নিঃশ্বাস, নীল অরণ্যে

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: সোম, ২৩/০৪/২০০৭ - ৯:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

।।১।।
‘ডেভলপমেন্ট ইকোনমিকস্’-এর ক্লাসে খুব ঘুম পাচ্ছিল হাসানের।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস যে দিকেই গড়াক, নিজের আর পরিবারের আর্থিক সামর্থ ক্রমশ: তলানীতে এসে ঠেকছে- হঠাৎ মনে পড়তেই খুব শীত শীত করছিল হাসানের। ইচ্ছে করছিল সামনের ডেস্কের একেবারে কোণায় বসা প্রতীতির চুলে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রান নেয়ার ।

মায়ের অসুখটা ক্রমশ: বাড়ছে। জলের মত টাকা খরচ হচ্ছে। অনার্সের পর এম.বি.এ করার জন্য জমিয়ে রাখা বাবার পেনশনের টাকা এবার যাচ্ছে। তবু হচ্ছে না। হাসানের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর নিঃশ্বাসের সমস্যা হলেই প্রতীতির চুলে মুখ ডুবানোর ইচ্ছেটা ও খুব তীব্র হয় ইদানিং । আর সে মেয়েও হাসানের ইচ্ছে’র ঘ্রান পায়।
চোখের পাতা একটুও না কাঁপিয়ে যে ছেলে চোখে চোখ রাখতে পারে, একবার- কেবল একবার সে নাম ধরে ডেকে উঠলেই তো প্রতীতি হয়ে যেতো তার অরণ্যের সবুজ।
কিন্তু কোন কোন পুরুষ যে সবুজ চেনেনা। তারা অরণ্যের নীলে খোঁজে অন্য অবগাহন। কেননা সবুজকে তো আর সবাই ই সবুজ বলে ডাকে!
ক্লাশের পর চার চাকার মোটরযান ক্রমশ: দূর মিলায়-প্রতীতিকে নিয়ে।
পিছনে প্রযুক্তির বিষ- কালো ধোঁয়া। নীল অরণ্যের পোষ্টম্যান হাসান-নিঃশ্বাসে আবারো কষ্ট!

।।২।।
সূর্য জ্বলছে
বাড়ী ফিরতেই মৃদু গোঙানী। মায়ের। একরাশ নিঃশ্বাস অকারণে হারিয়ে যায়। ওঘর থেকে যন্ত্রনা ভেসে আসে।
কাঁধের ব্যাগটা রাখে। টেবিলের উপর-প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট , জীবনানন্দ। আবুল হাসান। যে কোন একটা পাতা খোলে আংগুল-

‘হলুদ সন্ধ্যায় একা একা, আমি হায় কার অভিশাপে
এত নির্মোহ, বিমর্ষ স্তব্দতা এই আমার রক্তের,
করছি কেবল পান’

বিছানার পাশে বাবা, বড় আপা, একজন বিব্রত ডাক্তার।
জ্ঞান নেই। চোখ বন্ধ। উঠানামা করছে বুকের হাপর।
হাসানের কেমন অদ্ভুত লাগে সব কিছু। পৃথিবীর এত আলো-তবু বোঁজে আসছে একজনের দেখার চোখ । এত বাতাস চারদিকে । তবু থেমে আসছে একজনের নিঃশ্বাসের আয়োজন ।

হঠাৎ করেই বাঁধ ভাঙে। প্রবল শোকার্ত বৃষ্টিপাত। হাসান থামতে দেয়না। যাক ভেসে যাক, ভেসে যাক সব। সে জানে জননীর জন্য এই তার শেষকৃত্য। এরপর যা হবে- কেবলই আনুষ্ঠানিকতা ।

সন্ধ্যার পর সবাই কবরস্তান থেকে ফেরে। হালকা পাতলা শীত। মাথার ভেতর টলমল ক্লান্তি ।
কাউকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এল নাকি সে?
শেষ রাতের কোন ট্রেন?
মাঝরাতে ময়লা চাঁদ লোহার ব্রীজ পেরোয়। ট্রেন আর বিশাল জল। মাঝখানে শুন্যতা । আর তার থেকে থেকে জেগে উঠে পৌরাণিক মিথের মত কোমল শৈশব। যেন পরিত্রাণ আছে আজো, আছে ফিরে যাওয়া। হায়! যন্ত্রনার তীব্রতা জুড়ে ভাঙা কাঁচের আড়শী। রেনু রেনু ক্রোধ যেন ছিঁড়ে খায় ঝড়ের শরীর।

প্রিয় প্রতীতি, মৃত জননী অথবা চুরি যাওয়া নি:শ্বাস-কে যেন নাম ধরে খুব ডাকতে থাকে হাসানকে।
হায়, তবু তার ফেরা হয়না।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।