দাসপার্টির খোঁজে # খসড়াপর্ব- ১

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: বুধ, ২২/০৪/২০১৫ - ৩:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৭ এপ্রিল ২০১৫।
বাসা থেকে বের হয়েছি সকাল সাড়ে সাতটায়। বৈশাখের আজ চতুর্থ দিন। গত চারদিন প্রচন্ড গরম, কড়া রোদ নেই অথচ চড়া তাপমাত্রা, বাতাস নেই- হাসফাস লাগে আমার। অথচ আজ এই সকালবেলা, বৈশাখের চতুর্থদিনের সকালবেলা হেমন্তের সকালের মতোই স্নিগ্ধ ও মায়াময়- হালকা কুয়াশার মতো চারদিক, ঘাসের ডগায় একটু শিশির।
ছুটছি সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে। ছোট বড় বেশ কটি নদী , খাল এবং তার উপরে সেতু। বেশীর ভাগ সেতুই সরু ছিলো, জাইকার অর্থায়নে সেতু সম্প্রসারনের কাজ চলছে – তাই মাঝেমধ্যেই গাড়ির গতি কমে যাচ্ছে।
ঘন্টা দেড়েক চলার পর জাউয়াবাজার পেরিয়ে তারপর পাগলা বাজার। সুনামগঞ্জ শহর এখান থেকে সম্ভবতঃ বিশ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব। আমার আজকের প্রথম টার্গেট পাগলা ও জয়কলসের মাঝামাঝি সদরপুর বলে একটা জায়গা। চোখ রাখি রাস্তায়।
একটা ব্রীজ পেরোই। ব্রীজের নীচ দিয়ে একটা মোটামুটি প্রশস্থ নদী কিংবা খাল উত্তর থেকে দক্ষিনে প্রবাহমান। এখনো বর্ষা আসেনি, তেমন বৃষ্টি ও হয়নি। তবু নদী কিংবা খালটি শীর্ণ নয়, ভরা বর্ষায় বেশ প্রসস্থ হবে ধারনা করি। এটিই সদরপুর। ব্রীজ পেরিয়েই গাড়ি থেকে নামি। হাতের ডানে একটা চায়ের দোকান। দুতিন জন বসা কিন্তু সকলেই তরুন। আমি একজন মধ্যবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধের খোঁজে। অপেক্ষা করতে হয়না। ব্রীজ পেরিয়ে একজন এগিয়ে আসেন। আমি ও এগিয়ে যাই। আগ বাড়িয়ে সালাম দেই।
সদরপুর ব্রীজ- দাসপার্টির প্রথম অপারেশন photo SodorPur_Bridge_zpskicpppdd.jpg
ইনি আব্দুল মন্নান, পেছনের গ্রাম কামরুপদলং এর বাসিন্দা। আমি যেইসময়টাকে খুঁজছি, সেই সময়ে তার বয়স ছিলো পনেরো বছর। আমি এখানে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ কে খুঁজছি। ১৯৭১ এর যে ঘটনাকে খুঁজছি এখানে দাঁড়িয়ে কামরুপদলং এর আব্দুল মন্নান সেই ঘটনার স্বাক্ষ্য দেন।
১৯৭১ এর জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। আব্দুল মন্নানের অবশ্য জুলাই মনে নেই ‘ বাইরা’ মনে আছে। ‘বাইরা’ মানে বর্ষা কাল। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে পাকিস্তান আর্মির নিয়মিত যাতায়াতের জন্য এই ব্রীজটি ছিলো গুরুত্বপুর্ণ, ব্রীজে সার্বক্ষনিক পাহারায় থাকতো রাজাকারদের একটা দল।
সেক্টর-সাবসেক্টর গঠনের কাজ তখন প্রাথমিক পর্যায়ে। ৫ নং সেক্টরের বালাট সাব সেক্টরের অধীনে এই জায়গাটি। কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় সেই তাহিরপুরের টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের একদল গেরিলাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ব্রীজটি উড়িয়ে দেয়ার। টেকেরঘাট থেকে অনেকগুলো হাওর, নদী পার হয়ে বিশজনের দল কাছাকাছি এক গ্রামে এসে অবস্থান নিয়েছে। দলটির নেতৃত্বে একুশ বছরের এক তরুন- জগতজ্যোতি দাস। বাড়ি আরো ভাটিতে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে হলে ও সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র। এইসব এলাকা তার চেনা আর একমাসের প্রশিক্ষনে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স তাকে আলাদা করে দিয়েছে অন্যদের থেকে। জগতজ্যোতি ও তার দলকে বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলের পাকিস্তান আর্মির একটা লাইফ লাইনকে অকার্যকর করে দিতে। নদীপথে ঢাকা থেকে ভৈরব হয়ে হাওর পাড়ি দিয়ে আজমিরীগঞ্জ ও শেরপুর হয়ে সিলেট আসা যায় আবার আজমিরীগঞ্জ থেকে দিরাই জামালগঞ্জ হয়ে মহকুমা সদর সুনামগঞ্জ পর্যন্ত নদীপথ চালু আছে। এই পথে সিলেট- সুনামগঞ্জে পাকিস্তান আর্মির রসদ ও অস্ত্র সরবরাহ চলছে।
জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জগতজ্যোতির দাস পার্টি যুদ্ধ করে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের বিশাল এলাকাজুড়ে।

