এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহন করে অমিত সেন গুপ্ত- হার্ডনিউজ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক , নভেম্বর ২০০৫ এ
একটা পুরনো প্রশ্ন দিয়ে শুরু করছি । তেহেলকার উপর যখন নানামুখী চাপ সৃষ্টি করা হলো, তুমি বলেছিলে-ভারতে একজন নোয়াম চমস্কির দরকার । কেনো ভারতের প্রেক্ষিতে চমস্কিকে তোমার খুব প্রয়োজনীয় মনে হলো?
আমার মনে হয় তেহেলকার উপর চাপ সৃষ্টি কিংবা অন্য যে কোন ইস্যুতেই আমাদের প্রতিবাদ্গুলো বড় বেশী প্রতীকি হয়ে পড়ে । কোন প্রেক্ষিতেই সত্যিকারের প্রতিবাদ করা হয়ে উঠেনা ।
বেশীর ভাগ সময় কিছু মৌলিক প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে যাই । গনতন্ত্রের নামে কেনো সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাচারিতা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যা আদতে ফেসিজমে রুপ নেবে অথবা ‘নতুন ধারার’ গনতন্ত্রের সাথে কর্পোরেট বিশ্বায়ন, শোষন, সামরিকতন্ত্র ও যুদ্ধের কি সম্পর্ক? দুর্নীতি ও ক্ষমতার মধ্যে সম্পর্কের রুপরেখাটাই কেমন?
যখন তেহেলকা এক্সপোস এর ঘটনাটা প্রকাশ পেলো, এক পর্যায়ে আমার মনে হলো থ্যাংক্স গড! , বিজেপি ও যে দূর্নীতি করে, এই ধর্মজীবি সরকারের মন্ত্রী ও যে ঘুষ খায় সেটা প্রমানিত হওয়া বড় জরুরী ছিলো । তারা তো নিজেদের প্রায় ঈশ্বরের মতো শুদ্ধ বলেই প্রচার করতো । এই সব অতি শুদ্ধতাবাদ বরং অধিক ভয়ংকর ।
এই সময়ে ভারতে কর্পোরেট পুঁজিবাদ ও সামন্ততন্ত্রের ফিউশন ককটেল গড়ে উঠছে - বড় ভয়ংকর ককটেল , আমরা এর স্বাক্ষী থাকছি, আমাদের চোখের সামনেই পর্দা উঠছে ।
মাঝেমাঝে মনে হয় ‘গ্রামীন কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরন’ নামে যে সরকারী পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে-তার ভিন্ন ঘরানার বাস্তবায়ন ঘটাবে এই ককটেল । অর্ধেক মানুষ হয়ে যাবে নক্সালাইট, বাকী অর্ধেক যোগ দেবে নিরাপত্তা বাহিনীতে আর এইভাবে মহান বুশের বানীর ও স্বার্থকতা নিশ্চিত হবে । প্রতিটি মানুষকে হয় ‘মিত্র পক্ষ’ নয়তো ‘ শত্রু পক্ষের’ হয়ে যেতে হবে ।
আমরা ক্রমশঃ পতিত হবো এক চরম স্বৈরতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় ।
মাওবাদীদের ক্রমবর্ধমান কার্যক্রমে কি প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে, দেখো । শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক বিশ্লেষক রা পর্যন্ত একে স্রেফ আইন-শৃংখলার পরিস্থিতির অবনতি হিসেবেই দেখছেন । এটা যে একটা রাজনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিক ভাবেই এর সমাধান করতে হবে এই বোধ কারো হচ্ছেনা । মাওবাদীদের প্রভাব ক্রমশঃ বাড়ছে আর তা প্রতিরোধের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে আরো বেশী ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে, হয়তো সাধারন মানুষের হাতে ও অস্ত্র তুলে দেয়া হবে । এইভাবে একটা গৃহযুদ্ধকে প্রমোট করা হবে ।
অথচ ভারতীয় সুশীল সমাজের কাছে এটি খুব একটা ভাবনার বিষয় নয়!
