আমার পাথুরে চোখে আলফ্রেড সরেনঃঃ জন্মজন্মান্তরের এক বীর ( হযবরল এর লেখা)

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শনি, ১৮/০৮/২০০৭ - ৮:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.

ডিসক্লেমারঃ
(
ব্লগ বন্ধু 'হযবরল' অন্য এক সাইটে আলফ্রেড সরেন নিয়ে এই খুব দরকারী পোষ্ট করেছিলেন ।
আজ আলফ্রেড সরেন হত্যার সাতবছর ।
তারিখটা খেয়াল হতেই হযবরল' র সেই পোষ্ট এর কথা মনে পড়লো ।

অনুমতি নেইনি । ব্লগীয়বন্ধুত্বের দাবীতে কাজটা করে ফেললাম ।
)
----
----

কাঁচের দেয়াল নামে একটা ছবি আছে। আমাদের যুদ্ধোত্তর পরিবেশ একটা পরিবারের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেই ছবিতে।একটা ফ্রেইস আছে গ্লাস সিলিং। দুটোর আক্ষরিক এবং ঐতিহ্যগত মানে এক।

মানুষ ক্রমাগত চিৎকার করেছে অধিকার আদায়ের, অন্নের অধিকার , বস্ত্রের অধিকার , সম যোগ্যতার অধিকার, ভূমির অধিকার। প্যালেস্টাইনিদের ভূমির অধিকার আদায়ে আমাদের এই ভূখন্ড থেকে গেছে হাজার যোদ্ধা , প্রান দিয়ে দিয়েছে অকাতরে। আফগানিস্তানিদের মায়ের ভূমি উদ্ধারে আমরা ছুটে গিয়েছি কি ভীষণ প্রণোদনা নিয়ে। দেশ মাতৃকার আঁচল যেখানেই লুণ্ঠিত হয়েছে সেখানেই এই সবুজ বাংলার দামাল সন্তানেরা ছুটে গিয়েছে সমব্যথীর কাঁধ নিয়ে। আজো আমি র্গবিত হই সেই চওড়া সিনার বাংলাদেশী সন্তানের জন্য।

আমরা আমাদের কাঁচের দেওয়াল ভেঙ্গেছি। সারা পৃথিবীর আনাচ কানাচে যেখানেই দেখেছি কাঁচের দেওয়াল আমরা ছুটে গেছি আমাদের ঐতিহ্যের ধারায়।

ক.

আমার বন্ধুর বাবা কমলেশ বড়ুয়া, পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন একনিষ্ঠ র্কমী। দীর্ঘ আঠার বছর তিনি একা যুদ্ধ করে গেছেন, একটি পাতলা কাঁচের দেওয়ালের সাথে। আমাদের চৌদ্দ কোটি চওড়া সিনার একটিও পাননি কমলেশ বড়ুয়া তার এই যুদ্ধে। একসময় সময়ের কটাক্ষ আর এই যোদ্ধার তীব্র আত্মসম্মানের ভারে ভেঙ্গে পড়েছে সেই দেয়াল।

খ.

আমার এক ভাই এবং বন্ধু চৌধুরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের অক্লান্ত র্কমী। প্রতিনিয়ত এক অসম লড়াই করে যাচ্ছেন । এই কাঁচ রঙ্গিন, চকমকে। র্বণ, ভাষা আর র্ধমের মণি মুক্তা আঁটা এই দেয়ালের বিরুদ্ধে, এই যুদ্ধ একার যুদ্ধ।

গ.

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আদিবাসী জনগোষ্ঠি সাঁওতালরা দিনাজপুর,রাজশাহী, সিলেট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ , জামালপুরে বাস করছে কয়েকশো বছর ধরে। আজ তারা শস্যায়নের নামে হয়ে যাচ্ছে উদ্বাস্তু। নিজ ভূমে তারা আজ পরবাসী। প্যালেস্টাইন এর শিশুর কষ্ট আমাদের কাঁদায়। কিন্তু আমাদের শ বছরের সাথি জ্ঞান সরেন এর চোখের জল আমরা দেখিনা। বুচার অফ শাতিলা'র প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের হৃদয়ে আগুনের তুফান উঠে। ভীমপুরের কসাই, আমজাদ হোসেন তারা ' রা থেকে যায় চোখের আড়ালে। আলফ্রেড সরেন এর পোড়া লাশ আমাদের নাকে হয়ে যায় কচি ভেড়ার নধর মাংস। আলফ্রেড সরেন একটা কাঁচের দেয়ালের সাথে যুদ্ধ করছিলেন। যার একপাশে ছিল দেড় লক্ষ সাঁওতাল অন্যপাশে চৌদ্দ কোটি সিনা টান বাংলাভাষী বাংলাদেশী। কি এক অসম যুদ্ধে আগুনে পুড়ে মেরে ফেলা হল আলফ্রেড সরেনকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় অপরাধী কেও আমরা এত বড় কঠিন শাস্তি দিই নি।

কি অসম । কি অশ্লিল । কি পাথুরে নিষ্ঠুর আচরণ। সংখ্যা লঘু হওয়ার কি র্নিমম শাস্তি।

ইসরাইলিদের সংখ্যা কত? এক কোটি ও নয়। আমরা চৌদ্দ কোটি মানুষ এক আলফ্রেড সরেন এর বিরুদ্ধে।
এই শতাব্দীর সেরা যোদ্ধা, মতিউর এর ভাইটি ঘুমিয়ে আছে নিজের ভূমিতে গাদ্দার হয়ে।

আলফ্রেড সরেন আপনার প্রতিটি রক্তকণা
মহাদেব পুরের শিকড়ে শিকড়ে
সব বৃক্ষের পাতায় আজ তোমার নাম
=======================================

18'ই আগস্ট 2000 সালে আলফ্রেড সরেন এর গ্রাম মহাদেবপুরের সাঁওতাল পাড়া ঘিরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। খুঁজে এনে হত্যা করা হয় আলফ্রেড সরেনকে।

এই লিখাটি লিখার ইচ্ছা ছিল 18ই আগস্ট , আগে লিখলাম যাতে আমরা একবার আমাদের কাঁচের চোখে নিজের প্রতিবিম্ব দেখার সময় পাই।

=======================================

28 শে জুন, 2006
রাত 11:02
কলাম্বিয়া।


মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি

কিছু বলবার নেই। নির্মম ও পাশবিক।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ফারুক হাসান এর ছবি

মনটা খারাপ হয়ে যায়
তারপর ফুঁসে উঠে

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আলফ্রেড সরেন এর পোড়া লাশ আমাদের নাকে হয়ে যায় কচি ভেড়ার নধর মাংস। আলফ্রেড সরেন একটা কাঁচের দেয়ালের সাথে যুদ্ধ করছিলেন। যার একপাশে ছিল দেড় লক্ষ সাঁওতাল অন্যপাশে চৌদ্দ কোটি সিনা টান বাংলাভাষী বাংলাদেশী।

এই অনুভূতি আমারো।...আপনাকে, হযবরলকে অনেক ধন্যবাদ। আলফ্রেড সরেনকে অনন্ত শ্রদ্ধা।


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

ঝরাপাতা এর ছবি

এসব ঘটনাগুলি প্রচন্ড অপরাধবোধে আক্রান্ত করে, মনে হয় যেন আমিই নিজ হাতে পুড়িয়ে মেরেছি আলফ্রেড সরেনকে।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।