দাসপার্টিকে জানার জন্য, জগতজ্যোতি দাসকে বুঝার জন্য ইলিয়াসকে খুঁজে পাওয়ার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু ইলিয়াসের খোঁজ আমি পাইনা। সালেহ চৌধুরী জানেন না, সুনামগঞ্জে খোঁজ করে ও পাইনা। শুধু একটা সূত্র পাই যে, আনসার ভিডিপির উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসাবে অবসর নিয়েছেন নেত্রকোনা থেকে। আনসার ভিডিপির এক উর্ধতন কর্মকর্তাকে ধরে অফিসিয়ালী তল্লাশি চালিয়ে ও ইলিয়াসের খোঁজ পাইনা।
হঠাৎ করেই একটা বিকল্প ভাবনা এলো। জেলাওয়ারী সরকারী ওয়েবসাইটে প্রতিটি উপজেলা ও তার অন্তর্গত ইউনিয়ন সমুহের চেয়ারম্যানের নাম ও ফোন নম্বর দেয়া আছে। জেনেছিলাম আগে ইলিয়াসের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকৈলছেও ইউনিয়নে। ওয়েবসাইট থেকে নাম্বার নিয়ে ফোণ করি সেই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল হক ভূঁইয়াকে।, বিধি বাম- যিনি ফোণ রিসিভ করেন তিনি জানান এটি শ্রীমঙ্গলের কারো নাম্বার। এবার ওয়েবসাইট থেকেই নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দেই বদলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুসেঞ্জিত চৌধুরীর কাছে। বদলপুরেই খৈয়াগোপির বিল যেখানে জগতজ্যোতি শহীদ হয়েছিলেন। এবার কপাল ভালো, নাম্বারটি চেয়ারম্যানেরই। তাকে বিস্তারিত বলি। তিনি না জানলে ও ফোন হস্তান্তর করেন তার পাশে থাকা আরেকজনকে- ইনি মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী। দাসপার্টির নয়, অন্য গ্রুপের। কিন্তু ইলিয়াসকে ভালোভাবেই চেনেন। আমাকে জানান- পরে ফোন দিয়ে ইলিয়াসের খোঁজ দেবেন।
দশ মিনিটের ভেতরই তিনি ফোন দেন আবার। এবার ইলিয়াসের নাম্বার সহ। শুধু ইলিয়াস নয়- আব্দুর রশিদ নামে দাসপার্টির আরেক যোদ্ধার নাম্বার ও পেয়ে যাই যিনি আবার জ্যোতির ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আপাততঃ আমার প্রধান গন্তব্য ইলিয়াস। নাম্বার পেয়েই তাকে ফোন দেই। ভরাট কন্ঠের ইলিয়াস নিজের পরিচয় দেন। তিনি এখনো আনসার ভিডিপিতেই আছেন। অবসর নিতে আরো একবছর বাকী, হবিগঞ্জ শহরে থাকেন।
আমি ছোট্ট করে আমার উদ্দেশ্য বলি। বুঝিয়ে বলি তার সাথে দেখা হওয়া কেনো এতো জরুরী। শুধু দেখা না, আমি তার কাছে সময় চাই- তাকে নিয়ে যেতে চাই জলসূখা গ্রামে যেখানে জগতজ্যোতির জন্ম ও বেড়ে উঠা, খৈয়াগোপির বিলে যেখানে শেষ যুদ্ধ হয়েছিলো তাদের, পাহাড়পুর- কয়েকশো লুটেরাকে যেখানে তারা প্রতিহত করেছিলেন এবং আরো যদি কোন জায়গা থাকে তাদের যুদ্ধের স্মৃতিবাহী। এ ছাড়া ও যেতে চাই মাকালকান্দি নামের বানিয়াচংয়ের একটা গ্রামে যেখানে একদিনে ৭৯ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়াও যদি সময় করতে পারি সাড়ে চারশো বছরের পুরনো বৈষ্ণব সাধকদের আখড়া বিথঙ্গল ও যেতে চাই।
মাঝে আরো দুএকবার ফোনে কথা বলে আমরা তারিখ ঠিক করি ১৮ জুন। আমি যাবো সিলেট থেকে, ঢাকা থেকে আসবে নজরুল ইসলাম এবং অনিন্দ্য রহমান। এবার আমাদের সাথে ভালো ক্যামেরা থাকবে, পুরো ট্যুর ভিডিওফিকেশন হবে। প্রথম দিন হবিগঞ্জ শহরে ইলিয়াসের সাথে আলাপচারীতা, পরের দুইদিন তাকে নিয়ে পরিকল্পনামতো ঘুরাঘুরি। কিন্তু শেষ মুহুর্তে অনিন্দ্য অন্য কাজে আটকে গেলে তার বদলে তানিম নামে এক তরুন যোগ দেয়ার পরিকল্পনা, তানিম সিনেমা বানান।
