মৃত্তিক

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: রবি, ২৬/০৬/২০১১ - ২:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার উচ্চতা ভীতি নেই। অনেক উঁচুতে দালানের কার্নিশে দাঁড়াতে পারি। ভীতি নেই মাকড়সা,জোঁক কিংবা সাপে। ভীতি নেই পানিতে। মাত্র সেদিন আমরা ক'জন মিলে নদীপথে যাচ্ছিলাম বেড়াতে। অনেক বছর পর নদীর কোমল শরীরে সাঁতরাতে লোভ জাগলো। পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী গোয়াইন এর এপার থেকে ওপাড়ে গিয়ে ফিরে আসার সময় টের পেয়েছিলাম বয়স হচ্ছে, শরীর ভারী হচ্ছে, দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে প্রিয় সাঁতার ও আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেনা সহজে।
কিন্তু আমার ভীতি আছে। প্রবল ভীতি আছে। সেই ভয়ের কথা তেমন কাউকে বলিনি কখনো। নিজের লেখা দু একটা গল্পে কখনো সেই ভয়ের ইঙ্গিতটুকু লিখে রেখেছি।

মানুষ জন্মে ভয় আছে আমার। মানুষ জন্মের দীর্ঘ ধাপগুলো আমার অসম্ভব কষ্টকর ও অমানবিক মনে হয়। হয়তো কৈশোরের দুঃসহ স্মৃতি আমার স্নায়ুতে অজান্তে বপন করে দিয়েছে এই ভয়। আমার সাথে আমার একমাত্র ছোটবোনের বয়সের পার্থক্য পাক্কা তের বছর। অর্থ্যাৎ ওর যখন জন্ম হয় আমি তখন বছর তেরোর কিশোর। মায়ের বয়স সম্ভবতঃ পঁয়ত্রিশ। আমার মনে আছে, আমার এখনো মনে আছে ছোটবোনের জন্মের সময় কি ভয়াবহ কষ্ট হয়েছিলো আম্মার। পুরো নয় মাস জুড়েই প্রচন্ড বমি, বমির সাথে সাথে মনে হতো যেনো প্রান বেরিয়ে আসছে তার। আমরা পিঠাপিঠি দুভাইবোন জড়াজড়ি করে কাঁদতাম আম্মার কষ্ট দেখে।

বিয়ের রাতে মুন্নীকে বলেছিলাম- আমরা সন্তান টন্তান নেবোনা। কেবল দুজন মিলে উজাড় করে চলে যাবো জীবনের প্রচন্ড ভাঁড়ার। পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মেয়েটাও বোধ করি কিছু কিছু বাস্তব বিষয়ে খুব চাল্লু ছেলেটার চেয়ে ও বুদ্ধিমতি থাকে। আর যে এর আগের বছর আটেক ধরে আমাকে জড়িয়ে ছিলো, আমার এমন হঠকারী কথাবার্তায় তার তেমন চমকে উঠার কিছু ছিলোনা।

দেশ ছাড়লাম যখন, মৃন্ময় তখন ওর মায়ের গর্ভে-চার মাসের। প্রথম পিতৃত্বের আবেগটুকু আমি শেয়ার করেছি একাকী প্রবাসে কাম্ব্রিয়ান মাউন্টেন আর আইরিশ সাগরের সাথে। প্রথম পুত্র দর্শন ওর ভূমিষ্ঠের ছ'মাসের পর । আমি আমার মায়ের গর্ভকালীন কষ্ট দেখেছি তের বছর বয়সে, কিন্তু উনত্রিশ বছর বয়সে নিজের স্ত্রীর গর্ভকালীন কষ্ট দেখার সুযোগ হয়নি, কেবল শুনেছি মাত্র।

কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন আবার সেই সময় ফিরে এলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো সময়টা আমি পাশে। তেরো বছর বয়সের সেই ভয়, অনুভূতি, সংবেদনশীলতা আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকলো বিগত দশটি মাস।
একজন মানুষ, একজন নারী কি অমানুষিক, অমানবিক, অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে একটা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে?... এবং সন্তান জন্ম দেবার পর ও আরো দীর্ঘ সময়!
পৃথিবীর সবচেয়ে অনুভূতিশীল পুরুষের পক্ষে ও এই অসহ্য বেদনার ভারটুকু অনুধাবন করা সম্ভবের অতীত।