সদরপুর থেকে সামনে এগোতে থাকি কিছুক্ষন পর জয়কলস বাজার। জয়কলস থেকে রাস্তা সোজা চলে গেছে আহসানমারা ব্রীজ পেরিয়ে সুনামগঞ্জের দিকে। এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জয়কলসের প্রসংগ উঠে এসেছে বারবার। জয়কলসের সাত্তার রাজাকার কমান্ডার। যুদ্ধ শুরুর পর জেলা পালানো দাগী ডাকাতদের নিয়ে সে বিরাট রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছিলো। সদরপুর ব্রীজ থেকে শুরু করে জয়কলস ব্রীজ, আহসানমারা ফেরী পাহারা দিতো তার লোকজন। দিলা নামে এক কুখ্যাত ডাকাতকে সাথে নিয়ে সাত্তার মন্দির লুট, শরনার্থীদের উপর হামলা, আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়ীঘরে আগুন দেয়ার কাজ করছিলো। আগস্টের মাঝামাঝি নিজামউদ্দীন লস্কর ময়নার নেতৃত্বে বালাট থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা এসে সাত্তারের বাড়ী আক্রমন করেছিলেন- দিলা ডাকাত নিহত হলে ও সাত্তার পালিয়ে গিয়েছিলো। একই সময় এরা আহসানমারা ফেরি উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং জয়কলস এ থাকা পাকিস্তান আর্মির সাথে তাদের যুদ্ধ হয়েছিলো। এখানে শহীদ হয়েছিলেন মহররম আলী নামে একজন যোদ্ধা, কমান্ডার ময়না নিজে গুলীবিদ্ধ হয়েছিলেন। মহররম আলীর শহিদ হবার জায়গাটা আমি খুঁজে পাইনা কিন্তু নিজাম উদ্দীন লস্কর ময়নার দেয়া বর্ণনা মতে ধারনা করি জয়কলস ব্রীজ পার হয়ে আহসানমারার দিকে যেতে হাতের ডানে রাস্তার ঢালে হবে হয়তো।
তার আগে আমি জয়কলস বাজার থেকে বামের সরু রাস্তায় ঢুকে এগুতে থাকি। অনেক বছর আগে আমার ছোটবেলায় সিলেট থেকে নানাবাড়ি দিরাই যাওয়া আসার জন্য লঞ্চঘাটের রাস্তা ছিলো এটি। এই রাস্তার শেষ মাথায় ছিলো লঞ্চঘাট, সেই সময় ভীষন কর্মব্যস্ত জায়গা। লঞ্চে উঠার আগে আমরা নদী থেকে সদ্য ধরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতাম। সেই ঘাট নেই এখন আর। সিলেট থেকে দিরাই সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চলছে প্রায় দুইযুগ।
এইখানে এক চায়ের স্টলে ঢুকে সালাম দিয়ে পরিচয় করে নেই দুজন বয়স্ক মানুষের সাথে। একজন উজানী গাঁওয়ের আলমাছ আলি, আরেকজন জয়কলসের আব্দুল করিম। জিজ্ঞেস করি- এখানে মুক্তিযোদ্ধা তালেবের কবর কোথায়?
প্রথা অনুযায়ি নামধাম জিজ্ঞেস করেন। জানতে চান- আমি সাংবাদিক কিনা? উত্তরে না বলি। এবার আরেকটু কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করেন- আমি তালেবের কেউ হই নাকি? বলি- হ্যাঁ, তালেব আমার ভাই।
দুজনই আমাকে পথ দেখান। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় আর মসজিদ এর মাঝখানে এক চিলতে জায়গা। এটি একটি পারিবারিক কবরস্থান। স্থানীয় একটি পরিবারের। এখানেই দাফন করা হয়েছিলো তালেব ও তার দুজন সহযোদ্ধাকে। ছোট্ট একটা ফলকের মতো আছে কিন্তু সেখানে কোন নামধাম কিচ্ছু নেই।
জগতজ্যোতির মত তালেব ও ছিলেন সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র। বাড়ি দিরাই থানায়। বয়স বিশ-একুশের মতোই কিন্তু রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। জুলাই এর প্রথম সপ্তাহে সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি দিরাই থানা দখল করে, তালেব সেই দলে ছিলেন। পরে বালাট সাব-সেক্টরে সংযুক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে থাকেন। ২৭ নভেম্বর সীমান্তবর্তী মংগলকাটা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পাকিস্তান আর্মি আক্রমন করলে তালেব সহ একটি দল চলতি নদীর বালুচরে গিয়ে ডিফেন্স নেন। এখানেই পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়েন তালেব ও তার সহযোগী একজন চা বাগান শ্রমিক। সুনামগঞ্জ শহরে নিয়ে এসে তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয় সুনামগঞ্জ স্কুলের সামনে জনসভা করে তাকে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়।
৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমনে সুনামগঞ্জ শহর থেকে পাকিস্তান আর্মি পালিয়ে যাবার সময় তালেব, তার সহযোগী চাবাগান শ্রমিক এবং আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা কৃপেন্দ্রকে আহসানমারা ফেরীর কাছে গুলী করে হত্যা করে। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করে একই কবরে দাফন করা হয়।
আলমাছ আলী ও আব্দুল করিম সেইদিনের স্মৃতিচারন করেন। পাকিস্তান আর্মি চলে যাবার পর তিনজনের লাশ উত্তোলন হলো, জানাজা হলো, একই কবরে তাদেরকে শুয়ে দেয়া হলো চিরদিনের জন্য- একজন আবু তালেব, একজন কৃপেন্দ্র দাস, আরেকজনের নাম অজ্ঞাত। এই প্রায় বৃদ্ধ দুজন মানুষের এসব মনে আছে কিন্তু কবরস্থানের পাশ ফুটবল খেলছিলো, গেটে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিলো যে কিশোরেরা তারা এই মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানের কাহিনী কি জেনেছে? আমি নিশ্চিত হতে পারিনা।
তালেব, কৃপেন্দ্র ও অজ্ঞাত একজনের কবর photo Grave_Taleb_zps1qg4iwam.jpg

