যে শহরে ফিরিনি আমি-৩

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: সোম, ১৮/০২/২০০৮ - ১:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোট হয়ে আসছে লাগেজ

নানাবাড়ীর পুকুরে আমি সাঁতার শিখেছিলাম একটা বিশাল প্রজাপতির ডানায় চেপে । বড়মামা তখন ডাক্তারী পড়ছেন সোভিয়েতে । আসার সময় প্লাষ্টিকের এই বিশাল প্রজাপতি নিয়ে এসেছিলেন আমার জন্য ।
শৈশবের ঝুড়িতে আরো জমা হয়েছিলো টুকটুকে লাল গাড়ী,সবুজ রংয়ের জ্যাকেট,ছয়ঘোড়ার খেলনা পিস্তল,অনেক অনেক চকলেট । এসবের বেশীর ভাগই আসতো ইংল্যান্ড থেকে,কিছু কিছু মিডলইষ্ট,দুয়েকটা সোভিয়েত থেকেও । সবকিছু যে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেই আসতো তাও নয়,হয়তো মায়ের খালাত কিংবা চাচাতো ভাই এমনকি পাশের বাসার ভদ্রলোক ও একবার সিংগাপুর বেড়াতে গেলে একটা বায়নোকুলার নিয়ে এসেছিলেন আমার জন্য ।

প্রায় প্রতিবছর শীতকালে আত্নীয়স্বজনরা লন্ডন থেকে দেশে ফিরতেন বিশাল বিশাল সব লাগেজ নিয়ে । পরিবারের সকল তো অবশ্যই,কাছের দূরের আত্নীয়স্বজন,পাড়াপ্রতিবেশী এমনকি ঘরের কাজের লোকদের জন্য ও টুকিটাকি এটাসেটা ।

আমি এসেছি মাত্র ২০ কেজির একটা লাগেজ ,সাতকেজির হ্যান্ডব্যাগ আর ল্যাপটপ কাঁধে ঝুলিয়ে ।

সময় বদলেছে অনেক । ২০ পাউন্ড দিয়ে যে শার্ট লন্ডনে কিনতে হবে,একই মানের শার্ট আরো কমে দেশেই পাওয়া যায় । দেশেই পাওয়া যায় ক্যাডবেরী চকোলেট,খামোখা এতদূর বয়ে আনার কি দরকার?

নিজেকে ভালোই যুক্তি শোনাই ।
আসলে এইসব যুক্তিটুক্তি মিছে বাহানামাত্র । মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বেড়ে গেছে অনেক ।

বিনোদনের বাহারী ধান্দা

শহর সিলেটের নাগরিকদের নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গার বড়ো অভাব ছিলো । ঐতো বিকেল হলে এমসি কলেজের পুকুর পাড়ে নাহয় লাক্কাতুরা চাবাগানের গলফ ক্লাবে , যাদের হোন্ডা ছিলো তারা আরেকটু এগিয়ে পর্যটন মোটেল কিংবা এয়ারপোর্টের দিকে ।
আমরা তখন খবর শুনতাম ঢাকায় নাকি কিসব হয়েছে -ফ্যান্টাসী কিংডম,নন্দন এইসব টব । আমরা আরো শোকাতুর হতাম- আহা আমাদের শহরে বিনোদনের কিছু হলোনা!

নগর সিলেটে দেখি বিনোদনের মচ্ছব লেগেছে । এইদিকে ঐ দিকে এমিউজমেন্ট পার্ক । পর্যটন মোটেলের পিছনদিকে বিশাল পাহাড়ী এলাকা ছিলো । আমরা বন্ধুরা হোণ্ডায় চড়ে কতোদীর্ঘদিন ঐ এলাকায় গিয়েছি নিশ্চিন্তে গাঁজা খেতে ।
এই জায়গাটাও এমিউজমেন্ট পার্ক !
১০০ টাকা প্রবেশমুল্য তারপর প্রতি আইটেমের জন্য আরো গচ্ছা!
সন্দেহ জাগে সরকারী জমি লীজ নিয়ে এইসব পার্ক বানানোর ধান্দা ভিন্ন ।

