দাসপার্টির খোঁজে # খসড়া পর্ব-৫

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: সোম, ০৩/০৮/২০১৫ - ১২:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯জুন। পহেলা রমজান। সকাল বেলা।
কাকৈলছেও, আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
সেহরীর পর সামান্য কিছু সময় আমরা ঘুমিয়েছি। আটটার দিকে বের হই। আমি, নজরুল, তানিম ও ইলিয়াস। সামান্য পায়ে হেঁটেই নদীর পাড়ে আসি। কাল রাতে এসে পৌঁছে ছিলাম অন্ধকারে। এখন সকালের নরম আলোয় নদী দেখি, নদীবর্তী জনপদ দেখি। শেরপুর থেকে কুশিয়ারা নদী আজমিরীগঞ্জ হয়ে এদিকে এসেছে ভেড়ামোহনা নামে। ভেড়ামোহনা নেমে গেছে আরো ভাটিতে। পেছন দিকে সুনামগঞ্জ, দিরাই হয়ে কালনী এসে মিশেছে। ভেড়ামোহনা ও কালনী মিশেছে আরেকটু ভাটিতে, সেখান থেকে মেঘনার মোহনা। ঐ মোহনা ধরে এগুলেই ভৈরব। আমর দাঁড়িয়ে আছি কাকেলছৈও লঞ্চঘাটের কাছে। একসময় কাঠের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিলো এইঘাট।
নদী এখানে বিশাল। ইলিয়াস তার পরিচিত এক ইঞ্জিন নৌকা নেন। ছোট্ট একটা নৌকা। মাঝি ও ইলিয়াস হালের কাছে বসেন, আমি তাদের সামনে দাঁড়াই। নজরুল ও তানিম সামনের দিকে। নৌকা ভাসে ভাটিতে, আমরা পশ্চিমে নামতে থাকি- যতো ভাটিতে যাই ততো নদী আরো প্রশস্ত হতে থাকে। কিছুক্ষন যাওয়ার পর নদীর বুকেই বিদ্যুতের খুঁটির লম্বা সারি দেখি উত্তর-পুর্ব কোনে। ইলিয়াসকে জিজ্ঞেস করি- কোন এলাকা? বলেন- জয়সিদ্ধি। ইটনা থানার জয়সিদ্ধি। বাংলার প্রথম র্যাং লার আনন্দমোহন বসুর বাড়ি, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ তার অবদান।

নৌকা এগুতে থাকে জয়সিদ্ধির দিকে, ইলিয়াস ফিরে যান একাত্তুরে। জগতজ্যোতি শহীদ হবার পর দাসপার্টির যুদ্ধ থামেনি। দল পুর্নগঠিত হয় আবার, নেতৃত্বে আসেন ইলিয়াসেরই বন্ধু জগন্নাথপুরের বেতাউকা গ্রামের সফিকুল হক চৌধুরী। দাসপার্টির প্রথম দিকের সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী আমজদ তখন আরেক দল নিয়ে তার নিজের এলাকা ধর্মপাশা-তাহিরপুরের দিকে যুদ্ধ করছেন।
বুকে গুলীর ক্ষত আর প্রিয় কমান্ডার হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইলিয়াস ও তখন ক্ষ্যাপাটে। টেকেরঘাট কিংবা শিলং যাননি চিকিৎসার জন্য, প্রতিশোধই তার উপশম তখন। এ সময় দাসপার্টি ঘাঁটি করে জয়সিদ্ধিতে। ইলিয়াস একটা গ্রাম দেখান বামে। নদী ও হাওর এখানে মিশে গিয়ে বিশাল আকার নিয়েছে। বলেন- ডিসেম্বর প্রথম দিকের এক সকালে জয়সিদ্ধি থেকে তাদের দল পায়ে হেঁটে এসে এম্বুশ করেছিলো এই গ্রামে। শীতের নদী তখন শীর্ণ। একটা গানবোটে করে মিঠামইনের দিক থেকে আসছিলো তেরজন রাজাকারের এক সশস্ত্র দল। এই দলটাকে জীবিত অবস্থায় পাকড়াও করে হত্যা করা হয়েছিলো, তাদের গানবোট ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো এখানে, সম্ভবতঃ যে জায়গায় আমাদের নৌকা দাঁড়িয়ে ঠিক সেখানেই।

আমাদের নৌকা আরেকটু এগিয়ে বামে মোড় নেয়। জয়সিদ্ধি থেকে যায় ডানে। নৌকা ইউটার্ণ করে এগিয়ে যায়। এখানেই কালনী ও ভেড়ামোহনা মিশে গিয়ে আরেকটু ভাটিতে মেঘনা নাম নিয়েছে। আমরা মেঘনার দিকে না গিয়ে ভেড়ামোহনায় ফিরি- পেছনে কিশোরগঞ্জের ইটনা ও মিঠামইন, সামনে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ। নরম একটা চরের মতো জায়গা, নৌকা থামে তবে নেমে দাঁড়ানোর মতো মাটি নেই। এখানে ইলিয়াস দেখান- পাক আর্মির রসদবাহী দুটো বার্জ তারা ডুবিয়েছিলেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ভৈরব হয়ে সিলেটের দিকে যাচ্ছিলো। ভারত তখন স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশকে, এদিকে ভারতীয় বোমারু বিমান উড়ছে। বার্জ দুটো লক্ষ্য করে বিমান থেকে বোমাবর্ষন হলে ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এরপর এগুলো দখল করে রসদ সামগ্রী গ্রামের লোকজনের মধ্যে বিতরন করে গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে বিস্ফোরন ঘটিয়ে ডুবিয়ে দেন। স্বাধীনতার পর বার্জ দুটো ঊত্তোলনের চেষ্টা করলে ও সম্ভব হয়নি।

