সকাল সাতটার দিকে আমরা কাকেলছেও গ্রামের নদীর ঘাটে। ইলিয়াস পড়েছেন গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা ইউনিফর্ম পায়ে বুট মাথায় ক্যাপ। জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পোষাক এটি। ইলিয়াস তার সবথেকে বেদনাবিধুর যুদ্ধক্ষেত্রে আজ ফিরে যাবেন প্রায় ৪৪ বছর পর যোদ্ধার সাজে।
আমাদের আজকের পরিকল্পনায় জগতজ্যোতি দাসের গ্রাম জলসুখা। না তার পরিবারের কেউ সেখানে নেই এখন আর, ভিটে বিক্রী হয়ে গেছে। আমরা যাবো তার ছোটবেলা বন্ধু ও যুদ্ধদিনের সহযোদ্ধা আব্দুর রশিদের সাথে দেখা করতে, যে জায়গা দিয়ে তার লাশ রাজাকারেরা নিয়ে এসেছিলো প্রদর্শনের জন্য সেই জায়গাটা দেখা। তারপর জগতজ্যোতি দাসের শেষযুদ্ধের স্থান খৈয়াগোপির বিল, সম্ভব হলে পাহাড়পুর এবং অবশ্যই মাকালকান্দি।
এবার আমাদের নৌকা চলছে উজানে, কাকেলছেও থেকে আজমিরীগঞ্জের দিকে। এখনো রোদ উঠেনি তেমনভাবে, ছায়া ছায়া ভেজা ভেজা ভাব, আকাশে মেঘ আছে, নদী ও বিশাল। গতকাল সারাদিন যে জায়গাগুলো ঘুরেছি সেগুলো ক্রমশঃ পেছনে সরে যাচ্ছে।
এ জীবনে হয়তো আর কোনদিন এসব জায়গায় আসা হবেনা। ইলিয়াস চোখ বুজে বিশ্রাম নেন। নজরুল ও তানিম সিনেমার গল্প করে। দাসপার্টি নিয়ে সিনেমা করতেই হবে, কোথায় কোথায় শ্যুট করা যেতে পারে- দৃশ্যায়ন কেমন হবে, চরিত্রগুলো কেমন বাছাই করতে হবে এইসব গল্প করে তারা- আমি শুনি।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর হাতের ডানে আজমিরীগঞ্জ বাজার পেরোয় আমাদের নৌকা। আজমিরীগঞ্জ নামতে পারলে ঐ জায়গাটা দেখা যেতে পারতো যেখানে জগতজ্যোতির ক্ষতবিক্ষত শরীর বেঁধে রাখা হয়েছিলো প্রদর্শনীর জন্য। ইলিয়াসের সাথে কথা বলি কিন্তু তিনি বলেন আজমিরী বাজারে যেতে হলে ঘুরে যেতে হবে, সে ক্ষেত্রে পরবর্তী গন্তবব্যগুলোতে দেরী হয়ে যাবে। দুদিন আগে সন্ধ্যাবেলা আমরা আজমিরীগঞ্জ বাজারে পৌঁছেছিলাম। প্রায় অন্ধকারে দেখেছিলাম ‘মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স’ নামে একটা ভবন উঠছে। ইলিয়াস জানান এর কাছাকাছিই ছিলো সেই খুঁটি যেখানে যীশুর মতো বিদ্ধ হয়েছিলেন জ্যোতি। একজন মিথ, আরেকজন আমাদের খাঁটি করুণ বাস্তবতা।
আজমিরী থেকে আরো বেশ কিছু সময় উজানে এগিয়ে আরেকটা ঘাঁটে থামে আমাদের নৌকা। পিরোজপুর। দুজন মধ্যবয়স্ক আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সেখানে, এরা স্থানীয় আনসার ভিডিপির সদস্য- ইলিয়াস তাদের বলে রেখেছিলেন। নদীর এই পাড় থেকে মাইল দুয়েক পায়ে হেঁটে আমাদের যেতে হবে। তারপর আরেকটা নদী খেয়া নৌকায় পাড় হয়ে যেতে হবে জলসুখা। রাস্তার অবস্থা এতোই খারাপ, আমাদের পায়ের জুতা খুলে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হবে। শুধু ক্যামেরা, খাবার পানির বোতল, কাঁধের গামছা ছাড়া বাকী সব আমর নৌকায় রেখে নামি। ইলিয়াস তার সামরিক বুট খুলেন না, ডায়াবেটিক আক্রান্ত শরীরের পায়ের নিরাপত্তা তার জরুরী। পরিকল্পনা হয় জলসুখা থেক আবার নৌকায় ফিরে তারপর যাবো খৈয়াগোপির দিকে।
এবার আমরা পা টিপে টিপে হাঁটা শুরু করি। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। এঁটেল মাটির রাস্তা। পা আটকে রাখতে চায়। এভাবেই এগোতে থাকি আমরা সতর্কপায়ে। এগোতে এগোতে দূরে জলসুখা গ্রাম দেখা যায়। আরো সামনে গিয়ে খেয়া নৌকায় উঠতে হবে। এসময় হঠাৎ করেই বামে একটা বাঁধের মতো কিছু চোখে পড়ে এবং আমাদের এগিয়ে নিতে আসা একজন ইলিয়াসকে বলেন ঐতো ঐদিকে খৈয়াগোপির বিল।
মুহুর্তটা নাটকীয়। আমাদের পরিকল্পনায় ছিলো জলসুখা থেকে ফিরে নৌকা নিয়ে ঐদিকে যাওয়া কিন্তু এইদিকে পায়ে চলা আরেকটা রাস্তার কথা শুনে- আমাদের সাথে কোন কথা না বলেই ইলিয়াস হাঁটা শুরু করেন। আমরা তাকে অনুসরন করি। ইলিয়াসের হাঁটার গতি বাড়তে থাকে। ষাটোর্ধ একটা মানুষ, যার শরীর ডায়াবেটিস আক্রান্ত, শরীরের তিনটে জায়গায় যুদ্ধের জখম- মানুষটা হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দৌড়াতে থাকে। আমি, নজরুল, তানিম ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়ি। তানিম ইলিয়াসের ছুটে যাওয়া দৃশ্যবন্দী করতে থাকে। একটা সময় মনে হয় গাঢ় সবুজ পোষাক গায়ে মানুষটা বুঝি দিগন্তে হারিয়ে গেলো।
আমরা একটা ছোট্ট খাল, অনেকগুলো হাঁসের পাল, ডানে তেপান্তরের মতো একটা মাঠ তার ঐ পাড়ে জলসুখা গ্রাম রেখে যখন ইলিয়াসের পাশে দাঁড়াই তখন তিনি হাঁপাচ্ছেন। মানুষটা মাইল দেড়েক জায়গা প্রায় দৌড়ে এসেছে। এখানে নদীর বিশাল একটা বাঁক। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার বাম দিকে নদী চলে গেছে ভাটিতে আজমিরীগঞ্জ, কাকেলছেওর দিকে আমরা যেদিক থেকে এসেছি। আর ডানে বাঁক পেরিয়ে চলে গেছে মার্কুলী, শাল্লার দিকে।
একটু ধাতস্থ হলে পড়ে ইলিয়াস আমাদেরকে নিশানা দেখান। সেইসময় নদী আরেকটু উত্তরের দিকে সরানো ছিলো। নদীর পাড়, পাড়ের পর একটা বিল, নভেম্বর মাসে শুকনা ছিলো। জিয়াউর রহমানের আমলে খালকাটা কর্মসূচীর কারনে সেই বিলটা আর নেই -নদীর অংশ হয়ে গেছে।
ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত ইলিয়াসকে পানির বোতল এগিয়ে দেই, রোজা মুখে ইলিয়াস মাথায় মুখে পানি ঢালেন।নদীর পাড়ে প্রায় পা ডুবিয়ে বসি, তাকে ও বসাই। কিছুক্ষন পর বলি ‘ইলিয়াস ভাই এইবার ধীরে ধীরে সেই দিনের ঘটনাগুলো বলেন’
কয়েকটা নৌকায় তারা ৪২ জনের দল যাত্রা শুরু করেছিলেন খালিয়াজুরির কল্যানপুর থেকে। এই নদীপথ ধরে আজিমিরীগঞ্জ পেরিয়ে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস করা ছিলো তাদের মুল অপারেশন। মাঝখানে সুকুমার দাসের দলকে সহযোগীতা করার জন্য ঘুঙ্গিয়ারগাঁও- শাল্লায় তারা পাকিস্তান আর্মির সাথে গুলী বিনিময় করেছেন। ভোরবেলা সেদিক থেকে রওয়ানা দিয়ে নয়টার দিকে এসে পৌঁছেছেন বদলপুর ইউনিয়ন অফিসের সামনে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি নদীর বাঁকে, বদলপুর সেখান থেকে মাইল খানেক আগে। ইউনিয়ন অফিসের সামনে তাদের চোখে পড়ে রাজাকারদের কয়েকটি নৌকা, জেলেদের নৌকা আটকে চাঁদা তুলছে। এসময় একজন জেলে ইলিয়াসকে চিনতে পেরে অনুরোধ করেন- ‘ ও দাসবাবুর ভাই, আপনারা আমাদের বাঁচান’
রাজাকারদের নৌকা তারা আক্রমন করেন, কয়েকটা মারা যায় ঐখানেই। দুই নৌকা পালিয়ে আসতে থাকে এদিকে। জ্যোতি তখন বাকীদের ঐখানে অপেক্ষা করতে বারোজনকে নিয়ে ঐ দুই নৌকা তাড়া করেন। অন্যরা তার সাথে আসতে চাইলে ধমক দেন- কয়টা রাজাকার ধরার জন্য সবার আসার দরকার কী?
