তক্ষক

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: সোম, ৩১/০৩/২০০৮ - ৭:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.

১।
আইপডটা কানে গুঁজে দেবো কিনা ভাবছি ।

নিতান্ত অভদ্রতা হয়ে যায়, কিন্তু কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিনা । বয়স্ক ভদ্রলোক একটানা কথা বলে যাচ্ছেন ।
কথা বলা শুরু করেছেন অন্ততঃঘন্টা খানেক । আমি কিছুটা বিস্মিত ও হচ্ছি বটে । এই শীর্নশরীরের প্রায় বৃদ্ধ মানুষটা এতো কথা বলার শক্তি পাচ্ছেন কি করে?

যাচ্ছি ট্রেনে । এক জেলা শহরে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে । সুন্দর রোদেলা দিন । ট্রেনে ভীড় কম । জানালার পাশে বসেছি। পাশের সীট খালি ছিলো । চমৎকার বাতাস ।আইপডে লোপামুদ্রার গান । উপভোগ করছিলাম ।
প্রতীতির কথা মনে পড়ছিলো । পড়শু ডেটিং হলো আসিফের ফ্ল্যাটে । মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । গল্প এখন শেষ পর্যায়ে । আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই,ছিলো ও না কোনোদিন । তবু হয়তো আমার মনে পড়বে প্রতীতিকে, প্রতীতির ও আমাকে মনে পড়বে কোনো অবসরে ।
প্রতিবার ডেটিংয়েই প্রতীতি আমাকে শরীর দেয় আর দেয় এক একটা চমৎকার কবিতার বই । ও মেয়ে নিজে কবিতা টবিতা পড়েনা কিন্তু আমাকে পড়ায় । সম্পর্ক হওয়ার আগে কোন একদিন বোধ করি ওকে জানিয়েছিলাম আমি, কবিতায় আমার প্রেমের কথা । আমার অনেক কিছুতেই পরে ও আর বিশ্বাস রাখেনি, কিন্তু এই অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারটা মনে গেঁথে রেখেছে ।

ব্যাগ খুলে কবিতার বইটা বের করি । জয় গোস্বামীর কবিতা সংগ্রহ । আমি জয়ের কবিতার তেমন ভক্ত নেই । বড্ড বেশী লিরিক্যাল । তবু এই ছুটেচলা রোদেলা দুপুর, প্রায় নির্জন রেলের কামরা, হুহু বাতাস- আমি প্রতীতির প্রতি প্রেম ও কবিতার প্রতি কামবোধে আক্রান্ত হই ।

আইপড খুলে গলায় ঝুলিয়ে রাখি । বিশ্রাম নাও লোপামুদ্রা। ইতঃস্তত পাতা উল্টাই । বিন্যস্ত অক্ষর ও ছন্দের সমাবেশ । একটা পাতায় চোখ আটকায়ঃ

' একফোঁটা রক্ত শুধু ঝরে পড়ল,মাটি ফেটে গেলো আঘাতে?
শিশুদের মরামুখ ভেসে উঠল কি একবার?
তা কেউ দেখেনি,বড় মেঘ করে এসেছিল ।
নইলে দেখা যেত এই ফাঁকা
খেয়াঘাটে
চাঁদ চেপে ধরে আছে রক্তে ভেসে যাওয়া নাড়ী তার ।'

কেমন । কেমন যেনো লাইনগুলো ।অকারনে আমার গা কেঁপে উঠে ।

২।
-'দেখলেন ঘটনা । এইবার কিন্তু খেলা জমবো । সব চোর ধরা পড়তেছে'
ভদ্রলোক আবার কথা শুরু করেছেন ।
তার কোলের উপর কটকটে হলুদ রংয়ের খবরের কাগজ । এই আরেক আপদ শুরু হয়েছে আজকাল । ত্রানের টিন,রিলিফের কম্বল,ঘুষের টাকা,তেরশো নদী,ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল গিলে খেয়ে ধরা পড়ছে বন কর্মকর্তা,পুলিশের দ্বিতীয়কর্তা,রানীমাতার জৈষ্ঠ্য সন্তান । আর এইসব নিয়ে সিনেমা সিনেমা গল্প জুড়ে দেয়া চায়ের টেবিল থেকে ট্রেনের কামরা পর্যন্ত । বিরক্ত লাগে । যন্ত্রনাময় দিনকাল ।
-'আল্লাহর রহমত ছিলো, তাই দেশটা বেঁচে গেলো । আগামী ২০ বছর সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় থাকা দরকার,কি বলেন?'

