কোন কোন নাম ধরে তিনি ডেকে উঠতেন, কারো কারো সাথে কথা বলতেন, কাউকে কাউকে কোন নির্দেশ দিতেন, কারোর জন্য কাঁদতেন।
তার উচ্চারিত নামগুলো চেনাজানা কারো নয়, অন্ততঃ তার আশে পাশে সে সময়ে যারা থাকতেন তাদের কারো কাছে।
পাঁচ সন্তানের চারজনই স্থায়ীভাবে অভিবাসী। পঞ্চম জন ও পাসপোর্টে ভিসা লাগানো , যেতে পারছেনা শুধু তার জন্য। হৃদযন্ত্র ক্রমশঃ অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট তীব্র হয়, মাসে দুয়েক বার ক্লিনিকে ভর্তি করতে হয়। সন্তানেরা নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চায় আরো ভালো চিকিৎসা, নিশ্চিত শুশ্রুষার জন্য।
আশি পেরুনো শরীরে তার দারুন জেদ। কাদের কাদের নাম উচ্চারন করে বলতেন- এই মাটিতে ওদের কবর হয়েছে, অন্য মাটিতে তিনি শুতে পারবেন না।
ছোট মেয়েটাকে এবার চলে আসতেই হবে। তার ছেলেটার ও স্কুলে যাবার সময় হয়ে এলো। সবার উদ্বেগ, উৎকন্ঠা- এই জেদী, একগুঁয়ে, ক্ষ্যাপাটে বুড়োর এখন কি হবে? মাত্র এক সপ্তাহ পর মেয়েটার ফ্লাইট!
জীবন মাঝে মাঝে বড় অদ্ভূত প্রহসনের মতো সকল হিসেব মিলিয়ে দেয় সকলের। সবার সব উৎকন্ঠা ছাপিয়ে চলে গেলেন, চলে গেলেন তিনি কাল বিকেলে। গেলেন, আর ফিরবেন না।
আরেক বার গিয়েছিলেন তিনি, যুদ্ধে গিয়েছিলেন। মধ্যবয়সে। তিন সন্তানের জনক তখন। তার দু বছর আগে সশস্ত্র বাহিনী থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন উর্ধ্বতনের জাতঘৃণার প্রতিবাদ জানিয়ে।
সশস্ত্র বাহিনীর অভিজ্ঞতায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন মেলাঘর মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন শিবিরের একজন প্রশিক্ষক। কিশোর আর সদ্য তরুন যোদ্ধাদের দক্ষ হাতে গ্রেনেড ছুঁড়তে শেখাতেন, কখনো প্রিয় এসএমজি কাঁধে নিজেই কোন অপারেশনে।
যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে পোড়া ছাই পেয়েছিলেন পৈতৃক ভিটের। স্ত্রী ও সন্তানদের তখনো সন্ধান নেই। মাস দুয়েক পর খোঁজে পেয়েছিলেন মেঘালয়ের এক আশ্রয় শিবিরে।
পরিবহন শ্রমিকদের দাবী আদায়ের সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন পরে। বাইপাস সার্জারী হয়েছে কয়দিন আগে, ডাক্তার বলে দিয়েছে পুর্ন বিশ্রাম। অথচ সকাল বেলা বাড়ির লোকেরা তাকে আর খোঁজে পেলোনা। চট্রগ্রাম থেকে ফোন তার- চলে গেছেন পহেলা মে'র শ্রমিক সমাবেশে।
যুদ্ধদিনের কথা বলতেন না কখনো। কেবল শরীর ভাঙ্গছে যখন আরো, সময় ঘনিয়ে আসছে অন্তিম যাত্রার- তখন ঐ সব নাম ধরে ডাকতেন, ঐ সব নামদের সাথে কথা বলতেন, তাদের নাম ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন- 'বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো অস্ত্র হাতে মরতে পাঠালাম! '
তার নামে কোন শোকগাঁথা রচিত হবেনা আজ, অর্ধনমিত হবেনা পতাকা, বাজবেনা বিউগলের করুন সুর-- তবু নিশ্চিত এই মাটি পরম মমতায় গ্রহন করবে আজ দুপুরে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজনকে; যিনি নিজে ও অপেক্ষায় ছিলেন এই মাটির স্পর্শের, যে মাটিতে সমাহিত তার আরো সহযোদ্ধাগন।
জন্মদাতা নন, তবু পিতা ছিলেন তিনি।
পিতা, এই সামান্য সন্তানের প্রণতি গ্রহন করুন।
মন্তব্য
প্রিয় মোরশেদ, দয়া করে এই বীরের নামটা অন্তত জানান। এমনিতেই আমাদের অজ্ঞতা আর অকৃতজ্ঞতার সীমা নেই। কাহিনী যা বললেন তাতে বিষয়টিকে আর আপনার ব্যক্তিগত বলে মানতে পারছিনা। আপনার ভাষায়ই যুক্তি দেই,
"জন্মদাতা নন, তবু পিতা ছিলেন তিনি"
আমি আর কবে সোচ্চার হতে পারবো মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে?