রাজাকাররা নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে শুকনো বিল পেরিয়ে পালিয়ে যায় জলসুখার দিকে। জ্যোতি তার গ্রাম জলসুখার একেবারে কাছে এসে ও ফিরে যান। কাছাকাছি আরেক দালালের বাড়িতে এসময় তারা মর্টার চার্জ করেন।
এখান থেকে নদীতে রাখা নৌকায় ফিরে যাবার আগেই তারা চায়নিজ রাইফেলের গুলীর আওয়াজ শুনেন। রাজাকারেরা চায়নিজ রাইফেল পেতোনা, এদের থাকতো বন্দুক। চায়নিজ রাইফেল ছিলো শুধু পাকিস্তান আর্মির কাছে। নদীর পাড়ে যাবার আগে বিলের কাছে গিয়েই দেখেন একদিকে আজমিরীগঞ্জ, অপরদিকে শাল্লা ও মার্কুলির দিক থেকে গানবোট করে পাকিস্তান আর্মিরা এসে নদীর পাড়ে পজিশন নিচ্ছে। বদলপুরের দিকে ও গুলীর আওয়াজ। বুঝতে পারেন, ঐদিকে ও আক্রমন করেছে পাকিস্তান আর্মির আরেকদল আর তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে দুইদিক থেকে।
দুইদিক থেকেই এসে পাকিস্তান আর্মি পজিশন নেয় নদীর পাড়ে আর তারা বারো জন্য নদীরপাড় ও বিলের মাঝখানে। দূরত্বটা এতোই কাছাকাছি যে তারা জওয়ানদের পজিশন নেয়ার জন্য অফিসারদের দেয়া উর্দূ কমান্ড ও শুনছিলেন। শুরু হয় সামনাসামনি যুদ্ধ। ইলিয়াস ও জ্যোতি সামনের কলামে- দুজনের হাতেই মেশিন গান আর দু ইঞ্চি মর্টার- এরপর মতিউর, রশিদ, আইয়ুব আলী, বিনোদ বিহারী বৈষ্ণব, ধন মিয়া, কাজল, সুনীল, নীলু
জ্যোতি সবাইকে উৎসাহ দেন- আজকে শালাদের জ্যান্ত ধরবো হাতেনাতে। দুপক্ষেই আক্রমন পালটা আক্রমন চলতে থাকে, বেলা বাড়তে থাকে। মাথার উপর দিয়ে কয়েকবার চক্কর দিয়ে যায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফগার। আইয়ূব আলীর মাথার পাশে গুলী লাগলে জ্যোতি তাকে আরো দুজন সহ পিছিয়ে বদলপুরের দিকে পাঠিয়ে দেন। এরপর আরো একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
বদলপুরে অবস্থানরত মুল দলটি ও এদিকে এগিয়ে আসতে পারেনা তাদের সহযোগীতার জন্য, পাকবাহিনীর আরেকটি দল তাদেরকে ব্যস্ত রাখে উপুর্যপরি আক্রমনে।
ইলিয়াস এসময় জিজ্ঞেস করেন – ‘দাদা কী করবো?’
জ্যোতি নির্মোহভাবে বলেন- ‘তর যা খুশী কর’
কমাণ্ডার যেনো জানতেন এটাই তার শেষ যুদ্ধ। শেষযুদ্ধের ভার যেনো তিনি দিয়ে যান প্রিয় সহযোদ্ধা ইলিয়াসকে। এদিকে গুলী ও ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসতে থাকে। বিনোদবিহারী সহ আরো দুজনকে তারা বদলপুর থেকে যে কোনভাবেই হোক গুলী নিয়ে আসতে পাঠান। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে গুলী এসে লাগে ইলিয়াসের বুকের বাম পাশে। হাত দিয়ে দেখেন হৃদপিন্ড ভেদ না করে গুলী বেরিয়ে গেছে।
মাথার গামছা খুলে বেঁধে দিতে দিতে জ্যোতি জিজ্ঞেস করেন- বাঁচবি?
ইলিয়াস জবাব দেন- বাঁচতে পারি।
জ্যোতি আবার বলেন- তাহলে যুদ্ধ কর।
বারো জন থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে সংখ্যা এসে দাঁড়ায় পাঁচজনে। তারপর আরো কমে শুধুমাত্র জগতজ্যোতি ও ইলিয়াস। এমনকি জ্যোতির এলএমজিতে গুলী সরবরাহকারী ও নেই তখন। এবার ইলিয়াস গুলী লোড করতে থাকেন আর আর জ্যোতি একশো গজ দূরে সারিবদ্ধ পাকিস্তান আর্মিকে টার্গেট করে গুলী করতে থাকেন। এর ফাঁকে দু ইঞ্চি মর্টারের গোলা ও ছুঁড়তে থাকেন তারা। বারো থেকে পনেরোজনের মতো পাক সেনা নিহত হয়।
মধ্য নভেম্বরে বিকেল দীর্ঘ নয়। মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলী। এর ভেতর বুদ্দিদীপ্ত কৌশলে লড়াই করতে করতে তারা আশাবাদী হন আর কিছুক্ষন টিকে থাকা গেলে, অন্ধকার হয়ে গেলেই এই ব্যুহ ভেদ করে তারা বেরিয়ে যাবেন।
হায়! সময় ঐ সময়টুকু দেয়নি সেদিন।
সন্ধ্যা হবার ঠিক আগে জ্যোতির মাথা বুলেট বিদ্ধ হয়। তার নিজের মাতৃভাষায় জগতজ্যোতি শুধু একটি বাক্য উচ্চারন করেন- ‘আমি যাইগ্যা’
২০১৫ সালের জুনের ২০ তারিখ। ৪৩ বছর ৪ মাস ২৬ দিন পর ঠিক সেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ় ইলিয়াস থরথরে আবেগে কাঁপতে থাকেন, তাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হয়।
‘ গলাকাটা মহিষ দেখছেন কোনদিন? কেমন ছটফট করে, দুনিয়া তামাম করে দিতে চায়! দাদার রক্তমাখা শরীর এমন ছটফট করে। আমি জড়ায়ে ধরি তারে ‘দাদা ও দাদা’। আমার দাদা একবার মাথা তুলে, মাথা পড়ে যায়। নাই , আমার দাদা নাই, দাদা নাই...’
