জগতজ্যোতি, শেখ মুজিব ও অভিজাততন্ত্রের কালোজাদু

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/০৯/২০১৪ - ৩:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোট্ট করে জগতজ্যোতি দাসের কথা বলা যাক।
জগতজ্যোতি কোন মেজর, কর্ণেল, এয়ারমার্শাল কিংবা সৈনিক ও ছিলেন না। ছিলেন মাত্র একুশ বছরের এক সামান্য কলেজ ছাত্র। এই সামান্য ছেলেটা কী করেছিল- একটু মনে করা যাক। ভাটিবাংলার বিশাল হাওরবেস্টিত এলাকা- সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ,হবিগঞ্জের প্রায় প্রতিটি থানা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন হয়েছিলো তার নেতৃত্বে। ৩৬ জনের দল নিয়ে তার বাহিনী ‘দাসপার্টি’ । সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিলো তাহিরপুরের বড়ছড়া (টেকেরঘাট)। সেই তাহিরপুর থেকে জামালগঞ্জ, দিরাই, খালিয়াজুড়ি,মদন, মার্কুলি, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, বাহুবল হয়ে আশুগঞ্জ পর্যন্ত সে ছোটে বেড়াতো দেশী নৌকা নিয়ে। মার্কুলির কাছে পাক আর্মির জাহাজ ডুবিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব তার। জগতজ্যোতির ও তার দাস পার্টির ভয়ে ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত নৌ চলাচল বন্ধ ঘোষনা করতে বাধ্য হয় পাক আর্মি এবং এয়ারফোর্স সাপোর্ট সহ বিশেষ কমান্ডো টিম পাঠানো হয় শুধুমাত্র জগতজ্যোতিকে টার্গেট করে।
১৬ নভেম্বর ১৯৭১ শেষ যুদ্ধে শহীদ হবার পর তার লাশ প্রথমে আজমীরিগঞ্জ বাজারে পেরেক বিদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো প্রদর্শনীর জন্য, তারপর নৌকায় করে ঘাটে ঘাটে দেখানো শেষে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিলো ভেড়ামোহনা নদীতে।

মুজিবনগর সরকারের বরাত দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবানী থেকে ঘোষনা করা হয়েছিলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাকে সর্ব্বোচ সম্মানে ভুষিত করবে।

নাহ,জগতজ্যোতি দাসের ভাগ্যে সেই ‘সর্ব্বোচ্চ’ সম্মান জুটেনি। যে সাতজনের ভাগ্যে ‘সর্ব্বোচ্চ’ সম্মান জুটেছে নিঃসন্দেহে তারা বীর, তারা বীরের মতো লড়েই প্রান দিয়েছেন দেশের জন্য। এই আত্নত্যাগের কোন তুলনা হয়না। কিন্তু প্রশ্ন উঠে তখনই, যখন দেখা যায় ‘সর্ব্বোচ্চ’ সম্মানে ভুষিত বীরেরা কেবলই সামরিক বাহিনীর- বেসামরিক কেউ সেই সম্মানের যোগ্য নয়।
গোটা বাংলাদেশের একটা কোন স্বাধীন করে নিজের প্রান বিসর্জন দিয়েছে যে বীর তাকে দেয়া হয় ‌ ‘বীর বিক্রম’ খেতাব আর একই খেতাব পায় মুক্তিবাহিনীর বাহিনীর সর্বাধিনায়কের ফাইল বহনকারী সামরিক কর্মকর্তা ও।
অথচ মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটি গনযুদ্ধ, একটি রাজনৈতিক গনযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হবার পর নেতৃত্বে রাজনৈতিক শক্তিই ছিলো কিন্তু ‘সামরিক অভিজাততন্ত্র’ তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের কৃতিত্ব হিসাবে কুক্ষিগত করেছিলো। ১৯৭৫ এর পনেরো আগষ্ট মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক শক্তিকে উৎখাত করার পর মুক্তিযুদ্ধে ‘সামরিক অভিজাততন্ত্রের’ দখলদারিত্ব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পায়।