কবে তাঁদের কথা বলতে পারবো ব্যক্তিগত অকৃতজ্ঞতার গ্লানির ঊর্ধ্বে উঠে?
কবে আমার গর্বের পরিমান গ্লানির পরিমানকে ছাপিয়ে উঠতে পারবে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
একে একে চলে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল ।
উদ্ধৃতি
পিতা, এই সামান্য সন্তানের প্রণতি গ্রহন করুন।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
শ্রদ্ধা রইলো। পাশে আছি।
শ্রদ্ধা।
সকালে অফিসে এসেই আপনার পোস্টাটা দেখলাম। বুকের মধ্যে ভারি কোনো কিছু একটা আটকে গেল টের পেলাম।
পিতা, এই অকৃতজ্ঞ সন্তানদের আপনি ক্ষমা করবেন।
শ্রদ্ধা রইল
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
শ্রদ্ধা ।
একে একে চলে যাচ্ছেন সবাই
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
হৃদয়োৎসারিত শ্রদ্ধা।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
..... দিলওয়ার
শ্রদ্ধা।
......................
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আপনার এই লেখাটা পড়া হলো হিমু'র গল্পটা পড়ার পর। এবার আর সত্যিই কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না ..................
নামটা কি জানানো যাবে?
অজ্ঞাতবাস
অজ্ঞাতবাস
......................
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
স্তব্দ হয়ে বসেছিলাম।মৃত্যু সংবাদটি পেয়েছিলাম মাত্র কিছুক্ষন আগে। তারও আগের আটচল্লিশ ঘন্টা প্রতি মুহুর্তেই অপেক্ষা করছিলাম কখন শেষ খবর পাওয়া যাবে।
শেষ পর্যন্ত হিমু'র ঐ লেখাটি বাধ্য করলো ব্যক্তিগত শোকটুকু বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে।
আসলেই আমাদের কাউন্ট ডাউনের সময় এসে গেছে, এই দেশ থেকে শেষ জীবিত মুক্তিযোদ্ধাটির প্রস্থানের। একদিন হয়তো এই দেশ গোটা বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারে, কিন্তু কোন কিছুর বিনিময়েই আর একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হবেনা।
তিনি আমার শ্বশুড়। সিলেটের দক্ষিন সুরমার জনাব মইনউদ্দীন। পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন দীর্ঘদিন যখন ওয়াজিউদ্দীন খান ছিলেন সভাপতি। সেই সব বোকা মানুষদের একজন যারা রাজনীতি করে পৈতৃক সম্পত্তি হারিয়েছেন শুধু। বোকা ছিলেন বলেই হয়তো সাহসী ছিলেন ভয়ংকর। জোট সরকারের আমলে এক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিমন্ত্রীকে মঞ্চে উঠে গালিগালাজ করে বেরিয়ে এসেছিলেন। ২৬ শে মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরে নিজে নিজেই বাড়ির আঙ্গিনায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতেন। বাড়ির অন্যরা মুখ টিপে হাসতেন এই বৃদ্ধের ক্ষ্যাপামী দেখে।
আমি একবার তার মুখোমুখি হবার উদ্ধত্ত দেখিয়েছিলাম। সৌভাগ্য এই আমিই শেষে তার সন্তানদের চেয়ে ও বেশী সাহচর্য্য ও সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। মুলতঃ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার আগ্রহ এটি সম্ভব করেছিলো। দেশ থেকে বেরিয়ে আসার আগে তার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার বর্ননা রেকর্ড করেছিলাম। জানতাম, এই সুযোগ আর আসবেনা।
জাতীয় পতাকায় ঢেকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের মাধ্যমেই তার শেষযাত্রা হয়েছে। তবে গার্ড অফ অনার দেয়া শরীয়ত সম্মত কিনা এইসব প্রশ্ন তোলার মতো পশুদের উপস্থিতি ও ছিলো।
একজন গ্লাডিয়েটর চলে গেছেন, এই সব পশুরা রয়ে গেছে।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। অনেক অনেক শ্রদ্ধা জানাই এই গ্লায়িটেরকে। তার আত্মা শান্তিতে থাকুক।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এই একাউন্টটি কোন মডারেটরের নয়। এই একাউন্ট থেকে মডারেশন করা হয়না, কিংবা এই একাউন্টের কর্মকান্ডের দায়ভার সচলায়তন নেবে না।
'বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো অস্ত্র হাতে মরতে পাঠালাম! ' -- অনেক আগে পড়েছিলাম আপনার লেখাতেই, মনে দাগ কেটে ছিলো।
শ্রদ্ধা, প্রার্থনা আর সমবেদনা
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
সমবেদনা আপনার পরিবারের জন্য আর শ্রদ্ধা রইলো বীরপুরুষের প্রতি
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
হাসান ভাই, আপনি মনটাকে অনিবার্যতা আর বিষাদে ডুবাইলেন। প্রস্তুতির মতো আদেশ যেন।
শ্রদ্ধা...
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
নতুন মন্তব্য করুন