মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট তিনটি সেক্টরে বিভক্ত ছিলো। সেক্টর তিন চার ও পাঁচ। উত্তর-পূর্বের জৈন্তাপুর থেকে উত্তর পশ্চিমের তাহিরপুর-ধর্মপাশা পর্যন্ত ছিলো সেক্টর পাঁচ এর বিস্তৃতি। এই সেক্টরের সবচেয়ে পশ্চিমের সাব-সেক্টরটি বড়ছড়া বা টেকেরঘাট সাব-সেক্টর। এটি সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলাধীন টাঙ্গুয়ার হাওরের পাড়ে পশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ের কোলে। এর পরেই ভারতের গারো পাহাড় এবং বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলা- এগারো নম্বর সেক্টরের শুরু।
উলম্বভাবে উত্তর থেকে দক্ষিনে নীচের দিকে নেমে এলে- সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলা( একাংশ), জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলা নিয়ে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে চার নম্বর সেক্টরের জগন্নাথপুর ও নবীগঞ্জ, এগারো নম্বর সেক্টরের খালিয়াজুড়ি উপজেলায় এই সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে যেতে হতো।
এই বিশাল এলাকার পুরোটাই ভাটি অঞ্চল। উত্তরে পাহাড় আর সবদিকেই বিশাল বিশাল হাওড় আর নদী। হাওর এলাকার প্রায় মাঝামাঝি দিরাই উপজেলা। এই দিরাই উপজেলার গচিয়া গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান সালেহ চৌধুরী, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক।
আগষ্ট মাসে অফিসিয়ালি সাব-সেক্টর নির্ধারিত হওয়ার পর মধ্যবর্তী দিরাই এ অবস্থান করে সালেহ চৌধুরী টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের প্রধান সমন্বয়ক এর দায়িত্ব পালন করেন। অন্য সেক্টরগুলোর মতো এখানে মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলো প্লাটুন, কোম্পানী বিন্যস্ত হয়নি। ভাটি অঞ্চলের রনকৌশল হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করা হয়েছিলো। বারো থেকে চল্লিশজনের এক একটা দল হতো। তাহিরপুর, জামালগঞ্জ পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা দল নানা সময়ে আসতো দিরাই সালেহ চৌধুরীর সমন্বয় কেন্দ্রে। এখান থেকে তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হতো পরিকল্পনা মতো নানা অপারেশনে। অপারেশনের পর আবার এখানে ফিরে এসে দলগুলো চলে যেতো সাব-সেক্টর টেকেরঘাট। সমন্বয় কেন্দ্রে বসে সালেহ চৌধুরী অপারেশনরত গ্রুপগুলো ও টেকেরঘাটের মধ্যে যোগাযোগ রাখতেন। প্রথমদিকে মেসেঞ্জার পাঠিয়ে, পরে ওয়ারলেসের মাধ্যমে। কিন্তু আগষ্টের আগে তখনো অফিসিয়ালী সেক্টর কার্যক্রম শুরু হয়নি- প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা আসা শুরু করেনননি , সালেহ চৌধুরী স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুর থানা দখল করে নিয়েছিলেন এবং ভাটি অঞ্চলে রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি আজমিরীগঞ্জ আক্রমন করেছিলেন।
জুন-জুলাই মাসে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর গঠনের পরিকল্পনাকালে ভারতীয় কমিউনিকেশন জোন ওয়ান এর অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরবগ সিং গিল তাকে বলেছিলেন থানা দখল, রাজাকারদের নিস্ক্রিয় করার মতো নিয়মিত কাজের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ কাজ তাকে করতে হবে। সেটি হলো পাকিস্তান আর্মির জন্য নৌ-পথ বন্ধ করে দেয়া। ঢাকা থেকে সিলেটের সড়ক ও রেলপথ গেরিলা কার্যক্রমের জন্য পাকিস্তান আর্মির অস্ত্র, রসদ ও জনবল পরিবহনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। তখন ভৈরব থেকে হবিগঞ্জের শেরপুর হয়ে সিলেট পর্যন্ত স্টিমার চলাচল করতো আবার হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ হয়ে একেবারে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত নদীপথ। এই দুটি পথ হয়ে উঠে পাকিস্তান আর্মির লাইফ লাইন।
সালেহ চৌধুরী জানান- এই কাজের জন্য সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদের বদলে বিশেষ প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদল প্রয়োজন। জেনারেল গিল আশ্বস্ত করেন, মেজর বাথ ও ক্যাপ্টেন বার্মার তত্বাবধানে বিশেষ একটি দলের প্রশিক্ষন চলছে। বাছাই করা সাহসী ও বুদ্ধিমান ছেলেদের দল, নিয়মিত প্রশিক্ষনের বাইরে এদেরকে ভারী অস্ত্র ও নৌযান ধ্বংসের কলাকৌশল শেখানো হচ্ছে।