শুধু সামরিক অভিজাততন্ত্র নয় মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক অভিজাততন্ত্র ও ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমলা, বিচারপতি, কুটনীতিকরা ও ছিলেন। এই অভিজাতদের উল্লেখ্যযোগ্য অংশই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তখনই যখনপাকিস্তানীদের নৃশংসতা তাদের ‘কমফোর্ট’ জোনকে আক্রান্ত করা শুরু করেছে এবং অবস্থানপরিস্কার করার আগে বাংলাদেশ পক্ষে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থান ও নিশ্চিত করে নিয়েছেন দরকষাকষি করে। সৈয়দ শামসুল হকের একটা উপন্যাসে ( সম্ভবতঃ ‘বালিকার চন্দ্রাভিযান’) এরকম একজন আমলার চরিত্র আছে যিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পক্ষের সাথে দরকষাকষি করছেন স্বাধীন হতে যাওয়া নতুন দেশে তাকে কোন পদে নেয়া হবে- না হলে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ার অপশন ও কিন্তু খোলা আছে!

বেসামরিক অভিজাততন্ত্রের ভেতরে আবার রাজনৈতিক অভিজাততন্ত্র ও সক্রিয় ছিলো। ১৯৫০ এর জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির আগে এদের অনেকেরই নিজেদের জমিদারী ছিলো। ট্রেন্ড অনুযায়ী এদের অনেকেই পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হলে ও নিজেদের আভিজাত্য ত্যাগ করেননি। উদাহরন হিসেবে, শুধুমাত্র উদাহরন হিসেবেই একই অঞ্চলের সমসাময়িক দুজন আওয়ামী লীগ নেতার উদাহরন দেয়া যায়। দেওয়ান ফরিদ গাজী বিখ্যাত দিনারপুর পরগনার জমিদার সন্তান। অপরদিকে আব্দুস সামাদ আজাদ সেই সুনামগঞ্জের ভাটী অঞ্চলের একেবারে অখ্যাত কুলশীল এক হাওড়পাড়ের ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ। তার উঠে আসায় কোন পারিবারিক ঐতিহ্য কিংবা পরিচিতি নেই। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে দুজনেরই অসামান্য অবদান। প্রথমজন ছিলেন সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের বেসামরিক চীফ দ্বিতীয় জন মুজিব নগর সরকারের বিশেষ দূত। দেওয়ান ফরিদ গাজী কিন্তু কোনদিন আব্দুস সামাদ আজাদকে- সামাদ আজাদ কিংবা সামাদ সাহেব বলতেন না। টিভি লাইভে ও তাকে ‘ছমেদ’ বলেই ডাকতেন তুচ্ছার্থে।

তো, প্রশ্ন উঠতে পারে এই সামরিক,বেসামরিক, রাজনৈতিক অভিজাততন্ত্র শেখ মুজিবকে মেনে নিয়েছিলো কেনো?
অন্ততঃ মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময় থেকে ’৭৫ এর পনেরো আগষ্ট ভোরবেলা পর্যন্ত দেখা যায় এই অভিজাতেরা শেখ মুজিবের নের্তৃত্ব/ কর্তৃত্ব/ পির্তৃত্ব মেনে নিয়েছেন। অথচ মুজিব এই অভিজাততন্ত্রের কিংবা অভিজাতবলয়ের কাছাকাছি কেউ না।
যদিও তার পিতা মহকুমা আদালতের পেশকার ছিলেন তবু মুলতঃ কৃষক পরিবার। শেখ মুজিবের আত্মজীবনি স্বাক্ষ্য দেয় ধান বেচার টাকা দিয়ে তার কলকাতার কলেজের ফিস দিতে হতো। কলকাতা কলেজে পড়ালেখা- সে ও উল্লেখ করার মতো কিছু না আসলে।
তাও সোহরাওয়ার্দীর মতো হলে কথা, ফজলুল হক হলে ও চলে কিন্তু গোপালগঞ্জের বাওড় এলাকার কৃষক পরিবারের ছেলেকে কেনো একমেবাদ্বিতীয়ম বলে মেনে নেয়া?