আমাদের নৌকা এবার এগিয়ে চলে ফিরতি পথে কাকেলছৈও এর দিকে। যে ঘাট থেকে উঠেছিলাম এক সময়ে সেটা পেরিয়ে আরো পূর্বে উজানের দিকে। নদীর ডান পাশ ঘেঁষে নৌকা এগুতে থাকে। শাহপুর নামে একটা গ্রামে আমরা থামি। পাড় ধরে সারি সারি বাড়ি। ইলিয়াস একটা বাড়ি দেখান, হিন্দু বাড়ি- বলেন এই বাড়িটার সামনে পুকুর ছিলো, তখন ডিসেম্বরের দশ তারিখ সম্ভবতঃ, নদীর পানি অনেক কম, পাড় শুকনো। তারা ফিরছিলেন আজমিরীগঞ্জের দিক থেকে পায়ে হেঁটে নদীর পাড় ধরে। এসময় হঠাৎ শুনতে পান মিলিটারী গান বোটের আওয়াজ, পেছন থেকে এগিয়ে আসছে এদিকে। সম্ভবতঃ মার্কুলীর দিক থেকে পালিয়ে ভৈরবের দিকে ছুটছে পাকিস্তান আর্মিদের নিয়ে। দ্রুত তারা নদীর পাড় ধরে এম্বুশ নেন। তিনি নিজে মেশিনগান নিয়ে অবস্থান নেন পুকুর পাড়ে। রেঞ্জের ভেতর আসা মাত্র শুরু হয় গুলী। পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তান আর্মির দল ও ছিলো চুড়ান্ত রকম ডেসপারেট। শুরু হয় দুপক্ষের ভয়ংকর গুলী বিনিময়। ইলিয়াস হাত তুলে দেখান- এইদিকে গাছের একটা পাতা ও ছিলোনা, মিলিটারীরা ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিলো।

আমরা ফিরে আসি কাকেলছৈও ঘাটে। ঘাট থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এগুই বাজারের দিকে। টিপিক্যাল ভাটি এলাকার বাজার, দেখে মনে হয় সময় যেনো এখানে থমকে আছে। মাঝখানে সরু গলির মতো- বামপাশে সারিসারি দোকান নদীর উপর ঝুলে আছে। ডানে আরো কিছু। এখানে আমাদের সঙ্গী হন নূর মিয়া। জীর্ণ, ভাঙ্গাচুরা চেহারা, একটা ময়লা লুঙ্গী ও খয়েরী রংয়ের শার্ট গায়ে। মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধ করেছেন শেলা সাব-সেক্টরে। এসব এলাকায় দর্শনীয় কিছু নেই, বাজারটাই গুরুত্বপুর্ণ। রোজার প্রথম দিন, দোকানপাট তেমন খুলেনি- একজন বলেন চেয়ারম্যানের নির্দেশে এবার চা এর দোকান সব বন্ধ, দোকানীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আমার কাছে অমুসলিমই মনে হয়। বাজারগলির শেষ মাথা ঘুরে ফিরে আসার সময় ইলিয়াস দেখান- ঐ যে চেয়ারম্যান বসা। দেখি একটা পাকা দোকানের সামনে বয়স্ক একজন মানুষ উঁচু একটা চেয়ারে, তার দুই পাশে বেঞ্চে এবং পেছনে দাঁড়িয়ে আরো কিছু মানুষ। উপস্থিত সিদ্ধান্ত নেই এই চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলবো- যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ও এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। এগিয়ে যাই, সালাম দেই। খেয়াল করি তার চেয়ারটিই সবচেয়ে উঁচু সামনে আরো দু তিনটি চেয়ার তার থেকে নীচু। পাশে একটা বেঞ্চ, একটা চেয়ার। ঐ যে আরেকজন মধ্যবয়স্ক বসা। ইলিয়াসই পরিচয় করিয়ে দেন- ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নুরুল হক ভুঁইয়া আর পাশের চেয়ারে বসা তার ভাই মিজবাহ উদ্দীন ভুইঁয়া, ইনি আজমিরীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লিগের সভাপতি। চেয়ারম্যান আমাদের বসতে বলেন- আমি তার থেকে নীচে চেয়ারে বসি সামনা সামনি। নজরুল একটা ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে থাকেন আর তানিম শুরু করেন ভিডিও। চেয়ারম্যান ও তার ভাই দুজনেই পরিচয় জানতে চান। ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করছি’ বলার পর জানতে চান ‘কোন মিডিয়া, কোন চ্যানেল? ‘ । দ্রুত এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাই- কোন আইডেনটিটি কার্ড চেয়ে বসলে বিপদ। শুটিং চলছে- এমন আবহ তৈরী করে আমি চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করি- ‘জনপ্রতিনিধি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার ভূমিকা কি ছিলো?’
কয়েক সেকেন্ডের জন্যতার প্রাচীন ভ্রূঁ কুঁচকে উঠলে ও সামলে উঠে ইলিয়াস ও নূর মিয়াকে দেখিয়ে বলেন- ‘এদেরকে তো আমিই যুদ্ধে পাঠাইছি। ‘
নূর মিয়া মাথা নীচু করলে ও ইলিয়াস প্রতিবাদ করেন – ‘ আমি আর বদিউজ্জামান সবার আগে গেছি নিজে নিজে’
চেয়ারম্যান তার শতভাঁজ মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন আর গলায় খ্যাক খ্যাক করে আওয়াজ তুলেন- ‘আহা এইসব বিতর্কের দরকার কী?’
আমি কথা চালিয়ে যাই
‘ তখন কোন দল করতেন?’
-‘ আমরা সারা জীবনই আওয়ামী লীগ, এই যে আমার ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি’
- দাসপার্টির কথা কিছু বলবেন?
- এরা যুদ্ধ করছে নানা দিকে। আমাদের এই দিকে অবশ্য তেমন কিছু না।
এইসময় কথা বলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, চেয়ারম্যানের ভাই মিজবাহ উদ্দীন। ইনি ইলিয়াসদের সমবয়সী কিন্তু যুদ্ধে যাননি। নজরুল ও তানিমের ক্যামেরার লেন্স ঘুরে তার দিকে।
- আমরা যুদ্ধের সাথেই ছিলাম। একবার কয়েকটা রাজাকার ঘেরাও করে ধরছি আমরা। ধরে এই দাসপার্টির হাতে তুলে দিছি, এরা তখন একটা খারাপ কাজ করছে।
- কী খারাপ কাজ?
- সবাইরে মেরে ফেলছে। মারার দরকার ছিলোনা। আশে পাশের গ্রামের মানুষ, অনেক মিনতি করছিলো
( এসময় পাশ থেকে একজন ফোঁড়ন কাটেন- সক্কলে মুসলমান ছিলো)
আমাদের মনোযোগ ছিলো মিজবাহউদ্দীনের দিকে। ইলিয়াসের উত্তেজিত গলা শুনে তার দিকে ফিরে তাকাই
- রাজাকারদের হাতে রাইফেল ছিলো কিনা?
-তা ছিলো।
- তাইলে এরা দেশের শত্রু ছিলোনা? এরা আমাদের মারতোনা? দাসপার্টির নিয়ম ছিলো দেশের শত্রু কাউরে মাটির উপর রাখা যাবেনা।
মেজবাহ উদ্দীন তবু অনড়- কাজটা ঠিক হয় নাই। সাথে তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ও । ইলিয়াসের ভাই-ভাতিজা ও কয়জন উপস্থিত এই জটলায়। কন্ঠ ক্রমশঃ উত্তেজিত হয়। ইলিয়াস গর্জে উঠেন- ‘তোমরা সবাই পাকিস্তানের দালাল, পাকিস্তানের দালালেরা পাকিস্তানে ফিরে যাও।‘
জটলায় পক্ষ বিপক্ষে গুঞ্জন বাড়তে থাকে
ইলিয়াস ও নূর মিয়া বের হয়ে আসেন, আমরা ও তাদের সাথে সাথে। আমাদের পেছন পেছনে ঐ জটলার কিয়দংশ আসতে থাকে। ধারনা করি এরা এলাকায় চেয়ারম্যানের বিরোধী পক্ষ। বয়স্ক কয়েকজন উচ্চ কন্ঠেই বলেন- এরা আওয়ামী লীগে আসছে দেশ স্বাধীনের পরে, আগে তো দলাল ছিলো।