সেইদিন বোধ হয় ইলিয়াস কাঁদতে পারেননি, কাঁদার সুযোগ ছিলোনা যোদ্ধার। আজ ৪৩ বছর পর স্বাধীন মাটিতে ইলিয়াস কাঁদেন, চিৎকার করে কাঁদেন তার দাদার জন্য- তার কমান্ডারের জন্য। এই কান্না বড় তীব্র, শোকার্ত, কুশিয়ারার প্রবাহমান স্রোতের চেয়ে ও অধিক আর্তনাদময়। সময় যেনো থমকে থাকে এই মুহুর্তে।
দীর্ঘ বড় দীর্ঘ মনে হয় এই থমকে থাকা সময়। অনেকক্ষন পর নিষ্ঠুরের মতো আমি তার ঘোর ভাঙ্গি।
‘তারপর কী হলো ইলিয়াস ভাই?’
সেই প্রায় আলো ফুরিয়ে আসা ঘাতক বিকেল বেলা ইলিয়াস তার কমান্ডারের নিথর শরীর বিলের কাদা পানির ভেতর যতোটুকু সম্ভব পুঁতে ফেলেন- যাতে শত্রুর হাতে এই শহীদের কোন অবমাননা না হয়। নিজের এসএমজির সাথে হাতে তুলে নেন দলনেতার এলএমজি ও । তার বুকে বাঁধা গামছা ছুইয়ে রক্ত পড়ছে তখনো- গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে পেছনে ফেরতে থাকেন ইলিয়াস।
সন্ধ্যের মুখে বদলপুর গ্রামে যখন ঢোকেন সহযোদ্ধা আতাউর ও কাইয়ূম তার রক্ত ও কাঁদামাখা শরীর চিনতে না পেরে চ্যলেঞ্জ করেন। পরে তার গলা শুনে জিজ্ঞেস করেন ‘দাদা কোথায়? ‘ ইলিয়াস জবাব না দিয়ে বলেন তাড়াতাড়ি এখান থেকে নিরাপদ কোথাও যেতে হবে। গ্রামের ভেতর পিয়ারী বাবুর বাড়িতে তখন যুদ্ধক্লান্ত সহযোদ্ধারা সবাই ইলিয়াস ও জগতজ্যোতির অপেক্ষায়। পেছন থেকে তখনো তাড়া করে আসছে পাকিস্তানী মিলিটারী ও রাজাকারদের সম্মিলিত দল।
ইলিয়াস দ্রুত সবাইকে অবগত করেন ‘দাদা নাই’। শোকবিহবল সবাই ইলিয়াসের হাতে জ্যোতির এলএমজি দেখেই বুঝতে পারেন প্রিয় দলনেতা আর বেঁচে নেই। কিন্তু যুদ্ধের মাঠে শোকগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে আত্মরক্ষা জরুরী এই শিক্ষা ছিলো সেদিনের গনযোদ্ধাদের। এ ছাড়া সাতজন সহযোদ্ধা গুরুতর আহত। পায়ে গুলীবিদ্ধ গোপেন্দ্র দাস এর অবস্থা সবচেয়ে গুরুতর। আবু লাল কে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, সম্ভবতঃ শত্রুরা জিবিত কিংবা মৃত অবস্থায় নিয়ে গেছে তাকে। এ ছাড়া ভারী অস্ত্রসহ আরো চারজন খোঁজ।
রাতের অন্ধকারে পাক আর্মি ও রাজাকারদের দল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে চাইছে এই বিধ্বস্ত, আহত, দলনেতাহীন দলটিকে। গুলী করতে করতে তারা এগিয়ে আসছে দ্রুত। নিখোঁজ পাঁচজনের জন্য আর অপেক্ষা না করে আহত সাতজন সহ বাকী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নৌকায় চড়ে বসেন। রাতের গভীর অন্ধকারে নৌকা চলতে থাকে হাওর থেকে হাওরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পাক আর্মি ও ও রাজাকারদের টহল দল ও নৌকা নিয়ে হাওরে হাওরে খুঁজতে বের হয় ক্লান্ত যোদ্ধাদের ধরতে।
ক্রমাগত রক্তক্ষরন হতে হতে নৌকাতেই মারা যান গোপী। প্রথমে আড়িয়ামুগুর, তারপর কুঁড়িবলনপুরের আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছায় দুঃস্বপ্নের মতো একটা ভয়ংকর যুদ্ধদিন কাটিয়ে আসা দলটি।
‘গোপেন্দ্র দাস এর লাশ তাহলে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন?’
ইলিয়াস মাথা নাড়েন। না, লাশ ফেলে দেয়া হয়েছিলো হাওরের পানিতে। ভয়ংকর যুদ্ধের রাতে, যখন শত্রুরা প্রবল উদ্যমে খুঁজে বেড়াচ্ছে হতোদ্যম ক্লান্ত একটা যোদ্ধাদলকে যারা মোটামুটি নিশ্চিত এই অন্ধকার রাত আর ফুরাবেনা, নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরা হবেনা তখন নিহত সহযোদ্ধার লাশ বোধ হয় হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া যায়। এটাই যুদ্ধ, যুদ্ধ মানেই অস্বাভাবিকতা। ইলিয়াস তার দাদার লাশ না আনলে ও এলএমজিটা নিয়ে এসেছিলেন। এটাই যুদ্ধ, এটাই যুদ্ধের প্রশিক্ষন।
আরো বেশ কিছুক্ষন পর ইলিয়াস কিছুটা সুস্থির হলে আমরা ফিরতি পথ ধরি। এবার আগের মতো অতো জোরে, প্রায় দৌড়ে নয় ইলিয়াস হাঁটেন ধীর পায়ে। বুঝি, স্মৃতির আঘাত ও আবেগের ক্ষরণ তাকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে এখন। একসময় সেই জায়গায় এসে পৌঁছাই যেখান থেকে আমরা খৈয়াগোপীর দিকে রওয়ানা দিয়েছিলাম।
এটা একটা গুচ্ছগ্রামের মতো। কয়েকটা ঘরবসতি। এখান থেকে সোজা জলসুখা গ্রাম দেখা যায়। পরিকল্পনা হয় আমরা এখানে অপেক্ষা করবো, আমাদের সাথে আসা আনসারের দুজন নদীর ঘাটে গিয়ে নৌকায় রাখা আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে আসবেন, নৌকা ওখান থেকে বিদায় নেবে। আমরা জলসুখা থেকে অন্য নৌকা নিয়ে যাবো মাকালকান্দি।
আর্মিদের মতো পোষাক গায়ে ইলিয়াস,ক্যামেরা নিয়ে আমি নজরুল ও তানিম- গুচ্ছগ্রামের উৎসাহী লোকজন আমাদের ঘিরে ধরে। কয়েকটা চেয়ার আসে আমাদের জন্য। পাশেই একটা টিউবওয়েল। একটা কিশোর চাপ দেয়- আমরা হাত মুখ পা ধুয়ে নিই, পানি খাই।
ইলিয়াস বয়স্ক লোকদের কাছে জানতে চান তারা কবে থেকে আছে এখানে? ঐ ভাটির দিকের নদী ভাঙ্গনের শিকার মানুষজন এরা। নিজেরাই এই জনশূন্য পতিত জায়গায় ঘর তুলে থাকছে, এখনো ভূমির মালিকানা পায়নি।
আমাদেরকে সরকারী লোকজন মনে করে তারা অনুনয় বিনয় করতে শুরু করে। ইলিয়াস হঠাৎ ক্ষেপে উঠেন- গালি গালাজ শুরু করেন লোকজনকে।
উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার মতো করে বলতে থাকেন- ‘এই হারামজাদারা, কেউ কাউরে অধিকার দেয়না। তোমরা এই জমির মালিকানা ছাড়বানা। এই জমিতে, এইখান থেকে এক মাইল দূরে আমার দাদা প্রাণ দিছে- আমার বুকের রক্ত মিশছে এই মাটিতে। কেউ তোমাদের এই মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে পারবেনা’