আমি মনে মনে গালি দেই । 'মর্ষকামী ভোদাই পাবলিক' । এই সব পাবলিকের কারনেই হাঁটুতে ঘিলুওয়ালারা ছড়ি ঘোরায় । যখন তখন রাস্তায় কানধরে উঠবস করাবে তবু পাবলিকের প্রীতি দূর হয়না ।
মুখে কিছু বলিনা । খামোখা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । আর দিনকাল আসলেই খুব সুবিধার না ।

ট্রেনের গতি কমে আসছে । প্লাটফর্মে ঢুকতে আর খুব দেরী নেই । ভদ্রলোক কোমর উঠানো শুরু করেছেন । এবার তার ব্যাগ গোছানো শুরু করবেন নিশ্চিত । ট্রেন থামার আগেই দরজায় গিয়ে ভীড় জমাবেন, সেটা ও নিশ্চিত প্রায় । মনে মনে আরেক প্রস্ত গালি দেই ।
-'তা বাবাজী এসে গেলাম প্রায় । অনেক কথা বললাম । কিছু মনে করেননি তো । আমারো একটা ছেলে আছে । আপনার বয়সীই হবে । না , আপনার চেয়ে আরেকটু বড়ো'
অর্থহীন কথা । আমি আতংকিত হই । নতুন কোন গল্প শুরু হয় বোঝি ।
-'তবে আমার ছেলেটা আপনার মতো নয়'
-আমার মতো নয়, মানে?

নিজের অজান্তেই এই প্রথম আমি তার কথার জবাব দেই ।
-আমার ছেলেটা পংগু । একটা মাত্র ছেলেই আমার
সর্বনাশ । লোকটা এখন পংগু ছেলের গল্প ফেঁদে সাহায্য না চাইলেই হয় ।পোষাক আষাকে ভদ্রলোক যদি ও । বিশ্বাস কি? যা দিনকাল পড়েছে । আমার আর কথা না বাড়ানোই নিরাপদ ।

তবু কি আশ্চর্য! আমিই পালটা প্রশ্ন করি । আমার কন্ঠ কি কিছুটা আর্দ্র?
-দুঃখিত । কি হয়েছিলো ওনার? কোন অসুখ,কোন দুর্ঘটনা?
-দুর্ঘটনা? হ্যাঁ । তা দুর্ঘটনা ও বলতে পারেন
কি এক অদ্ভুত কারনে আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে এই বৃদ্ধের পংগু ছেলেটার কথা জানতে ।
-বলুন না প্লিজ? কি হয়েছিলো?
-১৯৯০ । মনে আছে বাবাজী? বয়স কতো তখন? ১০/১২? আমার ছেলেটা তখন ১৮ । কলেজে পড়ে । আন্দোলন করে । আর্মি পিটিয়ে ওর কোমরের হাড় আর দুপা ভেংগে দিয়েছিলো। বুট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছিলো ওর পুরুষাংগ'

আমি বেদনার্ত হই । অন্ততঃ হওয়া উচিত । একজন বাবার মুখ ঝুলে পড়েছে তার একমাত্র পুত্রের পংগুত্বের গল্প বলতে গিয়ে ।
কিন্তু আমি বেদনার্ত হইনা । এই বকবকে বুড়ো একটু আগেই বলছিলেন এই দেশে যেনো আরো ২০ বছর সেনা শাসন থাকে । এই বুড়োকে আমি মনে মনে গালি দিয়েছিলাম 'মর্ষ্কামী ভোদাই' বলে ।আমার এবার তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালি দিতে ইচ্ছে করে
-আমি দুঃখিত । কিন্তু আপনিই আগে বললেন অন্ততঃ আরো ২০ বছর সেনাশাসন দরকার । অথচ আপনার ছেলে ওদের হাতেই । আসলে আপনাদের মতো মানুষদের জন্যই...'

ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকছে এবার । গতি প্রায় থেমে এসেছে । বৃদ্ধ তার ব্যাগ গুছিয়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন । ফিরলেন । ফিরে এলেন আমার কাছে । আমার চোখে চোখ রাখলেন । কেমন ঘোলাটে । গা শিউরে উঠে । গলা নামালেন । হিসসিস করে বললেন-
২০ নয়, ২০০ বছর ধরে আমি আর্মির শাসন চাই । প্রত্যেক মা-বাবার একটা করে ছেলে গুলী খেয়ে মরুক নয়তো পংগু হয়ে পড়ে থাক বিছানায়, আমার ছেলের মতো ।

বাইরে চমৎকার রোদ । তবু কেনো জানি সহসা তীব্র শীতের কাঁপুনি আমার সমস্ত জুড়ে। গন্তব্য পৌঁছে গেছি । উঠা দরকার । উঠতে পারছিনা । পারছিই না আর ।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

পুরনো লেখা । ব্লগ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল । আজ মনে হল, এটাকে গল্প সংকলনে ঢুকিয়ে দেই ।
সচলদের পড়া বলে,প্রথম পাতায় আর পুনঃ প্রকাশ করলাম না ।

অনেকগুলো প্রিয় মন্তব্য ছিলো, এখানে লিংকযুক্ত করে রাখলাম ।

সেদিনের মন্তব্যগুলো

----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।