যে দেশে মানুষ ছোট

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শনি, ১৯/০৫/২০০৭ - ৬:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
৯৫ সালের কোন এক জোরালো হরতালের দুপুর ।
বন্ধুরা মিলে গিয়েছি আড্ডা পেটাতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে । হ্যাঁ, হাসপাতালেই আড্ডা পেটাতে ।
আমাদেরই এক বন্ধু অস্ত্রমামলায় কারাগারে । ভালো পয়সাওয়ালা পরিবারের ছেলে । কারাগারের ডাক্তারদের ম্যানেজ করে প্রায়ই সে অসুস্থ হয়। কারাগারের হাসপাতালের চিকিৎসায় সে অসুস্থতা সারবার নয় । মাস দুয়েক পর পরই ওসমানী হাসপাতালের কেবিনে সে ।
কেবিনের সামনে পুলিশ প্রহরা । ভেতরে তার ফেনসিডিলের মচ্ছব । পার্টির লোকেরা আসছে । আসছে গ্রুপের ছোট ভায়েরা । আমরা বন্ধুরা ও যাচ্ছি । তাস চলছে। পুলিশ মামা আর ডাক্তার ভায়েরা বিশাল উদার ।
সেই দুপুরে হঠাৎ আড্ডায় ছন্দপতন ঘটে এক প্রবল কান্নার শব্দে । আমরা প্রথমে পাত্তা দেইনা । ফেন্সি আর গাঁজা আর তাসের নেশা ফেলে এসবে মনোযোগ দিতে কার ইচ্ছে হয় । তবু একসময় কান্নার তীব্রতা অসহ্যরকম বেড়ে গেলে পর, আমরা দু একজন বেরিয়ে আসি উৎস সন্ধানে ।
ঘটনাস্থল জেনারেল ওয়ার্ড । আমাদেরই মতো এক তরুন ।ঠিক আমাদের মতো নয় কারন তার পরনে আমাদের মতো জিন্স,বুট নয় সে পরে আছে লুংগী, চকচকে শার্ট আর সস্তা স্যান্ডেল । তবে বয়সটা আমাদের মতোই । একটা শরীর সে আঁকড়ে ধরে আছে । বোঝা যায় শরীরটা মৃত । হাসপাতালের কয়েকজন সেই মৃত শরীর টেনে বেড থেকে নামাতে চাইছেন, আর তরুন সেই শরীর আঁকড়ে ধরে চিৎকার করছে । আমরা প্রথমে ভাবি হয়তো শোকার্ত তরুন তার মৃত কোন স্বজনের লাশ সরিয়ে নিতে দিচ্ছেনা ।
কিন্তু ঘটনাস্থলের কাছে গিয়ে জানি অন্য এক গল্প ।
বহুদুরের কোন গ্রাম থেকে এই তরুন নিয়ে এসেছিলো তার বাবাকে চিকিৎসা করাবে বলে । ভোর রাতে বাবা মারা গেছেন । হরতালের কারনে তরুন পারছেনা বাবার লাশ নিয়ে বেরুতে । গ্রামে খবর পাঠানো হয়েছে । গ্রাম থেকে হয়তো অন্যরা ও আসবেন হরতাল ভাংগার পর ।
কিন্তু এই সময়টা, এই অসহ্য বেদনার্ত সময়, মৃত জনকের শরীর একাকী পাহারা দেবার ভয়ংকর সময়- এই তরুনের জন্য আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন হাসপাতাল কর্ত্বপক্ষ । লাশ বহনের জন্য এম্বুলেন্স দেয়া যাবেনা, কারন এম্বুলেন্সের টাকা তরুন দিতে পারবেনা । হাসপাতালের লাশ সংরক্ষানাগারে ও সন্ধ্যা পর্যন্ত এ লাশ রাখা যাবেনা, কারন এ জন্য ও টাকা দিতে হবে । শোকার্ত তরুনের কাছে টাকা নেই ।
জনকের মৃত্যুর মুহুর্ত থেকেই দরকষাকষি করছে দানবপক্ষের দালালেরা । বেলা দুপুর গড়ালে পর এবার তারা সিদ্বান্ত নিয়েছে, এই লাশ টেনে হেঁচড়ে বের করে নিয়ে ফেলে রাখবে কোন নির্জন বারান্দায় ।
লাশের দখলে রাখা বেড হয়তো বিক্রী করবে আরো কোনো ভবিতব্য লাশের কাছে ।

২।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নী চিকিৎসকরা পিটিয়ে হাতপা ভেংগে দিয়েছেন এক রোগীনির অভিভাবককে । তার অপরাধ ছিলো দায়িত্বে থাকা চিকিৎসককে তিনি তাড়া দিয়েছিলেন তার মুমুর্ষ রোগীনির কাছে আসার জন্য ।
পিটিয়ে হাতপা ভেংগেই ডাক্তার স্যারেরা ক্ষান্ত দেননি । আহত লোকটাকে যেনো পুলিশ তাদের হাতে ছেড়ে দেয়, সেই দাবীতে তারা শুরু করে দিলেন তৎক্ষনাৎ চিকিৎসা বিরতি । হয়তো সেই মুহুর্তে একজনের জরুরী অপারেশনের আয়োজন চলছিলো, একজনের একটা ইঞ্জেকশন জরুরী তাকে বাঁচানোর জন্য । কি আসে যায় এই সবে? ডাক্তারদের নিজেদের ইজ্জত সম্মান, ঐক্য রোগীর জীবনের চেয়ে অনেক দামী ।
ফলাফল সেই রোগীনি সহ মোট পাঁচজন রোগীর মৃত্যু ।

৩।
কক্সবাজারে মোটর সাইকেল চালানোর সময় হেলমেট না থাকায় ২০ জনকে পানিতে চুবিয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী।
নাগরিক কোন আইন ভংগ করলে কোন শাস্তি সেটা সম্ভবতঃ আইনের বইয়ে আছে । আছে বলেই মানুষের সমাজ, মানুষের আইন আদালত ।
হেলমেট ছাড়া মোটর সাইকেল চালানোর শাস্তি পানিতে চুবানো- কোন আইনসিদ্ব? জানি, এ প্রশ্ন করা যাবেনা জলপাইতন্ত্রী বাংলাদেশে ।

যেনো দেশটা দখল করে নিয়েছে সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র ।
ডাক্তাররা সংঘবদ্ধ, যখন খুশী তারা চিকিৎসা দেবে, যখন খুশী চিকিৎসা বন্ধ করে দেবে, রোগী মারা যাবে- কারো কাছে জবাব করতে হবেনা । প্রকৌশলীরা সংঘবদ্ধ, বিল্ডিং ভেংগে ওভারব্রীজ ধ্বসে মানুষ মরবে-কোনো জবাবদিহী করতে হবেনা ।জলপাই কমবেটরা সংঘবদ্ধ, যখন যেভাবে যাকে খুশী শাস্তি দেবে- কোনো জবাবদিহী করতে হবেনা ।
সংঘবদ্ধ শিক্ষকসমাজ , সংঘবদ্ধ রাজনীতিকগন, সংঘবদ্ধ ধর্মের ঠিকাদারেরা ।

কেবল ছিন্নভিন্ন মানুষেরা ।
এই পোড়াদেশে সব সারমেয় ও বরাহনন্দনগন দেবতাতুল্য,প্রায় ইশ্বরের মতো বিশাল তারা ।

কেবল ক্ষুদ্র, খুব ক্ষুদ্র আর তীব্র অপমানিত মানুষেরা ।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।