এবার দেশে গিয়ে যে কটা কাজ করেছি তার মধ্যে একটা ছিলো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক এলবামের ছবিগুলো ডিজিটালাইজড করা ।মান্যবর নজমুল আলবাব সস্নেহে তার প্রতিষ্ঠানের একটি স্ক্যানার আমাকে ধার দিয়েছিলেন কয়দিনের জন্য ।
কিন্তু দাওয়াত খাওয়াজনিত ভয়ংকর ব্যস্ততার কারনে ডিজিটালাইজেশনের কাজ পুরোটা সমাধা করা যায়নি ।
যাহোক,পারিবারিক এলবাম ঘাঁটতে গিয়ে এইছবিটা পেয়ে গেলাম । পেছনে তারিখ দেখছি জানুয়ারী ১১,১৯৮৯ । আমার হাতে তোলা ছবি। স্থান সিলেট ওসমানী হাসপাতালের এক সাধারন পেয়িং বেড ।
জীর্ন শরীরের সাদাগেঞ্জী গায়ে একজন প্রৌঢ় । তাকে জড়িয়ে ধরে যিনি বসেছেন তাকে সচেতন ব্লগার ও পাঠক চিনে ফেলতে পারেন । সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ।
মেজর জলিল যাকে জড়িয়ে ধরেছেন তাকে আমরা চিনিনা,প্রায় কেউই চিনিনা । না চেনাটা কতোটুকু আমাদের নিজস্ব দায় কিংবা কিভাবে আমাদেরকে চিনতে দেয়া হয়না সে প্রশন,হিসেব নিকেশ থাক আপাততঃ ।
ইনি মেজর আব্দুল মোতালেব । । পাকিস্তান আর্মির এই সাবেক মেজরই 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'র আসামী ২৫ নং আসামী ।
২৫ মার্চ রাতে শহর সিলেটে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয় তাঁর গুলীবর্ষনের মাধ্যমে । বটেশ্বর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রাক ও জীপ ভর্তি পাক আর্মি শহরে প্রবেশ করছিল সে রাতে । এম সি কলেজের টিলার উপর থেকে মেজর গুলীবর্ষন করেন আর্মি জীপে এবং দুজন অফিসার নিহত হয় । এর আগেই অবশ্য তিনি চাকরীচ্যুত, মামলার আসামী হিসেবে ।
মেজর মোতালেব পরে চেলা সাব-সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন । সুনামগঞ্জ শহরকে শত্রুমুক্ত করেছিল যে দল, মেজর তার নেতৃত্বে ছিলেন । লুংগীপড়া হাতে ষ্টেনগান-মুক্ত সুনামগঞ্জে তাঁর এই ছবি দেখেছিলাম ।
স্বাধীনতার পর মেজর মোতালেব জাসদ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । জিয়ার সামরিক শাসনামলে মেজর জলিলদের সাথে তিনি ও কারাবন্দী হন । পরবর্তীতে মেজর জলিলের রাজনৈতিক বিশ্বাসে বৈপরীত্য এলে ও মেজর মোতালেব স্থির ছিলেন তার বিশ্বাস ও প্রতিজ্ঞায় ।
এইছবিতে আরো ক'জন পরিচিত মানুষ আছেন । বাম থেকে আমার বড়মামা আল-আজাদ । বড়মামা সে সময় অসুস্থ মেজরের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতি লিপিবদ্ধ করছেন (পরে এটা নিয়ে বই প্রকাশ ও হয়েছে) । তারপর মেজরের মেয়ে রেহানা খালা, আমার মেজোমামা সুজাত মনসুর , টাই পড়া ভদ্রলোক প্রগতিশীল সাংবাদিক মহিউদ্দীন শিরু । বাকী দুজনকে চিনতে পারছিনা ।
ধারনা করছি, রাজনৈতিক বিশ্বাসে আমুল পরিবর্তন এসে গেলে ও মেজর জলিল ছুটে এসেছিলেন তার মৃত্যুপথযাত্রী সাবেক সহযোদ্ধা ও কমরেডকে দেখতে ।
হাসপাতালের এই পেয়িং বেড থেকে মেজর মোতালেব আর ফিরে আসেননি । তার কিছুদিন পর মেজর জলিল ও গেলেন ।
(এই পোষ্ট উৎসর্গ হলো,প্রিয় ব্লগার নুরুজ্জামান মানিকের সম্মানে-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যার গুরুত্বপুর্ন কাজগুলো আমাকে মুগ্ধ করে)
মন্তব্য
৮২-৮৩এর দিকে আমরা থাকতাম সিলেটের মেজরটিলায়
আমাদের বাসার ঠিক উল্টো দিকেই ছিল মেজর মোতালেবের একটা সোমিল
তার এক মেয়ে পড়তো আমাদের সাথে
তাকে আমরা চিনতাম এক বদমেজাজি লোক হিসেবেই। এবং তার সম্পর্কে জানতাম না কিছুই
জানলাম আস্তে আস্তে। এবং আমার মেজর মোতালেব পাঠ আল আজাদের হাতে ধরেই
যুদ্ধের সময়ও নাকি একই রকমের বদমেজাজি ছিলেন মেজার মোতালেব। যুদ্ধের সময় নাকি একবার তিনি ক্ষেপে গিয়ে মিজান চৌধুরিকে বলেছিলেন- আপনারা সবাই নিজের জান নিয়ে পালিয়ে চলে এলেন আর তাকে (শেখ মুজিবকে) ছেড়ে আসলেন পাকিস্তানিদের হাতে?
