বাংলাদেশের হৃদয় হতে

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শুক্র, ১৬/০৩/২০১২ - ৪:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

Bangladesh

নগরে রাষ্ট্র থাকে, দেশ থাকেনা। নগরের তাই নিজস্ব চরিত্র থাকেনা কোনো, থাকেনা তাকে আলাদা করে চিনে নেয়ার মেজাজ। ঢাকা, দিল্লী, লন্ডন, প্যারিস, আমস্টার্ডাম, বার্সেলোনা- এখন পর্যন্ত দেখতে পাওয়া নগরগুলো তাই আলাদা করে দাগ কাটেনা আমার। নগর লন্ডনে ইংলিশ জীবনাচার, মুল্যবোধ,নিজস্বতা খুঁজে পাইনি- পেয়েছি লন্ডন থেকে চারশো মাইল দূরের গ্রামীন জীবনে।

দেশে ফিরে বহু বছর পর সুযোগ হলো আবার নিজ দেশকে দেখার। বেড়ে উঠার, জীবনযাপনের শহরটি নগর হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকবছর, সে নাগরিক জীবনে রাষ্ট্র যতোটা দৃশ্যমান, দেশ ততোটাই দূরবর্তী।

মাঝখানে একটা ছোট নদী। তার একপাড়ে শিমুল গাছ, গাছের উপর বসে থাকা গেরস্ত চিল অপর পাড়ে বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেত, হলুদের ফুটে থাকা সুন্দর। এই পাড়টি জেলা ময়মসিংহের গ্রাম, ঐ পাড়টি নেত্রকোনার শুরু।
গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের সেই গ্রামে, আমাদের পারিবারিক পুরনো বন্ধন। গল্প শুনেছি অনেক, যাওয়া হয়নি আগে। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির চরম বিপর্যয় ছিলো একসময়, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ছিলো চোর-ডাকাত, জাসদের গনবাহিনী আর সরকারের রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতা- সড়কের পাশে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা খুন হয়ে যাওয়া মানুষের শরীর। '৭৪ এর দুর্ভিক্ষে কৃষি নির্ভর গ্রামগুলোতে ক্ষুধা ও দারিদ্রের মরন কামড়!

এখন গ্রামের প্রধান সড়কটি পুরো পাকা। ঢাকা-ময়মসিংহ-নেত্রকোনা বাস চলছে, ভৈরব হয়ে সরাসরি বাস আসছে সিলেট থেকে। গ্রামের ভেতরের বেশীর ভাগ রাস্তা ও পাকা হয়ে গেছে। পল্লী বিদ্যুৎ এসেছে বেশ আগেই, কোন কোন বাড়ীতে সৌরবিদ্যুৎ, কেউ কেউ এখনো কুপিবাতিতে। গ্রামীন অর্থনীতি এখনো কৃষিভিত্তিক। সকলেই অন্ততঃ দুবার, কেউ কেউ বছরে তিনবার ফসল করছে- বর্ষায় এ অঞ্চল পানিতে ডুবেনা। সিলেট অঞ্চলের গ্রামে দেখেছি চাষের জমি সাধারনত বাড়ি থেকে আলাদা থাকে, এখানে বাড়ির উঠোন থেকে ফসলের চাষবাস শুরু।

'৭৪ এর দুর্ভিক্ষপীড়িত এক কিশোরীকে আম্মা সিলেট নিয়ে এসেছিলেন। আমি ও আমার পিঠাপিঠি বোন দুজনেরই দেখভালের দায়িত্ব ছিলো তার। বুবু ডাকতাম আমরা। পরে আব্বা তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন এই গ্রামে। বুবুর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহন করি। এদের অবস্থা খারাপ না। বুবুর স্বামী স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করেন- এটা প্রায় স্বেচ্ছাশ্রম। মুল পেশা কৃষিকাজ। বাড়ির সামনে চাষের জমি। ফজরের নামাজ পড়ানো শেষে এসে শুরু হচ্ছে ক্ষেত-কৃষি, জোহরের সময় হলে জমি থেকে উঠে চলে যাচ্ছেন মসজিদে। এক ছেলে নৌ-বাহিনীতে নাবিক হিসেবে ঢুকেছিলো, এখন কর্পোরাল- আমি যাচ্ছি জেনে ছুটি নিয়ে এসেছে। আরেক ছেলে জেলা সদরে হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক করছে, বাড়ির পেছনের একটা আম গাছ বিক্রী করে তার কয়েক মাসের পড়ার খরচ দেয়া হচ্ছে। বুবুর স্বামীকে জিজ্ঞেস করি- 'পুরো খরচ চালাতে পারবেন?' বিশ্বাস এবং ভরসায় তিনি মাথা নাড়েন- 'আল্লাহ আছে না?'