ইলিয়াসকে ভয়ংকর ক্ষিপ্ত দেখায়। আমরা তার পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারেই একটা মাঠ। এই মাঠে মুক্তিযুদ্ধের পরে কাদের সিদ্দীকি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সভা করে গেছেন। ২০০১ এর নির্বাচনের আগে জনসভা করে গেছেন শেখ হাসিনা। আমরা সেই মাঠে আসি। কই থেকে যেনো কয়েকটা প্লাস্টিকের লাল চেয়ার ও আসে। আমাদের ঘিরে থাকেন উত্তেজিত জনতা।

ইলিয়াসের ফোন পেয়ে আসেন শাহ জামান। জেনারেল ওসমানীর মতো পাকানো গোঁফ ও দাড়িতে তাকে অন্যরকম দেখায়। ইনি ডাউকি/ তামাবিল সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের আগে কৃষিকাজ করতেন, এখনো তাই করেন তবে এখন ভূমিহীন, নিজের জায়গাজমি নেই আর।
আসেন মনোরঞ্জন দাস। ছোটখাট সাধারন চেহারার মানুষ। জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ, পরিবারের আর সবার মতোই নদী থেকে মাছ ধরতেন। পড়ালেখা করেননি। যুদ্ধ করেছেন ৩ নং সেক্টরে তেলিয়াপাড়ার দিকে।
যুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছেন কিন্তু নিজের ভিটেমাটি আর ফিরে পাননি। এখনো মাছ ধরেন, থাকেন অন্যের বাড়িতে।
ইলিয়াস, নূরমিয়া, মনোরঞ্জন ও শাহজামাল- চার মুক্তিযোদ্ধার সাথে বসে গল্প করি, তাদের তখন এবং এখনকার গল্প শুনি। গ্রামের ক্ষমতাকাঠামোর ইতিবৃত্তটা বোঝার চেষ্টা করি। এরা সবাইই চেয়ারম্যানকে দালাল বলেন এবং অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগকে এই পরিবার দখল করে রেখেছে অথচ মুক্তিযুদ্ধের দুঃসময়ে তারাই ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী। এই এলাকায় হিন্দু প্রাধান্য ছিলো কিন্তু ক্ষমতাবৃত্তের মানুষদের দাপটে অনেক হিন্দু পরিবারই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, বাকীরাও বিপদ এ আছে। তারা তাদের দুই প্রয়াত সহযোদ্ধা বদিউজ্জামান ও আরেকজনের জন্য আফসোস করেন। বলেন ওরা বেঁচে থাকলে তাদের সাহস আরো বেশী থাকতো।

কী জানি! তারা হয়তো কেবল তাদের গ্রামের পরিস্থিতিটাই বিবেচনা করেন আমি এই গ্রামের ছবি দিয়েই গোটা দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক গভীর অসুখ টের পাই, এই অসুখ সহজে সারবার নয়। শেখ হাসিনা যখন নানা প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে রাজাকারদের বিচার করছেন তখন তার দলের একটা উপজেলা সভাপতি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সরাসরি অভিযুক্ত করছেন- যুদ্ধকালীন সময়ে রাজাকারদের শাস্তি দেয়ার? এরকম মনোভাব পোষন করেন কয়জন আওয়ামী লীগ নেতা- প্রান্তিক থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত? রাজাকারদের বিচার করার শেখ হাসিনার এজেন্ডা কী এরা সমর্থন করে? শেখ হাসিনা কোনদিন বিপদে পড়লে এই নেতারা তার পাশে দাঁড়াবে? নাকি হঠাৎ করে দৃশ্যপট বদলে গেলে ইলিয়াসের মতো যোদ্ধাদেরকেই এরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
জুমার নামাজের সময় হলে পর, আমরা বিদায় নেই।

গতরাতে এসে আমরা বিদ্যুত পাইনি, এই দুপুর পর্যন্ত ও বিদ্যুত আসার লক্ষন নেই। ভ্যাপসা গরমে হাসফাস লাগে। নামাজ শেষ হলে এবার আমরা পরিকল্পনা করি বিথংগল যাবার। রামকৃষ্ণ গোস্বামী নামে একজন বৈষ্ণব সাধক চারশো বছর আগে এই অঞ্চলে বৈষ্ণব সাধকদের জন্য আখড়া গড়েছিলেন। এবার নদী নয়, গ্রামের পেছনের হাওর ধরে আমরা যাত্রা শুরু করি কাকেলছৈও থেকে বিথঙ্গল এর পথে । ঝকমকে রোদ্দুর,শরতের আকাশের মতো সাদা সাদা মেঘ আর ঘন নীল আকাশ। আকাশে ছায়ায় হাওরের পানি ও নীল দেখায়। এখন যে পাল তোলা নৌকা চলে- এই অঞ্চলে না আসলে জানা হতোনা।
নৌকার গলুই এ বসে হাওরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকি আমরা আর ইলিয়াসের সাথে গল্প করি।
- মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন জগতজ্যোতি দাস?
- সিংহের মতো একটা কলিজা ছিলো তার। যুদ্ধের সময় আমাদের উপরে আল্লাহ আর নীচে দাদা। দলের কোন ছেলের মন খারাপ থাকলে নিজে নেচে গেয়ে মন ভালো করে দিতেন। একবার টেকেরঘাটে সেন দা ( সুরঞ্জিত সেন) আমাদের আগে খেতে বসে গিয়েছিলেন। জ্যোতি দা গিয়ে তারে বিরাট ঝাড়ি। আরেকবার ইন্ডিয়ান আর্মির সাথে লাগলো মারামারি...
ইলিয়াস এই ঘটনার বর্ণনা দেন। টেকেরঘাটের শরনার্থী শিবিরে আয়োজন করা হয়েছিলো দূর্গাপূজার। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো সেখানে, ভারতীয় জওয়ানরা ও আমন্ত্রিত ছিলো। এক হিন্দীভাষী জওয়ান বাঙ্গাল ঈএক মেয়েকে উত্যক্ত করছিলো পূজা মন্ডপে। জ্যোতি সেই জওয়ানকে মেরে মাথা ফাটিয়ে আটকে রাখেন। এই ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় ভারতীয় শিবিরে। একজন ইউনিফর্ম পড়া জওয়ানকে আঘাত করা মানে গোটাবাহিনীকে অপমান করা। জ্যোতি এবং তার দলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় মেজর ভাট এর দপ্তরে। কোর্ট মার্শাল হবে। জ্যোতি মেজর ভার্মাকে স্পষ্ট উচ্চারনে বলেন- পাকিস্তান আর্মির যে আচরনের জন্য আমরা অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছি, সেই আচরন ভারতীয় সৈনিকের কাছ থেকে পেয়েছি বলেই আমরা আঘাত করতে বাধ্য হয়েছি। গুলী করে মেরে ফেলতে হলে মারবেন কিন্তু হাতবাঁধা অবস্থায় না। হাত খোলা অবস্থায় আমাদেরকে গুলী করবেন। আমরা ক্রিমিনাল না, আমরা মুক্তিযোদ্ধা।
মেজর ভাট শাস্তি লঘু করে দেন, তার প্রিয় গেরিলাদের দিয়ে কয়েকটা বাংকার খুঁড়ানো হয় মাত্র।