আহসানমারা- এখানে তালেবদের হত্যা করা হয়েছিলো photo AhsanMara_Bridge_zps7sdhn0lm.jpg
আহসানমারা ব্রীজ পেরিয়ে সোজা রাস্তা সুনামগঞ্জের দিকে। আমি বামের রাস্তা ধরি। এই রাস্তা চলে গেছে দিরাই। একটু এগিয়ে হাতের ডানে রাস্তা বাঁক নেয়- এখান থেকেই আরো ঘন্টা দেড়েক দূরত্বে আমার আজকের গন্তব্য- জামালগঞ্জ।
আমি মুলতঃ দাসপার্টিকে খুঁজছি। দাসপার্টির জীবিত গেরিলাদের সাথে কথা বলা, যুদ্ধক্ষেত্রগুলো যথাসম্ভব দেখে নেয়াই আমার উদ্দেশ্য। দাসপার্টির সদস্য ছিলেন ছয়ত্রিশের জনের মতো। এদের মধ্যে কয়েকজন এসেছিলেন কিশোরগঞ্জ থেকে। জামালগঞ্জ-সাচনার যুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সিরাজ শহিদ হলে এরা কিশোরগঞ্জের যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যান। বাকিদের মধ্যে কয়েকজন তাহিরপুর-ধর্মপাশার, কয়েকজন দিরাই-শাল্লা-জগন্নাথপুরের এবং বাকীরা আজমিরীগঞ্জের। জামালগঞ্জ থেকে ছিলেন একজন আয়ূব আলী। আয়ূব আলীর কথা আমাকে জানিয়েছিলেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী, যিনি দিরাই শাল্লা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন।
জামালগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক, সাবেক ছাত্রনেতা আকবর আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। আকবর নিজে তার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্নবাসনের কাজ করেন। দাসপার্টির গেরিলা যোদ্ধা আয়ূব আলীর খোঁজে তাই আকবরের সাথে যোগাযোগ করি। আকবর জানান- আয়ূব আলী মারা গেছেন গতবছর চরম দরিদ্র অবস্থায়। আহ! বড় দেরী হয়ে যায় সবকিছুতে।
দাসপার্টির আর কোন সদস্য জামালগঞ্জে না থাকলে ও জামালগঞ্জ-সাচনার যুদ্ধ ছিলো তাদের অন্যতম অপারেশন। ঐ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুইটা গ্রুপ ছিলেন তাদের সাথে। সিদ্ধান্ত নেই- জামালগঞ্জ যাবো।
জামালগঞ্জ গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে এগারোটা। রোদ চড়া না কিন্তু অনেক গরম , সকালের স্নিগ্ধতা ফুরিয়েছে।
সুনামগঞ্জ থেকে সুরমা নদীর ভাটিতে জামালগঞ্জ। নদীর এপাড়ে উপজেলা সদর, ঐ পাড়ে বিখ্যাত সাচনা বাজার। সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ খসরুর ‘রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়ঃ- জুলাই মাসের প্রথম দিকে জামালগঞ্জ ও সাচনাবাজার এলাকায় পাকসেনারা ঢুকে বিরাট বিরাট পাকা বাংকার তৈরী করে শক্ত অবস্থান গড়ে এবং তান্ডব শুরু করে। হিন্দু প্রধান গ্রামগুলো ভস্মীভুত করে। আওয়ামী লীগ ও হিন্দু নিধনে পাক আর্মিকে সহযোগীতা করে তখনকার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি পিডিপির লাল মিয়া। জয়কলসের সাত্তার রাজাকারের মতোই সে ও খুনী ডাকাতদের নিয়ে বাহিনী গড়ে তোলে, পাকবাহিনীর যাতায়াতের জন্য তার দুটো লঞ্চ দান করে। এই লাল মিয়া তার বাহিনী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলকে ঘেরাও করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে মাছ শিকারে বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়ি আক্রমন করে ধ্বংস করে দিলে ও সে প্রানে বেঁচে যায়। ’৭৫ এর পর এই লালমিয়া বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। সে মারা গেছে বছর কয়েক আগে কিন্তু তার এক ছেলে বর্তমানে জামালগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান, আরেক ছেলে জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তার সম্মানে ‘লাল সাহেব’ নামে একটা যাত্রীবাহি লঞ্চ চলে সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ নৌপথে।
জুলাই মাসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর গঠিত হলে সুরঞ্জিত সেন সহ অন্যান্য সংগঠক- এডভোকেট আলী ইউনুস, নজির হোসেন, হোসেন বখত ও ভারতীয় মেজর বাট সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডারদের নিয়ে জামালগঞ্জ থানা ও সাচনাবাজার আক্রমনের পরিকল্পনা গ্রহন করেন।
গুরুত্ব বিবেচনায় তিনটি দল নির্বাচিত হয়। প্রথম দলে কমাণ্ডার ইপিআরের আব্দুল হাই, সেকেন্ড ইন কমান্ড সিরাজুল ইসলাম- এই দলের দায়িত্ব পড়ে সাচনাবাজারের বাংকারগুলো আক্রমন করা। জগতজ্যোতি ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী আমজদের দায়িত্ব নেন অপর পাড়ে জামালগঞ্জ থানা সদরের বাংকারের দখল নেয়া। মোজাহিদ মিয়া ও ইব্রাহিম খলিলের নেতৃত্বে আরেকটি দল ব্যাক আপ পার্টি হিসেবে।
৭ আগষ্ট ছয়টি বড় নৌকা নিয়ে টেকেরঘাট থেকে এসে তিনটি দল আক্রমন শুরু করে। জগতজ্যোতির দল থানা আক্রমন করার সাথে পাকসেনারা দক্ষিন দিকে পালাতে থাকলে মোজাহিদ মিয়ার দলটির প্রতিরোধে এগোতে না পেরে দুর্লভপুর গ্রামের দিকে পালাতে থাকে।
একই সময় নদীর অপর পাড় সাচনা বাজারে আব্দুল হাই ও সিরাজের দল একের পর এক গ্রেনেড চার্জ করতে করতে এগোতে থাকে। বাংকারের ভেতরে কিছু পাক আর্মি ও রাজাকার মারা যায়, অনেকগুলো পালাতে থাকে। পালাতে পালাতে বাজারের ভেতরের একটা বাংকারে সবগুলো জড়ো হয়। সিরাজ ক্রলিং করে এগিয়ে গিয়ে সেই বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করেন কিন্তু ঐদিক থেকে ছুঁড়া একটা গুলি তার চোখ ভেদ করে চলে যায়। পাকসেনা ও রাজাকারেরা পালিয়ে যায় আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে ঐখানেই শহীদ হন সিরাজুল ইসলাম। এই যুদ্ধে পাকিস্তান আর্মি মারা যায় পয়ত্রিশ জন।
সিরাজের লাশ সহযোদ্ধারা টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের ফিরিয়ে নিয়ে দাফন করেন। টেকেরঘাটে এখনো সেই কবরটি আছে। সাচনা বাজারের নামকরন করা হয় ‘সিরাজ নগর’ যদি ও পরবর্তীতে তা আর টিকে থাকেনি। এই বিজয়কে ধরে রাখার জন্য সাব-সেক্টর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল স্থায়ীভাবে এসে ঘাঁটি করে সাচনায়। আগষ্টের শেষের দিকে পাকিস্তান আর্মির বিশাল একটা দল অনেক প্রস্তুতি নিয়ে জামালগঞ্জ দখলের জন্য রওয়ানা দেয়। সেই সময়ের এই এলাকার অতি বিখ্যাত হুজুরে মাওলানা আমিনউদ্দীন ( শেয়খে কাতিয়া নামে পরিচিত) জোহরের নামাজের পর পাক আর্মির দলকে দোয়া দরুদ করে লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিলে ও জামালগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে আর ছিনিয়ে নিতে পারেনি।

সিরাজ শহীদ হবার এক সপ্তাহ আগে তার বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি সহযোদ্ধাদের মারফত পৌঁছায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখান থেকে নিয়মিত এই চিঠি পাঠ হতো মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে।

চিঠিটি ছিলো এরকমঃ
‘টেকেরঘাট হইতে’
তারিখঃ ৩০.০৭.৭১
প্রিয় আব্বাজান,
আমার ছালাম নিবেন। আশা করি খোদার কৃপায় ভালোই আছেন। বাড়ির সকলের কাছে আমার শ্রেনীমত ছালাম ও স্নেহ রহিলো। বর্তমানে যুদ্ধে আছি। আলী রাজা, রওশন, সাত্তার, রেণু, ইব্রাহিম, ফুলমিয়া সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করিবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারন দেশ স্বাধীন না হলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবেনা। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করিবনা। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে, চাচা-মামাদের ও বড়ভাইদের নিকট আমার ছালাম। বড়ভাইকে চাকরিতে যোগ দিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সমোয় মৃত্য হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলে ও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।
আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারন নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মতো শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সাধ মিটে যাবে। দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য জন্য দোয়া কর, মীরজাফরি করিওনা। কারন মুক্তিফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবেনা এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দিবেনা।
ছালাম, দেশবাসী ছালাম।
ইতি মো। সিরাজুল ইসলাম।

আমি জামালগঞ্জ পুলিশ স্টেশন ও হাইস্কুলের সামনে কিছুক্ষন হাঁটি। এখানেই ছিলো বাংকার এবং জগতজ্যোতি’র নেতৃত্বে তার দাসপার্টির গেরিলারা এখানেই যুদ্ধ করছিলেন সেদিন। আজ একদিনে দাসপার্টির দুটো অপারেশনের জায়গা দেখার সুযোগ পেলাম।