নজরুল ও তানিম সকাল সাড়ে আটটার বাসে ঢাকা থেকে, আমি পৌঁনে এগারোটার বাসে সিলেট থেকে। সাড়ে বারোটায় শায়েস্তাগঞ্জে আমাদের দেখা হবার কথা। আমি সময়মতো পৌঁছে গেলে ও নজরুলদের ঘন্টাখানেক দেরি হয়। ঝকঝকে উজ্জ্বল রোদেলা দিন। ওরা আসার পর শায়েস্তাগঞ্জ থেকে সিএনজি নিয়ে আড়াইটার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই হবিগঞ্জ শহরে। শহরের ভেতরে এখনো পুরনো দিনের ছিমছাম ভাবের কিছুটা ছোঁয়া রয়ে গেছে। আমিরচাঁন কমপ্লেক্স নামে একটা আধুনিক বিপনী বিতানের উপরে বেশ ভালো একটা হোটেলে আমরা রুম নেই। টিভিতে তখন বাংলাদেশ-ভারত ওয়ানডে সিরিজের প্রথম খেলা শুরু হয়ে গেছে। খেলায় চোখ রাখতে রাখতে দ্রুত গোসল করে নিয়ে ইলিয়াসকে ফোন দেই, কথা ছিলো তাই।
ইলিয়াস জানালেন সকালবেলা একটা জরুরী কাজে তাকে আজমিরীগঞ্জ যেতে হয়েছে, আমরা পৌঁছানোর আগেই তার ফিরে আসার কথা ছিলো কিন্তু এখনো ফিরতে পারেননি। আমরা তার অপেক্ষা করতে পারি অথবা আজমিরীগঞ্জ চলে যেতে পারি- সেখানে তার সাথে দেখা হবে।
নজরুল ও তানিমের সাথে আলাপ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেই- আমরা বরং এগিয়ে যাবো। হোটেল রুম ছেড়ে দিয়ে টপফ্লোরের রেস্টুরেন্টে তাড়াহুড়ো করে কিছু খেয়ে নিয়ে আসি আমরা খোয়াই ব্রীজ পেরিয়ে সিএঞ্জি স্টেশনে। এখান থেকে সিএনজি ভাড়া করে বানিয়াচং আদর্শবাজারের ঘাটে। হবিগঞ্জ শহর পেরুনোর পরই দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। দুপাশে হাওড় ও বিল। ঝকঝকে আকাশে সাদামেঘ, হাওড়ের পানিতে সেই মেঘের ছায়া। রাস্তাটা কোথাও ভালো, কোথাও ভাঙ্গা, দু পাশে প্রচুর গাছ। একবার সিএনজি থামিয়ে ছবি তুলি। বানিয়াচং আদর্শ বাজার যখন পৌঁছি বিকেল সাড়ে পাঁচটা প্রায়। হাতে সময় থাকলে বানিয়াচং ঘুরা যেতো। এটি নাকি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্রাম। একটা গ্রাম নিয়েই চারটি ইউনিয়ন এবং একটি উপজেলা। প্রাচীন লাউড়ের রাজধানী উত্তরের তাহিরপুরের লাউড়েরগড় থেকে এখানে স্থানান্তরিত হয়েছিলো মোগল আমলে। সেই আমলের বানানো মসজিদ, কমলা রানীর দীঘি, রাজবাড়ি এসব দেখতে পর্যটকরা আসেন বানিয়াচং। কিন্তু আপাততঃ আমাদের সময় নেই। রাত নামার আগে আজমিরীগঞ্জ পৌঁছাতে হবে। নজরুল ও তানিম ঢাকার মানুষ, যদি ও আমি সিলেটী কিন্তু এই এলাকায় আগে আসা হয়নি।
নয়শো টাকায় ট্রলার রিজার্ভ করি আমরা। বুঝি এটা অনেক বেশী কিন্তু কিচ্ছু করার নেই সেই মুহুর্তে, আর কেউ যাবেনা।
যাত্রা শুরু হয় আমাদের আজমিরীগঞ্জের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভার জানালেন দুঘন্টা লাগবে। আমরা ট্রলারের উপরে উঠে বসি। প্রথমে ছোট নদী তারপর আদিগন্ত হাওর। খোলা বাতাসে ঘুম আসতে চায়। বিকেল যতো ফুরাতে থাকে আদিগন্ত হাওরে ততোই অস্তমান সূর্যের আলো রঙ ছড়ায়। রঙধনু ও দেখি। এতো আলো , এতো বর্ণচ্ছটা- অভূতপূর্ব। ছোট ছোট নৌকায় মানুষেরা ঘরে ফিরছে, ফিরছে হাঁসদের পাল। প্রায় অন্ধকারে হাওরের মাঝখানে একটা ঈদগাঁ দেখি। ট্রলারের মাঝিকে জিজ্ঞেস করি- কোন গ্রাম? জবাব দেয়- জলসূখা।