জগতজ্যোতির গল্প শুনতে শুনতে আমরা বিথঙ্গল এস পৌঁছাই। বাজারের ঘাঁটে নেমেই পায়ে হেঁটে আখড়া। পুরনো কাঠামো, চারশো বছরের পুরনো। কিছু অংশ আবার সংস্কার করা হয়েছে। এখানে ঢুকতে হয় জুতা খোলে। চারপাশে হাওরের মাঝখানে এই দুর্গম স্থানে সেই চারশ বছর আগে বৈষ্ণবদের সাধনার জন্য নির্মিত হয়েছে , ভাবতেই অবাক লাগে। এখানে ১২০টি আলাদা কুঠুরি ছিলো , ১২০ জন বৈষ্ণব সাধনা করতেন। ইলিয়াসের হয়তো মনে পড়ে, ফুলবাসী বৈষ্ণব নামে একজন সহযোদ্ধার নাম উচ্চারন করেন। শাল্লার বৈষ্ণব পদধারী চারভাই তাদের সাথে দাসপার্টিতে ছিলেন। ফুলবাসী বৈষ্ণব পরে খুন হয়েছেন।
পরনো কুঠুরীগুলোর সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছেন কয়েকজন বয়স্ক রমনী। একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এগিয়ে আসেন। জিজ্ঞেস করি- এখন আর বৈষ্ণবরা আর সাধনা করেন না?
বলেন- এই দু চারজন আছে আর কি। এইটা বড় কঠিন সাধনা, এখন লোকজন চায়না আর।
ইলিয়াস তাকে মোহন্তের কথা জিজ্ঞেস করেন। আখড়ার প্রধান মোহন্ত বিশ্রামে তখন। ইলিয়াস বলেন তার নাম বলার জন্য- দাস পার্টির ইলিয়াস।
আমরা চারশো বছরের পুরনো স্থাপনা খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে দেখি। কতো মানুষ, কতো কাল, কতো ঘটনার স্মৃতি জমা এর পরতে পরতে। কিছুক্ষন পর মোহন্ত এসে স্বাগত জানান আমাদের। বয়স আশি পেরিয়েছে তার কিন্তু কাঠামো নুয়ে পড়েনি এখনো। জানালেন আশে পাশের গ্রামের দরিদ্র হিন্দুমুসলমান সকলেই আসে তার কাছে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে । ইলিয়াস নিজের পরিচয় দেন, মোহন্ত হাসেন।
‘চিনি আপনারে- সেই যুদ্ধের সময় দেখছিলাম, আর এতো বছর পর’
বিথঙ্গল থেকে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করি। তখন আলো কিছুটা নরম হতে শুরু করেছে। কাকেলছেও বাজারে একটা দোকানে এসে বসি। যার বাড়িতে আমরা থাকছি এটি তারই স্বর্ণের দোকান।
ইলিয়াস কাউকে ফোন করেন। কিছুক্ষন পর একজন বয়স্ক মানুষ এসে ঢোকেন। তাকে অসুস্থ দেখালে ও পরনের লুঙ্গী ও শার্ট বলে দেয় অন্যদের থেকে কিছুটা অবস্থাসম্পন্ন। ইনি মতিউর রহমান, দাস পার্টির অন্যতম যোদ্ধা। তার সাথে মনোরঞ্জন দাস ও এসেছেন, দুপুরবেলা যার সাথে আমাদের আলাপ হয়েছে।
মতিউর রহমান জোর করে আমাদেরকে নিয়ে যান তার বাড়িতে। বর্তমানে শ্রীহীন হলে ও পুরনো আভিজাত্যের চিহ্ন রয়ে গেছে এখনো। আমরা বাড়ির বারান্দায় বসি। ইফতারের খুব দেরী নেই আর।
একাত্তুরে তার বয়স ছিলো সাতাশ। বিয়ে করেছেন কিছুদিন আগে। স্ত্রী আটমাসের গর্ভবতী, প্রথম সন্তান হবে। এই অবস্থায় চলে গেছেন যুদ্ধে। সেই সন্তানের মুখ আর দেখা হয়নি যুদ্ধ থেকে ফিরে, নবজাতকটি মারা গিয়েছিলো। ছেলে যুদ্ধে গিয়েছে এই অপরাধে মতিউর রহমানের বাবাকে ও গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। অনেক টাকা পয়সার বিনিময়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছে তাকে। যুদ্ধের আগে বেশ অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন তারা কিন্তু যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের ধাক্কায় এখন আর আগের অবস্থা নেই।
জগতজ্যোতি দাসের শেষ যুদ্ধে মতিউর রহমান ও পাশে ছিলেন। এখন অসুস্থ, ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে কিছুদিন আগে। বেশী কথা বলতে পারেন না। তবে তার ছোট ভাই যিনি কিশোর ছিলেন যুদ্ধকালে, পারিবারিক বিপর্যয়ের স্বাক্ষী তিনি- ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যে মানুষেরা যুদ্ধের সময় নিরাপদ ছিলো, যুদ্ধে যায়নাই, কোন ক্ষতি হয় নাই বরং হিন্দুদের সম্পত্তি পানির দামে কিনে সম্পদশালী হয়েছে তারাই আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে এখন এলাকার প্রধান হয়ে গেছে।
আজান হয়। প্রথম ইফতার আমরা করি মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমার বাড়ির আঙ্গিনায়।