উত্তর আসলে কঠিন কিছু নয়। ’৬০ থেকে ’৭০ এর এক দশকে শেখ মুজিব নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যেখানে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই অভিজাতদেরকে ও তার পেছনে কাতারবন্দী হতে হয়েছে।
যারা রাজনীতিতে শেখ মুজিবের সামনের সারির ছিলেন সময়ের ব্যবধানে তারা গেছেন পিছিয়ে যেমন আবুল মনসুর আহমদ, যেমন আবুল হাশিম। সাথের যারা ছিলেন তারা তো আরো দুরস্ত যেমন অলি আহাদ।

কিন্তু শেখ মুজিব যখন নেই আর- অভিজাততন্ত্র তখন কিরূপ তার প্রতি? আগষ্ট পনেরোর সকালে যখন শেখ মুজিবের দীর্ঘ শরীর ভারী লাশ হয়ে পড়ে আছে বাংলাদেশের বুকের উপর- সামরিক, বেসামরিক, রাজনৈতিক অভিজাতেরা তখন কী করছেন?
একজন সামান্য মানুষ হিসাবে আমার জানতে ইচ্ছে হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীএকজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার দায় কী এখনো বহন করে? পেছনে যতো রাজনীতিই থাকুক খুনটাতো করেছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন অফিসারই? সেই রক্তাক্ত সকালে কোন তারকা জেনারেলকেই এর প্রতিবাদ করার, মধ্যম সারির খুনী অফিসারদের প্রতিরোধ করার কোন প্রমান তো পাইনা। এর পরের যেসব অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থান সে তো তারকা জেনারেলদের নিজদের ক্ষমতার লড়াই। কিন্তু সেই ভোরবেলা নিহত মুজিব কি কেবলই এক ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ই ছিলেন সেনাবাহিনীর কাছে? মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী, শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ ছিলো তার প্রতি। স্বাধীনতার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই অবসরে যাওয়া এই সিনিয়রমোস্ট কর্ণেল কে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন মুজিব, ’৭০ এর নির্বাচনে দলীয় সাংসদ করেছিলেন। বাকশাল নিয়ে মতবিরোধ জানিয়ে ওসমানী পদত্যাগ করেছিলেন, তবু তার প্রতি মুজিবের কোন বিদ্বেষের তথ্য জানা যায়না। এই ওসমানী হয়ে গেলেন খুনীদের উপদেষ্টা! বাকশাল তার নীতিতে গেলোনা কিন্তু খুনীদের উপদেষ্টা হতে অসুবিধা হলোনা। তবে কী এটা সেই উর্দির আভিজাত্যই ছিলো?
উদাহরন, কেবল উদাহরন হিসাবেই আরো দুজনের নাম টানি। একজন বেসামরিক অভিজাত গ্রুপে- আবু সাইদ চৌধুরী। আরেকজন রাজনৈতিক অভিজাত গ্রুপে –তিনি দেওয়ান ফরিদ গাজী। যে আবু সাইদ চৌধুরীকে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির পদে অলংকৃত করেছিলেন সেই চৌধুরী খন্দকার মোস্তাকের খুনী কেবিনেটের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে দ্বিধা করেননি।
একই কাজ করেছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী ও।
দেওয়ান গাজী যাকে তুচ্ছার্থে ‘ছমেদ’ ডাকতেন সেই আব্দুস সামাদ আজাদ কিন্তু কারাগারে! খুনী খন্দকারের উপদেষ্টা যখন ওসমানী আর মন্ত্রীসভায় চৌধুরী ও দেওয়ান- টাইটেল বিহীন তাজউদ্দীন তখন মুজিবের পরিনতিতেই ( সৈয়দ নজরুল ইসলাম’কে মনে রাখছি)।

