সংস্কৃত না পালি—ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ভাষা কোনটি তা নিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরেই বিতর্ক চলেছে। তবে সে বিতর্ককে পাশ কাটিয়েও বলা যায়, সংস্কৃত গ্রিকের চেয়ে বেশি নিখুঁত, ল্যাটিনের চেয়ে বেশি গভীর, এবং এ দুটো ভাষার তুলনায় অনেক বেশি নিপুণতার সাথে সংস্কারকৃত, যদিও তাদের উভয়ের সাথেই সংস্কৃতের যথেষ্ট পরিমাণে সাদৃশ্য রয়েছে। ক্রিয়াপদের মূল এবং ব্যাকরণগত গঠনপ্রণালীর দিক থেকে এ তিনটি ভাষায় এত বেশি মিল যে, ভাষাগুলোর উৎপত্তি যে একই উৎসমূল থেকে হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। সেই অজ্ঞাত মূল সূত্রটি অবশ্য চিরতরে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
প্রাচীন ভারতবর্ষে সর্বসাধারণের কথ্যভাষা ছিল প্রাকৃত ভাষা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একাধারে লিখিত ও কথ্য ভাষারূপে ভারতের নানা জায়গায় এ প্রাকৃত ভাষাসমূহ প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ধারণা করা হয় প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে পালি অন্যতম, যার জন্ম খ্রিষ্টজন্মেরও কমপক্ষে ছ শ বছর আগে। পালি ছিল মধ্য বিহারের মগধ অধিবাসীদের মুখের ভাষা। পালি মুখ্যত কথ্য ভাষা হলেও তার সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণ ছিল এবং তাতে কাব্য, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছিল।
যুগ যুগ ধরে ভারতে (মূল অংশে) যেমন সংস্কৃতের কদর বা ইউরোপে ল্যাটিনের—গঙ্গার এপারে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পালিও ঠিক তা-ই আছে এখন পর্যন্ত, যেমনটি শত বছর ধরে ছিল। কিন্তু এত যে পুরোনো ভাষা, এত সুদূরব্যাপী যার বিস্তার, এবং এত সব মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন যার রয়েছে সেই পালি তার যথাযথ মর্যাদা পায়নি। তার সম্মানে কোনো রচনা প্রকাশিত হয় না। এমনকি গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের নিকটও পালি যেন অনেটাই অপরিচিত। এই অসম্মান ও অনাদর পালির পাওনা ছিল না।
সংস্কৃতের মতোই পালিরও মৃত্যু ঘটেছে বহু শতাব্দীকাল আগেই। অর্থাৎ এখন আর এ ভাষার কোনো স্থানীয় জাতি নেই, বা সে অর্থে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহারের মানুষ নেই; কেবল সাহিত্যিক ও ধর্মীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। গৌতম বুদ্ধ এ ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করেছিলেন। মূলত একটি সাধারণ প্রাদেশিক ভাষা হয়েও এটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠেছিল, যা তাকে বসিয়েছে চিরায়ত ভাষার আসনে। সংস্কৃতের সাথে এর সম্পর্ক অনেকটা বোনের মতো। পালি এবং সংস্কৃত, যদিও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে দুজনের মধ্যে, ছিল হারানো আর্যভাষার সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বাধীন দুটি ভাষা-শাখা। এই অর্থে হারানো আর্যভাষাই এই সহদোরার প্রকৃত মা। [১]