সিলেটের গ্রামগুলোতে আমাদের আত্নীয়স্বজনদের মধ্যে কাউকে নিরাপত্তা বাহিনীর নন-কমিশন্ড পর্যায়ে চাকরী করতে দেখেছি বলে মনে পড়েনা, ওখানে এই প্রবনতা চোখে পড়লো এসএসসি পাশের পর সদ্য তরুনরা সেনা, নৌবাহিনীতে যাওয়ার চেষ্টা করছে, না হলে অন্ততঃ পুলিশে।

কৌতুহল হলো জানতে, বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীগুলোতে অঞ্চল ভিত্তিক অংশগ্রহনের অনুপাত কেমন?

চক্করসঙ্গী হিসেবে তরুন কর্পোরালকে পছন্দ হয়। দৈনিক ২০০ টাকা মজুরীতে একটা মোটর সাইকেল ভাড়া নেয়া হলো। আমি আর কর্পোরাল চক্কর শুরু করি। বৈখরহাটি- রামপুর হয়ে নেত্রকোনা সড়ককে বামে রেখে চলে যাই কেন্দুয়া থানা সদরে। প্রথম তত্বাবধায়ক প্রধান, বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের এলাকা। জীর্ণ, নিস্তরঙ মফস্বল। আবু ইউসুফ তালুকদারের সাথে দেখা হয়। তালুকদারি নেই অবশ্য, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের করুণ শিকার হয়ে টিকে আছেন কোনভাবে। রাষ্ট্রপতির বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হিসেবে শেখ মুজিব থেকে এরশাদ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। '৮৮ তে আমার বোনের ওপেন হার্ট সার্জারি অপারেশনের জন্য সরকারী অনুমোদন ও আনুসাঙ্গিক বিষয়ে তার সহযোগীতা ছিলো। প্রায় দুযুগ পর কৃতজ্ঞতা জানাতে যাওয়া।
'৭১ এর ২৫ মার্চ ছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। সহকর্মীদের লাশের ভেতর চাপা পড়ে বেঁচে যাওয়া মানুষটির যুদ্ধগাঁথা শুনেছি ছোটবেলাতেই।ধরা পড়েছিলেন আলবদরদের হাতে। তার পিঠে এখনো চালুনীর মতো গুলীর ছিদ্র, পিঠ থেকে বুকের দিকে বেয়নেটের দাগ। ঈশ্বরগঞ্জ পুলিশ স্টেশন দখলের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন সহযোদ্ধা চাচাতো ভাই মতিউর। জেলায় জেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামসম্বলিত স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেছে। ময়মনসিংহ জেলার শহীদ তালিকায় মতিউরের নাম নেই।
কেন্দুয়া থেকে বিকেল বেলা ফিরে এসে শহীদ মতিউরের বাড়ি যাই, গ্রামের মানুষ মতিউরের কথা মনে রাখে যথেষ্ট সম্মান সহকারে। মতিউরের মা-বাবা বেঁচে নেই। বড়ভাই একটা চায়ের দোকান চালান, ছোটভাই ঢাকা গেছে কাজের খোঁজে। শহীদ মতিউরের ভায়ের দোকানে চা খাই।

ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। মাঠজুড়ে 'আড়ং' বসেছে। রিক্সায় বসানো মাইকে ঘোষনা চলছে যাত্রাপালার। সন্ধ্যা ঘনালে বৈখেরহাটি বাজারে যাই। এই অঞ্চলের সবচেয়ে জমজমাট পুরনো বাজার। দোকানগুলো বহুপুরনো টিনের ছাওয়া। এরকম বাজার দেখলে মনে হয় গত কয়েকশো শতাব্দী এইখানে মানুষ আসছে বেচাকেনায়। একটা দোকানের টিনের বেড়ায় দেখলাম ক্ষেতমজুর সমিতির সভার আহ্বান- সস্তায় সার সরবরাহের দাবীতে। আমাদের নগরী উত্তাল শেয়ার বাজারের পতনে, ফটকাবাজিতে বোধ হয় তেমন কিছু আসে যায়না ভূমি-সংলগ্ন মানুষজনের।