ইফতারের পর আমরা তিনজন নদীর ঘাটে গিয়ে বসি। তখনো আলো নিভে যায়নি পুরোপুরি। সামনে প্রবাহমান নদী, দিগন্তে মেঘের উপর দিয়ে আসা অস্তমান সূর্যের শেষ ছটা। এই নদীর কোথাও ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিলো জগতকে, আমাদের আবারো মনে পড়ে।
অন্ধকার নেমে এলে পড়ে আমরা বাজারে ফিরে আসি। প্রথম রমজানের ইফতারের পর বাজার বেশ সরগরম হয়ে উঠছে তখন। একটা চায়ের দোকানে ঢুকি। কয়েকটা চেয়ার আর বেঞ্চ পাতা। আমরা একটা বেঞ্চে বস্তে গেলে চেয়ার থেকে কয়েকজন উঠে প্রায় জোর করে আমাদেরকে চেয়ারে বসান। কালকে রাতে যে আমরা এসেছি, বিশেষ করে সকালবেলা আমাদেরকে ঘিরে চেয়ারম্যান ও ইলিয়াসের বাদানুবাদ – এসব বেশ ভালোভাবেই প্রচার হয়েছে। কোন চ্যানেল থেকে এসেছি, কবে অনুষ্ঠান দেখাবে- এইসব কমন প্রশ্নে আমরা ডিপ্লোমেটিক থাকি। রঙ চা, দুধ চা আবার রঙ চা এর বৃত্ত ঘুরতে থাকে আমাদের। নজরুল ও তানিম নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ডকুমেন্টারির মতো মানুষদের কাছ থেকে দাস পার্টি বিষয়ক কথা রেকর্ড করতে থাকেন।
চা এর দোকান থেকে দীর্ঘ সময় পর উঠে বাজারের ভেতর দিয়ে আমরা ইতস্ততঃ হাঁটতে থাকি। মাঝেমধ্যে কোন একটা ভুষিমালের দোকান, একটা চুল কাটার সেলুনে ঢুকে দুই মিনিটের কথাবার্তা রেকর্ড করি- দাস পার্টি, মুক্তিযুদ্ধ এসংক্রান্ত। সেই সময়ে তরুন ছিলেন এমন মানুষ থেকে শুরু করে এই সময়ের তরুন পর্যন্ত। ‘ ইলিয়াসকে চিনেন? মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস?’- এক তরুন বলছিলেন- ‘ইল্যাস বেটা যুদ্ধের সময় বহুৎ মানুষ মারছে, তাই এখন তার মাথা নষ্ট’
গত ২৪ ঘন্টার পর্যবেক্ষনে আমরা বুঝি, এলাকায় ইলিয়াসের পরিচিতি মোটামুটি এরকমই। মাথাগরম, অন্যায় সহ্য না করা উচ্চকন্ঠের মানুষটাকে সবাই পছন্দ করেনা কিন্তু সমীহ করে এখনো। কেউ কেউ নিশ্চয় ঘৃণা ও করে কিন্তু সরাসরি তার সাথে লাগতে আসার সাহস এখনো কারো নেই।

তারাবীর নামাজ শেষে আমরা আবার বসি ছাদের উপর। গতরাতের মতো অতোটা তীব্র না হলে ও তারার আলোয় উজ্জ্বল একটা রাত। এবার একটু গুছিয়ে তার সাথে কথা বলি, বিশেষ করে তাদের যুদ্ধদিনের টাইমলাইনটা বুঝতে চেষ্টা করি।
বালাট থেকে তারা ১১৪ জনের দল গিয়েছিলেন ইকো-১ এ প্রশিক্ষনে। প্রশিক্ষন শেষে এদের মধ্যে ৩৬ জনকে নবগঠিত টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে সম্পৃক্ত করা হয় জুলাই’র ১ম সপ্তাহে। কমাণ্ডার জগতজ্যোতি দাস আর টু আই সি ধর্মপাশার আলী আমজদ।
জুলাইর দ্বিতীয়/ তৃতীয় সপ্তাহে তাদের প্রথম অপারেশন সদরপুর ব্রীজ ধ্বংস। টেকেরঘাট সাব-সেক্টর থেকে অনেক দূরে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের এই ব্রীজটি সফলভাবে উড়িয়ে দিয়ে তারা ফিরে যান টেকেরঘাটে।
টেকেরঘাট থেকে আগষ্ট এর তিন তারিখে শুরু হয় গুরুত্বপূর্ণ জামালগঞ্জ-সাচনা অপারেশন। মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুই দলের সাথে দাসপার্টি ও যোগ দেই এই অপারেশনে। প্রথমদিনের আক্রমনে ইলিয়াস পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে টেকেরঘাট ফিরে গেলে তার জায়গায় আসেন কিশোরগঞ্জের সিরাজ। সিরাজ শহীদ হন এই যুদ্ধে। (ইলিয়াস আমাকে নিশ্চিত করেন যে , শহীদ সিরাজ বীরবিক্রম দাসপার্টিরই সদস্য ছিলেন। )
জামালগঞ্জ-সাচনার সফল অপারেশনের পর পরই আগষ্ট মাসের দশ তারিখের দিকে দাসপার্টি চলে যায় দিরাই। পাকিস্তান আর্মি তখনো দিরাই পৌঁছায়নি। এর আগে জুলাই মাসে সালেহ চৌধুরী স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দিরাই-শাল্লা-জগন্নাথপুর পুলিশ স্টেশন নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছেন। দিরাই সিও ( সার্কেল) অফিস তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। শাল্লা-জগন্নাথপুর-আজিমিরীগঞ্জ-বানিয়াচং-নবীগঞ্জ-খালিয়াজুরি এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা তখন দিরাই ঘাঁটি করেছেন। দাসপার্টি এখান থেকেই তাদের মুল কাজ অর্থ্যাৎ নদীপথ দখলের অপারেশন চালাতে থাকে নিয়মিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৪ আগষ্ট তেলিয়াঘড়ি গ্রামে পাকিস্তান আর্মির গাদাবোট আক্রমন। আর্মিরা অন্য বোতে উঠে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলে ও তাদের গাদাবোটটি দখল করে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
আগষ্টের সতের তারিখে আজমিরীগঞ্জের পাহাড়পুর গ্রামে রাজাকারদের সাথে যুদ্ধ হয় দাসপার্টির। এর মাত্র কয়েকদিন আগে পাকিস্তান আর্মি সহযোগে রাজাকাররা বানিয়াচঙ্গের মাকালকান্দি নামের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে চালিয়েছে নারকীয় গনহত্যা। ৭৯ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে গোটা গ্রাম লুট কোঁড়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় কয়েকশো রাজাকার। মাকালকান্দি শেষে পার্শ্ববর্তী অপর হিন্দু গ্রাম পাহাড়পুরে একই রকম লুটতরাজের পরিকল্পনা করে রাজাকারেরা। ১৭ আগষ্ট সকালবেলা তিনশতাধিক রাজাকার প্রায় পঞ্চাশটি নৌকা নিয়ে গ্রাম ঘেরাও করে। কিন্তু আগের রাতে দাসপার্টি লুটের পরিকল্পনা জেনে রাজাকারদের আগেই ঐ গ্রামে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং লুটেরাদের উপর আক্রমন চালায়। শতাধিক রাজাকার নিহত হয় এই অপারেশনে।