বন্ধু আকবরের কথামতো এবার আমি ছোট্ট নৌকায় সুরমা নদী পাড়ি দেই, ঐটা সাচনা বাজার। খেয়া পাড়েই অপেক্ষায় ছিলেন আকবর। আমরা বাজারের ভেতরে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বসি। নদী পাড়ি দেয়ার সময় নৌকায় আমার সাথে উঠেছিলেন একজন বৃদ্ধ, লুঙ্গী ও বাদামী একটি শার্ট গায়ে। সেই বৃদ্ধ ও আসেন আমার সাথে। আকবর পরিচয় করিয়ে দেন ইনি মুক্তিযোদ্ধা সিকন্দর আলী।
প্রচন্ড গরম, আকবর ঠান্ডা পানীয়ের ব্যবস্থা করেন সবার জন্য। সিকন্দর আলী জামালগঞ্জের নোয়াহালট গ্রামের হলে ও যুদ্ধ করেছেন শেলা সাব-সেক্টরে ছাতক এলাকায়। ছাতক সিলেট সড়কের ঝাওয়া রেল সেতু ও সড়ক সেতু ধ্বংস এবং সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ডাবর ফেরি ধ্বংসের গুরুত্বপুর্ণ অপারেশনে তিনি ছিলেন। আনসার বাহিনীর সদস্য হিসেবে ১৯৬৫ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলো তার। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে ‘সেন্ট্রি সাইলেন্স’ এর গুরুদায়িত্ব পালন করতেন তিনি। সেন্ট্রি-সাইলেন্স হলো অগ্রবর্তী হিসেবে শত্রুর টার্গেট এরিয়ায় ঢুকে পাহারাদারকে নিস্ক্রিয় করা/ হত্যা করা, তারপর বাকী সহযোদ্ধাদের সিগন্যাল দেয়া অপারেশন শুরু করার জন্য। সিকন্দর আলী এটাকে বলেন- খালি হাতে জাতি সাপের ফনায় ধরা । আমি সিকন্দর আলীকে উস্কে দেই- এই যে সাপের ফনায় হাত দিতেন- যুদ্ধ শেষে কোন পদক টদক তো পেলেন না।
সিকন্দর আলী স্পষ্টভাষী। তার সাব-সেক্টর থেকে বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছেন লেঃ রউফ, তারই সহযোদ্ধা। এই সাব-সেক্টরে দু চারজন সেনা কর্মকর্তা, কয়েক জন তরুন ছাত্র এবং বাকী সবাই তার মতো অর্ধ-শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষেরা ছিলো। তিনি বলেন যুদ্ধ শেষে ছাত্ররা চলে গেছে পড়ালেখা করতে আমরা চলে আসছি হালচাষে আর আর্মির স্যারেরা পদক টদক সব নিয়ে গেছেন নিজেরাই, আমাদের খবর কেউ রাখে নাই কিন্তু যুদ্ধের সময় সবথেকে বিপদের কাজগুলো আমরাই করছি।
সেন্ট্রি-সাইলেন্ট সিকন্দর photo Sikandor_Ali_zpsifpxsghg.jpg
নদী ভাংগনে সিকন্দর আলীর পৈতৃক ভিটা-জায়গা জমি শেষ হয়ে গেছে। এখন জামালগঞ্জ বাজারে নদীর পাড়ে এক টুকরো খাসজমিতে একটা চালাঘর তুলে কোনমতে থাকেন স্ত্রী সন্তান সহ। বয়স হয়েছে, কাজ করতে পারেন না। সরকারী ভাতাটুকুই সম্বল।
আমার আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে। সিকন্দর আলীর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই, হাত জড়িয়ে অনুরোধ করেন যেনো ফেরার বেলা তার ছাপড়া ঘরে একতু বসে যাই।

