।। দ্যা আউটসাইডার ।।

হাসান মোরশেদ's picture
Submitted by hasan_murshed on Sun, 02/08/2009 - 3:16pm
Categories:

প্রথম পর্ব


..
চার
তিন
দুই
এক


পুরো সপ্তাহ কাটলো অফিসের ব্যস্ততায়। এর মধ্যে রেমণ্ড এসে জানালো একদিন, চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে। ইমানুয়েলকে নিয়ে দুদিন সিনেমা দেখলাম। ও প্রায় কিছুই বুঝেনা, কাহিনী ব্যখ্যা করে বুঝাতে হয়।

গতকাল ছিলো শনিবার। মেরী এসেছিলো। লাল এবং সাদার মিশেল একটা পোষাকে ওকে ভাল্লাগছিলো। বুকের উর্বরতা আর মুখের স্নিগ্ধতা মিলিয়ে বেশ উদ্দীপক। বাস ধরে আমরা চলে গিয়েছিলাম আলজিয়ার্সের বাইরে এক সমুদ্র সৈকতে। মেরী আমাকে নতুন একটা খেলা শেখালো ।
সাঁতার কাটার সময় মুখ ভর্তি পানি নিয়ে তারপর উপুড় হয়ে আকাশের দিকে পানি ছুঁড়ে দেয়া। ছুঁড়ে দেয়া পানি বাতাসে মিলিয়ে যাবে নয়তো বুদ্ববুদ্বের মতো এসে ছড়িয়ে পড়বে চোখে-মুখে। আমার ভাল্লাগলোনা। নোনা জলে মুখ ভরে গেলো শুধু।
পরে মেরী ও এসে সাঁতরালো আমার পাশে। পানির নীচে আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলাম, ওর বুকের উর্বরতায় মুখ রাখলাম। পানি থেকে উঠে ভেজা কাপড় বদলানোর সময় দেখলাম মেরীর চোখ জ্বলছে কামনায়। দ্রুত বাস ধরে ফিরে এলাম ঘরে। তারপর দুজন গড়িয়ে পড়লাম বিছানায়।

মেরী থেকে গিয়েছিলো কাল রাতে। সকালে বললাম থাকতে আরো কিছুক্ষন, দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে। আমার একটা পায়জামা পড়েছে পা গুটিয়ে। ওর মুখের স্নিগ্ধতা আমাকে আবার মুগ্ধ করলো, জড়িয়ে ধরে চুমো খেলাম। জিজ্ঞেস করলো- ওকে ভালোবাসি কিনা? বললাম- ‘ভালোবাসা তেমন কোন অর্থবহন করেনা তবু আমি ভালোবাসিনা’ । কষ্ট পেলো। তবে একটু পর খাবার কিনতে নীচে নামার সময় ও কেনো জানি হাসলো আবার। আবার আমি চুমো খেলাম অপ্রতিরোধ্য মুগ্ধতায়।

নীচে নামার সময় রেমন্ডের ঘর থেকে মেয়ে মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। প্রথমে কান্না, তারপর মৃদু চিৎকার, এখন আর্ত চিৎকার। আশেপাশের লোকজন এসে ভীড় করেছে দরজায়। মেরী পুলিশ ডাকতে বললো। বললাম- ‘ আমি পুলিশ পছন্দ করিনা’
তবু কে যেনো একজন পুলিশকে ডেকে নিয়ে এলো রাস্তা থেকে।

পুলিশ এসেই জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো দরজায়। কিছুক্ষন পর রেমন্ডকে দেখা গেলো। মুখে চুরুট আর অভিনেতার মতো বানানো হাসি। মেয়েটা দৌড়ে বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। এসেই তারস্বরে বর্ননা করতে লাগলো রেমন্ড কি করে পেটাচ্ছিলো তাকে। পুলিশ রেমন্ডকে নাম জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে সে নাম বললো। এরপর পুলিশ তাকে ধমকে বললো মুখের সিগারেট ফেলতে। জবাবে সে হাসিমুখে ধোঁয়া ছাড়লো। আর পরমুহুর্তেই ছিটকে পড়লো , চোয়ালে প্রচন্ড ঘুষি খেয়ে। জ্বলন্ত সিগারেট উড়ে গিয়ে পড়লো কয়েক হাত দূরে ।
একই সাথে মেয়েটা ও গালিগালাজ করতে লাগলো। দু এক মিনিট পর চোয়ালে হাত বুলাতে বুলাতে উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখ রেমন্ড পুলিশকে বললো- ‘ক্ষমা করবেন অফিসার, একজন ভদ্রলোককে এইভাবে প্রকাশ্যে গালাগালি কি আইনসম্মত?’ পুলিশটি জবাব না দিয়ে ঘাড় ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো আর সে মেয়েটার দিকে উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দিয়ে বললো- ‘আবার দেখা হবে প্রিয়ে, অপেক্ষায় থাকো!’