সম্ভবের অতীত বলেই হয়তো- যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা নিশ্চিত মৃত্যুকে কোনভাবে পাশ কাটিয়ে বেঁচে উঠে শরীরে ক্ষতচিহ্ন রেখে, সেই সন্তান মানুষ হতে হতে গিয়ে শেষপর্যন্ত পুরুষ হয়ে উঠে। পুরুষ হতে হতে সে জেনে যায় তার শারীরিক শক্তির কথা, আর সকল শক্তিই প্রদর্শন প্রিয় যেমন অর্থ, যেমন পেশী, যেমন ক্ষমতা।
তাকে আরো শক্তিমান হয়ে উঠতে ধোঁয়া দেয় সমাজ আর ধর্ম। সন্তান থেকে যখন সে স্বামী হয়ে উঠে তখন প্রভূত্ব স্বতসিদ্ধ হয়ে যায়। ধর্মগ্রন্থ যখন তাকে শিক্ষা দেয় অবাধ্য স্ত্রীকে পিটানো তার পৌরুষের অধিকার তখন অহংবোধে অন্ধ সে, অন্ধ চোখে উপড়ে তুলে য়ে নেয় আলোর চোখ- যে আলোতে সে নিজে একদিন পৃথিবী দেখেছিলো প্রথম।

মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন সামন্তপ্রথা সম্ভবতঃ পৌরুষ। আমার পিতামহ তার চার স্ত্রীকে মানুষ হিসেবে গন্য করার কোন চিন্তা নিশ্চয় করেননি কোনদিন, পিতা হয়তো একটু মানবিক ছিলেন স্ত্রীর প্রতি। আমি হয়তো আরেকটু সহানুভূতিশীল, তবু নিশ্চিতভাবেই এখনো মুক্ত নয় পৌরুষের মিথ্যে অহং থেকে, এখনো আমার রক্তে সেই সামন্তপ্রথার ধুলো-ময়লা-বিষ।

ঈশ্বরী পাটনীর মতো সন্তানের জন্য দুধভাতের প্রার্থনা করিনা, বরং সন্তান যেনো মিথ্যে অহং থেকে মুক্ত হতে পারে। পৌরুষে আলাদা কোন গৌরব নেই, নারীত্বে নেই কোন বঞ্চনা- এসব কেবলই লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়মাত্র, আর কিছু নয়। আমাদের পুত্ররা যেনো 'স্বামী' হয়ে না উঠার মতো মানবিক হয়, আমাদের কণ্যারা যেনো দেনমোহরকে অস্বীকার করার মতো মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠে।


মন্তব্য

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ভাবীকে তো অবশ্যই, সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা।
মৃত্তিকের জন্য শুভকামনা। আপনাকেও অভিনন্দন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অপছন্দনীয় এর ছবি

ধর্মগ্রন্থ যখন তাকে শিক্ষা দেয় অবাধ্য স্ত্রীকে পিটানো তার পৌরুষের অধিকার তখন অহংবোধে অন্ধ সে, অন্ধ চোখে উপড়ে তুলে নেয় আলোর চোখ- যে আলোতে সে নিজে পৃথিবী দেখেছিলো প্রথম

আমাদের পুত্ররা যেন 'স্বামী' হয়ে না উঠার মত মানবিক হয়, আমাদের কন্যারা যেন দেনমোহরকে অস্বীকার করার মত মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠে।

চলুক চলুক চলুক

পাগল মন এর ছবি

চমৎকার লেখা হাসান ভাই।

সন্তান যেন মিথ্যে অহং থেকে মুক্ত হতে পারে।

আমাদের পুত্ররা যেনো 'স্বামী' হয়ে না উঠার মতো মানবিক হয়, আমাদের কন্যারা যেনো দেনমোহরকে অস্বীকার করার মতো মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠে।

এর চেয়ে ভালো প্রার্থনা আর হতে পারে না।
আমাদের সন্তানেরা যেনো মানুষের মত মানুষ হয়, পুরুষ কিংবা নারী নয়।
মৃত্তিকের জন্য শুভকামনা রইল।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

নীলকান্ত এর ছবি

ঈশ্বরী পাটনীর মতো সন্তানের দুধভাতের প্রার্থনা করিনা, বরং সন্তান যেনো মিথ্যে অহং থেকে মুক্ত হতে পারে।