লোকজন মজা পায়। হাততালি দেয়। টের পাই মানুষটা এখনো আবেগের ক্ষরণ ও স্মৃতির ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
বেশ কিছুক্ষন পর লোকজন নৌকা থেকে আমাদের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এলে এবার আমরা জলসুখার দিকে হাঁটা শুরু করি। আধা কিমি হাঁটার পর একটা নদী কিংবা হাওর। আমরা দেখি একটা বেশ বড় নৌকা আসছে এদিকে। এই নৌকাতেই আমাদেরকে যেতে হবে জলসুখা।
নৌকা তীরে ভিড়লে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন দীর্ঘদেহী, শুশ্রুমন্ডিত একজন বয়স্ক মানুষ। সাদা পাঞ্জাবী, লুঙ্গি, মাথায় টুপি তাঁর চেহারায় একটা সৌম্য শান্ত ভাব, শিশুর সারল্য। ইনিই আব্দুর রশিদ। জগতজ্যোতি দাসের একেবারে ছোটবেলার বন্ধু, যুদ্ধদিনের সাথী। আব্দুর রশীদ এগিয়ে এসেছেন আমাদের নিয়ে যেতে।
ভাটি অঞ্চলের পরিচিত একটা জনপদ। হিন্দু এবং মুসলমান জমিদারদের বাস ছিলো এখানে। একটা সময় হিন্দুপ্রধান থাকলে ও এখন বোধ হয় আর নেই। শুনেছিলাম এই এক ইউনিয়নেই তালিকাভুক্ত রাজাকার ছিলো ৬৫জন। জলসুখার ঘাটে এসে পৌঁছাতে সময় লাগেনা বেশী। আব্দুর রশীদ নামেন, ইলিয়াস নামেন- আমরা তাঁদের অনুসরন করি। বাজারে একটা বড় চালের আড়ত। এর মালিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। ইলিয়াস এখানে বিশ্রাম নিতে থামেন। আওয়ামী লীগ সভাপতির সাথে পরিচয় হয়, মধ্যবয়স্ক মানুষ- দাঁড়ি টুপি পাঞ্জাবী পরিহিত। কথা বলে জেনে নেই যুদ্ধের সময় তিনি কিশোর ছিলেন। যুদ্ধে যাননি, তবে অনতিদূরে খৈয়াগোপির বিলের যুদ্ধ তার মনে আছে। বাবার সাথে ক্ষেতের কাজে ছিলেন, যুদ্ধ শুরু হবার পর পালিয়ে এসেছিলেন।
আমরা আব্দুর রশিদের পাশেপাশে হাঁটি। বলি, সেই জায়গাটা দেখতে চাই যেখান দিয়ে জগতজ্যোতি’র লাশ রাজাকারেরা নিয়ে এসেছিলো দেখানোর জন্য, সেই সময় উপস্থিত ছিলেন এমন একজনের সাথে কথা বলতে চাই। আব্দুর রশিদ বলেন, নিয়ে যাবেন সেখানে। তার আগে আরেকটা জায়গায় যেখানে গনহত্যা হয়েছিলো।
আমরা পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকি। একটু সামনে গিয়েই কয়েকটা ঘর। একটা তুলসী তলা। হিন্দু বাড়ি বুঝতে পারি। কয়েকজন মানুষ এগিয়ে আসেন। আব্দুর রশিদকে দেখে তারা কুশল বিনিময় করেন। কয়েকটা চেয়ার ও আসে। আব্দুর রশিদ একজনকে ডাকেন। উনি ও বৃদ্ধ মানুষ মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি- খালি গা।
জিজ্ঞেস করি তাকে- বলুন তো কি ঘটেছিলো এখানে?
দিন তারিখ মনে নাই। তবে ‘বাইরা’ মাস। মানে বর্ষাকাল। ফাঁকে আব্দুর রশিদকে জিজ্ঞেস করি- আপনারা তখন যুদ্ধে চলে গেছেন? বলেন- হ্যাঁ, তারা চৈত্র মাসের শেষের দিকেই বর্ডার ক্রস করেছিলেন।
এই গ্রামের ছেলে জগতজ্যোতি, আব্দুর রশিদ মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। হিন্দুপ্রধান গ্রাম। রাজাকারদের সহজ টার্গেট। শ্রাবন মাসের একদিনে রাজাকার সিরাজ আর আলী রাজা নিয়ে আসে পাকিস্তান আর্মির এক দল। পেছনের আরেক পাড়া প্রথমে আক্রমন করে। হাওরের দিকে কিছু মানুষ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, বাকী সবাইকে বেঁধে ফেলে ওরা। সেই পাড়া থেকে তারপর আসে এই পাড়ায়। এখানে ও এসে সবাইকে বেঁধে ফেলে। যে বৃদ্ধ আমাদেরকে বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি বলেন- এর কয়দিন আগে আজমিরীগঞ্জ বাজারে তাকে পাকিস্তান আর্মি আটকে নিয়ে গিয়েছিলো ওদের মেজরের কাছে। মেজর তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি মিথ্যে না বলে জানিয়েছিলেন ‘হিন্দু’। মেজর তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো।
এইদিন সেই মেজরই ছিলো দলনেতা। তিনি বহু কসরত করে তার দৃষ্টি আকর্ষন করেন। মেজর তাকে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করে কিছু বলতে চান কিনা?
মৃত্য নিশ্চিত জেনে ও তিনি মরীয়া হয়ে বলেন- হ্যাঁ এখানে সবাই হিন্দু কিন্তু নিরীহ মানুষ, এদের কেউ ‘মুক্তি’ না। ‘মুক্তি’ জগতজ্যোতি আর আব্দুর রশিদের কেউ নয় তারা। তাদেরকে যেনো মেজর প্রাণভিক্ষা দেন।
কিছুক্ষন চিন্তা করে মেজর তার সৈন্যদের নৌকায় ফিরে যেতে বলে নিজেও নৌকায় উঠে পরে। কিন্তু রাজাকার সিরাজ আর আলীরাজা দৌড়ে গিয়ে তাকে অনেকক্ষন ধরে কিছু বুঝায়। পাড়ে তারা তখনো হাত পা বাঁধা। তারা দেখেন মেজর মাথা নেড়ে ‘না’ বলছে কিন্তু দুই রাজাকার হাত জোর করে কাকুতি মিনতি করছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনের সেই ভয়ংকর মুহুর্তে তারা আবারো দেখেন মেজর মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে হাওরের বিশাল জলরাশির দিকে আর দুই রাজাকার ফিরে আসছে রাইফেল হাতে চারজন সৈনিককে নিয়ে। এসেই তারা গুলী শুরু করে নির্বিচার।
মারা যান নয়জন। পরে আরো দুইজন।
আমি জিজ্ঞেস করি- ঠিক কোন জায়গায়?
এর মধ্যে আরো বেশ কিছু মানুষ এসে জমায়েত হয়েছেন। কয়েকজন নারী ও। একজন হাত তুলে দেখান- ঐ যে ওখানে। একেবারে দ্রষ্টব্যহীন একটা গর্তের মতো, একটা ভাগাড়, ময়লা টয়লা ফেলা হয়। একটা গনহত্যার স্মৃতিচিহ্ন নাই হয়ে গেছে কী দারুন অবহেলায়।
বোকার মতো জানতে চাই- তারপর কী হলো? আপনারা লাশগুলো সৎকার করলেন কীভাবে?
