বর্তমান বাংলাদেশের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ এবং ভারতের মেঘালয়ের জৈন্তিয়া হিলস জেলার প্রায় পুরোটা জুড়ে এই রাজত্ব, রাজধানী ছিলো জৈন্তাপুরের নিজপাট ইউনিয়নে।
ইতিহাস থেকে এবার আমরা নেমে আসি বর্তমানে। ৪৭ এর দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত নিস্পেশনের শিকার হয়ে এই অঞ্চলের সংখ্যাগুরু খাসি জনগোষ্ঠীর পাহাড়ের দিকে নির্বাসনের শুরু। আসাম ও সিলেটের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাঙ্গালীরা এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। এই বসতি স্থাপন খুব সহজ ছিলোনা তাদের জন্য। পাহাড় টিলা জংগল হিংস্র প্রানীর আক্রমন মোকাবেলা করে বসবাসযোগ্য করতে হয়েছে এইসব দুর্গম অঞ্চল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু স্বাধীন দেশে ও এইসব বসত গড়া মানুষের ভূমির অধিকার পায়নি। যেহেতু গোটা উত্তর সিলেট খাসি রাজাদের সম্পত্তি ছিলো তাই পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ আমলে এই হাজার হাজার একর ভূমি খাস জমি হিসেবেই সরকারী দপ্তরে চিহ্নিত হয়েছে। যে মানুষেরা গত ৭০/৮০ বছর থেকে এইসব অনাবাদী জমিকে নিজেদের শ্রম দিয়ে আবাদী করেছে কাগজপত্রে এখনো তারা অবৈধ দখলদার। অথচ এই ভূমিতেই চা বাগান জাফলং চা বাগান, লালাখাল চা বাগান, শ্রীপুর চা বাগান, লোভাছড়া চা বাগান সৃজন করে লিজ দেয়া হয়েছে অর্থ বিত্তওয়ালাদের।
এইসব বাগানের পর ও আরো হাজার হাজার একর জমি, পাহাড়, টিলা রয়ে গেছে খাস ক্যাটাগরিতে যদিও হাজার হাজার মানুষের ঘরবসতি। কিন্তু এই মানুষদের উচ্ছেদ করে চা বাগানের নামে জমি দখল তেমন কোন জটিল বিষয় না!
অতএব রাজ্য দখল প্রক্রিয়ার শুরু একাধিক দিক থেকে।
বিগত বিএনপি-জামাত সরকারের শেষদিকে জৈন্তাপুরের চারিকাটা ইউনিয়নের ১২০০ একর জায়গা নিয়ে ‘মেঘালয় টি এস্টেট’ স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয় তারেক রহমান এবং সাইফুর রহমান পুত্রের আশীর্বাদে। স্থানীয় দরিদ্র মানুষেরা এর প্রতিবাদ শুরু করতে না করতেই সামরিক তত্বাবধায়ক সরকারের আগমন। আশীর্বাদের ছাতা বদলে গেলে ও দখল প্রক্রিয়া চলে পুরোদমে এবং কয়েক শো পরিবার উচ্ছেদ করে মেঘালয় টি এস্টেট গঠিত হয়ে যায়।
বিএনপি-জামাত জমানায় যদি ১২০০ একর গিলে ফেলা যায় তাহলে আওয়ামী জমানায় গিলতে না পারা রীতিমতো প্রেস্টিজ ইস্যু।
সারোয়ার হোসেন, কানাডা আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি বানকান টি এস্টেট এর নামে ১৮০০ একর জমির জন্য আবেদন করেছিলেন ২০০৬ সালে। তার এই আবেদন তখন চাপা পরেছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরের দিন ( হ্যাঁ পরের দিনই) তার আবেদন পুনরুজ্জীবিত হয়। এর মধ্যে দৃশ্যপটে হাজির হন মাহমুদুর রহমান নামের আরেক ক্ষমতাধর। তিনি ঢাকার লোক- কখনো দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালি পত্রিকার দোহাই দেন কখনো ঘোষনা দেন অর্থমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ জন বলে। তিনি আরো হাজার দুয়েক একরের জন্য আবেদন করেন এবং আমাদের সহজ সরল (!) অর্থমন্ত্রী তার অনুকুলে ডিও লেটার ও প্রদান করেন। এই দুই বিগশটের পাশাপাশি ফেউ হিসাবে থাকেন লন্ডন আওয়ামী লীগের একজন মোহিদ আলী মিটু আর পূর্বোক্ত মেঘালয়ট টি এস্টেট যাদের কীর্তি তাদের একজন। সব মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার একর জমি বন্দোবস্তের আবেদন যে জমিতে পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস কয়েক প্রজন্ম থেকে, এই মানুষদের অনেক পুরনো আবেদন রয়েছে জমি বন্দোবস্তের কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে তাদের আবেদনের কোন ব্যবস্থা নেই।
কাগজপত্র স্বাক্ষ্য দেয় পুরো প্রক্রিয়া চলছিলো কঠোর গোপনীয়তায়। ডিসেম্বর ২০১১ থেকে মে ২০১২- ছয় মাসের মধ্যে জেলাপ্রশাসন থেকে তিনবার তাগাদা পত্র দেয়া হয় উপজেলা প্রশাসনকে দ্রুত সরেজমিন প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য, তাদের পক্ষে চা বোর্ডের সুপারিশ ও চলে আসে এবং স্থানীয় ভূমি কর্মকর্তা ও রিপোর্ট দেন ‘ কিছু অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা গেলে এই ভূমি চা বাগানের জন্য উপযুক্ত’ ।
বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া যখন প্রায় চুড়ান্ত তখন কোন এক প্রকারে সাধারন মানুষেরা এর খবর পেয়ে যায় এবং মানুষের প্রতিবাদ ও আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। স্থানীয় মানুষেরা নিজ উদ্যোগেই মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ করেন এবং গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একই সাথে মানব জমিন, বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং স্থানীয় দৈনিক শ্যামল সিলেট ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঘটনাচক্রে ঐদিন বিকেলেই ছিলো জৈন্তাপুরে প্রতিবাদ সমাবেশ। সমাবেশ আয়োজনকারীরা স্থানীয় আওয়ামী লীগকে সম্পৃক্ত করতে চাইলে ও বোধগম্য কারনেই তারা সম্পৃক্ত না হয়ে বরং পুরো বিষয়টিকে জামাত বিএনপির সাজানো বলে প্রচারণা চালান যদিও জামাতকে স্পষ্টভাবেই এই প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে দূরে রাখা হয় ( এমনকি জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান জামাতের হওয়া স্বত্বেও)। বিএনপি নেতারা সুযোগ বুঝে ঝাঁজালো বক্তৃতাবাজি করে গেছেন যদিও তাদের আমলেই ‘মেঘালয় টি এস্টেট’ এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো সেটি বেমালুম চেপে গেছেন।
এদিকে প্রথম আলো সহ অন্যান্য জাতীয় ও স্থানীয় মিডিয়ায় এই আলোচনা ছড়িয়ে পড়ার পর জেলা প্রশাসন থেকে মৌখিকভাবে জানানো হচ্ছে বন্দোবস্তের চারটি আবেদনই প্রত্যাখান করা হয়েছে। বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে ব্যখ্যা চাওয়া হয়েছে এবং সমস্ত আবেদন বাতিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে জৈন্তাপুরের ভূমি রক্ষা আন্দোলনের সমর্থনে এবং সিলেটের অন্যান্য পাহাড় নদী বনভূমি রক্ষার দাবীতে আজকে শহরে কর্মসূচী ঘোষনা করা হয়েছে। জৈন্তাপুরের আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন - চা বাগান সৃজনের নামে ছয় হাজার একর জমি বন্দোবস্ত বাতিলের লিখিত ঘোষনা এবং তাদের নামে বন্দোবস্ত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবেনা।
শেষ কথাঃ সরকারের শেষ সময়। কে কোনদিকে হাঁ করে কী গিলে খাবে সেটা সতর্ক থাকা দরকার। নিজের সম্পদের পাহারা নিজে দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নাই।
প্রথম আলোর রিপোর্ট
ছয় হাজার একর পাহাড়, টিলা ও জমি বন্দোবস্তের তোড়জোড়
মন্তব্য
এই রাজ্যলুটের ঘটনা নতুন তো আর না । জৈন্তাপুরে পুরোটাই তো খাস জমী । বিএনপি'র ও লীগের প্রভাবশালী কিছু নেতার অনেক রিসোর্ট কটেজ আছে লিজ নেয়া । কোনদিন কাউকে ওসবের জন্য প্রতিবাদ করতে দেখি নাই । সাইফুর রহমানের ছেলে মৌলভীবাজারে বিশাল জমি লিজ নিয়ে রিসোর্ট করেছে । সুতরাং এসব যেন অতি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে । প্রতিবাদ- প্রতিরোধগুলো আজকাল সুযোগ সুবিধা বুঝে হয় ।
এসব যাবতীয় লিজ-টিজের বিষয়গুলো - রাজনৈতিক বিষয়েরও বাইরে টাকার বিবেচনায় দেয়া হয় । সেই অতিলোভী শ্রেনীকে বিপ্লবীক রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া দমানো সম্ভব নয় । ক দখল করতে না পারলে খ করবে । আবার খ যখন দখল করছে ক এসে সুশীল মানুষ সেজে প্রতিরোধ নাটক করবে । মাঝখান থেকে জনগন চ্যাপ্টা হোবে এবং ক এবং খ উভয়ের দ্বারাই প্রতারিত হতে থাকবে প্রতিনিয়ত
আপনার প্রদত্ত ফ্যাক্টঃ সরকারি সম্পত্তি সরকার একচেটিয়াভাবে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ভোগ করার লিজ দেয়।
আপনার অনুমানঃ " লিজ-টিজের বিষয়গুলো - রাজনৈতিক বিষয়েরও বাইরে টাকার বিবেচনায় দেয়া হয়"
আপনার প্রদত্ত সিদ্ধান্তঃ "অতিলোভী শ্রেনীকে বিপ্লবীক রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া দমানো সম্ভব নয়।"
মানে একচেটিয়া লিজ দেওয়ার ক্ষমতা থাকাটা সমস্যা না, সম্পত্তির উপর লোকে লোভ করছে কেবল সেটা সমস্যা?