সদরপুর, জামালগঞ্জ-সাচনার যুদ্ধ শেষ করে এই বিশেষ গেরিলা দলটি দিরাই আসে সালেহ চৌধুরীর কাছে আগষ্টের মাঝামাঝি। এই দলটিই দাস পার্টি , এই দলেরই প্রধান জগতজ্যোতি দাস নামের একুশ বছরের এক তরুন- আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রামে বাড়ি, সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী।
পরবর্তী তিনমাস ধরে এই দলটি ভয়াবহ ত্রাস হয়ে উঠে এই অঞ্চলের পাক আর্মি ও রাজাকারদের কাছে। ‘টেরর দাস’ অদম্য, অপ্রতিরোধ্য। তার মাথার দাম ঘোষনা করা হয় জীবিত অথবা মৃত। সালেহ চৌধুরীর সমন্বয় কেন্দ্রে এই সময়ে আরো অনেকগুলো মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ও আসে, নানা অপারেশন চলতে থাকে। পাশাপাশি দাস পার্টির নৌপথ অভিযান। পাকিস্তান আর্মির রসদবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া, অস্ত্রবাহী লঞ্চ দখল, রাজাকারদের নৌকা উড়িয়ে দেয়া চলতে থাকে নদী ও হাওড়গুলোতে। এক পর্যায়ে পাকিস্তান রেডিও থেকে ঘোষনা আসে ভৈরব টু শেরপুর ও সুনামগঞ্জ নৌ পথ বিপদ সংকুল। সকল নৌ যানকে এই পথ এড়িয়ে যাবার পরামর্শ। সরকার কোন দায়-দায়িত্ব নেবে না।
দাসপার্টির ইতিবৃত্ত সন্ধানে তাই সালেহ চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ। কয়দিন আগে সিলেটে এক অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হিসাবে আসলে পারিবারিক পরিচয় দিয়ে তার কাছে সময় প্রার্থনা করি। তিনিই পরামর্শ দেন ঢাকায় তার বাসায় যাবার জন্য।
তার দেয়া ঠিকানামতো আমরা যখন পৌঁছি বেলা তখন প্রায় সাড়ে দশটা। মুক্তিযুদ্ধকালে বয়স ছিলো ছয়ত্রিশ বছর, সন্তানের জনক হয়েছেন কয়দিন আগে। সেই হিসাবে বর্তমানে সালেহ চৌধুরীর বয়স ঊনআশি বছর। শরীরের দিকে তাকালে বার্ধক্যের চিহ্ন পাওয়া যায়, হাঁটতে অসুবিধা হয় ছড়ি ব্যবহার করেন। অবয়ব ও ভঙ্গিমায় এখনো তেজোদ্দীপ্ত, আভিজাত্য ফুটে উঠে তার শরীরি ভাষায়।
আলাপচারীতার শুরুতেই সালেহ চৌধুরী আমাদেরকে ৫ নং সেক্টর গঠনের ইতিহাস জানান।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকার সাথে সাথে সিলেট শহরে ও পাক আর্মির অপারেশন শুরু হয়। এর আগে সারাদিন সংগ্রাম পরিষদের অবরোধ, মিছিল-মিটিং চলছিলো। সংগ্রাম পরিষদের প্রধান নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের এমএনএ দেওয়ান ফরিদ গাজী। শহরের বালুচর এলাকায় থাকতেন সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ক্যাপ্টেন মুত্তালিব। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী। এই মামলাতেই তিনি বরখাস্ত হন এবং চরম নির্যাতনের শিকার হন। আগরতলা মামলার নির্যাতনের ফলেই মানুষটা ক্ষ্যাপাটে এবং বদরাগী হয়ে উঠেন ,রাজনীতিবিদদের সাথে তার পোষাতোনা। একটা বাইসাইকেলে চড়ে সারাদিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের বুঝিয়েছেন পাকিস্তান আর্মি যে কোন মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমন শুরু করে দিতে হবে।
রাত বারোটার দিকে যখন পাকিস্তান আর্মি শহরে আক্রমন শুরু করে এবং আন্দোলকারী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন তখন ক্যাপ্টেন মুত্তালিব তার পিস্তল নিয়ে একা এসে দাঁড়ান টিলাগড় পয়েন্টে এমসি কলেজের দিকে। বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকে পাকিস্তান আর্মির একটা জীপ। পয়েন্টে এসে জীপটি ডান দিকে মোড় নেয়ার জন্য গতি ধীর করতেই মুত্তালিব সরাসরি গুলী করেন ড্রাইভারের উপর, ড্রাইভার নিয়ন্ত্রন হারালে তার গুলীতে নিহত হয় আরোহী অফিসারটি ও। মুত্তালিব অফিসারের অস্ত্র তুলে নিয়েই উত্তর দিকে সরতে থাকেন।
এদিকে ২৮ মার্চ শহরের পশ্চিম প্রান্তে আখালিয়ায় ইপিআর ২২ নং উইংয়ের সদর দপ্তর ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ২৫ মার্চেই অবাঙ্গালী ইপিআররা পালিয়ে গিয়েছিলো। মোশাররফ হোসেন নামে স্থানীয় একজন বেঙ্গল রেজিমেন্টের নন কমিশন অফিসার ছুটিতে বাড়ী ছিলেন। ২৫ মার্চের পর সিদ্ধান্ত নেন ফিরে যাবেন না। মোশাররফ হোসেন আখালিয়ায় এসে বাঙ্গালী ইপিআরদের সংগঠিত করেন। সালুটিকর এয়ারপোর্টে তখন পাকিস্তান আর্মি তাদের শক্তি সমাবেশ করেছে এবং ক্ষন গননা হচ্ছে যে কোন মুহুর্তে পাক আর্মির আক্রমনের। সন্ধার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়, মাঝরাতে পাক আর্মির সহযোগীতায় ভারী অস্ত্রের আক্রমন শুরু হলে ইপিআর সদস্য পিছু হটতে বাধ্য হন কিন্তু পাকসেনা নিহত হয় তিনজন। এই ইপিআর যোদ্ধারা ও উত্তরের ভারতীয় সীমান্তের দিকে সরতে থাকেন।
