুলের বায়োলজির স্যার বলতেন, “বাবা রে সবই হরমোনের প্রভাব”। সেই থেক আমার বায়োলজির উপর অভক্তি। ইন্টারমিডিয়েট এ তাই বায়োলজির সংস্পর্শ পুরোপুরি ত্যাগ করলাম।
২
এক খান বাবাজী কিছুদিন আগে বাঙ্গালীদের নাচিয়ে গেলেন, আর আমরাও তার সাথে সাথে পকেটের পয়সা খরচ করে নাচলাম।তারই একখান মুভি “মোহাব্বত”।আমরা যখন হাইস্কুলে পড়ি তখনকার মুভি। যথারীতি আমরা বন্ধু বান্ধব সবাই ছিলাম এই মুভির ভক্ত। একখান ন্যাকা প্রেমের মুভি।সেদিন মুভিটা হলের ল্যান এ পেয়ে আবার দেখতে বসেছিলাম। ২০ মিনিট দেখার পর ন্যাকামির চোটে,বিরক্তির কারণে উঠে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।তবু কি জানি ছিলো ওই মুভিতে। মুভি থেকে বেশি জাদু ছিলো মনে হয় গানগুলোতে। আনন্দ বকশির লিরিক্সের গান। একটা গান ছিলো “দেখো আয়ে, আয়ে চোর(বলাবাহুল্য, মন চোর)”।গানটা শুনলেই সেই বয়সে কেন জানিনা, অজানা মন চোরের প্রতীক্ষায় আমরা সারাদিন হৈহুল্লোড় করা কয়েকটা ছেলের দল একেবারে চুপ হয়ে যেতাম।
৩
আমার অতি প্রিয় দূরবীন শাহর একটা গান। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে আসা এক আত্মিয়ের মুখে শুনেছিলাম গানটা-“ছাড়িয়া যাইওনা বন্ধুরে, বন্ধু আমায় পাশরিয়া”।প্রথম যখন গানটা শুনি, তখন হেসেছিলাম। গানটাতে একটা লাইন আছে-“চরণের নুপুর হইলে রে বন্ধু , যদি দুঃখ পাও,চরণ ধরে পড়ে থাকব,বুকে রাখব পাও বন্ধু রে ...”।আমি তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি। আমার হাসি দেখে ওই আত্মিয় বলেছিলো, “এখন হেসে নাও, পরে আর হাসি নাও থাকতে পারে জীবনে”।ওই কথা শুনেও হেসেছিলাম। বছর দুয়েক পর ওই আত্মিয় যখন আবার বাসায় আসলো, তখন তাকে গানটা আবার গাইতে বলি। গানটাতে একটা চরণ ছিলো—“আমার মনে যে বাসনা রে বন্ধু,সকলি তোর জানা,দূরবীন শাহ তোর চিরদাসী, বিনামূল্যে কিনা বন্ধু রে”।সেবার গানটা শুনে আর হাসিনি।শুধু বুঝেছিলাম, একটা মানুষ বিনামুল্যের দাস হয়ে গেছে।কেন যে মানুষ বিনামূল্যের দাস হতে চায়, সে প্রশ্ন আর মনে জাগেনি।
৪
এরপর অনেক দিন চলে গেছে। সুরমার,কুশিয়ারা,খোয়াইয়ের বুক দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে।পরীক্ষা শেষ করে অবসর বসে আছি। কি করা যায়?কোনো কিছু খুঁজে না পেয়ে সংগ্রহের পুরনো গানগুলো একটা একটা করে আবার শুনতে লাগলাম। কিন্তু কেন জানিনা,সেই অনুভূতি আর পেলাম না। মনে হলো, কেমন জানি যন্ত্র হয়ে গেছি।প্রিয় গানগুলো শুনে বুকের বামপাশটাতে আগের মতো সেই বিশেষ ব্যথাটা কেন জানি অনুভব করছিনা। অথচ মনপ্রাণ আকুলভাবে চাইছে,সেই বুকের মধ্যে দলাপাকানো ওঠার অনুভূতিটা আবার ফেরত পেতে। না কোনোভাবেই আর পেলাম না সেই অনুভূতি ।সবশেষে আমার মায়ের প্রিয় একটা গান শুনলাম। “আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। বাঁশি তো আর আগের মত বাজেনা ”। ওই গানটা কোনকালেই আমার প্রিয় ছিলোনা।তবু গানটা কেন জানি না আজকে অনেক অর্থবহ মনে হলো।আসলেই বাঁশিটা মনে হয় আর কোনদিন সেই সুরে বাজবেনা............
মন্তব্য
সময়ের সাথে সাথে রুচি, পারিপ্বার্শিকতা সবকিছুই বদলায়। এতে অস্বাভাবিকত্বের কিছু নেই। আর ফেলে আসা ভালোলাগার সময়গুলোও তাতে মিথ্যে হয়ে যায় না।
----------------------------------------------
আমার যত অগোছালো চিন্তাগুলি,
রয়ে যাবে এইখানে অযতনে ।।
লেখা ভাল লাগলো। আইয়ুব বাচ্চুর "নীলাঞ্জনা" শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। শেখ ইশতিয়াকেরও একটা গান ছিল এই টাইটেলে, খুবই হিট করেছিল গানটা। অনেক আগের কথা অবশ্য।
-রু
আইয়ুব বাচ্চুর গানটার লিঙ্ক।
http://beemp3.com/download.php?file=6716285&song=Nilanjona+by+Aiyub+Bachchu
নিন একটা গান..
http://www.youtube.com/watch?v=futedPK6054
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
কী কাকতাল!! গত দুইদিন থেকে চন্দ্রবিন্দুর গান শুনতেসি...আর কাল সারাদিন এই গানটা বাজছে পিসিতে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
গানটা একজনের খালি গলায় গাওয়া শুনেছিলাম। তাও শেষের দুই কি তিন লাইন। গানটা পেয়ে খুবই ভাল লাগল। ধন্যবাদ।
ভাই এক দম হাছা কইছেন ... মনের কথা কইছেন ...
আসলেই এখন আর "বাঁশি আগের মত বাজেনা।"
মাঝে মাঝেই সেই বাঁশি বাজার অনুভূতি টা খুঁজি কিন্তু পাই না ...
ভাল লাগল পড়ে ... ধন্যবাদ রু
ধন্যবাদ
লেখা ভালৈছে...আরও চাই।
সত্যি কথা বলেছেন। আমরা সবাই আসলে যন্ত্রই হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।
বিপ্লবী স্বপ্ন।
সুন্দর বর্ণনা
আরও দলা পাকানো গান শুনুন এবং আমাদের জন্যে তার গল্প লিখুন।
-অতীত
নতুন মন্তব্য করুন