জমায়েত কি মুহুর্তের জন্য নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো আমার এমন কান্ডজ্ঞানহীন প্রশ্নে। একজন নারী, মধ্যবয়স্ক নারী ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন আমার কাছে।
‘বাবারে রেজাকারের কোন সৎকার করতে দেয় নাই। গলা খুলে কাঁদতে ও দেয় নাই। চোখের জল নীরবে মুছতে মুছতে হাওরের জলে সব লাশ ভাসায়ে দিছি’
মধ্য দুপুরে তখন গনগনের রোদ। কিন্তু সেই মধ্যবয়স্ক নারীর বর্ণনায় আমার হাড় কাঁপিয়ে শীত আসে। নিহত স্বজনদের লাশ, গুলীতে ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত। কিন্তু কাঁদা যাবেনা, সৎকার করা যাবেনা। হত্যার বিভৎসতার পাশাপাশি স্বজনদের লাশ ভাসিয়ে দিতে হচ্ছে হাওরের ভাসমান জলে। এই লাশ ভেসে ভেসে কোথায় যাবে? কোথায় ডুববে? শকুনে খাবে, মাছে ঠুকরাবে। মুহুর্তের জন্য ৪৩ বছর আগের সেই দৃশ্যে নিজেকে উপস্থিত কল্পনা করে আমি ভয়ে আতংকে শিউরে উঠি।
ঐ পাড়া থেকে উঠে এসে বাজার পেরিয়ে আমরা অন্যদিকে এগোই। আমাদের সাথে আব্দুর রশিদ এবং আরেকজন অশীতিপর বৃদ্ধ, ১৭ নভেম্বর ১৯৭১ সকালে বেলা তিনি উপস্থিত ছিলেন যখন জগতজ্যোতির ক্ষতবিক্ষত লাশ নিয়ে আসা হয় এই গ্রামে। ঢাল পেরিয়ে আমরা একটা পুরনো একটা দালান বাড়ির সামনে আসি। এখানে আমাদের সাথে যোগ দেন আরেক মধ্যবয়স্ক। তিনি জানান এই পুরনো বাড়িটি ছিলো হিন্দু বাড়ি। তারা কিনে নিয়েছেন। যুদ্ধের সময় রাজাকারেরা দখল করে এই বাড়িকে বানিয়ে ছিলো তাদের ঘাঁটি। আমরা বাড়ির সামনের দিকে আসি। এখানে দাঁরিয়ে বুঝি কৌশলগত কারনেই এই বাড়িকে রাজাকার ঘাঁতি বানানো হয়েছিলো। বাড়ির সামনে দাঁড়ালে মোটামুটি একটা প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায় সবদিকে। সোজা সামনে বিল, তারপর নদী। এই বিল ও নদীর মাঝখানেই যুদ্ধ হয়েছিলো সেদিন।
সন্ধ্যাবেলা জগতজ্যোতি শহীদ হবার পর, সম্ভবতঃ রাতের বেলা আর খোঁজ করার সাহস করেনি ওরা। সকাল বেলা লাশ কাদা ও পানির ভেতর থেকে ভেসে উঠে। রাজাকারেরা তখন এই লাশ টেনে নিয়ে আসে তাদের ঘাঁটিতে।
আমাদের সাথে আসা বৃদ্ধটি হাত তুলে দেখান- ঐ ঐদিক থেকে তারা লাশ টেনে আনছিলো এইখানে। ‘এইখানে’ মানে আমরা ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেখানে। মধ্যবয়স্ক লোকটি ও স্বাক্ষ্য দেন- তারা ও ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে দেখছিলেন সে দৃশ্য।
তারপর? তারপর কী হলো?
জগতজ্যোতির মা ও বাবাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসলো রাজাকারেরা। জ্যোতির মা এক অসামান্য দৃশ্যের অবতারনা করলেন। পাথরের মতো শক্ত হয়ে বললেন- এ লাশ তার ছেলে জ্যোতির নয়, জ্যোতির বাম হাতে একটা আঙ্গুল বেশী।
একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলা তার সন্তানের লাশ সামনে রেখে কীভাবে এই অস্বীকৃতির সাহস করলেন? কেনো করলেন? তিনি কি তার বেঁচে থাকা অপর সন্তান ও স্বামীর জীবনের কথা ভাবছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তিনি মারা গেছেন কয়েকবছর আগে।
যুদ্ধ কতো ভয়ংকর ও অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা সে উপলব্ধির ক্ষমতা বোধ হয় আমাদের হবেনা কোনদিন।
বাড়ি ফিরে যেতে যেতে জ্যোতি’র মা বাবা দেখলেন তাদের ভিটেতে আগুন। আর তার লাশ তুলে নেয়া হলো নৌকার সামনে। জলসুখা থেকে আজমিরীগঞ্জ ঘাটে ঘাটে রাজাকারেরা প্রদর্শন করলো পাশবিক উল্লাসে। তারপর আজমিরীগঞ্জ পৌঁছে বেঁধে রাখলো বাজারের প্রাণ কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে।
ঈদের আগের শেষ বাজারে আশে পাশের সব এলাকা থেকে আসা উৎসবমুখর মানুষেরা দেখলো একজন দুস্কৃতিকারী, ভারতীয় দালালের ক্ষতবিক্ষত লাশ। আজমিরীগঞ্জ বাজার থেকে ফটোগ্রাফার ডেকে এনে ছবি ও তুলে নিলো পাকিস্তান আর্মির মেজর। ফটোগ্রাফার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি প্রিন্ট করলেন এক কপি অতিরিক্ত। তারপর সংগোপনে সেই ছবি পাঠিয়ে দিলেন দিরাই- সালেহ চৌধুরী কাছে। সালেহ চৌধুরী’র কাছ থেকে টেকের ঘাট- সাবসেক্টর কমাণ্ডে।
এখান থেকে ফিরে বাজার হয়ে এবার আমরা উপস্থিত হই জগতজ্যোতির জন্ম ভিটেয়। ছোট্ট একট বাড়ী, সামনে উঠোন। বাড়িটা বিক্রী হয়েছে কয়েকবছর আগে। এক হিন্দু ভদ্রলোকই কিনেছেন, জ্যোতির ভাইয়ের ছেলেরা হবিগঞ্জ সদরে থাকেন।
বাড়ির উঠোনে বসি আমরা। এখানেই আব্দুর রশীদের সাথে আমরা কথাবার্তা বলবো, নজরুল ও তানিম ভিডিও করবেন। আমাদেরকে ঘিরে উৎসাহী মানুষজনের বিশাল জটলা। ক্যামেরা দেখে মানুষের ধারনা কোন চ্যানেলের অনুষ্ঠান রেকর্ড হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ভদ্রলোক ও এখানে এসে হাজির হন। আব্দুর রশিদের পাশে তার জন্য ও একটা চেয়ার বরাদ্দ হয় দ্রুত। বুঝি স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোর এ ও এক প্রদর্শন। এলাকায় একটা গুরুত্বপূর্ন ঘটনা ঘটছে, বাইরে থেকে লোকজন এসে আব্দুর রশীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে যাচ্ছে- এর সাথে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রধান সংশ্লিষ্ট না থাকলে হয়না।
আব্দুর রশীদ স্মৃতির গভীরে ডুব দেন। সেই শৈশব থেকে তার বন্ধু। প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়। মেট্রিক পাশ করে জ্যোতি চলে গিয়েছিলেন ভারতে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে আবার ফিরে আসেন গ্রামে। গ্রামের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে ও যোগ দেন কিছুদিনের জন্য। পরে আব্দুর রশিদই তাকে পরামর্শ দেন সুনামগঞ্জ কলেজে গিয়ে ডিগ্রী ক্লাশে ভর্তি হতে। রশীদ নিজে ডিগ্রীতে ভর্তি হতে পারেননি কিন্তু নিজের এই ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। জগতজ্যোতি গরীব ঘরের ছেলে হলে ও পড়ালেখার মাথা ভালো, অনেক বড় হবে একদিন এরকম ধারনা সবারই ছিলো।
জ্যোতি সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হন, বামপন্থী রাজনীতির সাথে আরো বেশী জড়িয়ে পরেন। স্কুল থেকেই জ্যোতি, রশীদ বামপন্থী ছাত্রকর্মী ছিলেন। রশীদ পরে চলে যান জগন্নাথপুরের এক গ্রামে জায়গীর মাস্টারহয়ে।
মার্চের ২৭ তারিখে সুনামগঞ্জ প্রতিরোধ ও পতনের পর জগতজ্যোতি জগন্নাথপুরে তার কাছে যান, সঙ্গে তখন তার লুট করা রাইফেল। জানান, তিনি সীমান্ত অতিক্রম ভারত চলে যাবেন প্রশিক্ষনের জন্য- বন্ধুকে ও নিতে এসেছেন তার সাথে। রশীদ বলেন- তিনি যাবেন কিন্তু কয়দিন পর, বাড়ি গিয়ে আসতে হবে আগে। জ্যোতিকে ও অনুরোধ জানান বাড়ি গিয়ে মাকে দেখে আসতে। কিন্তু জ্যোতি বাড়ি না গিয়ে ওখান থেকেই সীমান্তের দিকে চলে যান। রশীদ যান কয়েকদিন পর। একই প্রশিক্ষন শিবিরে জগতজ্যোতির সাথে দেখা হয় তার পরের ব্যাচে। প্রশিক্ষন শেষে জ্যোতির দলেই তাকে সংযুক্ত করা হয় এবং শেষদিনের যুদ্ধ পর্যন্ত ছিলেন আমৃত্যু বন্ধুটির পাশে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি মাঝেমাঝেই দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করেন। বুঝি, তিনি কিছুটা গুরুত্ব আশা করেন ক্যামেরার সামনে। তাই এবার তার সাথে কথা বলি। জিজ্ঞেস করি- এরকম একজন বীর যোদ্ধা যাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দেয়ার কথা ছিলো, তার জন্য গর্ব বোধ করেন কিনা?