এখানে যারা বিষয়গুলো অনুধাবন করেন এবং রাষ্ট্রকে একটা শোষন যন্ত্র হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি জানান তারা মোটামুটি দুভাগে বিভক্ত । গান্ধীবাদী আর মাওবাদী ।
এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একটা সাধারন সমস্যা রয়েছে । অর্থনীতি কিংবা রাষ্ট্রীয় নীতির প্রশ্নে যিনি দুর্দান্ত প্রগতিশীল ভাবনা প্রকাশ করেন সেই তিনিই আবার দেখা যায় ভয়ংকর রকম গোঁড়া অন্য কোন বিষয়ে । হতে পারে সেটা নারী, বিবাহ,যৌনসম্পর্ক কিংবা আমাদের তথাকথিত ‘পারিবারিক মুল্যবোধ’ প্রসংগে ।
যেমন ধরো- অনেকেই আছেন গান্ধীবাদী, মাওবাদী কিংবা মার্ক্সবাদী আবার একই সাথে তারা ব্রাম্মন কিংবা উঁচু বর্ণের হিন্দু । একজন উঁচু বর্ণের গান্ধীবাদী কিংবা কমিউনিষ্ট কি সানন্দে মেনে নিতে পারবেন যদি তার সন্তান দলিত কিংবা মুসলমানকে বিয়ে করে অথবা সমকামী হয়ে যায়?
রাজনৈতিক অবস্থানের কারনে যাকে তুমি সমর্থন করছো, হয়তো তার বিরুদ্ধেই আবার দাঁড়াতে হবে তার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারনে ।
তো, এটা একটা জটিল অবস্থা । এই সব স্ববিরোধীতা মোকাবেলা করতে করতেই তোমাকে তোমার নিজের দাঁড়ানোর জায়গাট খুঁজে বের করতে হবে ।
মুন্সীপ্রেম চাঁদ, মুক্তিবোধ,নিরালা,কাইফি আজমীরা যে ভাষায় লিখেছেন-সেই হিন্দীভাষী অঞ্চল এখনো ভারতের মধ্যে সবথেকে স্থবির,পশ্চাদপদ ও দারিদ্রপীড়িত । তবু এই ভাষায় নিজস্ব রকমের আনন্দ, হাস্য কৌতুক, উদযাপনের আয়োজন ঘটতে থাকে । এই আয়োজন দলিতদের একেবারে নিজের রকমের । রূঢ় বাস্তবতার সাথে সৃষ্টিশীলতার এই সখ্যতা চমকপ্রদ । এতো নিস্পেষনের মধ্যে ও নতুন নতুন থিয়েটার, সাহিত্য, সিনেমা-একটা জমজমাট সংস্কৃতি…
এখানে সবসময়ই কিছু না কিছু ঘটছে । বাতাসে তার ঘ্রান পাওয়া যায় । এই উদ্দীপনা, প্রান চাঞ্চল্য কিন্তু পাশ্চাত্যে খুঁজে পাবেনা । আমেরিকা কিংবা ইউরোপে বসে বুঝা অসম্ভব, আসলে সারা পৃথিবীজুড়ে প্রতি মুহুর্তে কতো কি যে ঘটে যাচ্ছে । সেখানে পুঁজিবাদ,ভোগবিলাসের বাইরের জীবনবোধ কেবল বাতুলতা মাত্র । তারা এটাকে তোমার কৈশোরের আবেগের চেয়ে বেশী কিছু বলে বিবেচনা করবেনা ।
কিন্তু এখানে এখনো এটা আছে । যদি ও ক্রমশঃ ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে ভোগবাদের সাথে সাংঘর্ষিক অন্য সব বোধ, অন্য সকল ভাবনাকে ।
তুমি যেটা বললে, সেটা আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ন । এখনো সারা ভারত জুড়ে হাজার হাজার ছোটকাগজ বের হয় যারা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ধার ধারেনা । এটা খুব জরুরী, মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের সেতুটা এইভাবে টিকে থাকে কিন্তু ।
তবে প্রশ্ন হলো যোগাযোগের এই বিকল্প মাধ্যমগুলো কতোটুকু শক্তিশালী, কতোদিন টিকে থাকবে? তুমি পুঁজিবাদের ভয়ংকর শক্তিশালী কাঠামো টা চেনো । এইসব বিকল্প দিয়ে ঐ দানবের সাথে যুদ্ধ করে জেতা যায়?