শেখ মুজিব যখন নেই প্রায় ৪০ বছর, জগতজ্যোতি নেই ৪৪ বছর তখনো দেখি সামরিক অভিজাততন্ত্রের প্রতিনিধিরা ইতিহাস বয়ানের নামে মিথ্যাচার করে মুজিবকে তুচ্ছ করেন, জগতজ্যোতিদের অস্বীকার করেন।
এদের সাথে কী বেসামরিক ও রাজনৈতিক অভিজাতেরা ও আছেন সেই আগের মতো?
আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল হাশিমের উত্তরাধিকারেরা মাঝেমধ্যেই পুরনো বেদনা বহনের প্রমান দেন।

অভিজাতবলয়ের অনেক দূরে থাকা সামান্য আমার ঘটনাচক্রে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো একটা অভিজাত পরিবারের নিজেদের আড্ডায় মুজিব বিষয়ক আলাপ আলোচনা শুনার। এরা কেউ স্বাধীনতা বিরোধী নয় বরং মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারের ভালো অবদান আছে, এমনকি আওয়ামী লীগে ও। শেখ মুজিব শাপলাকে কেনো জাতীয় ফুল ঘোষনা করলেন? তার জন্ম ও বেড়ে উঠা গোপালগঞ্জের প্রায় ভাটি এলাকায়- বিল ও বাউড় অঞ্চল। বছরের একটা সময় খাদ্যশস্যে টান পড়ে তখন গরীব মানুষেরা শাপলা'র ফুল ও ডাঁটি খায়। শাপলা কোন অভিজাত ফুল না। শেখ মুজিব তার রুচিবোধ অনুযায়ীই একে জাতীয় ফুল করেছেন।সেইম টু জাতীয় পাখী। গ্রামাঞ্চলে খোলা টয়লেটের চারপাশে দোয়েল ঘুরাঘুরি করে। ইয়াক!
শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনি প্রসঙ্গে তার প্রায় সমসাময়িক আরেক অভিজাত ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলছেন- শেখ সাহেব গুন্ডাপান্ডা টাইপের নেতা ছিলেন, জেলখানায় বসে তার ডায়েরী লেখা! তিনি ঠোঁট উল্টালেন- এর মানে অনেক কিছুই হতে পারে।

মুজিবহত্যাকে আমি কখনোই ব্যক্তি হত্যা হিসাবে দেখিনা, মুজিব হত্যা ছিলো একটা শিশু রাষ্ট্রকে হত্যা- যে শিশু জন্ম নিয়েছিলো আভিজাত্যের অহমিকা মুক্ত একটা মহান আশাবাদ নিয়ে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসার ভেতর দিয়েই এই আশাবাদের পুনঃজন্ম ঘটেনা বরং এই আশাবাদ বেঁচে থাকে একজন গনমানুষের নেতা শেখ মুজিব- একজন গনমানুষের যোদ্ধা জগতজ্যোতির সঠিক মুল্যায়নের ভেতরে।


মন্তব্য

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের খেতাব দেবার পেছনের ইতিহাস নিয়েও কিছু গবেষণা হওয়া দরকার। সামরিক এবং অসামরিক খাতে কিভাবে/ কোন মাপে পদক বিতরন করা হয়েছিল, কাদের সুপারিশ লেগেছিল, কেউ প্রভাবিত করেছিল কিনা ইত্যাদি। খেতাবের সিদ্ধান্তটা কি রাজনৈতিক ছিল নাকি সামরিক কর্তাদের মর্জিমাফিক হয়েছিল তাও জানা দরকার। সার্টিফিকেট জালিয়াতির মতো ফাও খেতাবের জালিয়াতি ঘটেছিল কিনা এখন কি যাচাই করা সম্ভব? আমি এই বিষয়ে বিশেষভাবে অজ্ঞ, তাই কেউ যদি আলোকিত করতো উপকৃত হতাম।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু এর ছবি