চোখে মুখে রাজনৈতিক ছাপ রেখে তিনি বক্তৃতার মতো করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান এসব নিয়ে বলেন। এবার তাকে জিজ্ঞেস করি- গত ৪৩ বছরে জগতজ্যোতির নামে একটা স্মৃতিচিহ্ন গড়ে উঠলোনা কেনো এই গ্রামে? অথবা এই গ্রামেই যে গনহত্যা ঘটেছে তার কোন স্মারক নেই কেনো?
আওয়ামী লীগ সভাপতি তেমন কোন উত্তর খুঁজে পাননা।
আবার বলি- মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলের একজন নেতা হিসাবে তিনি মনে করেন কিনা এটা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব? মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেন।
‘তাহলে আগামী এক বছরের মধ্যে এই গ্রামে জগতজ্যোতির নামে একটা কিছু করবেন আপনারা?’
তিনি কথা দিয়ে উঠে চলে যান।
আব্দুর রশীদ জানান, কোন জাতীয় দিবসেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ তাদেরকে ডাকেনা। উপজেলা প্রশাসন সরকারী দায়িত্ব হিসাবে ১৬ ডিসেম্বর বা ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়- এই এতোটুকুই।
আরো কয়েকজন বয়স্ক মানুষ এসে অভিযোগ করেন ’৭০ এর নির্বাচনের আগে তারাই খেটেখুটে এই এলাকায় আওয়ামী লীগের সংগঠন করেছেন, অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন কিন্তু বর্তমানে আওয়ামী লীগে তাদের কোন ঠাঁই নেই।
এখান থেকে উঠে এসে সেই চালের আড়তে আমরা ঢুকি আবার। কথা হয় স্থানীয় তরুন তোফায়েল হোসেন লিটন এর সাথে। লিটন জানান গ্রামের নতুন প্রজন্মের কাছে জগতজ্যোতি এক অনন্য সাহসের নাম। ষোল ডিসেম্বর স্থানীয় সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তারা নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। স্থায়ী ভাবে তার নামে একটা পাঠাগার করার পরিকল্পনা ও আছে তাদের।
দুপুর হয়ে গেছে। ইলিয়াস ফিরেন জোহরের নামাজ পড়ে। এবার আমাদের উঠার পালা। আব্দুর রশীদ সহ স্থানীয়রা বভারবার আফসোস করেন- রোজার দিন, কোন আপ্যায়ন করা গেলোনা।
নৌকায় উঠার আগে আব্দুর রশীদের হাত স্পর্শ করি আবার। হয়তো কোনদিন জলসুখা গ্রামে ফিরে আসা হবে কোনদিন কোন কাজে , কিন্তু এই মানুষটার সাথে কি আর দেখা হবে? মানুষগুলো চলে যাচ্ছে দ্রুত, যাবার বয়স হয়েছে তাদের। হাজার বছরে আর একজন মুক্তিযোদ্ধা কি জন্ম নেবে এই দেশে?
কিন্তু খোলা নৌকা। গনগনে রোদ্দুর, খোলা হাওরে এই রোদ আরো তীব্র অনুভূত হয়। কিছু করার নেই। ইলিয়াসের একটা ছোট্ট ছাতা সাথে। তিনি সবুজ ইউনিফর্ম খুলে লুঙ্গী পড়ে মাথার কাছে ছাতা রেখে বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করেন। আমরা রোদে পুড়ে পুড়ে এগুতে থাকি হাওর পাড়ি দিয়ে উত্তরের দিকে, এবারের গন্তব্য মাকালকান্দি।
যেতে যেতে একটানা হাওর, কখনো নির্মেঘ আকাশ, কখনো হালকা মেঘের ছোঁয়া। আদিগন্ত হাওরের পানি নীল দেখায়। দূরে দূরে দিগন্ত রেখায় বিন্দুর মতো একটা একটা গ্রাম দেখা যায়। কোন গ্রাম পেছনে ফেলে, কোন গ্রাম পাশে রেখে ইঞ্জিন চালিত নৌকা এগুতে থাকে। মাঝে মাঝে সময় দেখি। আড়াইটা, তিনটা, সাড়ে তিনটা পেরিয়ে যায়।
এক জায়গায় এসে নৌকার ইঞ্জিন থেমে যায়। তাকিয়ে দেখি চারপাশে ফুটে আছে অসংখ্য শাপলা, নীচে এক্যুরিয়ামের মতো সবুজ শ্যাওলা আর তার ফাঁকে ছোটাছুটি করছে মাছের ঝাঁক। মাঝিরা জানায় ইঞ্জিনে লতা পাতা শ্যাওলা আটকে গেছে। একজন নেমে পরিস্কার করতে থাকে। একটা ছোট্ট নৌকায় দুইটা শিশু, জাল ফেলে বসে আছে। একটু দূরে হাওরের বুকে জংগলের মতো লাগে। এটা কী লক্ষীবাওরের বন?
মাঝিদের জিজ্ঞেস করি, শিশুদের কাছে জানতে চাই- কেউই নাম বলতে পারেনা। আমরা কী এই বন পেরিয়ে যাবো?
না, ইঞ্জিন পরিস্কার করার পর মাঝিরা নৌকা ঘুরায়। এই পথে এতো বেশী শ্যাওলা, লতাপতা- যাওয়া যাবেনা। আরেকদিকে পানির মাঝখানে একটা পথের মতো দেখা যায়। মাঝিরা নৌকা ঠেলে ঠেলে সেই পথে নিয়ে তারপর ইঞ্জিন চালু করে আবার। যেতে যেতে একটা গ্রাম, ভেসে আছে ছোট্ট দ্বীপের মতো।
আমরা জিজ্ঞেস করি- গ্রামের কী নাম?
উত্তর আসে- হারুনী
পালটা প্রশ্ন ভেসে আসে- কই যাবো?
বলি – মাকালকান্দি।
তারা দেখিয়ে দেয়- ঐ, ঐ দেখা যায় জিলুয়া মাকালকান্দি।
সময় প্রায় চারটা। মাকালকান্দির দেখা মিলেনা। মায়া মরিচিকার মতো আমরা ঘুরতে থাকি, আমরা কি দিক ভুল করেছি। চারদিকে থই থই পানি, দূরে দূরে একই রকম গ্রামের রেখা। হয়তো ঐদিকে বানিয়াচং, ঐ পেছনে নবীগঞ্জ, ঐ দূরে দিরাই- এখানে ভুল হতেই পারে।
শেষপর্যন্ত একটা গ্রামের মতো দেখি, পাশাপাশি দুটো মন্দির ভেসে আছে হাওরের পানিতে। এর সাথেই এক চিলতে লম্বাটে একটা গ্রাম। একপাশে গিয়ে আমাদের নৌকা ভিড়ে, কয়েকজন মানুষ বাঁশের বেড়ার কাছ দাঁড়ানো। তাদের জিজ্ঞেস করি- এটা কী মাকালকান্দি?
হ্যাঁ এটাই মাকালকান্দি।
‘এইখানে একটা স্মৃতিসৌধ আছে না?’