তীব্র আবেগ আর অযৌক্তিক জেদ থাকলে তুমি আশাবাদী হতে পারো ।
পুঁজিবাদের যে ভয়ংকর শক্তিশালী কাঠামো-তার বিরুদ্ধে কি করে মানুষ রুখে দাঁড়াবে? যেমন দাঁড়াচ্ছেন বারবার চমস্কি কিংবা তুমি?
একটা সময় পর্যন্ত আমরা প্রত্যেকে ভেবেছিলাম-প্রকৃত ঘটনাগুলো মানুষের জানাটাই জরুরী । মানুষ যখন আসল তথ্য পেয়ে যাবে,বুঝতে পারবে কি ঘটছে তখন মানুষ তার বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং পরিস্থিতি বদলে যাবে ।
কিন্তু বোকার মতো আমরা দেখলাম তথ্য জানাটাই সবকিছু নয় । এটা বড়জোর যুদ্ধের একটা অংশ মাত্র ।
একটা উদাহরন দেই । যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে মাইকেল ম্যুরের প্রামান্যচিত্র ‘ফারেনহাইট ৯/১১’ সেদেশের আনাচে কানাচে, ছোট ছোট শহরের সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছিল,ব্যাপকভাবে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষন করেছিল । অথচ বুশ আগের বারের চেয়ে ও বেশী ভোট পেয়ে ফিরে এসেছে হোয়াইট হাউসে!
এখন সারা পৃথিবীজুড়েই তথ্যের ছড়াছড়ি । সবাই সবকিছু জানে । চমস্কীর মতো মানুষদের এতে বড় অবদান আছে । কিন্তু কি হয় এতো তথ্য দিয়ে? এতো সত্য জেনে?
দেখা যাচ্ছে বেশীর ভাগ তথ্য ও তত্বই অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে । আন্তর্জাতিক সংহতির কি কোন কার্যকারিতা আছে এখন?
লক্ষ লক্ষ মানুষ ইরাক যুদ্ধবিরোধী মিছিল করলো সারা পৃথিবী জুড়ে । যুদ্ধ কিন্তু থামানো গেলোনা । দখলদারীত্ব বজায় হলো পুরোদস্তুর ।
আমি অবশ্যই স্বীকার করি , ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন করতে এইসব তথ্য প্রকাশ জরুরী ছিলো । কিন্তু তারপর?
একটা আগ্রাসনের তথ্য প্রকাশ করা, তার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা আর তাকে সফল ভাবে প্রতিরোধ করতে পারা কিন্তু এক নয় ।
যা জানার, যা জানানোর তা হয়ে গেছে । আমি এখন প্রতিরোধের নতুন কৌশল জানতে আগ্রহী । অহিংস কিংবা সশস্ত্র, সবধরনের কৌশল নিয়েই তর্ক হতে পারে…
এ বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবার, ভাবনাগুলোকে জীবনযাপনের অংশ করে ফেলার অন্য রকম একটা ঝুঁকি আছে কিন্তু । তুমি খুব রাশভারী, নীতিবাগিশ ও উন্নাসিক হয়ে উঠতে পারো । তোমার জীবন থেকে আনন্দ,হাস্য কৌতুকের মতো সহজাত বিষয়গুলো হারিয়ে যেতে পারে ।
দরিদ্র, কর্মজীবি মানুষেরা কি হাসেনা?