আহ জলসূখা! জগতজ্যোতির গ্রাম। এই গ্রামে আমাদেরকে আসতে হবে। জলসূখা পেরিয়ে সম্ভবতঃ আরো আধা ঘন্টার মতো। আজমিরীগঞ্জের নগরঘাটে যখন আমরা ট্রলার থেকে তখন অন্ধকার হয়ে গেছে, তেমন কিছু আর দৃশ্যমান নয়। কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা হতবাক হয়ে পড়ি। আকাশের রঙ কালো নয়, ঘন নীল। সেই ঘননীল উদার আকাশে এক দুই হাজার নয় লক্ষ লক্ষ তারা উঠেছে। চাঁদ এতো কাছে, আরো কাছে সন্ধ্যাতারা। এমন দৃশ্য এক জীবনে খুব বেশী দেখার নয়।
আমরা এই দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকি দীর্ঘক্ষন। আমার মোবাইলে ফোন আসে অচেনা নাম্বার থেকে। ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াসের ভাতিজা’ পরিচয় দিয়ে একজন বলেন- এইখানে দাঁড়িয়ে থাকতে, গাড়ী নিয়ে তিনি আসছেন আমাদের নিতে। আমরা দাঁড়িয়ে থাকি সেই তারাজ্বলা সন্ধ্যার অসামান্য বিস্ময়ে। এর মধ্যে দু চার জন কৌতুহলী এসে বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করেন, আমরা এড়িয়ে যাই। আরো পরে, অন্ধকার আরো ঘনালে, আকাশে লক্ষ লক্ষ তারার সাথে আরো অসংখ্য তারা জ্বলে উঠার পর- এক তরুন এসে আমাদেরকে তার পরিচয় দেন- ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াসের ভাতিজা আমি’। ব্যাটারী চালিত টমটমে করে এবার আমরা যাত্রা শুরু করি কাকেলছেও গ্রামে। অসংখ্য অসংখ্য তারা জ্বলা আকশের নীচ দিয়ে আমাদের টমটম এগোতে থাকে ঘন অন্ধকারে। রাস্তা কাঁচা। একবার আমাদেরকে নামতে হয়, আটকে গেছে কাঁদায়। ধাক্কা দিয়ে টমটমকে তুলে আমরা পায়ে হেঁটে এগুতে থাকি। এমন বিশাল খোলা আকাশ, অজস্র জ্বলন্ত নক্ষত্ররাজির অতুলনীয় প্যানারোমা আমাদের নাগরিক অভিজ্ঞতার অধিক। একসময় বুঝতে পারি কাকেলছেও বাজারের ভেতর দিয়ে চলছে টমটম। কিছুক্ষন পর আমাদের থামতে হয়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি – পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ থাকলে ও বিকেল থেকে বিদ্যুৎ নেই, কখন আসবে কেউ জানেনা। ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে অন্ধকারের আমরা আমাদের গাইডকে ফলো করি, এই বাড়ির সামনে দিয়ে ঐ বাড়ির পিছন দিয়ে একটা পাকা দালানের ভেতর আমরা প্রবেশ করি। মোমের আলো জ্বলছে একটা ঘরে। মেঝেতে শুয়ে ছিলেন কেউ, আমাদের প্রবেশের সাথে সাথে উঠে দাড়ান- গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, দীর্ঘাকৃতির নয় কিন্তু পেটানো শরীর। ভালো করে তখনো তার মুখ দেখতে পাইনা। হাত বাড়িয়ে দেন ‘ আমি ইলিয়াস’
এই বাড়িটা ইলিয়াসের নয়। পাকা বাড়ি, টাইলসের মেঝে, আলাদা বাথরুম এবং মোটরের পানি- যদি ও বিদ্যুৎ অনুপস্থিত কয়েকঘন্টা ধরে। তার বাড়ি এই গ্রামেরই অন্য পাড়ায়। এই বাড়ি তার এক আত্মীয়ের। ধারনা করি তার নিজের বাড়ির চেয়ে এই বাড়িটা উন্নত বলেই আমাদেরকে এখানে রাখার বন্দোবস্ত হয়েছে। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সাথে ও দেখা হয়। আমাদেরই সমবয়সী হবেন, মাথায় টুপি ও মুখে দাড়িতে অবশ্য তাকে বয়স্ক লাগে। গল্প করেন- ৯০ এর এরশাদ পতনের পর তার আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে আজমিরীগঞ্জ বাজারে মিছিল হয়েছিলো , তিনি তখন স্কুলে পড়েন। পেশায় স্বর্ণকার, স্থানীয় বাজারে নিজের সোনার দোকান আছে। কয়েক ভাই বাহরাইনে থাকেন- একই পেশায়। ৯৬ এ শেখ হাসিনা এখানে এলে নিজে ডিজাইন করে একভরি ওজনের সোনার নৌকা উপহার দিয়েছিলেন।