হারানো আর্যভাষা মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশেরই সদস্য। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ বলতে মূল ভাষাগোষ্ঠীকে বোঝায়। যেসব ভাষা ইউরোপের অনেকটা অংশজুড়ে এবং বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমে বিস্তৃতি লাভ করে তাদের সম্মিলিতভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবার বলা হয়। অবশ্য এসব ভাষাভাষী গোষ্ঠী বর্তমানে সারা পৃথিবীজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি মানুষ এ পরিবারভুক্ত ভাষায় কথা বলে থাকেন। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাসহ গ্রিক, ল্যাটিন, ইংরেজি, হিন্দি, ফারসি, ফরাসি, ডাচ, নেপালি ইত্যাদি ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এই মূল ভাষার অস্তিত্ব ছিল। এই ভাষা-পরিবারের ভাষা-শাখাগুলোর মধ্যকার পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আজ থেকে তিন বা চার হাজার বছর আগে। মূলত ওই সময়ের মধ্যেই গ্রিক, অ্যান্টোলিন এবং ইন্দো-ইরানীয় প্রভৃতি ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে এসব ভাষা এসেছে পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের সমভূমিতে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর উপজাতির কাছ থেকে। এ অঞ্চলকে একসময় ‘গোবি’ও বলা হতো। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ভাষাভাষী লোকেরা ইউরোপ ছাড়িয়ে আটলান্টিকের উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরের উত্তর কূলের দিকে আসতে শুরু করে। পারস্য ও ভারত জয়ের মধ্য দিয়ে তারা ছড়িয়ে যায় এশিয়ার দূর এলাকাসমূহে। সমসাময়িক সময়েই সিন্ধুর অধিবাসীগণও পূর্বদিকে (গাঙ্গেয় সমভূমি) এবং পশ্চিমদিকে (ইরান এবং আফগানিস্তান) ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে দুটি ভাষা-শাখা, ভারতীয় আর্যভাষা (ইন্দো-আর্য) এবং ইন্দো-ইরানীয় ভাষা, আলাদা হয়ে যায়।
ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসে তিনটি প্রধান স্তর লক্ষ করা যায়।
১. প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা—বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষার স্তর : সংস্কৃতের প্রাচীন রূপই হচ্ছে বৈদিক ভাষা, যা প্রচলিত ছিল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ পর্যন্ত। বৈদিক ভাষায় প্রথম ইন্দো-ইউরোপীয় কাব্য/ধর্মগ্রন্থ বেদ রচিত হয়েছিল। এ ভাষাটি যখন সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে তখন ব্যাকরণবিদগণ নানা নিয়ম বিধিবদ্ধ করে একটি মানসম্পন্ন ভাষা সৃষ্টি করেন, যার নাম সংস্কৃত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে এ ভাষাটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয় ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতে। মূলত সংস্কৃত ছিল সাহিত্য এবং প্রায়োগিক কৌশলসংক্রান্ত কাজের ভাষা। প্রাকৃত ভাষার যুগেও (যার শুরু আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে) সাহিত্যের ভাষা ও শিক্ষিত জনের ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহার ছিল। শিক্ষিত লোকজন সংস্কৃত ও প্রাকৃত এই উভয় ভাষাই জানতেন এবং প্রয়োজনে যে কোনো একটি ভাষা ব্যবহার করতেন। অনেকটা আমরা যেমন 'মান বাংলা' আর 'আঞ্চলিক বাংলা' এই দুই ভাষাই ব্যবহার করে থাকি বা করতে পারি তেমন। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত কালিদাসের কাব্য ও নাটকের ভাষা ছিল সংস্কৃত। রামায়ণ ও মহাভারত সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হয়েছে। এমনকি এত কাল পরেও সংস্কৃত ভারতে ব্যাপকভাবে পঠিত/চর্চিত এবং একটি পবিত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।
২. মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা—পালিসহ অন্যান্য প্রাকৃত ভাষার স্তর (অপভ্রংশ) : ধারণা করা হয় এই স্তরের সূচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৬০০ অব্দ। জৈন ধর্মের অনেক গ্রন্থ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক প্রাকৃত পালি ভাষায় লেখা।
মনে করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৭ অব্দে বোধি লাভ করে সিদ্ধার্থ গৌতম ‘বুদ্ধ’ নামে পরিচিত হন। একই সময় চতুর্বিংশতিতম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর একই ধরনের অপর একটি ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেন; পরবর্তীকালে যা জৈনধর্ম নামে পরিচিত হয়। বুদ্ধের শিক্ষা ও জৈন ধর্মতত্ত্ব নির্বাণতত্ত্বের কথা বলে। প্রাকৃত ভাষায় রচিত হওয়ায় তাঁদের ধর্মমত সহজেই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। [২]
সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে সর্বপ্রথম "অপভ্রংশ" শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত কিছু অশিষ্ট শব্দকে নির্দেশ করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমান ভাষাবিদদের মতে সমস্ত প্রাকৃত ভাষারই শেষ স্তরটি হল অপভ্রংশ এবং এই অপভ্রংশগুলি থেকেই সমস্ত নব্য ইন্দো-আর্য ভাষা উদ্ভূত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব ভারতে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে পূর্বী অপভ্রংশ উদ্ভূত হয়েছিল এবং সেই পূর্বী অপভ্রংশ থেকে মগহী, মৈথিলী ও ভোজপুরী—এই তিনটি বিহারী ভাষা এবং বাংলা, অসমীয়া ও ওড়িয়া—এই তিনটি গৌড়ীয় ভাষার উৎপত্তিলাভ ঘটে। অন্যদিকে, পশ্চিমের শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে হিন্দি ও অন্যান্য নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার উদ্ভব হয়। [৩]
অপভ্রংশ খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, যদিও খ্রিষ্টীয় দশম শতক থেকেই আধুনিক আর্যভাষাগুলো বিকশিত হতে শুরু করেছিল। ভাষার সংখ্যা অননুমেয় হলেও হিন্দি, উর্দু, বাংলা, বিহারি, গুজরাতি, কানাড়া, মালয়ালাম, মারাঠি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, রাজস্থানি, তামিল, এবং তেলেগুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব ভাষার প্রত্যেকটিতেই বর্তমানে এক কোটিরও বেশি লোক কথা বলেন।
৩. নব্য ভারতীয় আর্যভাষা—বাংলাসহ হিন্দি, গুজরাতি প্রভৃতি মধ্য ও উত্তর ভারতীয় আধুনিক ভাষাসমূহ : এই স্তরের সূচনাকাল খ্রিষ্টীয় ১০০০ অব্দ বলে মনে করা হয়। খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাদের শেষ প্রান্তে এসে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে যেসব আধুনিক ভারতীয় ভাষার উদ্ভব ঘটে, বাংলা তাদের মধ্যে অন্যতম। যদিও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, সপ্তম শতকেই অর্থাৎ ৬০১-৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলার জন্ম হয়।
বাংলা ভাষার ইতিহাসকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয় :
ক. প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০ খ্রিস্টাব্দ – ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ)—লিখিত নিদর্শনের মধ্যে আছে চর্যাপদ, ভক্তিমূলক গান; আমি, তুমি, ইত্যাদি সর্বনামের আবির্ভাব; ক্রিয়াবিভক্তি -ইলা, -ইবা, ইত্যাদি। ওড়িয়া ও অসমীয়া এই পর্বে বাংলা থেকে আলাদা হয়ে যায়।