এইসময় জাফলং চা বাগানের ব্যবস্থাপক ছিলেন নাজিম কয়েস চৌধুরী। কয়েস চৌধুরী বেসামরিক ব্যক্তিত্ব হলে ও এই এলাকায় তার প্রভাব দুর্দান্ত এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে ও যোগাযোগ ছিলো। কয়েস চৌধুরী তার বাগানের বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের নিয়ে দেশীয় অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সীমান্তে চলে যান এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সরবরাহের আবেদন জানান। ক্যাপ্টেন মুত্তালেব ও এসময় এখানে, জাফলং ফাঁড়ির ইপিআর রা ও যোগ দেন, সিলেট আখালিয়া যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে আসা ইপিআররাও মিলিত হন। তামাবিলে তখন কয়েক হাজার মানুষের সম্মিলন।
এদিকে ২৭ মার্চ সুনামগঞ্জ ঘটে গেছে আরেক প্রতিরোধ যুদ্ধ। সকাল বেলা থেকেই প্রচার হতে থাকে যে কোন সময় সিলেট থেকে চলে আসবে পাক আর্মির দল। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে চলতে থাকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। এর আগেই আনসার ক্লাবের ৫০ টি রাইফেল ও দুই হাজার বুলেট হস্তগত করা হয়েছে। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে পাক আর্মি কনভয়টি এসে থানায় ঘাঁটি গাড়ে। এদিকে পঞ্চাশ জনের মতো তরুন, আনসার এডজুটেন্ট এর নেতৃত্বে আনসার দল, পুলিশ এবং ইপিআররা ও প্রস্তুতি নেয়। নদী পেরিয়ে গ্রাম থেকে আসতে থাকে সাধারন মানুষ দেশী অস্ত্র হাতে। এক পর্যায়ে যুদ্ধ শুরু হয়, শহীদ হন আনসার কমাণ্ডার আবুল হসেন ও রিকশাচালক গণেশ। দুজন পাকসেনা নিহত হয়, ক্যাপ্টেন মাহবুব সহ বাকীরা পালিয়ে যায় সিলেটের দিকে।
হবিগঞ্জ অঞ্চলের দুই এমএনএ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রব ও কমান্ড্যাট মানিক চৌধুরী তখন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হবিগঞ্জেরই সন্তান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের সিনিয়র মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ও তখন ছুটি কাটাতে বাড়িতে।
জেনারেল রব, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ও মেজর চিত্তরঞ্জন পরিকল্পনা করলেন জেলা সদর সিলেট মুক্ত করতে হবে। কিন্তু মাঝখানে বিপত্তি শেরপুর। শেরপুর- সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের সংযোগস্থল। কুশিয়ারা নদীর উপর ফেরী। এই ফেরী পাড়ি দিয়েই সিলেট যেতে হয় আবার ভৈরব থেকে এখানে স্টিমার আসে, এখানে থেকে ভাটি অঞ্চল দিরাই শাল্লা আজমিরীগঞ্জে লঞ্চে যাতায়াত করা যায়। কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব জেনেই শেরপুরে মোতায়েন আছে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুই প্লাটুন সৈন্য, এক কিলোমিতার পর সাদিপুরে আরো এক প্লাটুন। তিন ইঞ্চি মর্টার, মেশিন গান আর চাইনিজ রাইফেলে সজ্জিত তারা।
সিদ্ধান্ত হয় যে কোন মুল্যে শেরপুর, সাদীপুর জয় করে সিলেটের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ইতিমধ্যে সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র জনতার সাথে অস্ত্র হাতে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন থানার পুলিশ এবং সীমান্ত ফাঁড়ির ইপিআররা। দিরাই শাল্লার তরুন এমপিএ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও নৌকা লঞ্চ ভর্তি রসদ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন শেরপুর মুক্ত করার যুদ্ধে। পরিকল্পনা মতো তিনটা গ্রুপ তিনদিকে অবস্থান নেয় পাক আর্মির অজ্ঞাতে। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত’র নির্দেশে ভোররাতে একসাথে আক্রমন শুরু হয়। এলএমজি মর্টারের বিপরীতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। হতচকিত পাকবাহিনীর বিক্ষিপ্ত মর্টারের আঘাতে নিহত হয় অনেক গ্রামবাসী। ৭ ঘন্টা ব্যাপী যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর তিনজন শহীদ হলে ও পাক আর্মির তিন প্লাটুন সৈন্যের প্রায় সকলেই নিহত হয়। শেরপুর, সাদিপুর জয় করে মুক্তিবাহিনী এগুতে থাকে উত্তরের সিলেট শহরের দিকে।