চট্রগ্রাম গেলাম ,একই অবস্থা । ফয়েজ লেককে ও লিজ দিয়ে বানিয়ে ফেলেছে বিনোদন উদ্যান । ১০০ টাকা প্রবেশ মুল্য ।
কয়দিন পর সমুদ্রে নামতে ও পয়সা দিতে হবে।

বাংলার মানুষের অনেক টাকা । ৩৫ টাকা কেজি চালের ভাত খেয়ে বিকেল বেলা ১০০ টাকার টিকেট কিনে আরো ৫০ টাকা দিয়ে নাগরদোলায় দুলছে তারা ...

সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফেরা ঝিমুনো পাখীগন

এই শহরে কোন সংস্কৃতি নেই অনেকদিন,রাজনীতি ও নেই ।
আড্ডাটুকু ও নেই । মানুষজন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফিরতে ব্যাতিব্যস্ত । প্রান্তিক নেই আর,স্বপন মরে গেছে, আশার আলো কিংবা পংখীভাইয়ের চায়ের দোকানে সন্দ্যার পর কোন আড্ডা নেই আর ।
সবই ঘরগেরস্তালী । ড্রইংরুমে বসে পুরনো দিনের জাবরকাটা ।
জিন্দাবাজার মোড়ে কয়েক প্রজন্মের আড্ডা ছিলো,বিশেষ করে রাজনীতির ছেলেপেলেদের । রিক্সায় চেপে আসতে যেতে সেইসব মুখগুলো চোখে ভাসে ।
সংঘবদ্ধ তরুনদের দেখিনা আর । বিচ্ছিন্ন একা একা ঘুরছে যারা তারা বড়বেশী ফিটফাট,পোষাক ও ফ্যাশন সচেতন,কাঠামো দেখলে বোঝা যায় তারা জিমে গিয়ে শরীর বানায় তবু আমার কাছে এঁদের মেরুদন্ড বাঁকানো মনে হয় ।

কি জানি আমি স্মৃতিকাতরতা থেকে বের হতে পারিনা বলেই এমন মনে হয়কিনা? আমি আমার সময় ও সময়ের সারথীদের ভুলতে পারিনা বলেই এমন মনে হয় কিনা?


মন্তব্য

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বিচ্ছিন্ন একা একা ঘুরছে যারা তারা বড়বেশী ফিটফাট,পোষাক ও ফ্যাশন সচেতন,কাঠামো দেখলে বোঝা যায় তারা জিমে গিয়ে শরীর বানায় তবু আমার কাছে এঁদের মেরুদন্ড বাঁকানো মনে হয় ।

কী আর বলবো ?

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আপনার দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে গেল আমাকেও; তবে আমি হয়তো আরেকটু অপেক্ষা করার পক্ষে।
প্রজন্মগত পার্থক্যটাকে ভুল বুঝে ফেলছি কি না সেটা ভাবার দরকার আছে।

ঢাকায় গিয়ে আমিও অবাক হয়েছিলাম -- আর কিছুই না; মানুষজনদের খুব অচেনা মনে হয়েছে। বিশেষত নতুনদের!

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

হাসান মোরশেদ এর ছবি

এসিড সার্ভাইভেল ফান্ডের নামে ও কনসার্ট করা যায়নি হুজুরদের বাধার মুখে আর এখন প্রতিসপ্তাহে নিশ্চিন্তে ঝাকানাকা নাচগান চলছে বিনোদন পার্কে ।
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অজানা এর ছবি

এতো এতো শপিং সেন্টার সিলেটে। গতবছর গিয়ে আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্হা। রাস্তাঘাটে মানুষ আর মানুষ। রিক্সা,গাড়ি, এমনকি হাটার পর্যন্ত উপায় নেই।