এবার আমার আর আকবরের গন্তব্য সাচনা বাজার থেকে দু মাইল পশ্চিমের গ্রাম লম্বাবাঁক। মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন। যাওয়ার আগে আকবর নিশ্চিত হতে চান আলাউদ্দিন বাড়ি আছেন কিনা। আলাউদ্দীন অন্যের বাড়িতে কামলা খাটেন, তাও অনেক দূরের জগন্নাথ উপজেলার কোন এক গ্রামে। অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন বলে আকবর শুনেছেন। নিশ্চিত হবার জন্য একই গ্রামের একজন দোকানদারকে মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দীনের কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর – ‘ ও বেশী মাতে যে আলাই, হে আছে বিছনাত পড়া’ । বেশী মাতে আলাই অথবা গেরিলা যোদ্ধা আলাউদ্দিনের সন্ধানে আমরা লম্বাবাঁক গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই রিক্সা নিয়ে। সুরমা নদী চলে গেছে পশ্চিমে, তার পাড় ঘেঁষে সমান্তরালে কিছু বাড়িঘর – তারপর ইট ও ব্লক ফেলে তৈরী করা রাস্তা এর পর উত্তর দিকে আদিগন্ত হাওর। হাওর চলে গেছে একেবারে টেকেরঘাট, পশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। আর কয়দিন পর পুরোটা থই থই পানি, নৌকা ট্রলার চলবে, ঢেউ উঠবে বিপদ্দজনক। এখন সোনালী ধানের উচ্ছ্বাস। বাতাসে ঢেউ খেলছে।
লম্বা বাঁক গ্রামে পৌঁছাই। ছাপড়া মতো ঘর সব। দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। স্যানিট্রেশন, বিশুদ্ধ পানির উৎসের কোন চিহ্ন দেখিনা। দারিদ্র ছাপিয়ে উঁকি মারে সুদৃশ্য দোতলা পাকা মসজিদ। জুমা’র নামাজের আজান পড়ে গেছে, মুসল্লীদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। আকবর পরিচিত মুখ, আমার প্রতি উৎসুক দৃষ্টি। আকবরকে আগেই বলা আছে, উৎসুক দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা কথা বলবো।
আকবর আলগোছে এগিয়ে যান ছাপড়াঘরগুলোর ভেতর দিয়ে। আমি তাকে অনুসরন করি, বুঝতে চেষ্টা করি কয়দিন পর বর্ষায় কী অবস্থা দাঁড়াবে এই ঘরগুলোর। আকবর তার দীর্ঘ দেহ নীচু করে একটা ছাপড়ায় ঢুকেন, আমি ও। প্রথমেই অন্ধকার চোখে লাগে এই মধ্য দুপুরে। কয়েক মুহুর্তের অন্ধকার চোখ সয়ে গেলে খাটের উপর চাটাই, তার উপর একটা শরীরের কাঠামো- শীর্ণ, হাড়গুলো স্পষ্ট, বুকের পাঁজর উঠা নামা করছে হাপরের মতো। এটা আমার চেনা, সিরিয়াস রকম হাঁপানি।
উঠে বসেন আমাদের দেখে, সালাম দেই। আকবরের সাথে আগের পরিচয় আছে। চোখে ইশারায় বসতে বলেন। তার পাশেই বসি আমি ও আকবর। আকবর সংক্ষেপে বলেন আমার আসার উদ্দেশ্যে। গেরিলা যোদ্ধা আলাউদ্দিন, শ্বাসকষ্টে বুক ঠেলে বেরিয়ে আসা আলাউদ্দীন ঠিক বুঝতে পারেন না কেনো আমি তার কাছে গিয়েছি, যুদ্ধের কাহিনী শুনে কী হবে? তার সবথেকে বড় সংশয় আমি আসলে কে?
মাঝেমধ্যেই এক লাইন ইংরেজি বলেন ‘ নাথিং ইজ এভরিথিং’ । ঘুরে ঘুরে এই কথাটাই উচ্চারন করেন কিছুক্ষন পর পর একেবারেই নিরক্ষর এই গেরিলা, যুদ্ধের আগে ভূমিহীন কৃষক ছিলেন, এখনো তাই। বয়স সত্তুর বছর- মানুষের জমিতে কামলা দেন।
মানুষটার কথা বলতে কষ্ট হয়। আমি সিদ্ধান্ত নেই তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করবোনা- শুধু তার পাশে বসে থাকবো কিছুক্ষন। নিজ থেকেই আবার কথা বলেন- ‘বাইরা’ মাসে যুদ্ধে গেছেন- ইকো ওয়ান ট্রেনিং ক্যাম্প, টেকেরঘাটের ঘাঁটি, আলী আমজদ কমান্ডার, তাহিরপুরের যুদ্ধ, তিনদিন ভরা যুদ্ধ এইসব মনে আছে তার। আমি ভিডিও করতে চাই। তিনি বুঝতে চান এটা কী জিনিস? আমি আসলে কে? তার ছবি তুলে আমি কী করবো? আবার নিজ থেকেই বলেন- যা খুশী করেন, আমি কী ডরাই নাকি? দালালের ফুয়া ( লাল মিয়ার ছেলে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান) পতাকা তোলার অনুষ্ঠান করে ( ১৬ ডিসেম্বর)। আমি তার অনুষ্ঠানে মুতি। আমরা মুক্তিরা আলাদা অনুষ্ঠান করছি, ডরাইছি নাকি কোন ব্যাটারে?
জিজ্ঞেস করি- ভাতা কী পান?
এজমা আক্রান্ত ফুসফুস থেকে বাতাস বের হয়ে আসে তার। উত্তর দেন ‘পাই’। গরীব দেশ বাবা, আমগোরে কী দিবো বলেন? দেশের মানুষ খাইতে পারেনা, তাও শেখের ফুরি আমগোরে ভাতা দেয়। আমরা খুশী আছি।
‘এই যে দালালদের বিচার হচ্ছে এখন...’
‘দলাল কী বাবা কম ছিলো? লাল মিয়া- আহারে কতো মুক্তি মারছে। হের বিচার নাই। বিচার কী বাবা আছে নাকি দেশে? ক্ষেমতা তো সব তারারই। কিন্তুক আমরা ডরাইনা, যেটা কওনের কই। এই যে আপনে, আপনারে কী আমি ডরাই? লেখেন আমি যা কইছি সব লেখেন, কোন দলালরে আমি চুকিনা’
আহ তার ভাঙ্গা বুক ভেতরে ঢুকতে থাকে, অনেক ভেতর থেকে নিঃশ্বাসের সুগভীর কষ্ট নিয়ে তার পাঁজর জেগে উঠতে সময় নেয়।
যেনো একা এক গেরিলা যোদ্ধা আলাউদ্দিন তার সমগ্র অহং নিয়ে আমার সামনে দন্ডায়মান আর ষোল কোটি নপুংসক এর অকৃতজ্ঞতার গুরুভার আমি আমার কাঁধে নিয়ে নতজানু তাঁর কাছে।
কোন বাক্য নাই, কোন শব্দ নাই- কেবল ইশারায় আমি ও আকবর দৃষ্টি বিনিময় করি। এতোক্ষন আড়ালে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। এবার তিনি আমাদের বলেন- বাজানরা কিছু মনে কইরেন না, মাথা বিগড়াই গেছে। আপনারা কিছু খেয়ে যান।
গেরিলা আলাউদ্দিন photo Alauddin_zpsm6ciqfe7.jpg

গেরিলা আলাউদ্দিনের হাইডআউট photo Houseof_Alauddin_zpsxuyrum38.jpg

বের হয়ে আসি। সুদৃশ্য দোতলা মসজিদ বিল্ডিং এখন মুসল্লীদের ভীড়, উত্তরের হাওর জুড়ে সোনালী সমৃদ্ধি, কিন্তু বাতাস নেই একফোঁটা। আমার নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। আমরা সাচনা বাজারের দিকে ফিরে চলি।

