আমি আমার সন্তানকে যে গল্প বলে যাবো

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: রবি, ০১/০৬/২০০৮ - ৭:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ থেকে বছর পনের পর, দুহাজার তেইশ সালের এপ্রিলের তেরো তারিখ,চৈত্রের শেষদিনে আমার ছেলে মৃন্ময়ের বয়স হবে আঠারো । আর আমি তখন আটচল্লিশ ।
ছেলেকে একটা গল্প শুনাবো সেদিন । সেদিনের গল্পের ড্রাফট লিখে রাখি আজ ।

'তোমার বয়স তখনো তিন পূর্ন হয়নি । তোমাকে নিয়ে ঢাকায় ফেব্রুয়ারীর বইমেলায় গিয়েছিলাম আমি ও তোমার মা । তার আগের সপ্তাহে গিয়েছিলাম সমুদ্র দেখতে । কক্সবাজার,সেন্টমার্টিন । তুমি জিজ্ঞেস করছিলে-'বাবা সমুদ্র কি?' আমি বলছিলাম-'জল,অনেক জল বাবা' । তোমার বিস্ময় চোখে তুমি জল দেখেছিলে,সমুদ্র ছুঁয়েছিলে ।
বইমেলার সেই সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম,তুমি আমার কোলে । হঠাৎ তাকিয়ে দেখলাম-তুমি চোখে চোখে কথা বলছো,হাত নাড়ছো,হাসছো আরেক শিশুর সাথে । বিরাট সে শিশু,বিশাল তার গোঁফ,কাধ ছাঁড়িয়ে তার ঝাঁকড়া ধবল চুল । সেই বিরাট শিশু এগিয়ে এলেন তোমার দিকে । আমাকে পাত্তা না দিয়ে কথা বললেন তোমার সাথে

'আমার নাম সমুদ্র'
তুমি বোধহয় তোমার বয়সের চেয়ে বেশী চৌকস ছিলে তখন । আড়াই বছরের তুমি,তোমার স্মৃতিতে তখনো সমুদ্র মানে জল । তুমি তাকে বললে
'তুমি সমুদ্র,আমি জল '

সেই বিরাট শিশু মেলার মাঠ কাপিয়ে হাহা করে হেসে উঠলেন । তোমাকে কোলে নিলেন, আশাপাশের অন্যদের ডেকে বললেন-দেখো,দেখো এই ছেলেটা আমাকে কথায় হারিয়ে দিয়েছে'

গল্পের এই এতোটুকু তোমাকে বলবো আমি ।
গল্পের গহীনে আরো গল্প জন্ম নেবে । সেই বিরাটশিশু একজন কবি ছিলেন এক পোড়াদেশের । সেই দেশ কবিকে হত্যা করে আর ঘাতককে দেয় বরমাল্য । সেই সমুদ্র কবি বড় অসহায় হয়ে পড়ে ছিলেন হাসপাতালের বেডে ।
আর তোমার জনক, মানুষ হয়ে জন্ম নিতে গিয়ে যে প্রথম কেঁদেছিল আর তারপর সারাটা জীবন কাঁদছে মানুষ হয়ে বাঁচতে না পারার কষ্টে-সে এই গল্পের ড্রাফট লিখেছিল সমুদ্র কবির অসহায়ত্বকে ধারন করে ।

গল্পের এই অংশটুকু না হয় তোমাকে আমি নাই বললাম কোনদিন ।


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

কী লিখবো বুঝতে পারছি না!


কি মাঝি? ডরাইলা?

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমি ও বুঝিনা । এইসব সংকটে কি হয় লিখে? অথবা ক'দিন পর পর এক একটা আলোকিত মানুষের এইসব সংকটে বিচ্ছিন্ন ভাবে আমাদের কটা টাকা পয়সা তোলে পাঠানো-- এই এতোটুকু মাত্র!
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুমন সুপান্থ এর ছবি

এই সব গল্প লিখে লিখে , আর অসহায়ত্ব উড়িয়ে একদিন বলা যাবে আর ও আরও কিছু গল্পআম আমরা না কবি ছিলাম , জানো ! আমরা না লেখক ছিলাম
তাই মরেছি আর দেখেছি মরতে.....

---------------------------------------------------------
নীল সার্ট নেই বলে কেউ আমাকে নাবিক বলেনি !
অথচ সমুদ্রে-ই ছিলাম আমি

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমি বলবো, "তোমার জনক ছিলেন ভিজে যাওয়া দেয়াশলাইয়ের একটা বারুদকাঠি! বাকী কাঠি গুলোও আছে। তবে ছড়ানো ছিটানো। একসঙ্গে জ্বলে ওঠা হয়নি, কখনো হবেও না!"
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

সৌরভ এর ছবি

কীভাবে কী হবে?
দর্শক হয়ে আছি।

সমুদ্র গুপ্ত, শুভ কামনা।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

আমার তিন বছরের ছেলেকে আমি কিভাবে বলব
এই দেশে জাতির পিতাকে হত্যা করাই পুন্য
মুক্তিযোদ্ধাদের ফাসিতে লটকানোই দেশপ্রেম
কবিকে চাপাতি দিয়ে কুপানোই ঈমান
আন্তজাতিক রাজাকারি প্রধান মন্ত্রী হাবার যোগ্যতা
ভিখাড়ি হওয়াই এখানে চরম সার্থকতা

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

তীরন্দাজ এর ছবি

অসাধারণ আকুতি আপনার হাসান মোর্শেদ! আঠারো বছর পর আপনার ছেলে আঠারো হয়ে আপনার অনুভুতিগুলোকে এগিয়ে নিতে প্রয়াসী হয়, সেটাও হবে এ লেখার স্বার্থকতা!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

অনেকক্ষণ বসে আছি, কী লিখবো বুঝতে পারছি না। মনেহয় পাথর হয়ে গেছি।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

দীর্ঘশ্বাস...

রণদীপম বসু এর ছবি

আপনার পোস্টে মন্তব্য করবো কী, অক্ষমতার কষ্টটাকে ঢালতেই তো পারছি না কিছুতেই। কিছু লজ্জা, কিছু অসহায়ত্ব, কিছু অক্ষমতা, কিছু ভালোবাসা যখন একসাথে জড়িয়ে যায়,তখন আর কথার কোন গদ্যভাষা খুঁজে পাই না আমি। তখন কবিতার আশ্রয়ে ছুটি। সেরকমই একটা যা আজই লেখা। কিন্তু এখানেও ব্যর্থ হলাম। তবু দিলাম নীচে-

গুপ্ত সমুদ্র
-রণদীপম বসু

[মুমূর্ষু কবি সমুদ্র গুপ্তের জন্য এলিজি]

ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে আদৌ কি আছে কিছু ?
অন্ধ চোখের ফ্রেমে ভাঙা অক্ষরে মাখা
টুকরো জানালা দিয়ে
আমি তো পষ্টই দেখছি সব-
চারদিকে ঘিরে থাকা অলৌকিক অক্ষমতা,
আলোহীন দৈবিক পৌরুষ
ছিটেফোটা বেদনার কৌটা পোরা টুপটাপ বৃষ্টি
আর ওল্টে পড়ে ভিজে যাওয়া চেনা চেনা নাম
যাকে নাকি কেউ কেউ ভালোবাসা বলেই ডাকে !
বাতাসের বিপরীতে কী নিঃস্ব ফুসফুসগুলো
খিল এঁটে বুঝে নেয় বাতাসের দাম্পত্য কলহ !
আমি তো দেখছি সবই-
ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে আদৌ কি আছে কিছু ?

নদীটা কখন যে লুকিয়েছিলো বুকে
উৎস থেকে নিয়েছে সে বিনাশের জল
গুপ্ত সমুদ্র হয়ে ফুঁসলো কখন ! বুকের নিথর পাড়
কী এমোন এসে যায় তাতে ! নদীর গন্তব্য থাকে,
ল্ক্ষ্যহীন সমুদ্র যদি খুঁজে ফেরে পাখির আবাস
লোকালয় নতজানু হলোই না হয় !
পাড়ে বসে কাঁহার আরোগ্য চাও ? পাখিদের হাসপাতাল নেই
থাকেনা আরোগ্যের আগাম চিকিৎসার বিল !
ওগুলো মানুষের যাপনের অংশীদার কেবল ;
কবি তো মানুষ নয়, অন্য কিছু,
অন্যকোন অনুষঙ্গেই মানানসই এরা !

তবু
অমরত্বের এই অসহ নির্বাসন
কবিকেই কেন পোহাতে হয় বার বার !

(০১/০৬/২০০৮)

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অনেক আগে পড়া মহাদেব সাহার কবিতার পঙক্তি মনে পড়লো:

তুমি দুঃখিত হবে, তুমি ভীত ভীত হবে বলে
এই সত্য কোনোদিন বলি নাই -
পৃথিবীর তিনভাগ জল, মাত্র একভাগ স্থল...

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আসলেই কিছুই বলার নাই... কিছুই বলার নাই...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সবজান্তা এর ছবি

এই রাষ্ট্র কবির দায়িত্ব নেয় না - কারণ কবি দাড়িপাল্লার রাজনীতিও করেন না, কবি ক্যান্টনমেন্টেও থাকেন না।

ওই দু গোত্র বাদে বাকিরা কেউ কি মানুষ নাকি এই চমৎকার দেশে ?


অলমিতি বিস্তারেণ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এইসব গল্প না হয় আমরাই লেখি
আমরাই পড়ি
আগামী প্রজন্মকে এইসব গল্প পড়িয়ে অভিশাপ না হয় নাই দিলাম

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আসলে একজন কবির জন্য শুধু নয়,এই আকুতি প্রতিটি মানুষের জন্য । এরকম তো আমরা প্রায়ই শুনি । আমি জানি প্রত্যেকেই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে অংশ চগ্রহন করেন ।
কিন্তু এটা তো কোন সমাধান নয় । মানুষের সবচেয়ে অসহায় সময়ে,জীবনমরনের প্রশ্নে যদি রাষ্ট্র দায়িত্ব না নিতে পারে তাহলে সেই রাষ্ট্রে আমার দরকার কি?

এইদেশে তো কতো বড় বড় আন্দোলন হয়-ভাষার,স্বাধীনতার, গনতন্ত্রের । দু একটা ছোট আন্দোলন হতে পারেনা- যেনো রাষ্ট্র নাগরিকের চিকিৎসার দায়িত্বটুকু নেয়,যেনো পুলিশ আর কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে না পারে?
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।