আমি তো যাবার সময় একটা স্কুল ব্যাগ নিয়ে হাটা দেই। সবই পাওয়া যায় দেশে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনার সাথে দেখা হলোনা, খুব দু:খের ব্যাপার। ভাল আছেন তো?
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

(দীর্ঘশ্বাস)

সৌরভ এর ছবি

সংঘবদ্ধ তরুনদের দেখিনা আর । বিচ্ছিন্ন একা একা ঘুরছে যারা তারা বড়বেশী ফিটফাট,পোষাক ও ফ্যাশন সচেতন,কাঠামো দেখলে বোঝা যায় তারা জিমে গিয়ে শরীর বানায় তবু আমার কাছে এঁদের মেরুদন্ড বাঁকানো মনে হয় ।

কথা বলে দেখেছেন এই তরুণদের সাথে?
এদের ভিতরে যে অন্তঃসারশূন্যতা আর স্বপ্নহীনতা বাড়ছে, তা আপনাকে স্পর্শ করে যাবে। আধুনিক মুঠোফোন হাতে তরুণদের জীবনে, নামমাত্র মূল্যে অজানা ফোন-বন্ধুদের সাথে কথা বলা রাত হয়ে উঠছে দীর্ঘ আর নিজের পাড়ার বন্ধুরা হয়ে উঠছে অচেনা।

হুমম, এইটেই বোধহয় সত্যিকারের উন্নতির সিঁড়ি।
পুরনোরা অফ যাওয়াই ভালো।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ফকির ইলিয়াস এর ছবি

সিলেট ----- আহা সিলেট----
আপনার চোখ দিয়ে আবার দেখা হয়ে গেলো !

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আমি এখনো সাঁতার জানি না।
আপনার সেই ছোট্ট বেলার বিশাল প্রজাপতিটা আমাকে দেবেন?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পরিবর্তনশীল এর ছবি

কিন্তু তবুও তো কেউ কেউ থাকতে পারে
যারা স্বপ্ন গাঁথতে জানে
স্বপ্ন দেখাতে জানে।
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এই প্রক্রিয়া আসলে অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। যান্ত্রিক জীবনের ভালোটা ফেলে রেখে খারাপ দিকগুলোই আমরা বেশি গ্রহণ করাই হয়তো সমস্যা।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- হীরা ফেলে কাঁচ তুলে নেবার টেনড্যান্সী।
যাকগে দাদা, গঞ্জিকা খাওয়ার জায়গার অভাব বোধকরি হবে না। আপনি না থাকলেও রং নাম্বার বাউলকে একটা এত্তেলা করে আসবেন আপনার এই অনুজ'র জন্য। চোখ টিপি

মরার আগে জীবনটা ভালো করে উপভোগ করতে চাই গো দাদা। দেঁতো হাসি
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আসলে এইসব যুক্তিটুক্তি মিছে বাহানামাত্র । মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বেড়ে গেছে অনেক ।

নির্মম সত্য। বেদনাগুলোর সাথে একমত। ছুঁয়ে গেল লেখাটা।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

আহারে ...কয়দিন পর ঢাকার ছোটখাট মাঠগুলোতে খেলতেও বুকিং দিতে হবে নিশ্চয়ই, অগ্রীম টাকা পরিশোধও হয়ত শর্তে জুটবে ... দেশ এগিয়ে যাবে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

s-s এর ছবি

সুপ্রিয় মোরশেদ:
কি অদ্ভুত বিষণ্ণতা - অজানার আঁধার ---- মনটা খারাপ লাগছে ----- বিষণ্ণ হৃদয়কে কি করে বলি,ভালো থাকুন?
বেঁচে থাকুন- এটুকুই বলি।

অমিত আহমেদ এর ছবি

আমি সব সময় আশাবাদী। আমাদেরকে যেমন সবাই বাতিল করে দিয়েছিলো তেমনি ভাবে আমিও নতুন প্রজন্মকে বাতিল বলে ঠকতে চাই না। মেঘের আড়ালে সূর্য থাকেই।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।