এদিকে উত্তর সীমান্ত থেকে পুর্ব পরিকল্পনামতো একুশ জনের একটা গ্রুপ নিয়ে সিলেট শহরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলেন ক্যাপ্টেন মুত্তালিব। খাদিমের কাছে এসে তিনি চলে গেলেন কয়েকজনকে নিয়ে হাতের ডানে বরজান চাবাগানের ভেতর, তাদের কাছে তিন ইঞ্চি মর্টার। এখান থেকে এয়ারপোর্টে শুরু করলেন শেলিং আর এগারো জনের অবশিষ্ট দলটি চলে গেলো শহরের দিকে। মর্টারের আঘাতে অয়েল ট্যাংকার থেকে গোটা বিমান বন্দর এলাকায় আগুন ছড়িয়ে গেলে অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য শহরের দিক থেকে পাক আর্মি এদিকে ছুটতে থাকে। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব ও দ্রুত শহরে প্রবেশ করেন। প্রধান কয়েকটি পয়েন্টে মেশিন গান স্থাপন করে মুত্তালিব এসে ঢুকেন কারাগারে। তালা খুলে মুক্ত করে দেয়া হয় দুই থেকে আড়াই হাজার রাজবন্দীদের।
শেরপুরের দলটি ও এগিয়ে আসে সুরমা নদীর দক্ষিন পাড় পর্যন্ত।
নয় এপ্রিল থেকে বিমান হামলা শুরু হলে সিলেট শহরের আবার পতন হয়, শেরপুর ও দখল হয়ে যায়, সুনামগঞ্জের ও পতন ঘটে। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব ফিরে যান ডাউকি, কয়েস চৌধুরী আগে থেকেই ঐ অবস্থানে ছিলেন। শেরপুরের পতন ঘটলে বালাট হয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও শিলং এর দিকে চলে আসেন। শরনার্থীর ঢল নামতে থাকে। বালাট শরনার্থী শিবির ও ইয়ুথ ক্যাম্প চালু করেন সুনামগঞ্জের এমএনএ দেওয়ান ওবায়দুর রাজা। ছাতকের বাঁশতলায় সেখানকার এমএনএ আব্দুল হক। সুরঞ্জিত সেন ঘুরতে থাকেন টেকেরঘাট, বালাট, বাঁশতলা, ভোলাগঞ্জ, ডাউকি হয়ে শিলং পর্যন্ত। এদিকে কয়েস চৌধুরী ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সবধরনের যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকেন। মুলতঃ এঁদের কর্মতৎপরতাতেই পাঁচ নম্বর সেক্টর গঠিত হয়। জুলাই মাসে মুজিবনগর সরকার মেজর শওকত আলীকে সেক্টর কমাণ্ডার করে পাঠানোর আগে নাজিম কয়েস চৌধুরীই আনঅফিসিয়ালী সেক্টর সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন। টেকেরঘাট সাব-সেক্টর সরাসরিই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সৃষ্টি। এখানে পাঠানোর মতো সামরিক অফিসারের সংকট থাকায় সেন সাব-সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করেন পরে অক্টোবরের দিকে মেজর মুসলেমউদ্দীন দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এদিকে ক্যাপ্টেন মুত্তালিব ডাউকি- তামাবিল থেকেই দেশের ভেতর যুদ্ধ করতে থাকেন। এর মধ্যে হরিপুর যুদ্ধ অবিস্মরনীয়। জুন মাসে জৈন্তাপুরের যুদ্ধে আহত হলে শিলং এ চিকিৎসা শেষে তাকে বালাট সাব-সেক্টরের দায়িত্বে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ডিসেম্বরের ছয় তারিখে সুনামগঞ্জ শহরে তিনিই প্রবেশ করেন যুদ্ধজয়ী অধিনায়ক হিসেবে।
সালেহ চৌধুরী তাঁর ভরাট কন্ঠে আমাদেরকে শুনাতে থাকেন যুদ্ধদিনের ইতিহাস। আমরা এবার আগ্রহ প্রকাশ করি তার নিজস্ব সম্পৃক্ততার কাহিনী জানতে।
জমিদার পরিবারের সন্তান হলে ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন পরবর্তী ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার আলোচনার দিকে সতর্ক চোখ রাখছিলেন সে সময়ের আর সকলের মতোই। সাংবাদিক হিসেবে পরিস্থিতি বিশ্লেষন করার বুঝার সুযোগ ছিলো আরেকটু বেশী। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সদ্যোজাত সন্তান ও স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে ২৫ মার্চের আগেই।
২৫ মার্চের আতংক ও বিভীষিকায় কাটে আর সব নগরবাসীর মতোই। পরে কারফিউ শিথিল হলে পত্রিকা অফিসে যান বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সম্পাদক তোয়াব খান অনুরোধ করেন থেকে গিয়ে কাজ চালানোর জন্য। সামরিক অধিদপ্তর থেকে নির্দেশ এসেছে পত্রিকা অবশ্যই চালু রাখতে হবে না হলে সম্পাদক সহ সকলকে হত্যা করা হবে। সপ্তাহ দুয়েক পর সম্পাদককে জানান- আর সম্ভব না ঢাকা থাকা, যে করেই হোক বাড়ি যেতে হবে। তোয়াব খান তখন অফিসিয়াল ছুটি মঞ্জুর করেন। সালেহ চৌধুরী ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ হয়ে দিরাই থানার গচিয়া গ্রামে পৌঁছেন পায়ে হেঁটে, বাইসাইকেল, গাড়ী, লঞ্চ চেপে। তখন ২৬শে এপ্রিল ১৯৭১। পরিকল্পনা ছিলো সবার সাথে দেখা করে সীমান্ত পাড়িয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষন নেয়া অথবা মুজিব নগর সরকারের হয়ে সাংবাদিক হিসেবেই দায়িত্ব পালন।
অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই দিরাই-শাল্লা অঞ্চলের সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তরুন সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। কিন্তু শেরপুর যুদ্ধের পর সেন চলে গেছেন উত্তর সীমান্তে, যুদ্ধকে আরো সংগঠিত করার জন্য। দিরাই এ তখন সংগ্রাম কমিটি চালাচ্ছেন ন্যাপ নেতা এডভোকেট আব্দুল লতিফ সর্দার, আওয়ামী লীগের তরুন কর্মী আব্দুল কুদ্দুস ও ডাক বিভাগের কর্মী চান মিয়া। পাকিস্তান আর্মি তখনো আসেনি এদিকে কিন্তু পুলিশ স্টেশনগুলোতে পাকিস্তান পন্থী অফিসাররা আছে, দালালরা দলবদ্ধ হয়ে গেছে, পাকিস্তান আর্মিকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটির বিপরীতে পাকিস্তানপন্থী পিডিপির কার্যক্রম ছিলো এদিকে। গোলাম জিলানী চৌধুরী ( পরবর্তীতে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতা) , খালেকের মতো পিডিপি নেতারা তখন প্রতাপশালী হয়ে উঠছে।
কিছুদিন বাড়িতে থেকে স্থানীয় অবস্থা পর্যবেক্ষন করে সালেহ চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন সীমান্তের দিকে যেতে হবে। মে মাসের মাঝামাঝি বালাট এসে পৌঁছান। বালাট তখন প্রধান শরনার্থী শিবির। হাজারে হাজারে মানুষ এসে জমা হচ্ছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ থেকে। চরম দুর্ভোগ ও অমানবিক পরিস্থিতি, কলেরায় শত শত শরনার্থী মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে থেকে তরুন বাছাই করে করে নানা প্রশিক্ষন শিবিরে পাঠাচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা। এখানে তার সাথে দেখা হয় কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আব্দুল হামিদের সাথে। কিন্তু সালেহ চৌধুরী অপেক্ষা করছিলেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের জন্য। অপেক্ষার দীর্ঘপ্রহর শেষে সুরঞ্জিত সেনের সাথে তার দেখা হলো। সেন এখান থেকে টেকেরঘাট যাবেন, সাথে একজন ভারতীয় ক্যাপ্টেন। সালেহ চৌধুরী সেনের সঙ্গী হলেন। বালাট থেকে পশ্চিমের দিকে তারা টেকেরঘাট গেলেন। টেকেরঘাটে অবস্থান করছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুজ জহুর ও হোসেন বখত।
এখানেই বিস্তারিত আলাপ হয়। সুরঞ্জিত সেন সালেহ চৌধুরীকে বলেন কলকাতায় যেতে চাইলে তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন কিন্তু কিছুদিনের ভেতরই সেক্টর গঠন হবে, যুদ্ধ আরো তীব্র হবে। দেশের ভেতর কারো কারো থাকাটা জরুরী। সেন প্রস্তাব করলেন, সালেহ চৌধুরী এলাকায় ফিরে গেলে তাকে যুদ্ধ সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হবে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগীতা ও নিশ্চিত করা হবে। উপস্থিত অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। সালেহ চৌধুরী আবার ফিরে আসেন নিজের গ্রামে।
মে মাসের শেষদিকে আওয়ামী লীগের কুদ্দুস ও চান মিয়া আসেন তার কাছে, জানান উচ্চপর্যায় থেকে তাদেরকে ও নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার সাথে কাজ করার জন্য। তখন তারা আশু করনীয় নির্ধারনে বসেন। প্রশাসন ভেঙ্গে পড়েছে তখন, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, গ্রামে গ্রামে ডাকাতি ও লুট চলছে। তারা সিদ্ধান্ত দিরাই-শাল্লা দুই থানা মিলে তারা টহল দিবেন, যুদ্ধের পক্ষে জনমত দৃঢ় করবেন এবং তরুনদের সীমান্তের ওপাড়ে পাঠাবেন প্রশিক্ষনের জন্য। এ পর্যায়ে তাদের সঙ্গী হলেন দুজন সাবেক সৈনিক মোঃ ইয়াসিন ও মন্তাজ আলী এবং আনসার কমান্ডার আব্দুল। সুনামগঞ্জ যুদ্ধে লুট করা রাইফেলগুলো থেকে কয়েকটি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো এদিকে সংগ্রাম কমিটির কাছে। এই রাইফেলগুলো এবার হাতে উঠে এলো তাদের। রাইফেল হাতে ছয়জনের দল নৌকা নিয়ে ঘুরতে থাকলেন দুই থানার গ্রামে গ্রামে আর এতেই জনমনে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি হলো, প্রচার হতে লাগলো এলাকায় শত শত মুক্তিযোদ্ধা চলে এসেছে।
চার জুলাই দিরাই সদর থেকে খবর এলো- আগের দিন পুলিশ ইন্সপেক্টর শরাফত উল্লাহর বাসায় দালালদের সভা হয়েছে। পরের বুধবার সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে মিলিটারী নিয়ে আসা হবে। সভা করে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন হবে এবং তালিকা অনুযায়ী দেশদ্রোহীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