ওসমানীর মর্জিমাফিক খেতাব বিতরণ করা হয়েছিলো। ওসমানীর তল্পিবাহক দফতরচারী কিছু অফিসার নানা মাপের খেতাব পেলেও মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, যিনি দেশের এক বিস্তৃত অঞ্চলের অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে সে অঞ্চলের খণ্ডিত সেক্টর ৮ এর অধিনায়ক ছিলেন, তাঁকে ওসমানী কোনো খেতাব দেননি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আসল ঝামেলাটা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ এমন একটা বিষয় যেখানে লুঙ্গিপরা, খালি গা, খালি পায়ের লোকজন সমানে সমানে যুদ্ধ করতে নেমে পড়ে। অভিজাত অ্যাকাডেমি’র প্রশিক্ষণ না পাওয়া ছোটলোকগুলো দেশপ্রেম, সাহস, সামান্য প্রশিক্ষণকে সম্বল করে প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত নিয়মিত বাহিনীর মোকাবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে এটা মেনে নেয়া যায় না। এই জন্য খন্দকার আবদুল করিমের বই থেকে শুরু করে আরো বহুজনের লেখায় কথায় লুঙ্গিপরাদের বেয়াদবীর বিরুদ্ধে ক্ষোভের সুর ফুটে ওঠে। জগতজ্যোতি তো ঐ লুঙ্গিপরার দলের লোক। তাকে নিয়ে অতো নাচানাচির কী দরকার!

সারা দুনিয়াজোড়া আলোচিত ভিয়েতকং মুক্তিযোদ্ধাদের ঝোলায় একটা বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের শিক্ষা ছিল। কিন্তু বাঙালী লুঙ্গীপরাদের ট্যাঁকে তাও ছিল না। তাহলে এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা কী করে ঘটলো? কী করে গ্রামের হতদরিদ্র মানুষটা রাতের অন্ধকারে খন্দকারদের পথ দেখিয়ে নিয়ে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়? নিজের একমাত্র মুরগীটা জবাই করে রান্না করে আপ্যায়ণ করে? কোন জাদুতে লোকজন রাস্তার পাশে পানি-মুড়ি-চিড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো শরণার্থীদের আপ্যায়ণের জন্য? কী করে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখতো, পাকিস্তানী আর রাজাকারদের সুলুক-সন্ধান এনে দিত? কী করে শত অত্যাচার-নির্যাতনেও তার কেউ একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও ধরিয়ে দেয়নি? কী করে তাদেরই ছেলেরা সামান্য অস্ত্র হাতে শত্রুর বাঙ্কার দখলের লড়াইয়ে নামতো? – এই সব কিছু সম্ভব হয়েছিল একটা চাষার পুত নেতৃত্ব নিয়ে তৃণমূল পর্যন্ত চেতনা, বিশ্বাস আর আস্থা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল বলে। চাষার ছেলের অসাধারণত্বটা ঐখানেই যা প্রেসিডেন্সীতে পড়ুয়া বা কেমব্রিজ-অক্সফোর্ড ফেরত সাহেবরা বা বিলাতফেরত ব্যারিস্টার সাহেবরা যুগের পর যুগ রাজনীতি করেও করতে পারেনি। অবশ্য তারা রাজনীতিতে নেমেছিল ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে দর কষাকষি করে নিজেদের সুবিধা আদায় করার লক্ষ্যে, ঔপনিবেশিকতাকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে নয়। বিকাশমান পুঁজিপতি, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, মাতাল-লম্পট জমিদারদের উৎখাত করে জুড়ে বসা নয়া জোতদারের দল – কেউই লুঙ্গিপরাদের বেয়াদবী সহ্য করে না। তাই লুঙ্গিপরাদের নেতা চাষার পুতকেও তাদের পছন্দ নয়। অবস্থার চাপে পড়ে সাময়িকভাবে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল মাত্র। যেই মাত্র সুদিন ফিরে আসলো, অমনি সাহেবরা নিজেদের আসল চেহারায় ফেরত যান। এখনো পর্যন্ত তাই অনেকে নীতি-বিশ্বাসে আওয়ামী লীগের কাছাকাছি অবস্থান করার কথা থাকলেও ঐ চাষার পুতের অমোঘ উপস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে যায়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্যাপারে আমার বিশ্লেষণ কিছুদিন আগে একটা লেখায় বলেছি। এখানে তার আর পুনরাবৃত্তি করলাম না। তবে জগতজ্যোতিদের সঠিক মূল্যায়ণ করতে গেলে তাদেরকে অপমান করার বা বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেবার জন্য দায়ী ব্যবস্থাটার পরিবর্তন হতে হবে। ব্যবস্থাটা টিকে থাকে বলে মোশ্‌তাক, শাহ্‌ আজিজ, ফ কা চৌধুরীরা মরে গেলেও তাদের রক্তবীজরা বার বার ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে। আর অফিসের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার দল সন্মুখসমরের অকুতোভয় যোদ্ধার সমান মর্যাদা পায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তারেক অণু এর ছবি
সুবোধ অবোধ এর ছবি
এনকিদু এর ছবি