‘আছে, গ্রামের ভেতর’
ইলিয়াস নৌকাতেই থাকেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখায়। আমি, নজরুল, তানিম নামি। বাংলাদেশের আর সব গ্রামের মতো নয়। এরকম বিস্তীর্ণ হাওরের মাঝখানে গড়ে উঠা গ্রামগুলোবোধ হয় এরকমই। খুবই সরু, চাপানো। দুই পাশে গাঁয়ে ঘেষে ঘেষে টিনের বেড়া দেয়া ঘরগুলো, মাঝখানে কোনমতে হাঁটা পথ। ঘরগুলো থেকে যারা উঁকি দেয় তার সবাই নারী ও শিশু।
মাকালকান্দি ছোট্ট একটা গ্রাম- একাত্তুরে এই গ্রামের সবাই ছিলো মৎসজীবি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, এখনো তাই। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটু প্রশস্ত একটা জায়গা পাই। এখানে একটা দোকান। দোকানের বারান্দায় বেঞ্চে বসা কয়েকজন পুরুষ মানুষ। তাদের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয়। বলি, এসেছি স্মৃতিসৌধটা দেখবো বলে। আঙ্গুল তুলে দেখান একজন। দোকানের ঠিক উলটো দিকেই সিমেন্টের বাঁধানো একটা দেয়ালের মতো। এটাই স্মৃতি সৌধ। কাছে যাই। ৭৯ জন মানুষের নাম।
এই ছোট্ট গ্রামের, যেখানে পঞ্চাশটার মতো পরিবার ছিলো একাত্তুরে- তাদের ৭৯ জন মানুষকে খুন করা হয়েছিলো এখানে, এক সকালে।
ভাদ্রমাসের প্রথমদিন ছিলো বিষহরি পুজার প্রস্তুতি। সকাল বেলা চন্ডীমন্ডপে চলছে পুজার আয়োজন। ৪০ টি নৌকা যোগে গ্রাম ঘেরাও করে ঘাতকের দল। বানিয়াচঙ্গের প্রধান রাজাকার ফজলুল হক ওরফে মতওল্লীর প্ররোচনায় মেজর দূররানীর নেতৃত্বে এসেছিলো পাকিস্তান আর্মির দল, সাথে স্থানীয় রাজাকারেরা। মন্দির প্রাংগনে চলে গনহত্যা ও ধর্ষন। পড়ে থাকে ৭৯ জন মানুষের রক্তাক্ত লাশ। বিধ্বস্ত, শোকার্ত, অপমানিত বাকী সকল স্বজনদের লাশ পেছনে ফেলে পালিয়ে গেলে গোটা গ্রাম লুট শেষে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
আমার মামার বাড়ির লোকজন তখন আশ্রয় নিয়েছিলেন দিরাই’র ভাটি অঞ্চল জগদল গ্রামে। আম্মা বলছিলেন- জগদল থেকে তারা মাকালকান্দির আগুন দেখেছিলেন। মাকালকান্দি আসবো জেনে জলসুখার আব্দুর রশীদ বলছিলেন- সেদিনের গনহত্যার আরো কয়েক সপ্তাহ পরে তারা মাকালকান্দি এসেছিলেন এখানে ঘাঁটি করার জন্য। গোটা গ্রাম তখন পরিত্যক্ত ভুতুড়ে। এখানে ওখানে ছড়িয়েছিলো পঁচে যাওয়া লাশ। লাশের দুর্গন্ধের কারনে এখানে তারা ঘাঁটি না করে পরে অন্য গ্রামে করেছিলেন।
দোকানের সামনে থাকা মানুষজন আমাদেরকে নিয়ে যান সেই মন্দিরের সামনে। ওখানে আরো কয়েকজন মানুষ বসা, দাঁড়ানো। আমাদের জন্য চেয়ার আসে। আমাদের পাশে গ্রামের দুজন বয়স্ক মানুষ ও বসেন। শিশুরা ঘিরে ধরে আমাদের। আশে পাশের ঘরগুলো থেকে তরুনী ও বৃদ্ধারা এসে জমায়েত হতে থাকেন।
প্রথম বয়স্ক পুরুষটিকে অনুরোধ জানাই সেদিনের ঘটনা একটু স্মৃতিচারন করতে। তিনি মৃদুভাষী। আস্তে আস্তে করে বলেন- ‘বেশী কিছু বলার নাই, আমার সামনে আমার মা বাবা ভাইরে খুন করছে, আমি কোন মতে বেঁচে গেছি। ‘ মৃদুভাষী ভদ্রলোক পাশের জনকে দেখিয়ে বলেন- ও বলতে পারবে, এরে ‘ওরা’ ধরে নিয়ে গেছিলো।
ইনি বেশ চটপটে। তখন বয়স তার বারো তেরো হবে। পুজোর সকাল, এই মন্দিরের সামনেই ছিলেন যেখানে আমরা বসে আছি। গ্রামের বাকীরা ও এখানেই আসছিলো। বয়স্ক পুরুষেরা হঠাৎ করেই খুব দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠেন এবং নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করতে থাকেন এবং একটু পর পর মন্দিরের চুড়োয় উঠে দেখতে থাকেন। সময় বয়ে যাচ্ছিলো দ্রুত। চল্লিশটা নৌকা কাছে চলে আসে এবং গ্রামের চারদিক ঘিরে অবস্থান নেয়।
সবচেয়ে বড় নৌকার সামনে দাঁড়ানো সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা গায়ে মুতওয়াল্লী আর পাকিস্তান আর্মির মেজর দূররানী। দূররানী হাত তুলে ইঙ্গিত দিলে মার্চ করে ঢুকে আর্মির একদল- রাইফেল হাতে, তাদের পেছনে পেছনে দা হাতে রাজাকারের দল। কোন কথা না বলেই শুরু হয় গুলী, দা দিয়ে কোপানো আর নারীদের চুলের মুঠি ধরে শুয়ে ফেলে প্রকাশ্য ধর্ষন। সেদিনের তের বছরের কিশোর বলতে থাকেন- তার বাবা, মা, ভাই এই মন্দিরের কাছেই মারা যান, বোনকে টেনে নিয়ে যাবার মুহুর্তটা এখনো চোখে ভাসে তার। এক পাকিস্তানী সৈনিক তাকে থাপ্পড় মেরে ফেলে দিয়ে বুট দিয়ে লাথি দিতে দিতে ছুঁড়ে দেয় নীচের এক ঝোঁপে। ঝোঁপের আড়ালে তিনি পড়ে থাকেন সংজ্ঞাহীন দীর্ঘসময়। তৎক্ষনে হত্যাযজ্ঞ প্রায় শেষ। জ্ঞান ফিরলে তিনি দৌড়ে যান গ্রামের আরেক প্রান্তে, সেখানে আবার ধরা পড়েন আরেক সৈনিকের হাতে। সে রাইফেল তুলে গুলী করতে গেলে রাজাকার প্রধান মুতওয়াল্লী আটকায়। বলে- এই হিন্দুর ছেলেকে সে তার বাড়ি নিয়ে মুসলমান বানাবে।
তেরবছরের সেই কিশোর যার পরিবারের সবাই খুন হয়েছে, তার আশ্রয় হয় সেই খুনীর বাড়িতেই। মুতওয়াল্লীর তত্বাবধানে কলেমা পড়িয়ে তাকে মুসলমান বানানোর চেষ্টা করা হয়। ঐ বাড়ির মহিলারা তাকে ভালো করে খাইয়ে দাইয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন কিন্তু তার একটানা কান্না আর চিৎকারে কোন কিছুই সম্ভব হয়নি। ঐ বাড়িরই একজন দয়াবতী মহিলা তার কাছে থেকে জেনে নেন- আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কেউ বেঁচে আছে কিনা? তিনি তার মামার বাড়ির ঠিকানা বলেন। সেই মহিলা গোপনে তার মামার বাড়ি খবর পাঠান। মামার বাড়ি থেকে গোপনেই কেউ এসে তাকে নিয়ে যান মুতওয়াল্লীর বাড়ি থেকে, সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত।
এই মানুষটার কাছ থেকে এই নৃশংসতা, অমানবিকতার আখ্যান শুনতে শুনতে বিহ্বল হয়ে দেখি মন্দিরের গাঁ ঘেষে বসে আছেন বেশ কয়েকজন নারী, এদের মধ্যে কয়েকজন অশীতিপর ব্রদ্ধা- তাদের পরনে সাদা শাড়ি। আমি দেখি এঁদের একজনের সাথে কথা বলছে নজরুল, তানিম ভিডিও করছে। আমাকে হাত ইশারায় ডাকে তারা। উঠে গিয়ে দেখি সেই বৃদ্ধা দাঁড়াতে পারেন না, তার শরীর থর থর কাঁপে। কিন্তু তিনি কথা বলছেন স্পষ্ট।
‘কী হয়েছিলো সেইদিন?’