আমরা শরবত খেতে খেতে তার গল্প শুনতে থাকি। স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নুরুল হক ভুঁইয়ার সাথে তার সম্পর্ক সুবিধার না। প্রায়ই বিভিন্ন মামলার ঝামেলায় তাকে পড়তে হয়। ইলিয়াস ও জানান তাকে ২৮ টি মামলা লড়তে হয়েছে এই চেয়ারম্যানের সাথে। চেয়ারম্যান ভুঁইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং তার ছোটভাই মিজবাহ উদ্দীন ভুইঁয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
আলো আসার কোন সম্ভাবনা নেই, আমরা তিনজনই গোসল করে সারাদিনের ভ্রমনজনিত ক্লান্তি কাটানোর চেষ্টা করি। ভ্যাপসা গরম লাগে তবু। আমরা সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির উপর ছাদে গিয়ে বসি। আমরা তিনজন এবং ইলিয়াস- এবং আরো কয়েকজন নানা বয়সের। মাথার উপর চূর্ণ হীরের উৎসব, হালকা মৃদু বাতাস।
কথা শুরু করি তার সাথে।
-‘ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে কী করতেন, কেন এবং কীভাবে যুদ্ধে গেলেন? ‘
ছিলেন স্থানীয় স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। তিনি এবং তার চাচাতো ভাই বদিউজ্জামান। স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি ছিলো, ইউনিয়ন পর্যায়ে ও সংগঠন ছিলো। দুভাই সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ৭০ এর নির্বাচনে দুজনেই খুব খেটেছেন। স্মৃতিচারন করেন ইলিয়াস। বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল হক ভুঁইয়া তখনো চেয়ারম্যান ছিলেন। বদিউজ্জামানের গলা থেকে নৌকা প্রতীক টান মেরে ছিড়ে ফেলেছিলেন। আওয়ামী লীগের বিরোধী ছিলেন তখন, এখন প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গনহত্যা শুরু হলে ২৬ তারিখেই তারা জানতে পারেন। পরের দিন কিংবা এর পরের দিন ইউনিয়নের সব কিশোর তরুনদের জরুরী সভা ডাকা হয়। যেহেতু তখন ভৈরব থেকে আজমিরীগঞ্জ, শেরপুর নৌপথ চালু ছিলো এবং কাকেলছেও গ্রাম এই পথেই, এই গ্রাম হিন্দু প্রধান এবং আওয়ামী লীগের ঘাঁটি তাই সহজেই পাকিস্তানীদের টার্গেট হবে। জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত নেন তরুনেরা হাওর পাড়ি দিয়ে তারা উত্তরের ভারতীয় সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাবে এবং যুদ্ধ করবে। এই তরুনদের মধ্যে চেয়ারম্যান এর ভাই মিজবাহ উদ্দীন ভুঁইয়া ও ছিলেন। কিন্তু পরদিন সকালে রওয়ানা দেবার সময় দেখা গেলো- ইলিয়াস ও তার ভাই বদিউজ্জামান ছাড়া আর কেউই নেই। যদিও পরে এই গ্রামের আরো কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু চেয়ারম্যানের ভাই যিনি বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি আর যাননি যুদ্ধে।