খ. মধ্য বাংলা (১৪০০–১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)—এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ লিখিত নিদর্শন চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন; শব্দের শেষে “অ” ধ্বনির বিলোপ; যৌগিক ক্রিয়ার প্রচলন; ফার্সি প্রভাব। কোন কোন ভাষাবিদ এই যুগকে আদি ও অন্ত্য এই দুই ভাগে ভাগ করেন।
গ. আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে)—ক্রিয়া ও সর্বনামের সংক্ষেপন (যেমন তাহার → তার; করিয়াছিল → করেছিল)। [৪]
নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ও মারাঠির শব্দভাণ্ডারে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ রয়েছে; অন্যদিকে হিন্দি ও অন্যান্য ভাষাগুলো আরবি ও ফার্সি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। হিন্দি এবং উর্দু নামে ভিন্ন হলেও যেন একই কুঁড়ির দুটি পাতা। প্রধান পার্থক্য লুকিয়ে আছে তাদের শব্দকোষ, লিপি, এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যে। আধুনিক হিন্দির শব্দভাণ্ডার প্রধানত এসেছে সংস্কৃত থেকে, আর উর্দুর শব্দ বলতে বোঝায় মূলে যাদের ফার্সি এবং আরবি শব্দ; হিন্দি লেখা হয় দেবনাগরী লিপিতে, এবং উর্দু পার্সিয়ান-অ্যারাবিক লিপিতে। হিন্দি প্রধানত হিন্দুদের ভাষা; উর্দু ব্যবহারকারীদের মধ্যে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ—ভারতে যেমন সমগ্র পাকিস্তানেও তেমনি। হিন্দি ভাষায় প্রায় এক শরও বেশি উপভাষা রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান দুটি হচ্ছে—পশ্চিমী হিন্দি যা উদ্ভূত হয়েছে দিল্লী অঞ্চল থেকে, এবং পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দি যা মূলত মধ্য উত্তরপ্রদেশ এবং পূর্ব মধ্যপ্রদেশে ব্যবহৃত হয়।
ভোজপুরি, মৈথিলি, এবং মাগাহি—মূলত এ তিনটি ভাষাকে একত্রে ‘বিহারি’ বলা হয়। বিপুলসংখ্যক ভাষাভাষী থাকলেও ‘বিহারি’ ভারতে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ভাষা নয়। এমনকি বিহার প্রদেশের শিক্ষাক্রম এবং দাপ্তরিক কাজকর্মে হিন্দি ব্যবহৃত হয়।
সিন্ধি মূলত বৈদিক সংস্কৃতের কয়েকটি উপভাষা থেকে সৃষ্টি। সিন্ধের অবস্থান অবিভক্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হওয়ায় ভারতে আসা 'কখনোই শেষ না হওয়া বহিরাগত'দের মিছিল সব সময়ই সিন্ধের ওপর দিয়ে এসেছে, এবং এভাবে হিন্দি, ফার্সি, আরবি, তুর্কি, ইংরেজি এবং পর্তুগিজ ভাষার বহু শব্দকে সিন্ধি আপন করে নিয়েছে। তাই সিন্ধ মানেই সেই স্থান যেখানে পারস্যদেশীয় এবং ভারতীয় সংস্কৃতি এসে একসূত্রে মিশে গেছে।
ভারতীয় আর্যভাষার অধিকাংশেরই লিপির সাথে সাযুজ্য রয়েছে ব্রাহ্মলিপির সাথে, যার উৎপত্তি ঘটেছে উত্তর সেমিটিক ভাষা থেকে। আবার এই ব্রাহ্মলিপি সংস্কার করেই দেবনাগরী লিপি তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে এই লিপিটিই হিন্দি, সংস্কৃত, প্রাকৃত ভাষাসমূহ, নেপালি, মারাঠি, কাশ্মিরি (হিন্দুদের) প্রভৃতি ভাষায় লেখার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলা, আসামি, এবং ওড়িয়া সবারই নিজস্ব লিপি রয়েছে, যা মূলত দেবনাগরী লিপি থেকেই উদ্ভূত। পার্সিয়ান-অ্যারাবিক লিপি ব্যবহৃত হয় উর্দু, সিন্ধি (দেবনাগরীতেও লেখা হয়), এবং পাঞ্জাবি ভাষাতে।
পরিশিষ্ট : বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত-দুহিতা বলা হয়। একটা ব্যাপার খেয়াল করুন, কেউ কিন্তু বলেন না হিন্দি বা গুজরাতি সংস্কৃতের দুহিতা। এর কারণ সংস্কৃতের সাথে বাংলা ভাষার যে সম্পর্ক তা যে হিন্দি বা গুজরাতির সাথে সংস্কৃত ভাষার যে সম্পর্ক তার চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ তা কেউই অস্বীকার করেন না। প্রশ্ন হতে পারে, এই সম্পর্কের ভিত্তি কী? ভিত্তি প্রধানত শব্দকোষগত। সংস্কৃত আর বাংলার মধ্যে শব্দকোষ আর রূপতাত্ত্বিক নিয়মের মিল আছে এবং সেই নিয়মের ভিত্তিতেই সংস্কৃতকে বাংলার জননী বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাক্যবিন্যাসের দিক থেকে যদি দেখা হয় তবে কোনো ভাষাই অন্য ভাষার দুহিতা হতে পারে না, বাংলাও এর ব্যাতিক্রম নয়। [৫] বিশেষত উইকিপিডিয়ার এই সূত্রটিও কিন্তু বলছে, বাংলা ভাষা ঐতিহাসিকভাবে পালির সাথেই বেশি সম্পর্কিত ছিল। তবে কিনা মধ্য বাংলায় (চৈতন্য যুগে) ও বাংলা সাহিত্যের আধুনিক রেনেসাঁসের সময় বাংলার ওপর সংস্কৃত ভাষার প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
তথ্যসূত্র :
[১] hubpages.com/hub/Pali-Language
[২] wmda.mobi/bn
[৩] wikipedia.org
[৪] wikipedia.org
[৫] somewhereinblog.net/blog/notundesh
পূর্ববর্তী পর্ব :
১. ই-কার বনাম ঈ-কার
২. ও কি এল, ও কি এল না
৩. হ্রস্ব স্বর না দীর্ঘ স্বর
৪. 'অনুস্বার' বনাম 'ঙ', সাথে 'এ' বনাম 'অ্যা'
৫. দন্ত্য-ন বনাম মূর্ধন্য-ণ
৬. বাংলার তিন 'শ'—দন্ত্য-স, মূর্ধন্য-ষ আর তালব্য-শ
৭. বাংলা হরফ বনাম রোমান হরফ—জ বনাম J, Z, G
৮. পাঠ্যবইয়ে বাংলা একাডেমীর বানানরীতি মেনে চলতে হবে
৯. ব-য় শূন্য 'র' বনাম ড-য় শূন্য 'ড়'
১০. কখন কি লিখব, কখন কী লিখব
১১. সংস্কৃত বানানরীতি বনাম বাংলা বানানরীতি
১২. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ কবে তৈরি হবে?
১৩. বাংলা ভাষায় বাঙালিয়ানা কতটুকু?
কুটুমবাড়ি
মন্তব্য
"হে আমাদের স্বর্গস্থ পিতা" এই বাক্যটি আমাদের মূলভাষায় কীভাবে বলা হতো? বাংলা ভাষা-পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাই* বা কীভাবে বলে/বলত? আসুন দেখি -
আমাদের মূল ভাষা : ইন্দো-ইউরোপীয় (পুনর্গঠিত) = Pater naseros cemeni
১. ইংরেজি = Our father, who art in heaven
২. পুরোনো ইংরেজি = Fæder ūre, þū þe eart on heofonum
৩. জার্মান = Unser Vater in dem Himmel
৪. ল্যাটিন = Pater noster, qui es in caelis
৫. ফরাসি = Notre Père, qui es aux cieux
৬ স্পেনিশ = Padre nuestro que estás en el Cielo
৭ পর্তুগিজ = Pai nosso, que estás no céus
৮. গ্রিক = Pater hēmōn, ho en tois ouranois (New Testament: Πάτερ ἡμῶν ὁ ἐν τοῖς οὐρανοῖς)
কাজিন : ইন্দো-ইরানীয়
১. ফার্সি = Ei pedar-e-ma, ke dar asman hasti
২. বালুচি = Phith mani, ki bihishta asti
৩. পশতু = Aj jmugplara, ce pa asman kxe ye
আপন : ইন্দো-আর্য
১. সংস্কৃত = Bho asmākam swargastha pitah
২. পালি = Saggatha no pita
৩. হিন্দি = He hamare swargbasi pita (हे हमारे स्वरगिक पिता)
৪. পাঞ্জাবি = He sade pita, jihra surg vic hai
৫. সিন্ধি = E asan-ja piu, jo asmana men
৬. কাশ্মিরি = Ai sani mali, yus asmanas path chu
৭. নেপালি = He hamra swargavasi pita
৮. গুজরাতি = O akasamanna amara bapa
৯. মারাঠি = He amacya swargatila pitya
১০. অসমীয়া = He amar swargat thaka pitri
১১. ওড়িয়া = He ambhamananka swargasha pita
১২. রোমানি = Dade amare, kaj isien k'o devle
*উল্লেখযোগ্য ভাষাসমূহ
কুটুমবাড়ি
নতুন মন্তব্য করুন