এবার সাচনা বাজার থেকে উত্তরে সাচনা গ্রাম। এই রাস্তা চলে গেছে বেহেলীর দিকে। বিখ্যাত কমিউনিষ্ট নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বরুন রায়ের বাড়ি। আমরা বেহেলী যাইনা। সাচনার বিখ্যাত ঘোষ চৌধুরীদের বাড়ি এসে ঢুকি। সাচনা বাজার সহ বিশাল এলাকার জমিদারী ছিলো এদের। আগের সেই অবস্থা নেই কিন্তু এখনো বাড়ী দেখলে সমীহ জাগে, পুরনো ঐতিহ্যের রেশটুকু পাওয়া যায়। এই বাড়ির ছেলে বাপ্পা ঘোষ চৌধুরী সিলেটের সুপরিচিত সাংবাদিক, এ ছাড়া এই বাড়ি আমার ছোটবেলার বন্ধু মান্না’র নানাবাড়ি। বাড়িতে ঢুকার আগে বাপ্পাকে ফোন দেই, বাপ্পা জোর করে যেনো তার মাকে দেখে আসি অবশ্যই।
চৌধুরি বাড়িতে যার খোঁজে যাওয়া তিনি বাপ্পার কাকা, শ্রী পরিমল ঘোষ চৌধুরী। একাত্তুরে উনি সুনামগঞ্জ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন। জগতজ্যোতি, তালেবদের সাথে আড্ডার ঘনিষ্ঠতা। ছাত্র ইউনিয়ন করলেও সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর থেকে আওয়ামী লীগ কর্মী হয়ে যান। ২৮ মার্চ সুনামগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধে তারা লঞ্চ বোঝাই দেশীয় অস্ত্র সহ যোগ দিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর জানতে পারেন তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। দ্রুত তাকে পাঠিয়ে দেয়া সীমান্তে। সেখান থেকে লাভা ইয়থ ক্যাম্প। ইয়ুথ ক্যাম্পে তাকে সহ বাছাই করা হয় ৩৭ জন তরুনকে যারা অন্ততঃ ইন্টারমিডিয়েট পাশ। এদেরকে আসামের তেজপুরে আটাশ দিনের এডভান্স ট্রেনিং এ পাঠান হয়। ট্রেনিং শেষে গারো পাহাড়ের তুরা, মহেন্দ্রগঞ্জ হয়ে সংযুক্ত হন কর্ণেল তাহেরের এগারো নম্বর সেক্টরে। কামালপুর যুদ্ধে কর্ণেল তাহেরের সাথে ছিলেন তিনি। দশদিনের এই যুদ্ধে কর্ণেল তাহের পা হারান, শহীদ হন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন মমতাজ। পা হারানোর পর ও তাহের কিভাবে ঠান্ডা মাথায় কমান্ড করছিলেন সেই বর্ণনা পরিমল চৌধুরী দিচ্ছিলেন আমাদের। পরিমল চৌধুরীর কাছেই পেয়ে যাই তাহিরপুর থানার সেই সময়ের ওসি শফিকুর রহমানের কন্টাক্ট। শফিকুর রহমান ২৫ মার্চের পরই পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান পুলিশ স্টেশন। তার সাথের পুলিশদের নিয়ে প্রতিরোধ গতে তুলেন এবং স্থানীয়দের প্রশিক্ষন দিতে থাকেন। তিনি নিজে কয়েকটা অপারেশন করে অবাঙ্গালীদের নিয়ন্ত্রাধীন ইপিআর ঘাঁটি দখল করেন। এই ওসি সাহেব এখন থাকেন চট্টগ্রামে।
গেরিলা পরিমল চৌধুরী photo Porimol_Ghos_zpswooytjig.jpg
চৌধুরী বাড়ির আপ্যায়ন শেষে সাচনা বাজারে ফিরে আসি। ফেরী ঘাটের ঠিক আগেই অযত্নে পড়ে থাকা একটি স্মৃতিসৌধ, ঠিক এই জায়গাতেই শহীদ হয়েছিলেন সিরাজ, কিশোরগঞ্জের সিরাজউদ্দীন এই জামালগঞ্জে এসে জীবন দিয়ে স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। স্মৃতিসৌধের চত্বরে সবজি বিক্রী হচ্ছে, কেউ একটা লুঙ্গী শুকাতে দিয়েছে। দালাল লাল মিয়া ও তার সন্তানেরা যেখানে ক্ষমতাসীন থাকে যুগের পর যুগ সেখানে একজন শহীদ সিরাজের স্মৃতিসৌধ এমন অবহেলায় পড়ে থাকাই বোধহয় স্বাভাবিক।
 photo Sohid Minar_zps0an6tbfc.jpg
এবার নদী পাড় হয়ে আমরা আবার চলে আসি জামালগঞ্জ বাজারে। একটু হেঁটে একটা ফার্মেসীর সামনে দাঁড়াই। আকবর সামনে, আমি পেছনে। ফার্মেসীর ভেতরে ঢুকে একটা পর্দা সরিয়ে আকবর আমাকে ইশারা করেন, আমি ও এগোই। পর্দার আড়ালে একটা চিলেকোঠার মতো। একটা খাট, মশারী অর্ধেক গোটানো। প্রায় অন্ধকার, ইলেক্ট্রিসিটি নেই। প্লাস্টিকের একটা চেয়ারে বসে আছেন নিবারস সরকার। হঠাৎ আধো অন্ধকারে সিরাজুল আলম খান বলে ভ্রম হতে পারে।
সিরাজুল আলম খানরা গড়ে তুলেছিলেন মুজিব বাহিনী/ বিএলএফ আর নিবারস সরকার সেই বিএলএফ এর এলএমজি ম্যান। জামালগঞ্জের বিনাজুড়া গ্রামের নিবারস মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলেন দিরাই’র ভাটিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২৮ মার্চের সুনামগঞ্জ যুদ্ধের পর লুট করা অস্ত্র নিয়ে ফেনারবাকের মুজিবুর রহমান, মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক তালেব এবং কালাশফিক ( জগতজ্যোতি শহিদ হবার পর ইনিই দাসপার্টি কমান্ড করতেন) তাদের গ্রামে আসেন এবং এদের উৎসাহেই বালাট যান। বালাট থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় হাফলং এ বিএলএফ এর পয়তাল্লিশ দিনের স্পেশাল ট্রেনিং এ। ট্রেনিং শেষে বিএলএফের ৭৫ জনকে পাঠানো হয় তুরায়। সেখানে ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে সম্মুখ যুদ্ধে পাঠাতে চাইলে তারা সম্মুখ যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানান কারন তারা ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। পরে এডভোকেট আব্দুল হামিদের মধ্যস্ততায় ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে গেরিলা অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করে এবং দেশের ভেতরে ঢুকে তারা একদিকে অপারেশন, অপরদিকে প্রশিক্ষন দিতে শুরু করেন।, তাদের উপর নির্দেশ ছিলো একএকজন বিএলএফ কে দশজন করে গেরিলা তৈরী করতে হবে।
নিবারস সরকার অকৃতদার। পরিবারের লোকজন বেশিরভাগ ভারতে চলে গেছেন। পরিচিত একজনের ফার্মেসীর পেছনের একটা খাটে একা একা শুয়ে থাকেন এলএমজি ম্যান নিবারস সরকার।
বিএলএফ এর এলএমজিম্যান নিবারস সরকার photo Nibaros Sorkar_zpsmcd6inis.jpg