দারুন বলেছো তুমি ।
ভারতে, নীতিবাগিশতা হচ্ছে একজন মানবাধিকার কর্মী কিংবা বুদ্ধিজীবির জন্য প্রধান ভেক । এটাকে পুঁজি করে অনেকে বেশ ক্ষমতাবান ও হয়ে উঠেন । কোন কোন মানবাধিকার কর্মীর নিজ নিজ এলাকায় বিশাল প্রভাব তৈরী হয়ে গেছে,লোকজন তাদের নামে হাততালি দেয়, মিছিল করে । এগুলো তাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয় । কেউ কেউ মুলধারার রাজনীতিকদের মতো আচরন ও করেন ।
আমি নিজে খুব অস্বস্তিতে ভুগি । যতোটা প্রাপ্য নয় তার থেকে অনেক বেশী মনোযোগ ও গুরুত্ব পাই আমি । অনেক জরূরী বিষয়ে মানুষজন আমার কাছে আসেন, আবেদন-নিবেদন করেন যেনো আমি হস্তক্ষেপ করি । মানছি , কোন কোন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ সাময়িক ফল দেয় কিন্তু এর একটা খারাপ দিক ও আছে । তুমি নিজেকে বেশ ক্ষমতাধর মনে করে বসতে পারো, সে তোমার সত্যিই কিছু থাক বা না থাক । এটা একটা বাজে ব্যাপার ।
আর জনপ্রিয়তা ও কিন্তু শেষবিচারে একটা পুঁজিবাদী উপাদান মাত্র । তুমি এটা অর্জন করছো, জমাচ্ছো, তারপর এটাকে খাটিয়ে বেশ চালিয়ে যাচ্ছো । কিন্তু এই পুঁজি তোমার জন্য সর্বনাশ ও হতে পারে, তুমি নিজেকে ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন ও একাকী করে ফেলতো পারো । জনপ্রিয়তা তোমাকে শূন্যে তোলে দিচ্ছে আর তুমি ভুলে যাচ্ছো কি করে ধরতে হয় পড়তে হয় দেয়াল লিখন ।
আমার মনে হয় মাঝে মাঝে প্রত্যাবর্তন বড় জরুরী । অসংখ্য তথ্য ও উপাত্ত, ঘটনা ও বাস্তবতা তোমাকে ক্লান্ত করবে, তোমার কল্পনাশক্তি কেড়ে নেবে । এটা একটা বন্দীদশা ।
আমি প্রস্তুত আছি এই বন্দীত্বকে অস্বীকার করতে ।
তুমি বলতে চাইছো বৃত্ত ভাংতে গিয়ে নিজেই বৃত্তবন্দী হয়ে পড়ার আশংকা আছে?
ঠিক তাই । এটা বড় বিপদজনক, বিশেষ করে একজন লেখকের জন্য ।
জনপ্রিয়তার চাপে তুমি তেমনই হয়ে উঠবে যেমন তোমার ভক্তরা প্রত্যাশা করে - তোমার আচরন, পোশাক -আশাক, কথাবার্তা হয়ে উঠবে তাদের পছন্দ মাফিক ; তুমি নিজেকে মহৎ ও ত্যাগী রুপে প্রদর্শন করবে কারন ভারতীয় জনগন তেমন দেখতেই ভালোবাসে ।
এটা স্রেফ একটা উন্মাদনা । বান্টি আউর বাবলি ‘র বাবলির মতো আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে- মুজে এইসি ইজ্জত আউর সরফরাত কি জেন্দেগী সে বাঁচাও
তোমার স্বত্ত্বা ,তোমার নিজস্বতাকে বন্দী করে ফেলার মতো বিশাল আয়োজন ছড়ানো রয়েছে চার
পাশে ।
জাঁপল সার্ত্রে আমার খুব পছন্দের । তিনি বলতেন টাকা জিনিসটা জমিয়ে না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে । টাকা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য তিনি মদ খেতেন, ট্যাক্সি করে ঘুরে বেড়াতেন উদ্দেশ্যহীন । আবার একই সাথে তার দুর্দান্ত ভূমিকা -সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চায়, স্পেনের গৃহযুদ্ধ কিংবা স্ট্যালিনের সমালোচনায় । ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটা ব্যবহারে আমার আপত্তি আছে । বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা আছে এমন যে কেউই বুদ্ধিজীবি । একজন মুচি ও সে অর্থে বুদ্ধিজীবি…