সেই সকালবেলা তারা দুভাই- আঠারো উনিশবছরের তরুন বেরিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে যাবার জন্য যদিও তারা জানতেন না কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন। এক কাঠ ব্যবসায়ীর নৌকা করে তারা দিরাই আসেন, দিরাই থেকে পরে সুনামগঞ্জ হয়ে বালাট সীমান্তে পৌছেন। বালাট তখন এই অঞ্চলের কয়েক লক্ষ শরনার্থীর আশ্রয়কেন্দ্র। এপ্রিলের মাঝামাঝি সেই সময়ে চরম দুরবস্থা, কোন নেতৃত্ব নেই, সিদ্ধান্ত নেই, যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক তরুনেরা ভীড় করেছে কিন্তু কোন দিকনির্দেশনা নেই।
এরমধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ কলেরার প্রাদুর্ভাব।একদিকে হাজার হাজার শরনার্থী এসে ভীড় করছে আরেকদিকে শতশত শরনার্থী মরছে প্রতিদিন কলেরায়। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এবং বিরোধীদলের একমাত্র নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও উপস্থিত এখানে কিন্তু পরিস্থিতি তাদের ও নিয়ন্ত্রনে না।
এই বিপদের মধ্যে আরেক উপদ্রব খাসিয়া জনগোষ্ঠী। ভারতিয় সীমান্তের ভেতর মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্যে বালাট। এগুলো খাসিয়াদের জায়গা, রাজনৈতিক কারনে এরা ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী। শরনার্থী হিসেবে কয়েক লাখ বাঙ্গালী এদের চক্ষু শুল। প্রায়ই এসে তারা হুমকী ধামকী মারামারি করে। অসহায় শরনার্থীদের কাছ থেকে মদ খাওয়ার জন্য টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
শরনার্থী হিসাবে আসা এক তরুন এর প্রতিবাদ করে। সে আরো কয়েকজন তরুনকে নিয়ে একটা দল গঠন করে। খাসিয়ারা শিবিরে আক্রমন করলে এরা পালটা আক্রমন করে কয়েকজনকে ধরে ফেলে এবং পাহাড়ি নদীর চড়ে এনে চরম শাস্তি দেয়। এই ঘটনার পর আর কোনদিন খাসিয়াদের পক্ষ থেকে বাঙ্গালী শরনার্থীদের ভোগান্তি হয়নি।
প্রতিবাদী সেই তরুনটি ইলিয়াসের চেয়ে বয়সে দুতিন বছরের বড়, আগের পরিচয় ছিলোনা যদি ও একই এলাকার। এই তরুনটি জগতজ্যোতি দাস। একই থানা আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রামে বাড়ি। জলসুখা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করার পর দুবছর আসামে পড়ালেখা করে বাড়ি ফিরে স্কুলে শিক্ষকতা ও করেছে। এরপরে চলে এসেছে সুনামগঞ্জ কলেজে ডিগ্রী পড়তে, ইংলিশ ও হিন্দী ভাষায় তার অনবদ্য দক্ষতা। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত। বন্ধুদের কাছে দুর্দান্ত সাহসী বলে পরিচিত। ২৭ মার্চের সুনামগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধে সে অংশ নিয়েছে এবং ট্রেজারী ভেঙ্গে রাইফেল লুট করে নিয়েছে।
সহজাত নেতৃত্বগুনে জগতজ্যোতি দাস যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক তরুনদের নেতা হয়ে উঠেন শরনার্থী শিবিরেই আর আঠারো/ উনিশ বছরের ইলিয়াস ও হয়ে উঠেন দাদার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ জন, পরবর্তীতে যুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি পরিচিতি পান ‘দাসবাবুর ছোটভাই’ হিসেবে। এপ্রিল মে দু মাস এভাবেই যায়, যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক তরুনরা ক্রমশঃ অধৈর্য্য হয়ে উঠতে থাকে। বালাট ক্যাম্পের তত্বাবধানে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুর রাজা চৌধুরী, হোসেন বখত, আব্দুজ জহুর এবং ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপর তারা চাপ তৈরী করতে থাকে। বয়সে তরুন থাকায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথেই এদের যোগাযোগ ছিলো ভালো। এ ছাড়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব ও মুলতঃ সুরঞ্জিতই পালন করতেন।