তখন বিকেল প্রায় চারটা। উত্তরের নদী ও হাওরের দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। আকবর বলেন- বৃষ্টি আসতে পারে। এখন আমাদের গন্তব্য দক্ষিনে মাইল দুয়েক দূরে লালবাজার। সেখান থেকে আরেকটা গ্রাম মামুদপুর। উপজেলা সদরের সরু রাস্তা ধরে আমরা লালবাজার পৌঁছাই। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন এই গ্রামের একজন ছাত্রলীগ কর্মী। লালবাজার থেকে এবার মাটির রাস্তা, গাড়ি যাবেনা। আমরা পায়ে হাঁটা শুরু করি। আকবর এবং নূর নামের সেই ছাত্রলীগ কর্মীর কাছ থেকে জানতে পারি- একাত্তুরে এই এলাকা ছিলো রাজাকারদের মুল শক্তি। এখানকার আটটা গ্রামে পাকিস্তানের পতাকা উড়তো। তালিকাভুক্ত রাজাকার ছিলো একশো বিশজন। আর আটটা গ্রাম মিলে একজন মাত্র মুক্তিযোদ্ধা। এই এলাকার প্রচলিত একটা কথা ‘ছয় কুড়ি দলালে এক মুক্তি’ । সেই এক মুক্তি মদরিছ আলীর খোঁজে যাচ্ছি। নূর আমাকে ইশারা দিয়ে দেখান একটা মাদ্রাসা , পাকিস্তান আমলের। এই মাদ্রাসাই ছিলো রাজাকার বানানোর মুল সূত্র। কথা বলতে বলতে আমরা গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে আসছি। এদিকে বাতাস বাড়ছে, শো শো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে হাওরের উত্তাল বাতাসের। মদ্রিছ আলীর বাড়ি গ্রামের সীমানা পেরিয়ে পতিত একটা জায়গায়। হাকম পেরোতে হয়। মদরিছ আলী মাছ ধরে বিক্রী করতে যান সেই দূরের সাচনা বাজারে। এই বাজারে কেউ তার মাছ কেনেনা। ছয় কুড়ি দলালের গ্রামে এখনো অচ্ছ্যুত একমাত্র মুক্তি মদরিছ আলী।
হাকম পেরোতে পেরোতেই ভয়ংকর শব্দে বজ্রপাত আর তুমুল বৃষ্টি, সেই সাথে উত্তাল হাওয়া- চারদিকে খোলা প্রান্তর, কোথাও মাথা বাঁচানোর সুযোগ নাই। এরকম খোলা জায়গায় বজ্রপাত মারাত্বক। আমরা তিনজন দৌড়াই। দৌড়ে একটা চালাঘর। ওটাই মদরিছ আলীর বাড়ি।
একটা কুকুর, মদরিছ আলী, তার স্ত্রী ও আরেকজন বয়স্ক লোক উঠোনে দাঁড়ানো। চালাঘরের দরজা খুলে ধরেন। কাছেই কোথাও আবার বজ্রপাত। হুড়মুড় করে আমরা ঘরের ভেতরে ঢুকি এবং একরাশ অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। অনভ্যস্ত চোখে এই অন্ধকার আরো বেশী ঘনীভূত হয় এছাড়া সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো উচ্চতাও নেই চালাঘরে। কয়েক মুহুর্ত পরে একটা কেরোসিন এর প্রদীপ জ্বলে উঠে। প্রদীপ ঘিরে আমরা গোল হয়ে বসি। এবার আস্তে আস্তে চোখে দৃশ্যমান হয় মানুষগুলো। মাটির দেয়ালে ঝুলানো বঙ্গবন্ধুর ছবি, একটা দোতারা। মদরিছ আলী জানান তিনদিন আগে সিলেটের হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছেন। আকবর তাদের ঘনিষ্ঠজন, এইসব প্রয়োজনে আকবর তাদের আশ্রয়।
মদরিছ আলী নাটকীয় ভঙ্গিমায় শুরু করেন তার যুদ্ধবয়ান। জৈষ্ঠ্যমাস। পাক আর্মি এসে ঘাঁটি গেড়েছে সাচনায়। তারি এক চাচাতো ভাই, মসজিদের ইমাম রাজাকার হয়েছে। তাকে ও এসে বলেছে রাজাকার হতে, না হলে ধরিয়ে দেবে। নিজে হাতে শেখ মুজিবরে ভোট দিয়েছেন , জয়বাংলার জন্য গান বেঁধে গেয়ে গেয়ে বেড়িয়েছেন গ্রামে , কেমনে বেইমানী করেন মদরিছ আলী? এইদিকে আশেপাশের গ্রামে সবাই রাজাকার। এক কুটুম আসেন তাহিরপুর থেকে। তার নৌকার ছইয়ের নীচে লুকিয়ে চলে যান গ্রাম ছেড়ে। গর্ব করে বলেন একেবারে প্রথম ব্যাচের মুক্তি আমি। কমান্ডার মুজাহিদের নেতৃত্বে সুরমা নদীতে পাক বাহিনীর রসদ বোঝাই কার্গো দখল করে এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সাথের সহযোদ্ধা প্রফুল্ল’র লাশ উড়ে গিয়েছিলো কার্গোর সাথে, আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুড়ে গিয়েছিলো তার মুখ আর গলা। কর্ণেল ওসমানী এসে টেকেরঘাটে তাদের দেখে গিয়েছিলেন।
তাহিরপুরের যুদ্ধে তার পিঠের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে গুলি আর তার ছেড়ে আসা পজিশনেই গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা কাশেম। এইসব কাহিনী শুনি আমরা কুপির আলোয়, বাইরে তখন শো শো ঝড়ো হাওয়া আর বজ্রপাত চলছে। আকবরের মোবাইলে ফোন আসে, পাশের কোন গ্রামে কেউ মারা গেছে সেই বজ্রপাতে। মদরিছ আলী গেরিলা যুদ্ধের বর্ণনা দিতে দিতে তার খাটের উপর পজিশনের ভঙ্গী করেন আর স্ত্রীকে তাড়া দেন কিছু একটা নাস্তা দেয়ার জন্য। নিসন্তান মদরিছ দম্পত্তির চালাঘরের অচ্ছ্যুত সংসার। সেই ঘোর অন্ধকারের সন্ধায় আমরা লবন দেয়া সেমাই আর চা খাই।
গেরিলা মদরিছ এর হাইড আউট photo Modorish_House_zpskh0e5tia.jpg

পজিশনে গেরিলা মদরিছ photo Position_zpsdsx0ceaa.jpg

বৃষ্টি কিছুটা থামলে পর আমরা তিনজন বের হয়ে আসি, মদরিছ দম্পত্তি আমাদের এগিয়ে দিতে চান। ঘন্টা খানেক যে মাটির রাস্তা শক্ত ছিলো, সেই রাস্তায় এখন পা রাখা যাচ্ছেনা। পিচ্ছিল কাদা। আমরা একজন আরেকজন ধরে পা টিপে টিপে এগোতে থাকি। মাইলখানেক কাদাময় রাস্তা পেরোতে যেনো অনন্তকাল। লালবাজারে যখন গাড়ির কাছে চলে আসছি তখন মসজিদে মাগরিবের আজান, তখন ঘন অন্ধকার। হাওর থেকে হুহু হাওয়া আসছে তখনো, বৃষ্টি ও শুরু হয়েছে আবার।
আকবর ও নূরের কাছ থেকে বিদায় নেই। গাড়ী চলতে শুরু করেছে অন্ধকারের বুক চিরে। অন্য কোন দিন হয়তো অন্য কোথাও- সুনামগঞ্জ শহর কিংবা দিরাই শাল্লা অথবা আজমিরীগঞ্জ ছুটে যাবো দাসপার্টির খোঁজে। হয়তো দাসপার্টির কারো সাথে দেখা হবে কিংবা অন্য কোন গেরিলার সাথে অথবা দেখা হবে কোন মুক্তিযোদ্ধার শহিদ হবার স্থান।
বাতাস আর বৃষ্টি প্রবল হচ্ছে। আপাততঃ ভীষন ক্লান্ত আমি। গাড়ির পেছনের সীটে গা এলিয়ে দেই। মাথার ভেতর অনুরনন করতে থাকে ‘বেশী মাতা আলাই’ এর বলা একটা লাইন ‘ nothing is everything…nothing is everything…nothing’


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

স্বপ্নের নায়ক দের কথা তুলে আনবার জন্য আপনার যে চেষ্টা হাসান ভাই, তাকে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করবোনা। আমার স্রদ্ধা নিবেন। আপনার এ সিরিজ এর সবগুলো লেখাই পড়বার সময় প্রচন্ড কাঁদতে হয়, আর একি সাথে ভাবি কি তীব্র জীবন এই নায়করা যাপন করেছেন। কোনভাবেই এই ঋণ শোধ করা যাবে না।

বাদুর পাগল  এর ছবি

ওনাদের প্রত্যেকের জন্য শ্রদ্ধা ।।

আর আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া । ওনাদের কথা জানানোর জন্যে।

... Nothing is Everything ... ধইরা ঠুয়া দিয়া দিমু...

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক চলুক চলুক *****

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

সত্যপীর এর ছবি

দাসপার্টি নিয়া একটা লম্বা সিরিজ নামান। পড়ি। শুয়োরের বাচ্চাদের গল্প দেখতে দেখতে ক্লান্ত, কিছু বাঘের বাচ্চার গল্প দেন পড়ি।

..................................................................
#Banshibir.