চলুক


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

এনকিদু এর ছবি

শেখ মুজিব শাপলাকে কেনো জাতীয় ফুল ঘোষনা করলেন? তার জন্ম ও বেড়ে উঠা গোপালগঞ্জের প্রায় ভাটি এলাকায়- বিল ও বাউড় অঞ্চল। বছরের একটা সময় খাদ্যশস্যে টান পড়ে তখন গরীব মানুষেরা শাপলা'র ফুল ও ডাঁটি খায়। শাপলা কোন অভিজাত ফুল না। শেখ মুজিব তার রুচিবোধ অনুযায়ীই একে জাতীয় ফুল করেছেন।সেইম টু জাতীয় পাখী। গ্রামাঞ্চলে খোলা টয়লেটের চারপাশে দোয়েল ঘুরাঘুরি করে। ইয়াক!

ভাগ্যিস মুজিব গ্রামাঞ্চলে বেড়ে ওঠা মানুষ ছিলেন। অভিজাত লোকের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলে হয়ত এরোপ্লেন কে জাতীয় পাখি ঘোষণা করত - পাখির মত উড়তে পারে, আবার তার পেটের মধ্যে অভিজাত লোকের বৈঠকখানাও আছে।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

দারুণ!

____________________________

এক লহমা এর ছবি

চলুক
"মুজিবহত্যাকে আমি কখনোই ব্যক্তি হত্যা হিসাবে দেখিনা, মুজিব হত্যা ছিলো একটা শিশু রাষ্ট্রকে হত্যা- যে শিশু জন্ম নিয়েছিলো আভিজাত্যের অহমিকা মুক্ত একটা মহান আশাবাদ নিয়ে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসার ভেতর দিয়েই এই আশাবাদের পুনঃজন্ম ঘটেনা বরং এই আশাবাদ বেঁচে থাকে একজন গনমানুষের নেতা শেখ মুজিব- একজন গনমানুষের যোদ্ধা জগতজ্যোতির সঠিক মুল্যায়নের ভেতরে"
- পূর্ণ সহমত

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

পৃথ্বী এর ছবি

একজন সামান্য মানুষ হিসাবে আমার জানতে ইচ্ছে হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীএকজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার দায় কী এখনো বহন করে? পেছনে যতো রাজনীতিই থাকুক খুনটাতো করেছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন অফিসারই? সেই রক্তাক্ত সকালে কোন তারকা জেনারেলকেই এর প্রতিবাদ করার, মধ্যম সারির খুনী অফিসারদের প্রতিরোধ করার কোন প্রমান তো পাইনা। এর পরের যেসব অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থান সে তো তারকা জেনারেলদের নিজদের ক্ষমতার লড়াই। কিন্তু সেই ভোরবেলা নিহত মুজিব কি কেবলই এক ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ই ছিলেন সেনাবাহিনীর কাছে?

চলুক

খুনী সেনা কর্মকর্তারা তো নিশ্চয়ই চেইন অব কমান্ড ভেঙেই এই হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল। সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট কেন এটার বিচার করল না? সামরিক বাহিনীতে তো চেইন অব কমান্ড ভাঙার শাস্তি মারাত্মক হয় বলেই জানি।

সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট অবশ্যই এই মুজিবহত্যার দায় বহন করে। এটা তাদের বুকে একটা "তারকা" চিহ্ন হয়ে থাকবে।


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

স্যাম এর ছবি

অসাধারণ!