দ্রুত তারা ফিরে এলেন গ্রামের বাড়িতে। এদিএক বালাট থেকে আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুর রাজা এমএনএ, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আট/ দশজনের একটা মুক্তিযোদ্ধা দল ওপাঠিয়েছেন। এ ছাড়া মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক তরুন আব্দুল মোতালেব ( আরো পরে যিনি শহীদ হয়েছেন আহসানমারায়) ও সাথে আছেন। সিদ্ধান্ত হলো পরের দিনই দিরাই থানা দখল করে নিতে হবে কিন্তু সাথে সাথে শাল্লা (ঘুঙ্গিয়ার গাঁও) থানা। ভোরবেলা দখল হবে শাল্লা, দুপুরের পর দিরাই।
সেদিন ৫ জুলাই ১৯৭১।
আগের সন্ধ্যাবেলা তারা এসে আশ্রয় নিয়েছেন শাল্লা থেকে দু মেইল আগে হাওরের পাড়ে আঙ্গাউড়া নামে এক গ্রামে। সালেহ চৌধুরী, চাঁন মিয়া, ইয়াসিন, আব্দুল, তালেব এবং রাজ্জাকের নেতৃত্বে বালাট থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের দল। কুদ্দুস থেকে দিরাই, পুলিশের উপর নজর রাখবেন বলে। দুই নৌকায় তার পনেরোজন সশস্ত্র। এই গ্রামে ছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মী শ্রীকান্ত দাস। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির রাতে হাওরের ঢেউয়ের মাঝে পরিকল্পনার ছক কাটা হলো পরের দিনের থানা আক্রমনের।
ভোর ছয়টায় থানা কম্পাউন্ডে ঢুকে গেলো মুক্তিযোদ্ধা দল। ঝড়বৃষ্টির ভোরে পুলিশ বাহিনী ঘুমে। ঘুমন্ত অবস্থাতেই সবাইকে বন্দী করা হলো, অস্ত্র ও গুলাবারুদ নেয়া হলো দখলে। এসময় থানার ওসি কেঁদে আর্জি জানালো কিছু গুলাগুলি করার জন্য, বিনা প্রতিরোধে আত্নসমর্পণের কথা জানলে পাক আর্মি তাদের খুন করে ফেলবে। ওসি অনুরোধে কয়েক রাউন্ড গুলী করা হলো আর আতংকে গ্রামের মানুষ শুরু করলো দৌড়াদৌড়ি।
সালেহ চৌধুরী ওয়ারলেস লাইন কেটে দিয়ে পুলিশদের ছেড়ে দিলেন। তার পর অস্ত্র ও গুলী নৌকায় বুঝাই করে রওয়ানা দিলেন এবার দিরাই’র দিকে।
এদিকে সেই ওসি ওয়ারলেস লাইন ঠিক করে দিরাই থানায় জানিয়ে দিলো সব ঘটনা আর নিজে তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে পিছিয়ে আজমিরীগঞ্জে গিয়ে যোগ দিলো রাজাকারদের সাথে।
তিনটার দিকে দিরাই থানায় আক্রমন হলো। সালেহ চৌধুরী নৌকায় থেকে গিয়েছিলেন দখল করা অস্ত্রের কাছে, ভেবেছিলেন শাল্লার মতোই নির্ঝঞ্জাট হবে দিরাই দখল। কিন্তু একটু পরেই শুনলেইন গুলীর শব্দ। গুলীর শব্দ শুনে দৌড়ে গেলেন থানা কম্পাউন্ডে, একটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে।
শাল্লা থেকে ওয়ারল্যাসে থানা লুটের সংবাদ শুনে পুলিশ ইন্সপেক্টর শরাফত উল্লাহ করনীয় নির্ধারনে ডেকে এনেছিলো অন্য থানায় কর্মরত দিরাইর স্থানীয় আরেক পুলিশ কর্মকর্তা আব্দু রাজ্জাককে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নির্দেশ ছিলো বাধা দিলে শরাফত উল্লাহকে খতম করে দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা কম্পাউন্ডে প্রবেশ করা মাত্রই আব্দুর রাজ্জাক লাফিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে, তার হাতে ছিলো লাইটার। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিলেন সে রিভলবার বের করেছে। এ ছাড়া এখানে গুলীতে নিহত হয় আগের রাতে ওসি হিসাবে যোগ দেয়া আরেকজন।
এই থানা থেকে ও সব রাইফেল ও গোলাবারুদ নৌকায় তোলা হয়। সালেহ চৌধুরী তার স্থানীয় সহযোদ্ধাদের নিয়ে থেকে যান দিরাই আর দুই থানার অস্ত্র বোঝাই নৌকা নিয়ে বালাট ফিরে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের দল। ছাত্রনেতা তালেব ও চলে যান বালাট, আর ফিরে আসেননি।
জনগনকে আস্বস্ত করা ও শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার জন্য সালেহ চৌধুরী ও আব্দুল কুদ্দুস দিরাই শাল্লার সর্বত্র ছুটে বেড়াতে থাকেন।
এরপর সুরঞ্জিত সেনের কাছ থেকে খবর আসে যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর গঠিত হয়েছে, এই এলাকা টেকেরঘাটের সাথেই থাকবে। এখন থেকে নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের দল আসতে থাকবে। তখন পর্যন্ত কোন সেনা কর্মকর্তা না পাওয়ায় সুরঞ্জিত নিজেই সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ভারতীয় পক্ষ থেকে উপদেষ্টা ছিলেন মেজর বাথ ও ক্যাপ্টেন বার্মা। সালেহ চৌধুরী ও গেলেন টেকেরঘাট। এসময়ই জেনারেল গিল এর সাথে নদীপথ দখল নিয়ে তার কথা হয়।