এরপর অবশ্য নির্ঝঞ্চাটেই আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। সলোমনের ঘর থেকে শাপ-শাপান্ত শুনা গেলো- ‘নোংরা জঘন্য জানোয়ার ‘ । মেরীকে বুড়ো আর তার কুকুরের কথা বললাম। সে হাসলো। আমি চুমো খেলাম আবার। চলে গেলো একটার দিকে। আমি ঘুমালাম।

কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। বেলা তিনটা দরজা খুলে দেখি রেমন্ড দাঁড়িয়ে- সেই হাসিমুখ।ফিরে চলে এসেছে পুলিশের থেকে। আমি আবার এসে বিছানায় পড়লাম। সে বসলো বিছানার কাছ ঘেঁষে। কিছুক্ষন কিছুই বললোনা। তারপর বললো-সে করতে পেরেছে যা করতে চেয়েছিলো। চরম মুহুর্তে মেয়েটার মুখে থুথু ছিটিয়েছে কিন্তু মেয়েটা তাকে উলটো থাপ্পর মারাতেই যতো বিপত্তি। বললাম মেয়েটার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, এবার তার খুশী হওয়া উচিত। জানালো- সে খুশী তবে পুলিশের আচরনে সে মর্মাহত। এর পর জানতে চাইলো আমি কি আশা করেছিলাম পুলিশকে সে পালটা ঘুষি দেবে। বললাম- আমি আসলে কিছু আশা করিনি। তবে পুলিশকে আমার কখনোই পছন্দ নয়।

রেমন্ড খুশি হলো। অনুরোধ করলো -আদালতে তার হয়ে স্বাক্ষী দেয়ার জন্য। কিসের স্বাক্ষী জানতে চাইলো বললো- মেয়েটার প্রতারনার। আশ্বস্ত করলাম- স্বাক্ষী দিতে আমার কোন আপত্তি নেই।
তারপর আমরা দুজনে হাঁটতে বেরুলাম।সে আমাকে এক বোতল ব্রান্ডি কিনে দিলো। আরো কিছুক্ষন হাঁটার পর প্রস্তাব দিলো পতিতালয়ে যাবার। বললাম- আমার এসবে আগ্রহ নেই, সে চাইলে যেতে পারে।

কিন্তু সে না গিয়ে আমার পাশে পাশে হাঁটতে থাকলো। রাস্তার ওপাড়ে বুড়ো সলোমনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। অন্যদিনের চেয়ে আরো বেশী গোমড়া, আরো বিষন্ন। আমি আবার তাকালাম। কুকুরটা নেই। স্পেনিয়াল কুকুরটা বুড়ো সলোমনের সাথে সত্যিই নেই! গত আট বছরে এই প্রথম।

সলোমন এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে ঘাড় ফিরিয়ে, উঁকি দিচ্ছে হলঘরের বদ্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে, ছোট ছোট চোখ দিয়ে খুঁজছে এমনকি অন্ধকারেও। তারপর রাস্তা পেরিয়ে এসে এদিকে খুঁজতে লাগলো ইতস্ততঃ।
রেমন্ড জানতে চাইলো- কি হয়েছে? কিন্তু সে কোন উত্তর দিলোনা। আমি তাকে কেবল বিড়বিড় করতে দেখলাম- ‘নোংরা জঘন্য জানোয়ার’ । জিজ্ঞেস করলাম- কি হয়েছে? ঝাঁঝের সাথে উত্তর দিলো এবার- হারিয়ে গেছে। একটু পর নিজ থেকেই আবার বলতে শুরু করলো- ‘গিয়েছিলাম প্যারেড গ্রাউন্ডে, রাজ্যের লোক জড়ো হয়ে কেনাকাটা করছে। দাঁড়িয়ে দেখছিলাম হঠাৎ দেখি নেই। মানছি, নতুন কিছু আমি কিনে দেইনি অনেক। তাই বলে পালিয়ে যাবে? নোংরা জঘন্য জানোয়ার’