মাসুদ সজীব এর ছবি

চলুক চলুক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে মানতে না পারার শ্রেণী শুধু সামরিক, আধা-সামরিক আর অভিজাতদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। নাক উঁচু সাম্প্রদায়িক চিন্তা সম্পন্ন অনেক বড় লেখকও সেই দলে ছিলেন, এখনো আছেন। এদের নানান অপব্যাখ্যা আজ ছাগুদের প্রিয় বুলি।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

সুবোধ অবোধ এর ছবি
ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

শেয়ার দিলাম

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

নজমুল আলবাব এর ছবি

শেষ পর্যন্ত এইটাই সত্য। বাঙগালের পোলার আবার এতো ডাট কি?

ফাইয়াজ জামাল এর ছবি

পারিবারিক সুত্র থেকে যতদুর জানি, আবু সায়ীদ চৌধুরীর মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগদান সম্পূর্ণই চাপে পড়ে, বাধ্য হয়ে। পরবর্তিতে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সকলেই আওয়ামী লীগের সাথেই ছিলেন। আবু সায়ীদ চৌধুরীর ছেলেকে শেখ হাসিনা প্রথম মন্ত্রীসভায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও বানিয়েছিলেন। দেওয়ান ফরিদ গাজীও মৃত্যু পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এম পি ছিলেন। তাই তাঁদের মোশতাক সরকারে যোগদানকে অভিজাততন্ত্রের মুজিব বিদ্বেষ হিসেবে না দেখে বরং অভিজাতদের স্বভাবসুলভ ভীতি ও কাপুরুষতা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

যতো বড় অভিজাত, তত বেশী লোভী এবং ছোটলোক, এই সত্যটা পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় লিখে রাখা দরকার, যাতে সাধারন কেউ অভিজাত হবার স্বপ্ন দেখে না বেড়ায়।

আভিজাত্য একটা কুৎসিত রোগ, আর এটার শাস্তি হওয়া উচিৎ পশ্চাদ্দেশে বেত্রাঘাত আর করজোড়ে 'চাষা'দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা। একটা পরিবর্তন দরকার.........

অতিথি লেখক এর ছবি

জগতজ্যোতি দাস আর মার্কুলির মণীন্দ্র শীলের কথা বলতে বলতে চোখে পানি এসেছিল এক রিক্সা চালক মুক্তিযোদ্ধার । ছোট বেলায় দেখা সে জল এখনো ভুলি নি। আপনি আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন !

অছ্যুত গ্রামে নদীতে ভেসে যাওয়া, কুকুরে শেয়ালে খাওয়া আমার পূর্বপুরুষের লাশ এই বিশ্বাসঘাতক অভিজাতদের ধিক্কার দেয় !

রাজর্ষি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এটাই নিয়ম হাসি
আমজনতা থাকবে মিছিলে আর হতাহতের সংখ্যায়। শুধু ভোটের সময় যা একটু গুনতে হবে তাদেরকে। বাকি সব দায়িত্ব অভিজাতদের।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চিন্তা জাগানিয়ে পোস্ট। এই আভিজাত্য, কৌলীন‌্য -এই জিনিসগুলো গোলমাল বাঁধানো ছাড়া আর কি ভালো কিছু করেছে?

লেখায় ৫ তারা।

স্পর্শ এর ছবি

জগতজ্যোতিকে সর্বোচ্চ খেতাব দেবার জন্য আমরা এখন কোনো পিটিশন করতে পারি না?


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

যতদুর মনে পড়ে,
ইয়ে, মানে... মুক্তিযুদ্ধে প্রদত্ত খেতাবগুলো আর না দেয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত হয়েছিল

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

স্পর্শ এর ছবি

ভিন্ন ক্ষেত্রে কাউকে না দিক। এখানে তো একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেবার জন্যই বলা হচ্ছে। যার ব্যাপারে এমনকি পাবলিক ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিলো।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ঈয়াসীন এর ছবি

অসাধারণ।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।