যথার্থ।
আপনাকে আর ভাবীকে অভিনন্দন। মৃত্তিকের জন্য শুভকামনা।


অলস সময়

কৌস্তুভ এর ছবি

চলুক হাততালি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার এই অনুভূতিকে গুরু গুরু
এই অনুভূতি আপনার সন্তানকেও সারাজীবন ছুঁয়ে থাক।
আপনাকে অভিনন্দন আবারো হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গুরু গুরু

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সাজেদুল ওয়াহিদ নিটোল এর ছবি

প্রতিটি বাক্যের সাথে সহমত। গুরু গুরু

নিটোল

দেবজ্যোতি দাস দেবু এর ছবি

হাততালি গুরু গুরু

মৃত্তিকের জন্য শুভ কামনা আর সকল মায়েদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা আর ভালবাসা ।
এতো কঠিন সত্য উপলব্ধি করার পরও যখন কিছু মা'কে বৃদ্ধাশ্রমে দেখি তখন এই লজ্জা লুকানোর আর কোন জায়গা পাই না ।
মরু বুকে হালকা বৃষ্টির পরস পাইয়ে দিলেন বলে ধন্যবাদ ।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

অনেক শুভকামনা ভাইয়া! লেখাটা খুব ভালো লাগলো! কোট করে কুল পাবোনা, তাই আর করলাম না! হাসি

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

মৌনকুহর. এর ছবি

অভিনন্দন!!

অনেক অনেক শুভ কামনা মৃত্তিকের জন্য......

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

অসাধারণ লেখা। এই অনুভূতি সকলেরই হওয়া উচিত কিন্তু হয়না। চলুক

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

শায়ের আমান এর ছবি

আমার কাছে এইটা আজীবন বিস্ময়- এতো কষ্ট পাওয়ার পরও সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানটির দিকে তাকিয়ে এক পলকে কেমনে মা সব কষ্ট ভুলে যান!!? আল্লাহ'র কাছে প্রার্থনা রইলো।

Nusrat Jannah স্নিগ্ধা এর ছবি

...মা এর কষ্ট দেখিনি, বুঝি না...ভাবি কে দেখেছি, কষ্ট গুলোও...সবার অনুভুতি দেখছি, ভাই এর, আমার, মৃন্ময় এর ও...সবকিছুর পর শুধু এটুক বুঝলাম, ভালোবাসি মৃত্তিক কে...পরিবার কে...।।

Ayesha Sabrina এর ছবি

ভাল লাগলো। এই চেতনা সবার মাঝে এলে বোধকরি অনেক সমস্যার খুব সহজ সমাধান পাওয়া যেত। লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। হাসি

বইখাতা এর ছবি

সুন্দর নাম মৃত্তিক। মৃত্তিক ও তার মায়ের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
নিত্যানন্দ রায় এর ছবি

আমার ধারনা, এই রকম কুচিন্তা গুলো ধর্ম আমাদের অজান্তে মনশপটে একে দেয়। ভবিষৎ প্রজন্ম কে ধর্ম নয় বরং
সত্য, সুন্দর এবং বিশুদ্ধতার চর্চায় নিমগ্ন করা উচিত। (এটা আমার একান্ত মত হয়ত ভুলও হতে পারে )

--------------------
নিত্যানন্দ রায়

নিত্যানন্দ রায় এর ছবি

ধর্ম নয় বরং নতুন প্রজন্মকে সত্য, সুন্দর ও বিশুদদ্ধতার দিকে আগ্রহী করে তোলা উচিত, এটা আমার মত ভুলও হতে পারে।

----------------
নিত্যানন্দ রায়

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ লেখা। ছেলেবেলায় ইস্কুল থেকে ফেরার সময় শোনা দোতারার সুরে কোন এক বাউলের গান আচম্বিতে কানে এসে ঠেকলো,
মায়ের একধার দুধের দাম
কাটিয়া গায়ের চাম
পাপোষ বিছাইয়া ঋণের শোধ হবে না
এমন দরদী ভবে কেউ হবে না।

মায়ের জাতিকে শত কোটি প্রণাম!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ঝরাপাতা এর ছবি

আমার বোনকে দেখেছি... কি যে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল... সব কষ্ট শেষে স্বর্গীয় অনুভূতি... যার দেখা আমরা পুরুষরা কখনোই পাবো না....


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।