সাম্য এর ছবি

চলুক লেখার পাশাপাশি একটা ম্যাপ থাকলে জায়গাগুলোর অবস্থান বুঝতে আরো সুবিধা হত।

--------------------------------
বানান ভুল থাকলে ধরিয়ে দিন!

নৈষাদ এর ছবি

দুর্দান্ত। চলুক

এক লহমা এর ছবি

চলুক এই সব ইতিহাস বার বার সামনে আনা দরকার।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার এই সিরিজটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ন কাজের অংশ বলে মনে করি। এই তথ্যগুলো সব একত্রিত করে বই আকারে সংরক্ষিত করা দরকার। পরিশ্রমী কাজ নিঃসন্দেহে। কিন্তু এরকম কাজ করার এখনই উপযুক্ত সময়। কাউকে না কাউকে এই কাজগুলো করতে হতো। আপনি শুরু করেছেন বলে অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আলোর দিশারী সেই সোনার মানুষগুলোকে অন্তত শব্দ দিয়ে অক্ষর দিয়ে আমরা সম্মান জানাতে চেষ্টা করি। সিরিজ চলুক!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এরকম একটি সিরিজ শুরু করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ!

জয়কলসের সাত্তার রাজাকার কমান্ডার। যুদ্ধ শুরুর পর জেলা পালানো দাগী ডাকাতদের নিয়ে সে বিরাট রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছিলো।

জেল পালানো হবে কি?

সাচনা বাজারের নামকরন করা হয় ‘সিরাজ নগর’ যদি ও পরবর্তীতে তা আর টিকে থাকেনি।

এরকম আরও বহু নাম টিকে থাকতে পারে নি, যেমন কুড়িগ্রামের সামাদনগর(জয়মনিরহাট), রাজশাহীর আজিমনগর(গোপালপুর), ইত্যাদি। নামগুলি টিকিয়ে রাখতে হলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই যে রকম প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ছিল, সেরকমটা নেয়া হয় নি। আর পঁচাত্তরের পর এইসব ব্যাপার একেবারে ডিপফ্রীজে চলে যায়।

দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলে ও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।

মুক্তিযোদ্ধাগন এরকমই বিশ্বাস করতেন, এরকমই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, এরকমটা হয় নাই। পুত্রহারা পিতা, পিতৃহারা পুত্র, কিংবা স্বামীহারা স্ত্রীদের কথা কেউ আর ভাবে নি, তাদের পানে কেউ আর ফিরে তাকায় নি, কেউ না।

অরফিয়াস এর ছবি

কান্দাইলেন।

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি কী ডরাই নাকি? দালালের ফুয়া ( লাল মিয়ার ছেলে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান) পতাকা তোলার অনুষ্ঠান করে ( ১৬ ডিসেম্বর)। আমি তার অনুষ্ঠানে মুতি। আমরা মুক্তিরা আলাদা অনুষ্ঠান করছি, ডরাইছি নাকি কোন ব্যাটারে?

অসাধারণ একটা কাজ হচ্ছে।

স্বয়ম

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

লেখা চলুক। চলুক

তাসনীম এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করলেন। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব পরের পর্বের জন্য।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

মুস্তাফিজ এর ছবি

লেখায় "এডভোকেট আব্দুল হামিদ" এর নাম এসেছে, উনি কোন এডভোকেট আব্দুল হামিদ? (আমাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এডভোকেট আব্দুল হামিদ সেসময় ঐ অঞ্চলেই সক্রিয় ছিলেন)।

...........................
Every Picture Tells a Story

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হ্যাঁ, এডভোকেট আব্দুল হামিদ। ইনি টেকেরঘাটে ও ছিলেন প্রথম দিকে। কিশোরগঞ্জের অনেক শরনার্থী এদিকে ভারত গিয়েছেন, আবার কিশোরগঞ্জের অনেক মুক্তিযোদ্ধা এইদিকে যুদ্ধ করেছেন। হামিদ সাহেব শরনার্থী ব্যবস্থাপনা ও মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও বাছাই প্রক্রিয়ায় ছিলেন।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

গৃহবাসী বাউল এর ছবি

অসাধারণ, অসাধারণ একটা কাজ হচ্ছে মোরশেদ ভাই। আপনাকে স্যালুট।
চলতে থাকুক। সাথে আছি।

-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কৃতজ্ঞতা সকলে। যারা পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন।
লেখার ধরন, ভঙ্গিমা নিয়ে যদি কোন পরামর্শ থাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না।
এখন যা হচ্ছে তথ্য সংগ্রহ। সংগ্রহ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ছবিটা কী দাঁড়াবে সেটা আমি নিজে ও এই মুহুর্তে জানিনা।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সাফি এর ছবি

পড়ে খুবই ভাল লাগলো। একটা ছোট পরামর্শ। ছবিগুলোর নীচে আলাদা করে ক্যাপশন দিয়ে দিতে পারেন।

নজমুল আলবাব এর ছবি

সবখানেইতো গিয়েছি। কিন্তু মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়নি। লোভ হচ্ছে খুব। শুভকামনা

সজল এর ছবি

মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা এত ব্লিক দেখে কেমন জানি কান্না পেলো।

গরীব দেশ বাবা, আমগোরে কী দিবো বলেন? দেশের মানুষ খাইতে পারেনা, তাও শেখের ফুরি আমগোরে ভাতা দেয়। আমরা খুশী আছি।

কার কাছে ক্ষমা চাই!

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

এক লহমা এর ছবি

"গরীব দেশ বাবা, আমগোরে কী দিবো বলেন? দেশের মানুষ খাইতে পারেনা, তাও শেখের ফুরি আমগোরে ভাতা দেয়। আমরা খুশী আছি।" - বুকটা এমন মোচড় দিয়ে ওঠে!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অসাধারণ।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ উদ্যোগ মোরশেদ।
এই প্রকল্প থেকে অনেকগুলো আউটপুট হতে পারে।
স্বাভাবিক ইতিহাস ধরবার প্রচেষ্টাতো আছেই।
শুধু গেরিলা লড়াইগুলোর সাহসী অংশগুলো নিয়ে শিশুদের জন্য আলাদা প্রকাশনা হতে পারে।

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

শান্ত এর ছবি

চমৎকার কাজ মোরশেদ ভাই। চলুক দাস পার্টির খোজ। আমরা অপেক্ষায় রইলাম।

__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত

মুদ্রা সংগ্রাহক এর ছবি

চমৎকার কাজ। আর কিছুদিন পর কোন মুক্তিযোদ্ধা আর জীবিত থাকবেন না। তাই যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাছ থেকে আমাদের জেনে নিতে হবে আগুনঝরা সেই দিনগুলির গল্প।

Shafiul Alam Biplob এর ছবি

Trying to get contact number of Vasan vai. I am from dharmapasha and want to meet with him soon. I didn't able to sleep last night after reading this article. We need to do something for those freedom fighters.

Shafiul Alam Biplob এর ছবি

নিসন্তান মদরিছ দম্পত্তির চালাঘরের অচ্ছ্যুত সংসার। already sent someone to contact with him. I want to hear the story from him and villagers. Can't believe that is happening there, within Bangladesh!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।