মজা লাগলো।
একটু বিস্তারিত বললে ভালো হতো। আমি এই এলাকায় এই সেক্টরেই কাজ করি। আমার জানামতে এই এলাকায় আপনার কথিত 'বিএনপি'র ও লীগের প্রভাবশালী কিছু নেতার অনেক রিসোর্ট কটেজ ' নেই। একটা হচ্ছে নলজুড়ি রেস্ট হাউজ- এটি সরকারী। একটি হচ্ছে 'জৈন্তাহিল রিসোর্ট' এর মালিক বাবরুল হোসেন বাবুল, এক সময়ের আওয়ামী নেতা হলে ও গত রিসোর্ট বানানর বহু আগে থেকেই রাজনীতি থেকে নির্বাসিত। আমার জানামতে, এই রিসোর্টের কিছু অংশ অর্পিত সম্পত্তি- কিন্তু লিজ নয় । এর বাইরে , লালাখালে নাজিমগড় রিসোর্টের ব্যবস্থাপনায় তৈরী হচ্ছে আরেকটি রিসোর্ট, এর মালিক নাজিম কামরান চৌধুরী বহু আগে বিএনপি রাজনীতি করতেন কিন্তু আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি এর এক ইঞ্চি জমি ও লিজ নেয়া নয়, ব্যক্তি সম্পত্তি।
আপনার মুল বক্তব্য কী? বিপ্লব বাবু লাল শার্ট গায়ে দিয়ে মঞ্চে হাজির না হওয়া পর্যন্ত এইসব আন্দোলন টান্দোলন সকলই ঝুট! বিপ্লব বাবু না আসার অভিমানে এখন এই কয়েক হাজার মানুষ তাদের বসত ভিতার অধিকার ছেড়ে দিবে? এই মানুষরা আজকে 'ক' কে প্রতিরোধ করবে, কালকে 'খ' এলে তাকে ও করবে। এরা এতো তত্ব বুঝে কারো অপেক্ষায় বসে থাকেনা।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
বোয়ালে গজারের ভাগাভাগির দখল লড়াই, টেংরা-পুটির অধিকার নিয়ে কে ভাবে ?
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা, নদীনালা
গ্রামগঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী...
ওনাদের ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয়...
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
উপমহাদেশে রাজ্যলোপাটের ঘটনা আছে মনেহয় কয়েকশ'। সেখানে হায়দরাবাদ বা কাশ্মীরের মতো বিশাল রাজ্য থেকে শুরু করে কাপুরথালা, জৈন্তাপুরের মতো ছোট রাজ্য আছে। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশরা যখন যেমন সুবিধা পেয়েছে তখন তেমন লোপাট করেছে। আর ১৯৪৭ সালের পর স্বাধীন দেশের সরকাররা নিজস্ব বিবেচনা প্রয়োগ করে যথাশিঘ্রী রাজ্যগুলোকে লোপাট করেছে। আমি বলি ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়নি, তখন অনেকগুলো দেশকে জোড়া লাগিয়ে ২টা (৩টা) দেশ বানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে জমির মালিকানা নির্ধারণের ব্যাপারটি রকেট সায়েন্সের চেয়েও জটিল-কঠিন বিষয়। তবে সেটা যত কঠিন ও জটিলই হোক না কেন সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের অধিকার রক্ষায় সরকারের দ্রুত ও সক্রিয় হস্তক্ষেপ কাম্য।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
facebook
১৯৬৯ এ এই বাবরুল হোসেন বাবুল ছিলেন একজন ছাত্রনেতা। যাহোক, সে সময় জৈন্তাপুরে দেখেছিলাম, খাসিয়াদের বিশাল পল্লী। পল্লীর নেতাকে মামু ডাকার রেওয়াজ ছিলো। আর ছিলো অনেক অনেক কমলালেবুর বাগান। বছর দুয়েক আগে গিয়ে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। খাসিয়াদের সংখ্যা অনেক কম, আর বাগান নেই বললেই চলে।
নতুন মন্তব্য করুন