আগষ্টের আটাশ তারিখে পাকিস্তান আর্মি ঝটিকা আক্রমন করে দিরাই থানা দখল করে নিলে দাসপার্টির সদস্যরা সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার টেকেরঘাটে ফিরে আসে। দিরাই দখল করে নিলে ও মুলতঃ থাকা সদরের দুই কিমি এর বাইরে পাকিস্তান আর্মির নিয়ন্ত্রন ছিলোনা। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল সক্রিয় ছিলো চোরাগোপ্তা হামলায়। সালেহ চৌধুরী তার নিয়ন্ত্রন কক্ষ সরিয়ে নেন কুঁড়ী বলনপুর গ্রামে।
টেকেরঘাট থেকে জয়কলসের কাছে বাইবনা গ্রামে এক অপারেশনে এসে শহীদ হন দাসপার্টির আরেক সদস্য আরশ আলী। আরশ আলী এই গ্রামেরই ছেলে, দাস পার্টির অপারেশন ছিলোনা সেটা। কিন্তু ঐ গ্রামের ছেলে হিসেবে আরশ আলী সেই গ্রুপের সাথে চলে এসেছিলেন। যুদ্ধে যোগ দেয়ার কয়েকদিন আগে তার আকদ হয়েছিলো। প্রশিক্ষন ক্যাম্পে ইলিয়াস ও আরশ আলী একই তাঁবুতে থাকতেন।
সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্য দলগুলোর সহযোগী হয়ে দাসপার্টি যুদ্ধ করতে থাকে তাহিরপুরের দিকে। এসময় একবার জগতজ্যোতি শিলং এ যান। তারঁর শিলং যাওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায় অঞ্জলী লাহিড়ির বইয়ে। মেঘালয় রাজ্য সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রী অঞ্জলী লাহিড়ী ছিলেন মুলতঃ সিলেটের মেয়ে। ভারতীয় রেড ক্রসের হয়ে তিনি শরনার্থী শিবিরগুলোতে ত্রান কার্যক্রম চালাতেন এবং শিলং শহরের বাঙ্গালীদের সহযোগীতা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, পোষাক এসবের ব্যবস্থা করতেন। তারশিলংয়ের বাড়িটি হয়ে উঠেছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের আরেক আশ্রয় স্থল। অঞ্জলী লাহিড়ী তার বইয়ে স্মৃতিচারন করেছেন- জগতজ্যোতি নামের বাচ্চা বয়সের একটা ছেলেকে দেখিয়ে কেউ একজন তাকে বলেছিলো- এরই মধ্যে ছেলেটা সতেরটা সফল অপারেশন করেছে, তার শরীরের ভেতর স্পিন্টার। অঞ্জলী তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বললে সে বলেছিলো- সময় নেই মাসীমা, যুদ্ধে ফিরে যেতে হবে।

জগতজ্যোতি শিলং থেকে আসার পর দাসপার্টি আবার কুঁড়িতে ফিরে আসে। এখান থেকে তারা আজমিরীগঞ্জ থানা আক্রমন করে। ভেড়ামোহনায় কার্গো কনভয় ডুবায়। জগন্নাথপুরের রানীগঞ্জ বাজারে রাজাকারদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়। মার্কুলীতে দুইশতাধিক রাজাকারদের আস্তানা দখল করা হয়, ডুবিয়ে দেয়া হয় নৌ জেটি।
অক্টোবরের আঠারো তারিখ ১ম রমজানের রাতে মুক্তিযোদ্ধা রমেশ পান্ডের দল আর জগতজ্যোতির দাস পার্টি মিলে আক্রমন করে পাকিস্তান আর্মির শক্তিশালী ঘাঁটি বানিয়াচং থানা। প্রবল যেই যুদ্ধে এলএমজি হাতে জ্যোতি ঢুকে গিয়েছিলেন পাক আর্মির ব্যুহের ভেতর। ৩৫ জন পাক আর্মি নিহত হয় এবং বানিয়াচং থানা দখলমুক্ত হয় সেই যুদ্ধে।
এরপর মার্কুলীর কাছে আরেকটি বার্জ দখল করা হয়, খবর ছিলো এই বার্জে পাকিস্তান আর্মি থাকবে। কিন্তু দখল করার পর আর্মির বদলে অস্ত্রসহ কয়েকজন রাজাকার আর মোহাম্মদ আলী নামে এক কিশোরকে পাওয়া যায় ( এই মোহাম্মদ আলী এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র)। বার্জটি পরে গচিয়া গ্রামে এনে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
অক্টোবরের শেষে দাসপার্টি আবার ফিরে যায় টেকেরঘাট। নভেম্বরের তিন তারিখে তাহিরপুরের বিখ্যাত শ্রীপুর যুদ্ধে অংশ নেয় তারা- যে যুদ্ধ চলছিলো তিনদিন।