উত্তরে মিজান চৌধুরি যখন বলেছিলেন- তিনি ইচ্ছা করেই আসেননি
তখন নাকি মোতালেব আরো ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন- তাকে জোর করে ধরে আনতে পারলেন না? এনে আমার কাছে দিতেন
আমি তাকে এখানে বসিয়ে রেখে বলতাম- বলেন কী করতে হবে
তিনি বসে বসে আদেশ দিতেন আর আমি যুদ্ধ করতাম....
ধন্যবাদ মোর্শেদ
বালুচরে আমরা ও প্রতিবেশী ছিলাম দীর্ঘবছর । শৈশবের পুরোটা তাকে পাড়ার ক্ষ্যাপাটে বুড়ো বলেই জানতাম ।
আমার চেনাজানার মধ্যে বেশ ক'জন যোদ্ধাকে দেখেছি যারা লাভের গুড়টা খাননি-তাদের আচরনের মধ্যে সুক্ষ পর্যবেক্ষনে কিছুটা অস্বাভাবিকতা দেখেছি । কেউ ক্ষ্যাপাটে,বদমেজাজী,কেউ খুব বিষন্ন,চুপচাপ- আমার শ্বশুর এখন মৃত্যুপথযাত্রী,শয্যাশায়ী । '৭১ এ মুক্তিবাহিনীর তুরা ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন । ৮০ বছরের বৃদ্ধ এখন দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন- ' কি কারনে তাজা ছেলেগুলারে ট্রেনিং দিয়ে গ্রেনেড হাতে মরতে পাঠালাম, কি লাভ হলো?'
যুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ের বাস্তবতা একটা প্রজন্মের উপর কি প্রতিক্রিয়া তৈরী করেছিল তার একটা মনোসমীক্ষা বোধ হয় প্রয়োজন ছিলো ।
প্রয়োজন তো আদতে কতোকিছুই ছিলো !
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
- স্মৃতি অনেক কথা বলে দাদা!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
খুবই সত্যি।
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
ধন্যবাদ।
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
আবারো বলি কি লাভ হলো?
====
এম. এম. আর. জালাল
"ফিরে দেখুন একাত্তর ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ।"
এম. এম. আর. জালাল
"ফিরে দেখুন একাত্তর ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ।"
পড়লাম
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
বুকটা ভারী হয়ে এলো ভালবাসার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
' কি কারনে তাজা ছেলেগুলারে ট্রেনিং দিয়ে গ্রেনেড হাতে মরতে পাঠালাম, কি লাভ হলো?'
...দুর্লভ ছবি। সংরক্ষণযোগ্য পোস্ট।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
যারা লাভের গুড়টা খাননি (হাসান মুরশেদ ) মেজর মোতালেব ছিলেন তাদের একজন। ১০০% একমত।
৭ মার্চ '৭১ সিলেট আওয়ামী লীগ অফিসে সবাইকে আনন্দ করতে দেখে তিনি বলেছিলেন "আনন্দ না করে যুদ্ধ এর প্রস্তূতি নেন" । তিনি যখন বের হয়ে আসছেন তখন তার কানে শুনতে পেলেন "মাথায় ছিট আছে scrue ঢিলা । আগরতলার আসামি তো তাই যুদ্ধ করার খায়েশ ।" " মন্তব্যটি একজন বিলাত ফেরত ব্যরিস্টারের ।" মেজর মোতালেব ঐ ব্যরিস্টারের কলার চেপে ধরে বললেন "যদি বেচে থাকি
যুদ্ধ করে দেশ স্বাধী্ন করব । ফিরে এসে তোর ফয়সালা করব । "
যুদ্ধের সময় তিনি ক্ষ্যাপাটে/বদমেজাজী ছিলেন কিনা জানিনা তবে তিনি কারো কমান্ড মানেননি কারন তার মতে তাদের বিরুদ্ধে লুটপাট সহ নানা অভিযো্গ ছিল। যেই অভিযো্গ অফইসিয়াল্লি দেবার অপরাধে ৭২ সালে কর্নেল তাহের কে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল সেনাবাহিনী থেকে।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
ছবি শুধু ছবি নয় ।
হুমম। কত অজানাই যে রয়ে গেল এই জীবনে।
কত সত্য কাহিনী হারিয়ে যেতে বসেছে!
ধন্যবাদ লেখার জন্য।
হাসান মুরশেদ ভাই কে বিনীত ভাবে জানাচ্ছি যে,মেজর মোতালেব চাকরীচ্যুত হননি , তারসাথের আর সবাই , যেমন হুদা, নুরুজ্জামান প্রমুখ আর্মীতেই ছিলেন । যা হো্ক মুল ঘটনা এখানে দেয়া হল ঃ
ফেব্রু ২২ ,১৯৬৯ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার হাবার পর ১৪ ডিভিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা তার কাছে জানতে চান "সে কোথায় posting চায় ? তিনি কর্মকর্তার কাছ থেকে একটা সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে ( কমিশন বা পদত্যাগে প্রেসিডেন্ট এর signature লাগে ) লিখেন ঃ
"Honouarble President,
I hereby resign my commission and I hope which will be acceptable ."
৩ মাস পর তার পদত্যাগের আবেদন গ্রহন করা হয়। ফেব্রু-সেপ্ট মাস তিনি বেকার ছিলেন । এরপর তিনি সিলেট আসেন । প্রথমে জ্বালানি লাকরির ব্যবসা করেন , পরে কিছু জমি কিনে ধান চাষ শুরু করেন । এ সময় কেউ কেউ তার সাথে দেখা করতে আসত । কেউ কেউ বল্তঃ " তো্মরা দেশটা ডূবায়ে দিলা ", " এখন আর্মীতে থাকলে কত কি করতে পারতি " ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নতুন মন্তব্য করুন