হ্যালো জন,
চিঠির জন্য ধন্যবাদ । না, মোটেও আহত হইনি পড়ে। বরং ধন্যবাদ,আমার অতীতটাকে আবার মনে করিয়ে দেয়ার জন্য । তুমি সবই জানো ।
এমনকি যারা সেই সময় নিয়ে গল্প লেখে,সিনেমা বানায় তারা ও ঠিকঠাক সব কথা বলেনা । না, এটা কখনোই '৯ টা-৫ টা' ছিলোনা,যেমন তারা বলে। আসলে একটানা একঘেঁয়ে ছিলো সেই দিনগুলো,মধ্যাহ্ন বিরতি বলে কিছু ছিলোনা । চাকরী হারাবার ভয়ে এই দীর্ঘ সময়ে কেউ কিছু খাবার সাহস ও করতোনা । 'ওভারটাইম' করতে হতো কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই ।
সেই দিনগুলোতে আমার মনে হতো-
দাসত্ব কখনোই বিলুপ্ত হয়নি আসলে,বরং সম্প্রসারিত হয়েছে । শুধু কালোদের বদলে এখন সাদা কালো সকলেই দাস
সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলো এই -চাকরী বাঁচানোর জন্য ষে অসুস্থ প্রতিযোগীতা মানুষকে মানবতাবোধহীন করে তুলেছিল । আমি মানূষগুলো দেখতাম । ফাঁপা,অনুভূতিহীন । শরীরে ভয়,মনে দাসত্ব,চোখ মৃতমাছের মতো স্বপ্নহীন, কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে তাদের কন্ঠস্বর । এবং কুৎসিত তাদের শরীর,হাত,হাতের নখ ,চুল,জুতো-সবকিছু ।
সেদিন এক তরুন হিসেবে আমার মেনে নিতে কষ্ট হতো যে-মানূষ এইভাবে বেঁচে আছে!এইরকম পরিণতিহীন!
আজ প্রায় বার্ধ্যকে পৌঁছে ও আমি মেনে নিতে পারিনা-মানূষের এই জীবন যাপন । মানুষের জীবন যাপনের লক্ষ্য কি? যৌনতা? টেলিভিষন?মোটরগাড়ী?মাসের শেষে নগদ টাকা? অথবা সন্তান?
এই সন্তানেরা ও আবার একই নিয়মে,একই জীবন যাপন করবে?
সেই তারুন্যে যখন আমি একটার পর আরেকটা চাকরী ছাড়ছি,ধরছি-সেই সময় মাঝে মাঝে সহকর্মীদের সাথে কথা বলতাম-
' মালিক এসে এখনই তো কারখানা বন্ধ ঘোষনা করে দিতে পারে । তখন আমাদের উপায় কি হবে? আমরা কেনো আমাদের আগামী দিনের কথা ভাবছিনা?'
তারা নিস্পলক তাকিয়ে থাকতো । আমার মনে হতো যেনো নতুন কিছু ভাবতে তারা ভয় পায় ।
এতোদিন পর ও অবস্থা বদলায়নি একটু ও । এখনো হুটহাট কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে,শ্রমিকেরা চাকরী হারাচ্ছে নতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে না পেরে
' আমি ৩৫ বছর এখানে শ্রম দিলাম...'
'এটা অন্যায়...'
'আমি জানিনা এখন কি করবো?...'
তারা কখনোই দাসদের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক দেয়না যাতে তারা মুক্ত হতে পারে । ঠিক ততোটুকুই দেয় যতোটুকুতে তারা বেঁচে থাকতে পারে, এবং অবশ্যই দাস হিসাবে ।
আমি এইসব বুঝি । তারা কেনো বূঝেনা,বলতে পারো?
আমার মনে পড়ে,তখন কাজ করি একটা প্যাকেজিং ফ্যাক্টরীতে । একঘেঁয়ে,সম্ভাবনাহীন দীর্ঘ সময় কাজের ক্লান্তিতে এক শ্রমিক চিৎকার করে বলেছিলো-
'এ থেকে আমার মুক্তি নেই!'
তার সেই চিৎকার শুনে সুপারভাইজার হেসে উঠেছিলো । তৃপ্তির হাসি । যেনো এই লোকটা ফাঁদে আটকা পড়েছে-সেই আনন্দে শিকারীর হাসি । অথচ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম,সুপারভাইজার নিজে ও ফাঁদে আটকে পড়া অসহায় পশু মাত্র ।
আমি সেই জীবন পিছনে ফেলে এসেছি অনেক আগেই । এখন আমি পেশাদার লেখক । আমি সেই জীবনের গল্প বলি,গল্প লিখি । কিন্তু আমি কি আদতে মুক্তি পেয়েছি? আমি কি নিজেও ফাঁদে আটকে পড়া সেই পশু নই?
তবু লিখি আমি, সেই সব দিনের কথা আমাকে লিখে যেতে হবে, আমার নিজের কাছে নিজের অনেক ঋন জমা হয়ে আছে । অনেক দেরী হয়ে গেছে,তবু ঋন শোধের চেষ্টা করে যাবো ।
কতো হত্যা,কতো হাহাকারের ভিতর দিয়ে এই জীবনকে টেনে নিয়ে এসেছি শেষপর্যন্ত একটা শোভন মৃত্যুর লোভে ।
এই জীবনকে একেবারে নষ্ট হতে না দেয়াটাই হয়তো পরিতৃপ্তি,আমার নিজের জন্য ।
শুভকামনায়
হ্যাংক ।
------------------------------------------------------------------
-----------------------------------------------------------------
বীট জেনারেশন এর কবিদের মধ্যে এলেনগিন্সবার্গ বাংলা কবিতার পাঠকদের সবচেয়ে কাছের জন ।
গিন্সবার্গ আমার ও প্রিয় । তবে এঁদের সকলের মাঝে চার্লস বুকস্কি 'র কবিতায় আমি মেতেছি বেশী । দেশে থাকতে নাম ও শুনিনি । অথচ প্রথম পড়ার পরই আটকে গেলাম ।
একটা ঘোরের মতো আবছায়া ভালো লাগায় তাঁর কিছু কবিতার ভাবানুবাদ ও করেছিলাম :-
----------------------------------------------------------------------
উপরের এ চিঠি চার্লস বুকস্কির লেখা ।
লিখেছিলেন তাঁর বন্ধু ও প্রকাশক জন মার্টিন'কে । পড়তে পড়তে হঠাৎইচ্ছে হলো বাংলা করে রেখে দেই নিজের ব্লগে ।
এই চিঠির কথাগুলো তো আর আমার থেকে খুব দূরবর্তী নয়!
মন্তব্য
মাঝে মাঝে হাস্যকর রকমের অসার মনে হয়।
বুকস্কি'র কবিতা আগে পড়িনি, আপনার ভাবানুবাদ পড়ে ভাল লাগলো।
অনেকেই বুঝি, এই জীবনকে নষ্ট হতে না দেয়াটাই পরিতৃপ্তি। কিন্তু তারপরও হৃদয় যখন মস্তিষ্কের বদলে বোধের পুরোটাই দখল করে নেয়, তখন কিসে যে পরিতৃপ্তি আসে, সেটি বুঝা যায় না।
গৌতম
পড়লাম
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
..হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দার জলে...
আমাদের দেশে কারখানাগুলোও যখন তখন বন্ধ হচ্ছে
পাটকল-চিনি কল...
বৃত্তের বাইরেও জীবন আছে, সে জীবন সীমাহীন, অনন্ত.... সবাই পারে না বৃত্তের বাইরে যেতে, কেউ কেউ পারে।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
নতুন মন্তব্য করুন