শেষপর্যন্ত ১১৪ জন তরুনের প্রথম দলটি বালাট থেকে যাত্রা শুরু করে প্রশিক্ষন ক্যাম্প ইকো-১ এ।
নিশ্চয় এ এক অবিস্মরনীয় মুহুর্ত ছিলো। মুলতঃ পনেরো থেকে পঁচিশের বয়সের সকলে, আরেকটু বেশী বয়সের ও কেউ কেউ ছিলেন হয়তো- এরা কেউ এসেছে সুনামগঞ্জ থেকে, কেউ হবিগঞ্জ এর ভাটি অঞ্চল থেকে, কেউ কিশোরগঞ্জের হাওর থেকে, নেত্রকোনার পাহাড় অঞ্চল থেকে ও হয়তো কেউ। এদের কারো স্বজন নিহত হয়েছে- ধর্ষিত হয়েছে, কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, কেউ পরিবারের সদস্য নিয়ে, কেউ বা শুধু একাই চলে এসেছে আরেক দেশের এই শরনার্থী শিবিরে- প্রথমতঃ প্রাণ বাঁচানোর প্রয়োজনে, এরপর প্রতিশোধের স্পৃহায়। এরা কেউ ছাত্র, কেউ কৃষিজীবি, কেউ হাওর নদীর জেলে, কেউ রাজনৈতিক কর্মী- প্রশিক্ষন যাত্রার শুরু থেকে এরা সবাই আরেক অনন্য পরিচয়ের অধিকারী- এরা একটা দেশের মানূষের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে, এরা একটা মানবিক ইতিহাসের অতি গুরত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যাচ্ছে।
বালাট থেকে চেরাপুঞ্জি হয়ে শিলং এর দিকে যেতে প্রশিক্ষনার্থী যোদ্ধাদের বহনকারী একটি গাড়ী খাদে পড়ে কয়েকজন আহত হয়। বাকীরা শিলং গিয়ে রাত্রিযাপন করে, শিলং থেকে পরদিন ইকো- ১ ট্রেনিং ক্যাম্প। ইকো-১ ছিলো মেঘালয় এর জৈন্তিয়া হিলস এর জোয়াই শহরের কাছাকাছি কোথাও।
৩২ দিনের নিবিড় প্রশিক্ষন চলে এখানে। এর মধ্যে বাছাই করা কয়েকজনকে বিশেষায়িত প্রশিক্ষন দেয়া হয় ব্রীজ ও স্থাপনা ধ্বংস, জাহাজ ও নৌ পথ যুদ্ধের। ৩২ দিনের প্রশিক্ষন শেষে পুরো দলকে তিনটা গ্রুপে ভাগ করা হয়, একটা গ্রুপ পাঠানো হয় ডাউকি/ তামাবিল সাব-সেক্টরে, একটা গ্রুপ বালাট সাব-সেক্টরে আর আরেকটা গ্রুপ সদ্য গঠিত টেকেরঘাট/ বড়ছড়া সাব-সেক্টরে। পশ্চিম খাসিয়া হিলস এর নীচে, টাঙ্গুয়ার হাওরের পাড়ে টেকেরঘাট ছিলো লাইমস্টোন কারখানা। মাঝখানে হাওর, চার/ পাঁচ মাইল দক্ষিনে থানা সদর তাহিরপুর পাকিস্তান আর্মির দখলে। অবকাঠামো ও অবস্থানগত বিবেচনায় সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে এখানেই গড়ে উঠে ৫ নং সেক্টরের সবচেয়ে উত্তর পশ্চিমের সাব-সেক্টরটি। প্রথম দিকে কোন আর্মি ম্যান না থাকলে ও পরে মেজর মুসলিম উদ্দীণ সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এখানে। কিছু আনসার- ইপিআর এবং অতি সামান্য সামরিক সদস্য ছাড়া এই সাব-সেক্টরের পনেরো শো গেরিলার প্রায় সকলেই ছিলেন বেসামরিক। সামরিক-বেসামরিক সংখ্যার অনুপাতে, ধারনা করি সারা দেশের মধ্যে এই সাব-সেক্টরেই গনযোদ্ধারা সবথেকে বেশি ছিলেন।