ইতিমধ্যে দাসপার্টির উপুর্যপরি অপারেশনে পাকিস্তান আর্মির লাইফ লাইন ভৈরব-শেরপুর নদীপথ তাদের জন্য প্রতিকুল হয়ে গেছে। এসময় জগতজ্যোতি দাসকে আরেকটি গুরুদায়িত্ব দেয়া হয় সাব-সেক্টর কমাণ্ড থেকে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রধান বিদ্যুৎ লাইনটি এসেছে আশুগঞ্জ থেকে শাহজিবাজার হয়ে বাহুবলের উপর দিয়ে। নৌ-যান ডুবানো, ব্রীজ-কালভার্ট ধ্বংসের পাশাপাশি বিদ্যুৎ লাইন অকার্যকর করার বিশেষ প্রশিক্ষন ছিলো দাসপার্টির। তাই তাদের উপর দায়িত্ব পড়ে টেকেরঘাট থেকে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুৎ লাইন উপড়ানোর। বাহুবলের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্ষেত্রে সহযোগীতা করবেন। বিশেষ এই অপারেশনের জন্য ৪২ জন সহযোদ্দাহ নিয়ে জ্যোতি আসেন কুঁড়িতে, সালেহ চৌধুরীর সমন্বয় কেন্দ্রে ১৪ নভেম্বর। এখান থেকে তারা চলে যান খালিয়াজুড়ি থানার অন্তর্গত কল্যাণপুর গ্রামে। এর পাশে শাল্লা থানা তখন পাকিস্তান আর্মির দখলে। এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুকুমার দাস , জ্যোতিকে অনুরোধ করেন শাল্লা মুক্ত করতে তাকে সহযোগীতা করার জন্য। ১৫ তারিখে শাল্লা ঘুঙ্গিয়ার গাঁওয়ে পাকিস্তান আর্মির সাথে তাদের গুলী বিনিময় হয়। ১৬ নভেম্বর ভোরবেলা তারা রওয়ানা দেন বাহুবলের দিকে, পরিকল্পনা ছিলো আজমিরীগঞ্জ হয়ে যাওয়া হবে। আজমিরীগঞ্জ যাওয়ার আগেই বদলপুরের কাছে রাজাকারদের দল দেখে জ্যোতি ৩০ জনকে এখানে রেখে বারোজনকে সাথে নিয়ে রাজাকারদের পিছু ধাওয়া করেন। এটা ছিলো তাঁদের পাতানো ফাঁদ। রাজাকারের দল এগিয়ে গিয়ে পালিয়ে যায় তার নিজের গ্রাম জলসুখার দিকে আর তাদের বারোজনের দল আটকে যান পাকিস্তান আর্মির ত্রি-মুখী আক্রমনে।
১৬ নভেম্বরের এই যুদ্ধে শহীদ হন দলপতি জগতজ্যোতি দাস ও গোপেশ। মাথায় গুলিবিদ্ধ হন আইয়ুব আলী আর বুকে ইলিয়াস চৌধুরী।
১৬ নভেম্বরের পর দাসপার্টির কমাণ্ডারের দায়িত্ব পান তারই বন্ধু শফিকুল হক চৌধুরী। ডিসেম্বরের তেরো তারিখে আজমিরীগঞ্জ থানা সদর মুক্ত করে দাসপার্টির যুদ্ধ শেষ হয়।
পরে জানুয়ারী মাসে সুনামগঞ্জে ক্যাপ্টেন মুত্তালিব এর কাছে দাস পার্টি তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে।

ইলিয়াসের কাছ থেকে তাদের যুদ্ধদিনের গল্প শুনতে শুনতে সেহরির সময় হয়ে আসে। সেহরির পর ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে আবার বের হবো আমরা খৈয়াগোপির বিল, জলসুখা, পাহাড়পুর,মাকালকান্দির উদ্দেশ্যে । কিন্তু একটা ইস্যু নিয়ে কথা বলা আজই দরকার।
‘মোহাম্মদ আলী কি আসলেই স্পাই ছিলো?’
প্রশ্নটা করি এবার ইলিয়াসকে।
একই প্রশ্ন করেছিলাম সালেহ চৌধুরীকে ও। অক্টোবরের মাঝামাঝি দিকে মার্কুলির কাছে যে বার্জ দখল হয় সেটি থেকে উদ্ধার করা হয় মোহাম্মদ আলী নামে এক কিশোরকে। বয়স বারো/ তেরো হলে ও খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। ছন্নছাড়া টাইপের এই ছেলেটি তার বাড়ি নারায়নগঞ্জ থেকে পালিয়ে বার্জে উঠে গিয়েছিলো। বার্জটি দখল করে ডুবিয়ে দেয়ার পর ছেলেটিকে নিয়ে সংকট তৈরী জ্যোতি তার দলের সাথেই একে রেখে দেন। দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জগতজ্যোতি, এই কিশোরকে খুবই স্নেহ করতেন। সপ্তাহ তিনেক পর ছেলেটির বাবা খুঁজে খুঁজে এসে উপস্থিত হন কুঁড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা দলের কাছে। তখন জানা যায় যে, ছেলেটির বাবা পাকিস্তান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা। ইতিমধ্যে মাসখানেকের অবস্থানে বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটি দাসপার্টির সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ, এমনকি পরবর্তী পরিকল্পনা ও তার জানা ছিলো।
ইলিয়াস বলেন- তিনি সহ অন্যরা যুদ্ধের নিয়ম মেনে ছেলেটি ও তার বাবাকে গুলী করে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্নেহপ্রবন জ্যোতি তাকে চলে যেতে দেন। এরা চলে যাবার পরের অপারেশনেই জ্যোতিকে প্রান দিতে হয়। বদলপুরের সেই যুদ্ধের ধরন নিশ্চিত করে- পাকিস্তান আর্মির কাছে খবর ছিলো তাদের, সেই অনুযায়ী তাদের পরিকল্পনা ছিলো, এমনকি বিমান আক্রমনের ও প্রস্তুতি ছিলো।
এপ্রিল মাসে যখন জামালগঞ্জ গিয়েছিলাম, মুক্তিযোদ্ধা মদরিছ আমাকে বলেছিলেন- এই ছেলেটি তার বাবার কাছে দাসপার্টির সব খবর দিয়েছিলো এবং তার বাবার কাছে থেকে পাকিস্তান আর্মি তাদের পরবর্তী অপারেশন সম্পর্কে অবগত হয়েছিলো। ইলিয়াস ও জোর গলায় এটি বলেন যে তারা মোহাম্মদ আলীর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন।
কিন্তু সালেহ চৌধুরীকে আমি এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বিষয়টাকে গুরুত্ব দেননি একেবারেই। বরং বলেন যে, মোহাম্মদ আলীর বাবা- আইবি’র ইন্সপেক্টর যখন তাদের কাছে এসেছিলো তার ছেলেকে নিয়ে যেতে তখন তিনি তার কাছে দুটো চিঠি পাঠান ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার জন্য। লোকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিঠিগুলো জায়গামতো পৌঁছে দিয়েছিলো।
৭৩ এর দিকে মোহাম্মদ আলী ঢাকায় তার সাথে যোগাযোগ করে কিন্তু পরে যখন শুনতে পান যে সে মীরপুরের দিকে একটা বাড়ি দখল করে বসেছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে তখন তাকে তাড়িয়ে দেন।
কথা প্রসঙ্গে ইলিয়াস জানান যে- দাসপার্টির আরেক সদস্য কিশোরগঞ্জের রওশন এর সাথে কিছুদিন আগে মোহাম্মদ আলী যোগাযোগ করেছে তার স্বাক্ষ্যের জন্য। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য রণাঙ্গনের একজন সহযোদ্ধার স্বাক্ষর লাগে। মোহাম্মদ আলী সেই স্বাক্ষর চায়।
সেহরির সময় ও শেষ হতে চলছে তখন। আমরা দ্রুত সেহরি করতে করতে কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা রওশনকে ফোন দেই, তাঁর সাথে কথা বলে বলে মোহাম্মদ আলীর ফোন নাম্বার নেই। এই মোহাম্মদ আলীকে ও দরকার।