সংজ্ঞা নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই । একজন লেখক যে কোন বিষয়েই তার ভাবনাকে সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা থেকে বের করে আনতে চান ।
টাকাপয়সা বিষয়টাকে আমি সবসময় হাল্কা ভাবে নিতে চেয়েছি । বিশ্বাস করো আমি এসব থেকে মুক্ত থাকতে চেয়েছি কিন্তু ব্যাপারগুলো খুব সহজ নয় । টাকা জিনিসটা পারমানবিক বর্জ্যের মত । এটা নিয়ে তুমি যা কিছুই করো, যতো চাপা দাও, যতো রিসাইকেল করো- সমস্যা তৈরী করবেই ।
আমি আমার কম কম সবকিছু নিয়েই সুখী ছিলাম । কম টাকা,কম পরিচিতি,কম চাপ-বেশী ফুর্তি ।
আমার উপর চেপে বসা বেশী বেশী দায়-দায়িত্ব মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে । আমি একটা চাপহীন সাধারন জীবন যাপন করতে চেয়েছি, কিন্তু এখন…
নিজেদের মধ্যবিত্ত বিলাস ও কল্পনার মিশেল চাপিয়ে দিতে মানুষ ক্রমাগতঃ চারপাশে আইডল খুঁজছে, নায়ক ,ভিলেন, ত্রাতা । যে কোন ক্ষেত্রের সফল মানুষেরাই হয়ে উঠছেন একএক জন ‘সেলিব্রেটি’ । এটা একটা পেশা হয়ে দাঁড়াচ্ছে । আমাদের পেশাদার সেলিব্রেটির সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে । কলেজগুলো সেলিব্রেটি তৈরীর কোর্স শুরু করতে পারে ।
এর কোন বাছবিচার নেই । বিশ্বসুন্দরী থেকে শুরু করে লেখক, বস্তাপচা সিরিয়ালের নির্মাতা সবাই ই এখন সেলিব্রেটি । যে কোন দিকে কেবল সফল হলেই হলো ।
আমার কাছে ও কেউ কেউ আসেন তারকা দর্শনের লালসা নিয়ে । আমি কে সেটা মুখ্য নয়, আমার কিছুটা পরিচিতি আছে এটাই যথেষ্ট । এই পরিচিতি বুকার জয়ের জন্য নাকি জিটিভির হরর শো’র জন্য সেটা বিবেচ্য নয় ।
এটা একটা প্রহসন , এই সেলিব্রেটি প্যারেড । প্রত্যেকে নিজেকে সর্ব্বোচ্চ পরিমানে বিক্রয়যোগ্য করে প্রদর্শন করছে । ব্যর্থতার কোন স্থান নেই এখানে । অথচ একজন লেখক হিসেবে ব্যর্থতার বেদনাবোধই আমাকে বেশী টানে । সাফল্য বড় সংকীর্ন , একঘেঁয়ে ।
তুমি বুকার এর প্রাইজ় মানি দিয়ে দিয়েছো এনবিএ’কে, সিডনি’র প্রাইজ মানি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে, লানান এর প্রাইজ মানি দিয়েছো আরো ৫০ টি সংস্থাকে যারা নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছে ; তুমি তাদের বিশ্বাস করেছো । তুমি তোমার টাকা স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিয়েছো । যদিও টাকাগুলো তুমি পেয়েছো অন্যদের কাছ থেকে তবু এগুলো তোমার টাকাই । খুব কম লোক এভাবে নিঃশর্ত বিলিয়ে দেয় । তোমার প্রতি সকলের আগ্রহ,ভিন্ন দৃষ্টি তো থাকবেই, নাকি?
দেখো ,আমি আমার সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছি-তা তো না ।
এখনো যা আছে, একা একজন মানুষের জন্য যথেষ্ট । সকলের তরে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার মতো অতি আদর্শবাদ আমার নেই আর এইসব অতি আদর্শবাদের বিনিময় মুল্য কিন্তু চরম ।
আমি জানি টাকা যেমন অনেক ক্ষেত্রেই ভালো কাজ করতে সহায়তা করে তেমনি এটা ক্ষতিকর ও হতে পারে-তা আমার উদ্দেশ্য যতই সৎ থাকুক ।
কি আর করা? সবসময় কি আর ভালো-মন্দ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব?
টাকা পয়সা নিয়ে আমি এমনিতেই অস্বস্তিতে থাকি । আমি আমার বিলগুলো পরিশোধ করতে পারি, জীবন ধারনের ব্যায় মেটাতে পারি, আমার কোন দেনা নেই । ব্যাস আমি খুশী । এর বাইরে ও আমি অনেক খরচ করি এমনি এমনি । কিন্তু যখনই টাকার ধ্বংসাত্নক ক্ষমতার কথা মনে আসে, আমি আতংকিত হয়ে পড়ি । ঈশ্বরকে ধন্যবাদ , আমি উত্তরাধিকার সুত্রে কিছু পাইনি । উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া টাকা-পয়সা এক বিরাট অভিশাপ ।
বিলিয়ে দেয়া টাকা অনেক জটিলতা ও সংঘাত তৈরী করে, এ ছাড়া এটা আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ও পরিপন্থী । কিন্তু কি করবো? আমি টাকাগুলো জমিয়ে রাখবো ব্যাংকে? সুদে আসলে আরো বাড়তে থাকবে?
এটা একটা বিশ্রী জটিলতা । উদ্বৃত্তের জটিলতা । আমি জানি, এই ক্ষুধা ও দারিদ্রপীড়িত দেশে এটা অপ্রীতিকর,অশ্লীল । কিন্তু কি করবো? একদিকে অভাব আরেকদিকে উদ্বৃত্ত-এই বাস্তবতা তো আছেই …
শেষপ্রশ্ন । তোমার নিজের মধ্যে কিছু বিষয়ে দ্বন্ধ আছে যদি ও অংগীকার ও অবস্থানের প্রশ্নে তুমি সুস্পষ্ট । তোমার দাঁড়ানোর জায়গাগুলো অনেক সময় নৈর্ব্যক্তিক ঠেকে । এ অবস্থা কাটিয়ে তুমি কি একটা সিদ্ধান্তমুলক অবস্থানে আসতে পারোনা যেখানে তোমাকে স্ববিরোধীতায় ভুগতে হয়না?