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ৩৬ জন বিশেষ প্রশিক্ষিত গেরিলা জোয়াই- শিলং-চেরাপুঞ্জি- বালাট হয়ে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে সংযুক্ত হন। তাদের সামরিক পরামর্শক ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর ভাট ও ক্যাপ্টেন ভার্মা। আর গেরিলা দলটির কমান্ডার জগতজ্যোতি দাস, । তার নামেই দলটির দাপ্তরিক নাম দাস পার্টি। টু-আইসি ধর্মপাশার আলী আমজদ। গোটা ভাটি অঞ্চল মুক্ত করার যুদ্ধে অন্যান্য গ্রুপের সাথে থাকার পাশাপাশি এদের বিশেষ দায়িত্ব ভৈরব-আজিমিরীগঞ্জ-শেরপুর নদীপথ পাকিস্তান আর্মির জন্য বিপদসংকুল করে তোলা।
[ দাসপার্টির যুদ্ধসীমানা]
[ ভৈরব- আজিমিরী-শেরপুর নদীপথ। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককের বেশীর ভাগ সেতু ও ফেরী গেরিলা আক্রমনে পর্যুদস্ত হলে এই নদীপথ হয়ে উঠে পাকিস্তান আর্মির রসদ ও অস্ত্র সরবরাহের লাইফ লাইন।দাসপার্টির একের পর এক অপারেশনে, সেপ্টেম্বরের শেষদিকে পাকিস্তান রেডিওতে এই পথ পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয়]
হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং, বানিয়াচং থেকে হাওর নদী পাড়ি দিয়ে আমরা যখন আজমিরীগঞ্জ নামি পূব আকাশে তখন সরু চাঁদ আর সন্ধ্যাতারা, টমটম নিয়ে কাকেলছৈও পৌঁছাতে পৌঁছাতে আকাশ জুড়ে লক্ষ তারার হীরে ; একজন আঠার বছরের গেরিলা এখন একষট্টি বছরের প্রৌঢ়- তাদের যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতির গল্প শুনতে শুনতে আকাশ পানে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যাতারা শুকতারা হয়ে গেছে, সরু চাঁদ অনেকটাই পশ্চিমে। আজকে প্রথম রোজা, সেহরির সময় প্রায় হয়ে গেছে।
কাল সকাল বেলা আমরা বের হবো যুদ্ধক্ষেত্রগুলো দেখতে ।
সেহরির জন্য নেমে আসি আমরা তারা জ্বলা আকাশের নীচ থেকে।
মন্তব্য
গল্পটা তে ঐতিহাসিক ছোয়া আছে , পরে ভালো লেগেছে ।
একটি অসাধারণ বই (The Biggest Secret-by David Icke) জেনে নিন এই পৃথিবীর হাজার বছরের অজানা ইতিহাস |
বইটি ডাউনলোড করতে ও বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পড়তে পড়তে যেন ওই তারা জ্বলা গ্রামে পৌঁছে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের গল্পের সাথে ভ্রমণগল্পও হয়ে যাচ্ছে একসাথে। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
পাঁচতারা।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পড়ছি। এই সিরিজটার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমার গ্রামের বাড়ি শাল্লাতে, ছোট বেলা একা একা সেখান থেকে হবিগঞ্জ শহরে আসার পথে দিরাই, জলসুখা, আজমিরীগঞ্জ এইগুলো পাড়ি দিয়ে এসেছিলাম। দেশে থাকলে হবিগঞ্জ থেকে আপনাদের সাথে জুটে যেতে পারতাম।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
একটাই দুঃখ, আমাকে নিয়ে গেলে না।
__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত
মুক্তিযুদ্ধের একটি অজানা অধ্যায় সম্পর্কে এখানে জানলাম মনে হচ্ছে। আমি এর আগে দাসপার্টির নাম শুনি নি।
jaraahzabin
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
আমি তোমাদের কেউ নই -> আতোকেন
দুর্দান্ত একটা কাজ হচ্ছে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন