।। দ্যা আউটসাইডার ।।

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শুক্র, ২৪/০৭/২০০৯ - ৪:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব


..
দুই

এক


ঘুম থেকে জেগে উঠার পর, মনে পড়লো ছুটি চাওয়ায় বস কেনো অপ্রসন্ন হয়েছিলো।
ভুলে গিয়েছিলাম আজ শনিবার। শনি রবি সহ একটানা চারদিনের ছুটি নিচ্ছি - এই ভেবে ব্যাটা বেজার হয়েছিলো।
কিন্তু আমি তো কোন কিছুর জন্যই দায়ী নই। তারা গতকালের বদলে এর আগের দিনই মাকে সমাহিত করতে পারতো, তবু আমি আমার শনি রবি দুদিনের ছুটি পেতাম।

গত দুদিনের ক্লান্তি এখনো রয়ে গেছে। শেভ করতে করতে ভাবছিলাম, কি করা যায়? তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম সাঁতার কাটতে যাব। নিচে নেমে ট্রাম ধরে চলে গেলাম সুইমিং পুলে। সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেক তরুন-তরুনীর ভীড়। তাদের মধ্যে আমি মেরিকে খুঁজে পেলাম।

মেরি কর্ডোনা, আমাদের অফিসের টাইপিষ্ট ছিলো । সে সময় বোধ হয় আমি ওকে পছন্দ করতাম, সে ও সম্ভবতঃ আমাকে। কিন্তু পরে ও অফিস ছেড়ে দিলে আর কিছুই হয়নি আমাদের। ও একটা প্লাষ্টিকের প্রজাপতির উপর ভাসতে চাইছিল, আমি এনে দিলাম এবং আলতো করে ছুঁয়ে দিলাম ওর বুক । মেরি হাসলো নিঃশব্দে। ও ভাসতে লাগলো, আমি ওকে ঘিরে সাঁতরাতে লাগলাম । ভালো লাগছিলো, আমি খেলার ছলে ওর খোলা পেটে মাথা রাখলাম। কিছু বললোনা ও। আমরা দুজনেই ভাসতে লাগলাম। মেরির খোলা পেটে মাথা রেখে আকাশ দেখছি, ঘন নীল আকাশ। আমার মাথার নীচে ওর হালকা মেদবহুল পেট ওঠছে,নামছে। অনেকক্ষন পর ও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পানির মধ্যে আমি ওর কোমর জড়িয়ে ধরলাম। আমরা একসাথে সাঁতরালাম। পাড়ে উঠে শরীর মোছার সময় মেরী বললো- ‘দেখো আমি তোমার চেয়ে কালো’ । আমি বললাম- ‘বিকেলে সিনেমা দেখতে যাবে? ‘ । ও বললো ফার্নান্দেলের একটা সিনেমা দেখতে চায়। কাপড় পড়ার সময় আমার কালো টাই দেখে ও জিজ্ঞেস করলো কোন শোক পালন করছি নাকি? মাথা নাড়লাম। জানতে চাইলো- কে? বললাম- মা’
-কবে?
- গতকাল।
ওর ভেজা ঠোঁট আলগা হয়ে ঝুলে রইলো কয়েক মুহুর্ত। কিন্তু কিছুই বললোনা।

একবার মনে হলো বলি- আসলে এ ঘটনার জন্য আমি দায়ী নই। পরে আবার মনে হলো- এই কথাটা একবার বলে ফেলেছি বসকে। এটা বলে আসলে কিছুই এড়ানো যায়না। যা ঘটে, ঘটে যায় -কোন না কোন ভাবে তার কিছু দায় তো থেকেই যায়, নাকি?

বিকেলে মেরী এলো, আমরা সিনেমা দেখতে গেলাম। মায়ের মৃত্যু বিষয়ে ও কিছুই জিজ্ঞেস করলোনা আর। সিনেমাটা বেশ হাসির ছিলো, আমরা অনেক হাসলাম। আমার পা দিয়ে ওর পা জড়িয়ে থাকলাম, ওর বুকে হাত দিলাম-কিছুই বললোনা। সিনেমা শেষে ওকে চুমো খেলাম, কিন্তু চুমোটা তেমন ভালো হলোনা।
তারপর ও আমার ঘরে এলো।

সকালবেলা ঘুম ভাংগার পর মেরী চলে গেলো, ওর কোন এক আন্টিকে দেখতে যাবে, আর আমার মনে পড়লো আজ় রোববার। মনে পড়তেই মেজাজ খারাপ হলো। রোববারগুলো অসহ্য ঠেকে, আমার কিছুই করার থাকেনা। বিছানায় পড়ে থাকলাম। বালিশে লেগে থাকা মেরীর চুলের ঘ্রান । বিছানায় পড়ে পড়ে অনেকগুলো সিগারেট টানলাম।

দুপুর হলো, পাড়ার রেস্তোঁরায় যেতে ইচ্ছে করছেনা। গেলেই ওরা সেই একই প্রসঙ্গে কথা বলবে, আমার ভাল্লাগছেনা। ঘরে একা একা রান্না করলাম।ডিম সেদ্ধ। রুটি নেই। সেদ্ধ ডিমই খেলাম। নীচে নেমে রুটি আনতে ইচ্ছে করছেনা।

খাবার শেষে আর কিছুই করার ছিলোনা, ঘরের চারপাশে তাকালাম। মা যখন আমার সাথে ছিলেন, এখানে বসে থাকতেন চুপচাপ। এখন এই ঘর একাকী আমার জন্য অনেক বড়। খাবার টেবিলটা নিয়ে যাবো শোবার ঘরে। এই একট ঘরই যথেষ্ট আমার জন্য। বেতের চেয়ার,আয়না লাগানো আলমিরা, ঘুমোনোর মতো একটা বিছানা, এই তো। বাকী সব অপ্রয়োজনীয় আয়োজন।
কিছুক্ষন পর, স্রেফ কিছু একটা করতে হবে বলেই-পুরনো পত্রিকার একটা সংখ্যা হাতে তুলে নিলাম। লবনের বিজ্ঞাপন কেটে লাগিয়ে রাখলাম পুরনো খাতায়। এই খাতায় এরকম হিজিবিজি অনেক কিছু জমা আছে, যখন যা ভালো লাগে আমার। তারপর হাত ধুয়ে ব্যালকনীতে গিয়ে বসলাম।

শহরের উপকন্ঠে মুল সড়কের পাশেই আমার ঘর। আজ বিকেলটা সুন্দর। রাস্তায় লোকজন কম। দুটো ছেলে, একটা মেয়ে, একজন নারী, একজন পুরুষ-গোটা একটা পরিবার। তারপর সাইকেলে চড়ে আরো কটি কিশোর, হাতে লাল রুমাল উড়িয়ে ছুটছে তারা। সম্ভবতঃ সিনেমা দেখতে যাবে বলে ট্রাম ধরার তাড়া।
তারা চলে যাওয়ার পর সবকিছু আবার নীরব। রাস্তার উল্টোপাশের সিগারেটের দোকানদার একটা চেয়ার বাইরে টেনে এনে বসলো। তার দোকানের পাশের রেস্তোরার মেয়েটি বাইরে এসে ধুলো উড়ালো। কিছুক্ষন আগে ভর্তি ছিলো যে ট্রামবাস, এখন শূন্য হয়ে ফিরছে।
গতানুগতিক আরেকটা রোববার বিকেল।

আমি ও দোকানদারের মতো চেয়ার টেনে বসলাম ব্যালকনীতে। কিছুক্ষন পর উঠে গিয়ে কিছু চকোলেট নিয়ে আসলাম। জানালার কাছে বসে চকলেট খেলাম, সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লাম। আকাশ কালো হয়ে এলো। মনে হলো গ্রীষ্মকালীন ঝড় উঠতে পারে কিন্তু দমকা হাওয়া বইলো শুধু। পাড়ার আকাশে কেবল এক পোচ মেঘ আটকে থাকলো, বৃষ্টি হলোনা আর। দীর্ঘক্ষন আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের আকাশ।
পাঁচটার দিকে কিছুটা হল্লা হলো। এক ট্রাম ভর্তি লোকজন ফিরলো ফুটবল মাঠ থেকে। পরের ট্রামে এসে নামলো পাড়ার ফুটবল খেলুড়েরা। তারা মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে কথা বলছে। একজন আমার দিকে হাসি ছুঁড়ে দিলো- ‘আমরা জিতে গেছি ‘। আমি ও হাসি ফিরিয়ে দিলাম।
হঠাৎ পাড়া জেগে উঠলো আবার। দুটো ছেলে, একটা মেয়ে, একজন নারী, একজন পুরুষ-গোটা একটা পরিবার। তারপর সাইকেলে চড়ে আরো কটি কিশোর, হাতে লাল রুমাল উড়িয়ে ফিরে এলো তারা। সিনেমা শেষে ফিরছে সবাই। কারো কারো মুখে বিগত হাসির রেশ, এরা বোধ হয় হাসির ছবি দেখে ফিরছে। কারো কারো মুখ বেশ গম্ভীর, তারা বেশ জরুরী ভঙ্গিতে কথা বলছে। একদল উজ্জ্বল তরুনী, বাদামী গায়ের রঙ তারা একজন আরেক জনের হাত ধরে উড়ে উড়ে আসছে। ক’জন তরুন কিছু একটা মন্তব্য করছে, তরুনীরা হাসিতে ভেংগে পড়ছে। তাদের কাউকে কাউকে চিনি আমি, আমাকে ও চিনে কেউ কেউ। একজন হাত তুলে আমাকে ইংগিত করলো, আমি ও হাত নাড়লাম।

রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠলো। গাছের মাথায় অন্ধকার, আকাশের মিটমিট তারাগুলো ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। এতো মানুষ, এতো আলো আমার চোখকে ক্লান্ত করে, আমি টের পাই। রাস্তা, রাস্তায় জমে থাকা জল, ছুটে যাওয়া ট্রাম, হাসির ঝলক, উজ্জ্বল আলো, ঝকমকে নকশা-এইসব, এইসব কিছুর প্রতিফলন আমাকে ক্লান্ত করে।
আরো পরে, সব ট্রাম ছুটে গেলে পর, সব মানুষ ফিরে এলে পর, গাছেদের মাথার উপর আরো অন্ধকার জমাট বাঁধার পর, একাকী বেড়ালটি রাস্তায় নেমে এলে- আমার মনে পড়ে- রাতের খাবারের সময় হয়েছে এবার।

একটানা দীর্ঘক্ষন চেয়ারে বসে থাকার ফলে ঘাড়ে ব্যাথা করছে। আমি নিচে নেমে এলাম, রুটি কিনে ঘরে ফিরলাম। খাবার পর জানালার পাশে বসে সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো কিন্তু ঠান্ডা লাগছে এখন। শোবার ঘরে আসার পর আয়নার ভেতর দিয়ে চোখে পড়লো টেবিলের এক কোনা, সেখানে আমার গ্যাস-বাতি জ্বলছে আর তার পেছনে পড়ে আছে কটি শুকনো রুটি।

টের পেলাম, আরো একটি রোববার চলে গেলো আরো একটি সপ্তাহকে কাঁধে নিয়ে। মাকে সমাহিত করে আসলাম, কাল থেকে আবার অফিস শুরু করবো। আসলে কিছুই আলাদা নয়- সবই এক, একই।


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অনুবাদ বুঝি না, কিন্তু পড়তে দারুণ লাগছে... এটুকু জানিয়ে গেলাম।

আরো পরে, সব ট্রাম ছুটে গেলে পর, সব মানুষ ফিরে এলে পর, গাছেদের মাথার উপর আরো অন্ধকার জমাট বাঁধার পর, একাকী বেড়ালটি রাস্তায় নেমে এলে- আমার মনে পড়ে- রাতের খাবারের সময় হয়েছে এবার।

টের পেলাম, আরো একটি রোববার চলে গেলো আরো একটি সপ্তাহকে কাঁধে নিয়ে।

আমি জানি না মূল বইতে কেমন আছে, কিন্তু এই অংশগুলোতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

বিপ্লব রহমান এর ছবি

অসাধারণ! চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

জাহেদ সরওয়ার এর ছবি

পড়ছি...মসৃণভাবে...চলুক...।।

*********************************************
আমার আত্মা বোমায় দু'হাত উড়ে যাওয়া কোনো আফগান শিশুকন্যা।

*********************************************

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগছে...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

স্কুল জীবনে প্রচুর রুশ অনুবাদ পড়েছি। অল্পবিস্তর ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষার। এরমধ্যে অনেকদিন অনুবাদ পড়া হয়নি। আপনারটা পড়ছি। কিন্তু ভাষাশৈলীর জন্যে অনুবাদ মনে হচ্ছেনা,ভালো লাগছে। - মারুফ

সুমন সুপান্থ এর ছবি

দোস্ত, তোমারে মুন্নিমোবারক ... এই অনুবাদের মতো তুমি সব কিছুতেই এমন মসৃণ কি না, জাতি সেটা জানবার ইচ্ছা পোষে !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

স্বপ্নহারা এর ছবি

মারাত্মক হইতাছে!...অনুবাদ যে এত্ত সুন্দর হইতে পারে বুঝি নাই!

হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

স্বপ্নহারা এর ছবি

মারাত্মক হইতাছে!...অনুবাদ যে এত্ত সুন্দর হইতে পারে বুঝি নাই!

হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

রূপকথা এর ছবি

অনুবাদটা অনেক ভালো লাগলো। এর আগে যা পরেছিলাম, তা অনেক কাঠখোট্টা লেগেছিল। ধন্যবাদ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সঙ্গে আছি...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।