সামান্য সময়ের যখন আমরা বিছানায় যাই, ফজরের আজান হচ্ছে তখন। ঘন্টাখানেক পরেই উঠে যেতে হবে। দীর্ঘ ঘটনাবহুল আরেকটা দিন আমাদের সামনে।


মন্তব্য

শান্ত এর ছবি

যতটুকু মনে হয় মোহাম্মদ আলী অবশ্যই স্পাই ছিল। তাকে সরাসরি একটা প্রশ্ন করার প্রস্তাব দিলাম। "কেন এই বিশ্বাসঘাতকতা?" মোহাম্মদ আলীর স্বাক্ষাতকার এর অপেক্ষায় রইলাম।

দাস পার্টি'র সব জীবিত সদস্যদেরকে এক জায়গায় করে একটা গ্রুপ ছবি তোলে রাখার ব্যবস্থা করা যায় না। সেটা আজমিরিীগঞ্জ বা জলসুখা গ্রামে বা কোন এক জায়গায়। হয়তো বার্ধক্যের কারণে অনেকে আসতে পারবেন না। তবুও যতজনকে সম্ভব।

__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

পড়ছি। চলুক

রণদীপম বসু এর ছবি

চলুক চলুক এবং আপনাদের অভিযান সফল হোক আমাদের প্রয়োজনেই।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

হিমু এর ছবি

চলুক।

নজমুল আলবাব এর ছবি

শফিকুল চৌধুরী বল্লেতো সবাই চিনবে না। সাথে বাচ্চুও বলতে হবে।

কুঁড়ি বল্লনপুর না বল্লভপুর?

মোহাম্মদ আলীর বাপ যাই থাকুক। সে স্পাই না হয়ে যায় না। আদতেই এই লোক ইতর। নয়তো মুক্তিযুদ্ধা পরিচয় দিয়ে বাড়ি দখল করতো না সেই তরুণ বয়েসে। আর এখন সার্টিফিকেটের জন্য স্বাক্ষর চাইতো না।

চলুক। চলুক

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কুঁড়ি-বলনপুর।
মোহাম্মদ হয়তো স্পাই ছিলোনা। কৈশোরের সহজ আবেগে হয়তো বাবাকে জানিয়েছে সব। তার বাবা আইবি ইন্সপেক্টর ছিলো।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তানিম এহসান এর ছবি

এই সিরিজ’টাতে আমার শুধু বলতে ইচ্ছে করে, আছি, সাথে থাকছি। হাওরের মুক্তিযুদ্ধের গল্প হাওরের মানুষের মুখের কথায় কেউ আগে লিখেছে বলে আমার জানা নেই। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তানিম এহসান এর ছবি

কিশোরগঞ্জের শহীদ সিরাজ সম্পর্কে আরও একটু ডিটেইলস দিতে পারবেন? কিংবা কিশোরগঞ্জের আরও কারও সম্পর্কে? আমি একটু খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করতাম নিজের এলাকায়; কতদূর পারবো জানি না তবে একটা চেষ্টা করতে চাইছি।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

প্রথম পর্বে কিছুটা আছে উনার সম্পর্কে। শহীদ হবার কয়েকদিন আগে বাবাকে চিঠি লিখেছিলেনঃ
সিরাজ শহীদ হবার এক সপ্তাহ আগে তার বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি সহযোদ্ধাদের মারফত পৌঁছায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখান থেকে নিয়মিত এই চিঠি পাঠ হতো মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে।

চিঠিটি ছিলো এরকমঃ
‘টেকেরঘাট হইতে’
তারিখঃ ৩০.০৭.৭১
প্রিয় আব্বাজান,
আমার ছালাম নিবেন। আশা করি খোদার কৃপায় ভালোই আছেন। বাড়ির সকলের কাছে আমার শ্রেনীমত ছালাম ও স্নেহ রহিলো। বর্তমানে যুদ্ধে আছি। আলী রাজা, রওশন, সাত্তার, রেণু, ইব্রাহিম, ফুলমিয়া সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করিবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারন দেশ স্বাধীন না হলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবেনা। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করিবনা। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে, চাচা-মামাদের ও বড়ভাইদের নিকট আমার ছালাম। বড়ভাইকে চাকরিতে যোগ দিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সমোয় মৃত্য হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলে ও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।
আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারন নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মতো শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সাধ মিটে যাবে। দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য জন্য দোয়া কর, মীরজাফরি করিওনা। কারন মুক্তিফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবেনা এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দিবেনা।
ছালাম, দেশবাসী ছালাম।
ইতি মো। সিরাজুল ইসলাম। '

এডভোকেট আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জের তরুনরা মুলতঃ সুনামগঞ্জ হয়েই ট্রেনিং এ গিয়েছিলেন। সিরাজ ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ছিলেন গুরুদয়াল কলেজের। সিরাজ সহ কিশোরগঞ্জের আট-দশজন টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের দাসপার্টিতে সংযুক্ত হয়েছিলেন। সিরাজ শহীদ হবার পর কিশোরগঞ্জের এরা এদিক ছেড়ে নিজেদের এলাকায় চলে যান যুদ্ধে। টেকেরঘাটে উনার কবর দেখেছি আমি। সাচনায় দেখে এসেছি ঐ জায়গাটা যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

রওশন, নজরুল ঠাকুর সহ মিঠামইন ও ইটনার কয়েকজনের নাম পেয়েছি আমি। এদের মধ্যে রওশন এর সাথে আমার ফোনে আলাপ হয়েছে। ইচ্ছে আছে কিশোরগঞ্জের উনাদের সাথে দেখা করার।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

গগন শিরীষ  এর ছবি

অসাধারন! এই শান্ত নরম বাংলায় এরকম থ্রিলার রচিত হয়েছিল একাত্তরে,সেটা এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়!

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

সাথে আছি, থাকবো।

____________________________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।