পরিশিষ্ট ২ - আব্দেল্লাহীল কাফীঃ একজন শিক্ষক, একজন প্রতারক, না একজন যৌন নিপীড়ক

হাসিব এর ছবি
লিখেছেন হাসিব (তারিখ: সোম, ১৯/০৪/২০১০ - ৮:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মূল পোস্ট এখানে
(এই প্রতিবেদনটি ২০০০ সালে "জাহাঙ্গীরনগর সংবাদ"-এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত । )

কাফী । এ সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেশ উচ্চারিত নাম । আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াতে এসে তিনি যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পর্কিত হন এবং সম্পর্কিত হবার পর তার অন্যান্য সম্পর্কের যে ধরণগুলো প্রকাশিত হতে থাকে তা তাকে বহুল উচ্চারিত হবার জায়গায় দাঁড় করায় ।

পুরো নাম আব্দুল্লাহেল কাফী । ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে এডহক ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে । তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন পূর্বতন উপাচার্য আলাউদ্দিন আহমেদের ১৯৭৩ সালে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের বিশেষ ক্ষমতার ব্যবহারের মাধ্যমে । এডহক নিয়োগের পূর্বে তিনি দু’বার অযোগ্য বিবেচিত হয়ে প্রত্যাখ্যাত হন । কাফী ছাড়াও পূর্বতন ভিসি-র ক্ষমতার ব্যবহারের মাধ্যমে আরো ৯ জন শিক্ষক বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ পান । সেসময় এই নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় । তাৎক্ষণিকভাবে ৪২ জন শিক্ষক প্রতিবাদ জানান । পরবর্তী সময়ে আরো অনেক শিক্ষক প্রতিবাদ জানান, ছাত্র ছাত্রীরা প্রতিবাদ জানায় । আর এই নিয়োগপ্রাপ্তরা এমন এক সময়ে পড়াবার জন্য নিযুক্ত হন – যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকে প্রতিহত করবার জন্য অনির্দিষ্টকালের ছুটি চলছিল ।

পূর্বতন ভিসি আলাউদ্দিন আহমেদের এডহক নিয়োগ নিয়ে অনেক ক্ষোভ, প্রতিবাদ আছে, তারপরও সুনির্দিষ্ট ভাবে আব্দুল্লাহেল কাফীকে নিয়ে বলছি; যার এডহক নিয়োগ স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়াধীন আছে । কাফী প্রসঙ্গ এই জন্যই যে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যৌন নিপীড়নের, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের এবং যিনি একটি ডাকাতি মামলার পলাতক আসামী । কাফী প্রসঙ্গটি এজন্যই যে এই বিষয়গুলো পত্রিকায় সংবাদ হওয়া সত্ত্বেও সিন্ডিকেটের সভায় তার নিয়োগের বিষয়টি সিলেকশনের পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়; যে সিলেকশন কমিটি তাকেই যোগ্য বিবেচনা করে ।

পত্রিকান্তরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক জনাব আব্দেল্লাহেল কাফী সংক্রান্ত তথ্যগুলো এরকম –
১. ১৯৯৬ সালে কাফী ইতিহাস বিভাগের এম.ফিল পর্যায়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় সাভারস্থ একজন প্রকৌশলীর স্ত্রীর প্রতি যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করেন এবং সেখানে তিনি তার নাম পরিচয় ব্যবহার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন শিক্ষকের নামে । (সূত্র: সংবাদ, ভোরের কাগজ, সাপ্তাহিক ২০০০)
২. নিজ এলাকা টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে যৌন নিপীড়ন, ডাকাতি, সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্ত করে এলাকাবাসীর পক্ষে মামলা দায়ের করেন জনৈক আয়নাল হক গত ২৫জানুয়ারী, ২০০০ (মামলা নং - ১৭) । কাফীকে প্রধান আসামী করে পুলিশ মামলার চার্জশিট দেয় ৬ মার্চ, ২০০০ । (সূত্র: সংবাদ, ‌১৩ মার্চ, ২০০০)

পত্রিকায় পরিবেশিত সংবাদ জনাব আব্দুল্লাহেল কাফীকে যে ভাবমূর্তিতে দাঁড় করায় তা হ’ল মূল্যবোধহীন একজন দুশ্চরিত্র ব্যক্তিতে । দুশ্চরিত্র চিহ্নিত অনেকের নামই ক্যাম্পাসে মুখে মুখে ফেরে – মানিক, সীমান্ত, নাইম, মিরাদুল, রনি; কিন্তু দুশ্চরিত্রের ধারক হিসেবে অভিযুক্ত একজন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রেনীর হতে যান, তখন প্রশাসনের উদ্যোগটা কি? প্রশাসনের উদ্যোগের জায়গা থেকে কিছু বিষয় পরিস্কার করা দরকার ।

প্রথমত, ১৯৯৬ সালে এম.ফিলের ছাত্র থাকাকালে জনাব কাফীর বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলিংয়ে যে অভিযোগ উঠেছিলো, সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে যে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলো, সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কী? পত্রিকার বক্তব্যে জানা যায়, জনাব কাফী সেই তদন্ত কমিটিতে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন (সাপ্তাহিক ২০০০)। অথচ, এখন পর্যন্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অপ্রকাশিত । বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনের মাধ্যমে তদন্ত কমিটির সদস্য নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক জনাব আফসার আহমেদের কাছেই এই প্রশ্ন । প্রশাসনের উদ্যোগে এই জায়গায় বক্তব্য হ’লো – আগে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হোক । তাতে করে আব্দুল্লাহেল কাফী ব্ল্যাকমেইলার কি-না, তার পাশাপাশি স্পষ্ট হবে সাভারে তিনি যৌন নিপীড়নমূলক আচরণ করেছিলেন কি-না । জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চেতনা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ধর্ষককে চিহ্নিত করে, সেই চেতনা ধর্ষণ-মানসিকতা সম্পন্ন একজনকে শিক্ষক হিসেবে মনোনয়ন দেয় না – এটাই সরল হিসাব হওয়ার কথা । তারপরও কিছু হিসাব নিকাশ থাকলে সেটাও স্পষ্ট হোক ।

দ্বিতীয়ত, সিলেকশন কমিটি নিয়ে । বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাক্টে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে নিয়োগ দানের জন্য যে সিলেকশন কমিটি হবে, তার সদস্য হবার সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা হল –‘বিষয় বিশেষজ্ঞ’ হওয়া । আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সিলেকশন কমিটির দু’জন শিক্ষক হলেন ইতিহাস বিভাগের । তাদের কেউই ‘বিষয় বিশেষজ্ঞ’ নন । শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম দুর করার দাবীতে ১২৫জন শিক্ষক যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে ‘সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে সম্পর্কহীন শিক্ষক দ্বারা সিলেকশন কমিটি’, ‘দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে সিলেকশন কমিটি’ তৈরী করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন । এই সিলেকশন কমিটির দুই জনের মনোনয়ন পাওয়া জনাব কাফী এস.এস.সি ছাড়া আর সবক’টি ধাপে ২য় বিভাগধারী; যিনি অন্যান্য ২১ জন প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন । জনাব কাফীর চেয়ে অধিক যোগ্যতাসম্পন্নরা মনোনয়ন না পেয়ে কাফী ঠিক কোন যোগ্যতায় অধিকতর যোগ্য হয়ে ওঠেন – সিলেকশন কমিটির কাছে বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানা দরকার । উদ্যোগটা প্রশাসনকেই নিতে হবে ।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অস্থায়ী শিক্ষক জনাব আব্দুল্লাহেল কাফীর স্থায়ীকরণ প্রক্তিয়ার এই পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকের কাফীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোকে স্পষ্ট করতে হবে । বিশ্ববিদ্যালয় কাকে বেছে নেবে, একজন শিক্ষিত ‘শিক্ষক’কে, নাকি ‘শিক্ষিত’ যৌন নিপীড়ক, ব্ল্যাকমেইলারকে?

ব্লগনোট :

এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত ভিসি আলাউদ্দিন জাবিতে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের সময় ভিসি ছিলেন ।


মন্তব্য