সালেক খোকন
কাঁটাতারের বেড়ার ঐ পাশেই ভারতের রাধিকাপুর। দূর থেকেই সেখানকার থেমে থাকা ট্রেনগুলো দেখা যায়। এ পাশে দিনাজপুরের রামচন্দ্রপুর গ্রাম। দেশভাগের পূর্বে রাধিকাপুর আর রামচন্দ্রপুর দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন আমল থেকে প্রতি বছর এই রামচন্দ্রপুরেই বসে শংকবাণী মেলা।
এক সময় শংকবাণী ছিল দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা। সময়ের গতিতে রাধিকাপুরের লোকেরা এখন আর শংকবাণী মেলায় আসতে পারে না।
আদি বা হিন্দু পঞ্জিকার হিসাবমতে বৈশাখ মাসের প্রথম মঙ্গল বা শনিতে রামচন্দ্রপুরে শংকবাণীর মেলা বসে। বছরে একবার গ্রামটিতে নামে মানুষের ঢল। সূর্য ওঠার সাথে সাথে অপরিচিত জনদের পদচারণায় রামচন্দ্রপুরের নীরবতা ভাঙ্গে। আশপাশের জেলাগুলো থেকে আসা নানা বয়সের মানুষেরা বিভিন্ন সাজপোশাকে ভিড় জমায় গ্রামটিতে। মেলাপাগল মানুষদের পায়ের ছাপ পড়ে গ্রামটির মেঠোপথে। সাইকেল, ভ্যান, মহিষের গাড়ি, মটরসাইকেল কিংবা পায়ে হাঁটার পথ। যে যেভাবে পারছে দল বেঁধে ছুটে চলছে মেলামুখো।
পুরোনো জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে বছরের শুরুতেই প্রাচীন এই শংকবাণী মেলা দেখতে হাজির হয়েছিলাম দিনাজপুরের রামচন্দ্রপুর গ্রামে। জীর্ণশীর্ণ গ্রাম্য রাস্তায় কাঁঠালপাকা রোদে চলছি গরম জিলাপি, পাঁপড় আর পুণ্যসন্ধানীদের মুখ দেখব বলে।
শংকবাণীর মেলায় যখন পৌঁছাই তখন মধ্যদুপুর। বড় একটি বট গাছের ছায়ায় বসেছে মেলাটি। দীর্ঘদেহী ছড়ানো বটগাছটিই যেন মেলার প্রধান সৌর্ন্দয্য। যতটা সাদামাটা ভেবেছিলাম মেলার আয়োজন তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। বটগাছের তলায় নানা বাহারি জিনিস নিয়ে বসেছে দোকানিরা। বাচ্চাদের খেলনার দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। বাঁশ আর কাঠের তৈরি নানা রঙের মন ভোলানো খেলনা কিনতে বাচ্চারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
পাশেই বেশ কয়েকজন দোকানি বসেছে শাঁখা আর কাচের চুড়ি নিয়ে। চুড়ির শব্দে ঢেউ লেগেছে তরুণীদের মনে। হাত বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছে পছন্দের চুড়িগুলো। কেউবা আবার দোকানির হাতেই পড়ে নিচ্ছে পছন্দের শাঁখা বা চুড়ি।
মেলার একপাশে রঙিন কাপড় টাঙ্গিয়ে লাইন ধরে বসেছে কয়েকটি মিষ্টির দোকান। দোকানগুলোর ভেতরের পাম্প চুলায় শোঁ শোঁ শব্দ। সেখানে গরম তেলে নানা ঢঙের জিলাপি ভাজা হচ্ছে। সাজিয়ে রাখা হয়েছে গুড়ের জিলাপি, ছানার সন্দেশ, চমচমসহ নানা রসের মিষ্টি। দূর থেকে দেখলেই জিভে জল এসে যায়। একটি দোকানে ফুঁ দিয়ে দিয়ে পালা করে জিলাপি খাচ্ছে আগতরা।
মেলার মাঝ বরাবর মাটির তৈরি খেলনা, কাঁসার প্রদীপ আর তালের পাখা নিয়ে বসেছে এক দোকানি। তাকে ঘিরে ধরেছে ভিড়ের এক অংশ। ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে সবাই যেন কেনায় ব্যস্ত।
মেলার একপাশে একটি উচু জায়গায় ছোট্ট একটি মন্দির। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে মন্দির আছে। এটিই শংকবাণী মন্দির। ধারণা করা হয় মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। মনোবাসনা পূরণের ইচ্ছা নিয়ে মন্দিরটিতে পূজা দিতে লাইন ধরেছে শত শত লোক। সকলের হাতে পাতায় মোড়ানো ধূপ ও সিঁদুর।
ভিড় ঠেলে মন্দিরের ভেতরে যেতেই দেখা মিলে পূজারী ফগেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি জানান শংকবাণী পূজা নিয়ে প্রচলিত কাহিনীটি।
প্রায় ৩০০ বছরের আগের কথা। এখানেই ছিলেন এক রাজা, যার নাম শংক। আর তারই আদরের একমাত্র মেয়ে শংকবাণী। একদিন রাজবাড়ির পাশ দিয়ে এক শাঁখারি শাঁখা ফেরি করতে করতে যাচ্ছে। শাঁখার কথা শুনে রাজকন্যা শংকবাণীর মন উদ্বেল হল। ঘরকন্নায় ব্যস্ত রাজকন্যা আকুল হয়ে ছুটে এল স্নানঘরে নিজের কাপড় ধোয়া ফেলে রেখে। শখ করে শাঁখা কিনল সে আর কুমারী অবস্থাতেই হাতে পরল সেই শাঁখা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। শুনে রাজা ক্ষিপ্ত হলেন, ক্রোধের বশে আঘাত করতে গেলেন মেয়েকে। বাবার আচরণে শংকবাণী মনে কষ্ট পেল। মনের দুঃখে সে ঝাঁপ দিল রাজবাড়ির পাশের দীঘিতে।
ঝাঁপ দেয়ার সময় সে রাজার উদ্দেশ্যে বলে যায়, 'আজ তুমি আমাকে অপমান করলে, তবে একদিন তুমি আমাকেই পূজা দেবে’। এর কিছুদিন পরেই নাকি এই স্থানে এক রাতে পাথরের মুর্তি ভেসে ওঠে। সে থেকে এখানে মা শংকবাণীর পূজা হয়ে আসছে। প্রচলিত বিশ্বাস, যে যেই ইচ্ছা নিয়ে এখানে আসে তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়ে যায়। মূলত এই শংকবাণী পূজাকে ঘিরেই প্রতি বৈশাখে এখানে একদিনের মেলা বসে। মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে ভিড় জমায় হিন্দু, মুসলমান আর আদিবাসীরা। একদিনের এই শংকবাণী মেলাকে ঘিরে প্রতি বছর প্রায় সাত হাজার লোকের সম্মিলন ঘটে।
পূজার দিন হাজার হাজার লোক শংকবাণীকে ফল,আতপ চাল, সিঁদুর, ধুপ, কাঁচা দুধ দিয়ে ভোগ দেয়। পাতায় মোড়ানো ধূপ-সিঁদুর মানত করে ছুঁড়ে দেয় শংকবাণীর দিকে। কেউ কেউ রুপা বা স্বর্নের পাদুকা বানিয়ে শংকবাণী মুর্তির শরীরে লাগিয়ে দেয়। অতপর তাকে প্রণাম দিয়ে প্রসাদ নেয় পূজারীর কাছ থেকে।
মন্দিরস্থলে শুরু হয় এক ধরনের আচার। হঠাৎ ঢাক-ঢোল আর বাঁশির করুণ সুর বেজে ওঠে। দেবংশী চন্দ্রকান্ত রায় মন্ত্র পাঠ করতে থাকেন। আর যুবক বয়সী চারজন হাতের মধ্যে কবুতর নিয়ে খালি গায়ে নানা অঙ্গভঙ্গিতে নাচতে থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস মতে দেবতারা (শংকবাণী, শশ্মান কালি, মশান কালি, বুড়ি কালি) নাকি তাদের ওপর ভর করেছে।
নাচ শেষে দেবংশী একে একে ভোগ খাইয়ে তাদের মুক্তি দেন বা বির্সজন দেন। ভোগ হিসেবে খাওয়ানো হয় কলা, আতপ চাল আর ঘি। ভোগ মুখে দেয়ার সাথে সাথে যার ওপর দেবতা ভর করে সে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পরে। সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যা তিনপর্বে নামে দেবতারা। অনেকেই আবার মন্দিরের পাশেই বলি দেয় মানতের পাঠা।
পূজা শেষে সকলেই ব্যস্ত হয়ে পরে মেলার কেনাকাটায়। পাশের সেতাবগঞ্জ থেকে মেলায় এসেছে সত্তর বছর বয়সী মালতি রাণী। মনবাসনার ধূপ-সিঁদুর মন্দিরে ছুড়ে দিয়ে নাতনির জন্য বাতাসা কিনছেন মেলা থেকে। কী চাইলেন শংকবাণীর কাছে? উত্তরে শুধুই মুচকি হাসি। মনবাসনার কথা বলতে হয় না এটাই এখানকার নিয়ম।
বিকেলের দিকে পুরো দমে জমে উঠেছে শংকবাণী মেলাটি। তিল পরিমাণ জায়গা নেই মেলাপ্রাঙ্গণে। হাজার হাজার মানুষ। অথচ কোনো ভেদাভেদ নেই। শংকবাণীর টানে বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে সবাই যেন উজার করে দিচ্ছে নিজেকে। সূর্য ডোবার আগেই ফেরার পথ ধরি। দৃষ্টির সীমানা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যায় শংকবাণী মেলা।
সালেক খোকন
মন্তব্য
ছবি দিলেন না?
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
গ্রামের নাম দুটো দারুন ।
শংকবাণী মেলায় যাওয়ার ইচ্ছা রইলো ।
-------------------------------
নিক : সবুজ পাহাড়ের রাজা ।
আমার ছোটোবেলায় মেলায় ঘোরার অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ভালো লিখেছেন। আচ্ছা, শংকবাণী শব্দটার অর্থ বা উৎস কী?
প্রায় ৩০০ বছরের আগের কথা। এখানেই ছিলেন এক রাজা, যার নাম শংক। আর তারই আদরের একমাত্র মেয়ে শংকবাণী। একদিন রাজবাড়ির পাশ দিয়ে এক শাঁখারি শাঁখা ফেরি করতে করতে যাচ্ছে। শাঁখার কথা শুনে রাজকন্যা শংকবাণীর মন উদ্বেল হল। ঘরকন্নায় ব্যস্ত রাজকন্যা আকুল হয়ে ছুটে এল স্নানঘরে নিজের কাপড় ধোয়া ফেলে রেখে। শখ করে শাঁখা কিনল সে আর কুমারী অবস্থাতেই হাতে পরল সেই শাঁখা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। শুনে রাজা ক্ষিপ্ত হলেন, ক্রোধের বশে আঘাত করতে গেলেন মেয়েকে। বাবার আচরণে শংকবাণী মনে কষ্ট পেল। মনের দুঃখে সে ঝাঁপ দিল রাজবাড়ির পাশের দীঘিতে।
ঝাঁপ দেয়ার সময় সে রাজার উদ্দেশ্যে বলে যায়, 'আজ তুমি আমাকে অপমান করলে, তবে একদিন তুমি আমাকেই পূজা দেবে’। এর কিছুদিন পরেই নাকি এই স্থানে এক রাতে পাথরের মুর্তি ভেসে ওঠে। সে থেকে এখানে মা শংকবাণীর পূজা হয়ে আসছে।
ও, আচ্ছা। ধন্যবাদ। তাহলে এই শংক শব্দটা শংখ শব্দ থেকে এসেছে?
নতুন মন্তব্য করুন