তার শরীর কাঁপে কিন্তু কন্ঠ কাঁপেনা। ছেলের বয়স আট, তাকে মেরে ফেললো দায়ের কোপে। কোলে ছিলো দুইবছরের মেয়ে, টান দিয়ে নিয়ে আছাড় মেরে শেষ করে দিলো, স্বামীর বুকে গুলী-অনবরত রক্ত ঝরছে, সেই রক্তের উপর দিয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে...
আমার শরীর থরথর কাঁপছে। তানিমের ক্যামেরা বন্ধ হয়ে আছে, নজরুল মাথা নীচু করে কাঁদছে। নাহ, আর নেয়া যায়না। একবার মনে হয় কেনো এলাম এইসব ভয়ংকর সত্য জানার জন্য? এই সত্য জানার সাহস কী আছে আমাদের? ঐ বয়স্ক লোক যে তের বছরের কিশোর ছিলো সেদিন কিংবা এই বৃদ্ধার সামনে দাঁড়ানোর অধিকার আছে আমাদের?
টের পাই একই অনুভূতি আমাদের তিনজনেরই, দ্রুত সম্ভব এখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। গোটা মাকালকান্দি গ্রাম যেনো ভারী পাহাড়ের মতো চেপে ধরছে আমাদের। এখানে দেয়ালে দেয়ালে ঘাসের সবুজে তাজা রক্ত, বাতাসে লাশের গন্ধ জীবন্ত- এটা গনহত্যা, এটা কোন উপন্যাস না, বানানো কোন সিনেমা না। একাত্তুর নিয়ে উপন্যাস লিখতে, সিনেমা বানাতে ফিকশন লাগেনা- মাকালকান্দি গ্রামে একাত্তুর তরতাজা আছে, থাকবে যতোদিন এই মানুষগুলো বেঁচে আছে। এমন কোন পরিবার নেই, যেখানে কয়েকজন শহীদ নেই! একাত্তুর এরা ভুলবে কী করে?
সেই ভোরবেলা থেকে ছুটে চলা নয়, মাকালকান্দির শক আমাদের ক্লান্ত-বিধ্বস্ত করে দেয়। আমরা প্রায় টলতে টলতে এসে নৌকায় উঠি। ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন ‘কাজ হলো?’ । মাথা কাত করি। ইলিয়াস কী হাসেন?
আমাদের আর কথা বলার শক্তি, সাহস নাই। নৌকা এগোয় এবার বানিয়াচংগের দিকে। জুনমাসের দীর্ঘ বিকেল ধীরে ধীরে ফুরোতে থাকে। মাকালকান্দি ক্রমশঃ দূরে সরে যায়। হাওর পেরিয়ে নদীতে নৌকা ঢুকলে মাঝিকে থামতে বলি। লাফিয়ে নামি নদীতে, নজরুল তানিম ও নামে। সাঁতার কাটি। উপুর হয়ে ভেসে থাকি দীর্ঘক্ষন, মাথার উপর আদিগন্ত আকাশ- ডুবে আছি নদী ও হাওরের মাঝখানে, নিজেকে খুব ক্ষুদ্র তুচ্ছ মনে হয় এরকম সময়ে।
বানিয়াচং ঘাটে আসার ঠিক আগে আগে মাগরিবের আজান পড়ে। সাথে থাকা মিনারেল ওয়াটার দিয়েই ইফতার করি আমরা। আদর্শ বাজার থেকে সিএনজি নিয়ে হবিগঞ্জ আসতেই প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি। একটা দোকানে ঢুকতে হয় আশ্রয়ের জন্য। বৃষ্টি থামলে পর ইলিয়াস বিদায় জানান- তিনি হবিগঞ্জেই থেকে যাবেন, এখানেই তার কর্মস্থল। আমরা যাবো শায়েস্তাগঞ্জ, সেখান থেক সিলেট ও ঢাকা।
শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় দশটা। সিলেটের একটা গাড়ি আছে, ঢাকার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। নজরুল, তানিমকে নিয়ে সিলেটের গাড়িতেই উঠে পড়ি, ওরা কাল ঢাকা যাবে সিলেট থেকে।
সিলেট এসে পৌঁছাই রাত বারোটার পর।
কাকেলছেও, জলসুখা, মাকালকান্দি- দূরের দূরের জনপদগুলো আরো অনেক অনেক দূরেরবলে ভ্রম হয় ক্লান্তিতে নুয়ে পড়া মাঝরাতে।
মন্তব্য
চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছু বলবার নেই।
__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত
আহা! পড়তে পড়তে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
এই হচ্ছে রাজাকার। আর এইগুলার বিচারের বিরুদ্ধেও কিছু কুত্তা কথা বলে।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
লেখার শুরুতে একটা সূচীপত্র দেয়া যায় কিনা দেখেন। ওখানে আগের লেখাগুলোর লিংক থাকবে। আরেকটা পরামর্শ হলো ফটোবাকেটজাতীয় সাইটে ছবি আপলোড না করে দীর্ঘমেয়াদে থাকবে এবং কোয়ালিটি নষ্ট হবে না এরকম সাইট যেমন ফ্লিকারে ছবিগুলো আপলোড করে সেখান থেকে লিংক দেন। ছবিগুলোও ঐতিহাসিক ডকুমেন্টেশনের অংশ। সেগুলো একটু নির্ভরযোগ্য যায়গাতে আপলোড করা উচিৎ।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
...........................
Every Picture Tells a Story
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল বার বার।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
একটা কাজ আমরা খুব সফলতার সাথে করতে পেরেছি, গণহত্যার ইতিহাসকে 'গণ্ডগোল' বানিয়ে দিতে পেরেছি। গণকবরে চাপা পড়া পিতার হাড়ের ওপর বাড়িঘর-মার্কেট-রাস্তা বানিয়ে মহাসুখে আছি। মাতার ধর্ষক আর তার সহযোগীদের আপন করে নিয়ে সব কিছু ভুলে গেছি।
অকৃতজ্ঞ কুলাঙ্গারদের জন্য কি কোন বিশেষ নরক আছে? কেউ কি জানেন সেখানে কী শাস্তি দেয়া হবে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কি আর বলবো, ভাষা হারিয়ে ফেলছি!
পড়ছি...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আহ, যদি আপনার এই অসম্ভব রকমের ভাল একটি কাজের অংশ হতে পারতাম! নজরুল ভাইয়ের মত এই সত্য সন্ধানে আপনার সঙ্গী হতে পারতাম!
একটি অন্য প্রসঙ্গ- এটি খসড়া। অবশ্যই বই আকারে বেরুবার আগে অনেক ঘষা মাজা হবে। কয়েক জায়গায় 'পড়া' ও 'পরা'-র মধ্যে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। পরবর্তী সংখ্যায় আশা করি বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন।
একদিন এই লেখা আমাদের কাছে একটি দলিল হয়ে থাকবে।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
এটা সচল না হলে সিলেটটুডে২৪ডককমে পড়ি নিয়মিত। এতো অসহ্য কষ্ট লাগে পড়তেই।
আপনাদের সামনে বসে শুনতে কতোটা কষ্ট হয়!
মন দিয়ে কয়েকবার পড়লাম। হাহাকার বাজে। তারপর আবার পড়ি।
........ আমার অনেক ঋণ আছে
কতবার যে পড়লাম এই লেখাটা! ফিরে ফিরে আসি।
---মোখলেস হোসেন
নতুন মন্তব্য করুন