তাদের পক্ষ থেকে এবার দায়িত্ব দেয়া হলো জগন্নাথপুর থানা দখল ও জয়কলস রাজাকার ঘাঁটি উৎখাত।
জয়কলসে সাত্তারের নেতৃত্বে শক্তিশালী একটা রাজাকার বাহিনী গড়ে উঠেছে, এরা সিলেট সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ফেরি ও ব্রীজ পাহারা দেয়, মন্দির লুট এবং হিন্দুদের উৎপীড়ন করে এ ছাড়া শরনার্থী নৌকা আটকে লুটতরাজ করে।
জয়কলস আক্রমনের জন্য কাছাকাছি গ্রাম ডুমুরিয়া রেকি করে আসলে ও টেকেরঘাট থেকে জানিয়ে দেয়া হয় জয়কলস বালাট সাব-সেক্টর এর আওতায় পড়েছে। বালাট থেকেই এখানে আক্রমন হবে।
জগন্নাথপুর থানা আক্রমনের তারিখ নির্ধারিত হয় ২০ জুলাই। ভাটিপাড়ার মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা তখন এসেছেন সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে। কুদ্দুস মিয়া চলে যান জগন্নাথপুর এলাকা রেকি করে আসার জন্য।
জগ্ননাথপুর থানা ও আক্রমন করা হয় ভোরেবেলা। এখানে ও বিনা রক্তপাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করা হয়। বাকী পুলিশদের ছেড়ে দিলে ও থানার ওসিকে বন্দী করা হয় আর বন্দী করা ব্যাংক ম্যানেজারকে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ এই ব্যাংক ম্যানেজার মানুষজনকে বাধ্য করছিলো পাকিস্তানের পতাকা উড়াতে। পরিকল্পনা করা হয়েছিলো হাওরে গিয়ে খতম করে ফেলা কিন্তু তার কান্না আর কাকুতি মিনতিতে ছেড়ে দেয়া। ছেড়ে দেয়ার পর এই লোক ব্যাংকের ভল্ট থেকে সব টাকা নিয়ে গিয়ে সিলেট হেড অফিসে জমা দিয়ে সরকারী পদক পেয়েছিলো যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই। আর থানার ওসিকে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে দাপ্তরিক কাজে লাগানো হয়েছিলো।
জগন্নাথপুর থানা থেকে দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা চলে যান টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে। তখন পর্যন্ত সালেহ চৌধুরী হাতে ছড়ি আর কোমরে ছুরি রাখতেন। কিন্তু সেবার টেকেরঘাটে গেলে মেজর বাথ তাকে স্টেনগান দেন। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র সমর্পণ পর্যন্ত এই স্টেনগানটি তার সঙ্গী ছিলো।
এবার টেকেরঘাট থেকে ফিরে এসে বড় অপারেশন আজমিরীগঞ্জ। আজিমিরীগঞ্জ ভাটি অঞ্চলের প্রধান বন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র। সিরাজ মিয়ার নেতৃত্বে দুই শতাধিক রাজাকারের বিশাল বাহিনী। এরা রীতিমত পোষ্ট বসিয়ে প্রতিটি নৌকা চেক করে, পর্যবেক্ষন টাওয়ার বানিয়ে সেখান থেকে হাওর ও নদীপথে চোখ রাখে আর ভৈরব থেকে প্রতি সন্ধ্যাবেলা স্টিমার ভর্তি হয়ে পাক আর্মি আসে এদিকে টহলে, রাতে অবস্থান করে ভোরবেলা চলে যায়। আজমিরীগঞ্জ দখলে রাখার মতো তখনো অবস্থা তৈরী হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের। সিদ্ধান্ত হয় হাটবারে তড়িৎ আক্রমন করে রাজাকারদের ভড়কে দিতে হবে এবং পাকিস্তান আর্মির স্টিমার এসে পৌঁছার আগেই নিরাপদে ফিরে আসতে হবে। এ জন্য বানিয়াচঙ্গের নজরুল, ভাটিপাড়ার নজরুল ও আওয়ামী লীগ নেতা রমেশ পান্ডের নেতৃত্বে ত্রিশজনের তিনটা দল এসে উপস্থিত হয় দিরাই।
ভাটি অঞ্চলে বাজারে বাজারে পণ্য বিক্রী করার জন্য একও ধরনের বড় নৌকা থাকে। এরকম একটা নৌকা জোগাড় করা হয় এবং মুক্ত এলাকায় শাল্লায় আক্রমনের রিহার্সাল ও দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় এলএমজি হাতে একদল যাবে থানায়, একদল বাজারে রাজাকারদের ডিউটি এরিয়ায় আরেকদল রাজাকার সিরাজের বাড়িতে আর সালেহ চৌধুরী থাকবেন নৌকায়। আক্রমনের সমোয় বিকাল ঠিক চারটা।
৮ আগষ্ট শাল্লা থেকে রওয়ানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দল আজমিরীগঞ্জ বাজারে গিয়ে পৌঁছে ঠিক চারটায় কোন বিপত্তি ছাড়াই। যদিও তার কথা ছিলো নৌকায় থাকায় কিন্তু অপারেশনের উত্তেজনায় স্টেনগান হাতে সালেহ চৌধুরীই লাফিয়ে নামেন সবার আগে। তিনটি গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা ও লাফিয়ে নেমে তিনদিকে দৌড় দেন। পর্যবেক্ষন টাওয়ার থেকে রাজাকাররা দেখতে পেয়ে গুলী ছুড়লে ও মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজির আওয়াজ শুনে থানার পুলিশ ও রাজাকাররা পালাতে থাকে হাতের অস্ত্র নদীতে ফেলে। স্থানীয় মানুষদের সহযোগীতায় সব অস্ত্র নদী থেকে তোলা হয়, থানা থেকে গুলী। সার্কেল অফিসারকে বন্দী করা হয় আর স্থানীয় মানুষদের সহযোগীতায় বাড়ি বাড়ি তল্লাশী দিয়ে বন্দী করা হয় চার রাজাকারকে। সার্কেল অফিসারকে পড়ে ছেড়ে দিলে ও রাজাকারদের খতম করে ভাসিয়ে দেয়া হয় হাওরে।
দ্রুত অপারেশন শেষ করে যখন তারা নদীপথ পেরিয়ে হাওরে চলে যাচ্ছেন তখন পেছনে দেখা যাচ্ছে ভৈরব থেকে আসা পাক আর্মি ভর্তি স্টিমার। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দল নিরাপদেই ফিরে আসেন তাদের আস্তানায়।
৫ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী তার গ্রন্থ ‘The Witness’ এ ছোট্ট করে আজমিরীগঞ্জ অপারেশনের কথা উল্লেখ করছেন।
সালেহ চৌধুরীর কাছ থেকে একাত্তুরের গল্প শুনতে শুনতে পেরিয়ে গেছে ঘন্টা চারেক যদিও মাত্র আগষ্ট মাসের শুরু- বাকী রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু, দাস পার্টির পুরোটাই। কিন্তু প্রৌঢ় যোদ্ধা ক্লান্ত একটানা বলতে বলতে যদি ও তাঁর স্মৃতিশক্তি অসামান্য।
আবার আসবো, আবার আমাদেরকে সময় দিতে হবে- কথা আদায় করে যখন বের হয়ে আসি, দুপুর গড়িয়ে গেছে তখন।
মন্তব্য
অসাধারণ বললে কিছুই বলা হয়না। এত শ্রমে আর প্রেমে লেখাটির আকার দেখে ভেবেছিলাম আজ অর্ধেকটা পড়ি, কাল না হয় বাকিটা... এর মাঝে শুরু হয়ে গেল সালেহ চৌধুরীর কথা, শীঘ্রই আবার আপনাদের দেখা হোক উনার সাথে।
পড়তে পড়তে মনে হল একটা মানচিত্র থাকত আর কিছু সাবহেডিং!
ম্যাপ বানানোর চেষ্টা করছি, সময়ের অভাবে পারছি না পুরোপুরি শেষ করতে।
আলাদা পোস্ট হিসেবেই দিবো, যেটা লাগবে কপি করে যুক্ত করে দেবেন।
অদক্ষ হাতে একটি ম্যাপ যোগ করে দিলাম। এটি টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের যোদ্ধাদের ওয়ার এরিয়া
দক্ষ হাতে আরো কিছু ম্যাপ লাগবে। দাস পার্টির যুদ্ধের জায়গা গুলো। এ ছাড়া ভৈরব থেকে নদীপথ এইসব।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
মোরশেদ ভাই, প্রথমটি পড়ার পর এটির জন্যে প্রতীক্ষায় ছিলাম। শুধুতো লেখা নয়, এটি একটি বিশাল কর্ম। শুভকামনা রইল। আর বই আকারে যেদিন সম্পূর্ণ রচনা একত্রে পাবো, সেদিন প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হবে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ব্লগের জন্য ভাষা ঠিক আছে, বইয়ের জন্য ঠিক নাই। বইয়ের ভাষা হতে হবে পাঠ্যপুস্তকে যেমন নৈর্ব্যক্তিক হয় তেমন। আপনি যা কিছু করলেন সেটা পূর্বকথন বা পরিশিষ্টে যোগ করবেন। আর বাকি যা যা কিছু বলার সেগুলো আগেই আপনাকে জানিয়েছি।
আপনার কাজ চলুক, লেখা চলুক। পরের পর্ব কবে পোস্ট করতে পারবেন সেটা নিয়ে ভাববেন না। কাজ শেষ হওয়াটা প্রায়োরিটি।
সকল শুভ কামনা থাকলো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হ্যাঁ। এই মুহুর্তে অগ্রীম কিছুই ভাবছিনা। লিখে যাওয়াটাকে প্রাধান্য দিচ্ছি।
তবে এখনই গুচিহিয়ে লিখতে পারলে মনে হয় ভালোই হতো।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
এখন লিখে যান, পরে বই আকারে করার সময় এখান থেকে বাহুল্যগুলোকে সরিয়ে দিলেই হবে। আমরা মূল ঘটনার পেছনের ঘটনাগুলোও জানি, ইতিহাসের খোঁজে কাজ করা একজন মানুষের পথের সব অভিজ্ঞতা শুনি। যেগুলো হয়তো একদিন আমাদেরও কেউ সাহস দিবে এমন কাজ করতে।
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
এই বয়সেও তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি মুগ্ধ করেছে। প্রতিটি ঘটনা, নাম, তারিখ এতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে রেখেছেন!
সালেহ চৌধুরীর একটা আত্মজীবনী হলে খুব ভালো হতো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভালো লেগেছে। ইতিহাসভিত্তিক বইয়ের ভাষা কেমন হবে সেটা সব সময় সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে এমন ধারণা থেকে আমাদের সরে আসার সময় হয়েছে। টিকা না টিকার ব্যাপারটা ভাষার থেকে উপাদান ভিত্তিক আমার তাই মনে হয়। লেখক কে ধন্যবাদ।
এই লেখাগুলো ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। লিখতে থাকুন। তথ্য ঠিক থাকলে আর কিছু দরকার নাই। বই বের করার সময় হলে গোছানো যাবে।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
আগরতলা মামলা খ্যাত মেজর (অবঃ) এম. এ. মুত্তালিব আমার নানা ছিলেন। যাকে এখানে ক্যাপ্টেন মুত্তালিব বলা হয়েছে। তিনি আগরতলা মামলার ২৫ নং আসামি ছিলেন।
নতুন মন্তব্য করুন