আমার তো মনে হয় আমরা প্রায় সবাই ই সিদ্ধান্ত গ্রহনের জটিলতার মধ্যেই জীবন যাপন করে যাচ্ছি ।
অতিআদর্শবাদীরা চান- মানুষের পৃথিবীটা একেবারে শুদ্ধ,নির্ভুল একটা জায়গা হিসেবে গড়ে উঠুক । এ রকম ভাবনা আমাকে আতংকিত করে ।
হিটলার , স্ট্যালিন ও এরকম ভেবেছিলেন- এক ধরনের সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং । কয়েক মিলিয়ন মানুষ -যাদেরকে তারা অশুদ্ধ মনে করেন তাদেরকে শেষ করে দিয়ে একটা নতুন নির্ভুল পৃথিবী গড়ে তুলবেন । অতি শুদ্ধতার ভাবনা শেষপর্যন্ত গনহত্যা উসকে দেয় । জন গ্রে এ বিষয়ে কিছু লিখেছেন ।
বিপরীতে কি আছে? ভাগ্য, নিয়তি, ধর্ম এইসবে ভরসা করে বসে থাকা? । এতে অবশ্য সুবিধাভোগী শ্রেনী এবং বর্ণপ্রথার লাভ হয় ।
আমরা কেউ কেউ চেষ্টা করছি -এই দুটো বিপরীত অথচ একই রকম বিভৎস, সিদ্ধান্তমুলক অবস্থানের বাইরে নতুন কিছুতে আলোকপাত করতে ।
মন্তব্য
অনেকেরই জানা আছে নিশ্চিত, তবু তেহেলকা এক্সপোস বিষয়ে ছোট্ট নোটঃ
ভারতের অনলাইন পত্রিকা তেহেলকার একদল সাংবাদিক অস্ত্রব্যাবসায়ীর ছদ্মবেশে যোগাযোগ করেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের সাথে, তাদের কাছ থেকে কিছু অস্ত্র কিনতে মন্ত্রনালয়কে রাজী করানোর জন্য । এটি ২০০৪ সালের প্রথমদিকের কথা । বিজেপি সরকার ক্ষমতায়, জর্জ ফার্নান্দেজ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ।
দেখা গেলো অস্ত্র ক্রয়ের সাথে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কয়েকজন জাঁদরেল জেনারেল হয়ে স্বয়ং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জড়িত এবং প্রত্যেকে বিভিন্ন মাত্রায় ঘুষ নিলেন । ঘুষ লেনদেনের প্রতিটি পর্ব গোপনে রেকর্ড করলেন সাংবাদিকরা । পুরো প্রক্রিয়া শেষ হওয়া মাত্র তারা পত্রিকায় এটি প্রকাশ করে দিলেন ।
সেই সময়ে এটি সারা ভারতে প্রবল আলোড়ন তুলে, ধর্মাশ্রয়ী বিজেপি জোটকে বেকায়দায় ফেলে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে সাময়িক পদত্যাগ করতে হয়
এটা গেলো ঘটনার এক দিক । আরেকদিকে শুরু হয় তেহেলকার সাংবাদিক এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিশোধপর্ব ।
মুল ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়ায় তেহেলকার আক্রান্ত হওয়া বিষয়ে একটা ফিচার আছে নিচের লিংকে । আগ্রহীগন দেখতে পারেনঃ
তেহেলকা'কে যে মুল্য দিতে হলো...
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
হুম ..................... গনতন্ত্রের নামে কেনো সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাচারিতা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যা আদতে ফেসিজমে রুপ নেবে ............... একদম ঠিক কথা ।
নিবিড়
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
একদম ঠিকঠাক ৷
অভিনন্দন আপনাকে৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
আপনি ধৈর্য্য ধরে এখনো পড়ছেন জেনে ভালো লাগলো । মুল বইটা আপনার কাছে আছে বলে, অনুবাদের ভুল ত্রুটিগুলো ও নির্দেশ করতে পারেন ।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
এই অনুবাদ-ধারবাহিকটির আমি এক অন্ধ পাঠক। যখন পড়ি, তখন শুধু অরুন্ধতীকেই দেখি। মনে-মনে ধন্যবাদ জানাই অনুবাদককেও।
*******************************
'ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত'
-সুভাষ মুখোপাধ্যায়
*******************************
'ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত'
-সুভাষ মুখোপাধ্যায়
কৃতজ্ঞতা ।
পাঠকঈশ্বর অন্ধ কেনো হে ?
আমি বরাবর চেষ্টা করছি অরুন্ধতীর কথাগুলোকে সবচেয়ে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করতে । তবু যদি কোন সাজেশন থাকে দয়া করে জানাবেন ।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
" জনপ্রিয়তা তোমাকে শূন্যে তোলে দিচ্ছে আর তুমি ভুলে যাচ্ছো কি করে ধরতে হয় পড়তে হয় দেয়াল লিখন ।"
রাকিব, অনেক দিন পর ।
ভালো তো?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
পড়ছি!
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
নতুন মন্তব্য করুন