বাজার থেকে ফিরে দেখি উঠোনে বসেছে পিঠা বানানোর রঁদেভূ। আশেপাশের বাড়ির নারী-পুরুষ ও এসেছেন। গল্প চলছে। পাশের বাড়ির এক প্রায় বৃদ্ধ যেনো হুমায়ূন আহমদের নাটকের চরিত্র। বোকা বোকা ভঙ্গিতে বলে চলছেন মজার সব 'গফ-সফ' । স্ত্রী হাসতে হাসতে বলছেন চোর এসেছে শুনে স্বামীটির ভয় পাবার গল্প। পাশ থেকে আরেক ভাবী টিপ্পনী কাটেন- 'এই সাহস নিয়া মিয়া যুদ্ধে গেছলেন কেম্বায়?' টিপ্পনিতে আরো গতি পায় গফ-সফ। যুদ্ধে যাওয়ার কোন ইচ্ছা বা সাহস ছিলোনা তার কিন্তু দেশে থাকলে পাক আর্মি আর রাজাকারের হাতে মরতে হবে সেই ভয়ে গেরস্ত বাবা ধান বিক্রীর সব টাকা ছেলের পকেটে দিয়ে বলেছিলেন সীমান্ত পেরুতে। ছেলের ইচ্ছে ছিলো সীমান্ত পেরিয়ে কলকাইত্যা শহরে গিয়ে সিনেমা দেখার। সীমান্ত পেরুনোর সময় কলকাতা কতোদূর জানতে চেয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী সিংজী'র কাছে ইচ্ছেটা প্রকাশ ও করেছিলো সে। কিন্তু বেরসিক সিংজী তার বিশাল হাতের থাবায় কান বরাবর থাপ্পড় মেরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন প্রশিক্ষন শিবিরে।
মাস তিনেক পর ঈশ্বরগঞ্জ দখলের যুদ্ধে মতিউরের ফিনকি দেয়া রক্ত এক হাতে চেপে ধরে আরেক হাতে এসএলআর চালাচ্ছিলো সেই সিনেমাপাগল তরুন।

প্রথম ভাপা পিঠা তুলে দেয়া হয় আমার হাতে। কলা পিঠা ও হয়ে আসছে। অদ্ভূত মিষ্টি ঘ্রান । মাটির চুলোয় সোনালী আগুন। কুয়াশা আরো মিস্টিক। চাঁদ আরো মায়াবী। গল্পপ্রবণ মানুষেরা আরো মানবিক।
বাংলাদেশ -আছে এখনো তার নিজের কাছে।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ফাঁকিবাজের দলে নাম উঠার আশংকায় ড্রাফট খুঁজে এই বছর পুরনো লেখাটি উদ্ধার করতে হলো। কী অবস্থা মন খারাপ

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হাহাহা
এরকম ভয়টয় থাকা ভালো।
মানুষের জীবনের গল্পগুলোই আসলে আসল গল্প, তাই না?

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

লেখায় উত্তম জাঝা!

এমন জীবনঘনিষ্ঠ লেখা আরও চাই। নইলে আপনার রেহাই নাই।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

তারেক অণু এর ছবি
প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

ভাগ্যিস ফাঁকিবাজদের দলে আপনার নাম উঠেছিল । খাইছে

লেখায় চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

এক সময় আমাদের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সোহারাব হাসানের 'বাংলাদেশের হৃদয় হতে' নামক কলাম পড়তাম। এখনো মাঝেমাঝে দেখি পত্রিকা খুলে।

আজ আপনার লেখাটাও পড়লাম। প্রাণের প্রকৃতি, ধানের গান, টইটুম্বুর কলকল শব্দে বয়ে যাওয়া সোনার বাংলাদেশকে আপনার চোখে দেখে এতো ভালো লাগল।

ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা আপনাকে।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
রণদীপম বসু এর ছবি

এসব গল্প কি কখনো পুরনো হয় ! যেদিন পুরনো হবে সেদিন তো এ দেশটা থাকবে না, যার কথা বলে গেলেন এতোক্ষণ !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শিশিরকণা এর ছবি

কি মায়া মায়া আমার এই দেশটা। কি একটা শান্তি, সহজিয়া সুখের জীবন।

বাংলাদেশের ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি আসলে হওয়া উচিত গ্রাম বাংলায়, কোন এক গেরস্তের বাড়িতে দু-দিন পরিবারের সবার সঙ্গে মিলে মিশে থাকা। দুনিয়ার সবচে' সুখী মানুষগুলোর সঙ্গে সময় কাটিয়ে জীবন সমন্ধে নতুন উপলব্ধি নিয়ে ফিরে যাওয়া। বাংলাদেশের সবচে' বড় সৌন্দর্য এর মানুষগুলা।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

দময়ন্তী এর ছবি

অপূর্ব!
বিভুতিভূষণ পড়ছি মনে হল|

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

রু (অতিথি) এর ছবি

খুব সুন্দর!! আরও খুঁজে দেখেন, এরকম পুরানো কিছু লেখা দেওয়া যায় কিনা।

তাসনীম এর ছবি

দুর্দান্ত লাগলো। একদম মাটির গন্ধ পেলাম।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

ধ্রুবনীল এর ছবি

হাততালি

আপনার গল্প বলার ধরণ অসাধারণ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।