রেমন্ড বুড়োকে বললো- হয়তো পালায়নি, হয়তো হারিয়ে গেছে। এরপর সে স্বান্তনা দেবার জন্য এরকম অনেক ঘটনা বর্ননা করলো কি করে হারিয়ে যাওয়া কুকুর ফিরে এসেছে তার প্রভূর কাছে। কিন্তু বুড়োকে আরো বিমর্ষ দেখালো। সে বললো-এই নোংরা জানোয়ারটাকে কেউ ফেরত আসতে দেবেনা। কেউ একে পছন্দ করেনা। সবাই চাইবে যেনো ও ফেরত না আসে।
আমি বললাম-কুকুরের খোঁয়াড়ে খোঁজ নিতে। পথ হারানো কুকুর খুঁজে ফেলে লোকজন খোঁয়াড়ে দিয়ে আসে। সামান্য টাকার বিনিময়ে ফেরত আনা যায়। সলোমন জানতে চাইলো কতোটাকা লাগবে। বললাম ঠিক জানিনা।
এবার সে খেঁকিয়ে উঠলো- ‘এহ, এই নোংরা জঘন্য জানোয়ারের জন্য আমি পয়সা খরচ করবো? পালিয়েছে বেশ হয়েছে, আমি বেঁচে গেছি ‘

আমি ও রেমন্ড এক সাথে হেসে উঠলাম। তারপর শুভ রাত্রি বলে চলে এলাম ঘরে। কিছুক্ষন পর কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দেখি বুড়ো সলোমন। ভেতরে আসতে বললাম। কিন্তু না এসে সে দাঁড়িয়ে থাকলো। চোয়াল আরো ঝুলে গেছে তার। হাত দুটো এলিয়ে পড়েছে শরীরের দু পাশে। খুব ভেজা ভেজা কন্ঠে সে বললো- ‘খোঁয়াড় থেকে ওরা ওকে তাড়িয়ে দেবে না তো? আমার কাছে ফেরত দেবে তো ওরা? যদি তাড়িয়ে দেয়, যদি আমি ওকে ফিরে না পাই তাহলে কি হবে বলতে পারেন? ‘
আমি স্বান্তনা দিলাম- ‘তিনদিন পর্যন্ত ওরা রাখবে। কাল সকালেই গিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন’ । বুড়ো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো কয়েক মুহুর্ত। তারপর ‘শুভ রাত্রি’ বলে চলে গেলো।

আরো পরে দেয়ালের ওপাশে বুড়োর ঘর থেকে বিচিত্র শব্দ শুনতে পেলাম। আটবছর ধরে শুনতে থাকা শাপ-শাপান্ত নয়। এই শব্দ কান্নার মতো। এই শব্দ কান্নার। বুড়ো সলোমন কাঁদছে তার ‘নোংরা জঘন্য জানোয়ার’ টার জন্য।

আর আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো কেনো জানি । কিন্তু সকালে অফিস আছে যে।ঘুমানো দরকার।
খেতে ইচ্ছে করছেনা। ভাল্লাগছেনা। বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম।


Comments

জাহেদ সরওয়ার's picture

পড়ছি
*********************************************
আমার আত্মা বোমায় দু'হাত উড়ে যাওয়া কোনো আফগান শিশুকন্যা।

*********************************************

নাহার মনিকা [অতিথি]'s picture

পড়ছি। ইংরেজীটা পড়া ছিল।
কামু অনুবাদে হাত দেওয়াই বিরাট সাহসের কাজ, তার ওপর প্রাঞ্জল করে করা!
অভিনন্দন!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর's picture

মুগ্ধতা নিয়ে পড়ছি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তুলিরেখা's picture

চমৎকার লাগছে অনুবাদ।
আমার মূল লেখা পড়া নাই, ইংরেজিতেও না। কিন্তু কেমন করে জানি আগের অংশেই মনে হচ্ছিলো বুড়া আর তার কুকুরের ব্যাপারটা আসলে যেমন নিষ্ঠুরমতন দেখাচ্ছে তা নয়। কামুর লেখার কায়দাই হয়তো এরকম, অনাসক্ত অনুরাগীর চোখে দেখা।
এমন চমৎকার লেখার জন্য ধন্যবাদ।
----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তানজিনা আফরিন's picture

শেষ নাকি ?ইয়ে, মানে... আমি মূল বইটা পড়িনি, তাই বুঝতে পারছি না শেষ নাকি..

হেমন্তের ঘ্রাণ's picture

রেমন্ডকে পুলিশ টানতে টানতে নিয়া যায়নাই তো! কিছুক্ষন কথা বলার পর রেমন্ড দরজা বন্ধ করে দেয় ।

সুব্রত শুভ's picture

শেষ নাকি ? ইয়ে, মানে... আমি মূল বইটা পড়িনি, তাই বুঝতে পারছি না শেষ নাকি..

তবে ভাল লেগেছে সবগুলো বাঘের বাচ্চা

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.