ইসলামিক স্টেট তাদের ম্যাগাজিন দাবিকের ১৩তম ইস্যুতে আবারো বাংলাদেশে পরিচালিত তাদের অপারেশনগুলোর এক ফিরিস্তি প্রকাশ করেছে। এখানে তারা কয়েকটি ঘটনা এবং সেগুলো তারা কীভাবে কী অস্ত্র ব্যবহার করে ঘটিয়েছে সেটার বিবরণ প্রকাশ করেছে।
A selection of military operations conducted by the Islamic State শিরোনামে ম্যাগাজিনের প্রবন্ধটিতে যেসব হত্যা বা আক্রমনের স্বীকারোক্তি করা হয়েছে সেগুলো হলো
১. দিনাজপুরে পিয়েরো পারোলারিকে আক্রমন
২. রংপুরের বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিনকে আক্রমন
৩. রংপুরে আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলী হত্যা
৪. বগুড়া জেলায় শিয়া/রাফিদি মসজিদে হামলা
৫. কাদিয়ানী মসজিদে আত্মঘাতি হামলা
৬. ঝিনাইদহে খ্রিষ্টান মিশনারী সমীরউদ্দিন হত্যা।
এ তালিকায় আওয়ামী লীগ নেতার উপর আক্রমনের ঘটনাটি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। এর আগে তারা ভিন্নধর্মাবলম্বি ও বিদেশীদের উপর আক্রমনে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলেও এবার তারা একজন স্থানীয় রাজনীতিবিদকে হত্যার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে। এছাড়া তারা চোরাগোপ্তা হিট এন্ড রান পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আত্মঘাতি হামলা শুরু করেছে।
এসব আক্রমনে আইসিস আক্রমনের পদ্ধতি ও অস্ত্র সম্পর্কে কিছু তথ্য তাদের বক্তব্যে পাওয়া যায়। তারা এসব আক্রমনে যা ব্যবহার করেছে সেগুলো হলো,
১, সাইলেন্সড পিস্তল
২. অটোমেটিক অস্ত্র
৩. ছুরি
৪. বেল্টে বহনযোগ্য বোমা
দাবিক ম্যাগাজিনে বাংলাদেশ অংশটা অনুবাদ এরকম দাঁড়ায়,
৭ই সফর (১৮ই নভেম্বর, ২০১৫), ইসলামিক স্টেট সিকিউরিটি ইউনিট দিনাজপুরের কাছে মিশনারী হিসেবে কাজ করা এক ইতালিয় ক্রুসেডার পিয়েরো পারোলারিকে সাইলেন্সড পিস্তল দিয়ে কয়েকবার গুলি করে গুরুতর আহত করে। এই অপারেশনের দুই সপ্তাহ আগে ২৫শে মহররম (৮ই নভেম্বর ২০১৫) কাফের বাহাই সম্প্রদায়ের এক নেতা রুহুল আমিন যে রংপুর অঞ্চলে বাহাই সেন্টারে কাজ করতো তাকে টার্গেট করা হয়। তাকে সাইলেন্সড পিস্তল দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। এছাড়া রংপুরে কাউনিয়াতে মুরতাদ রহমত আলী, যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়, তাকে ২৭ মহররম (১০ই নভেম্বর, ২০১৫) বাড়ী ফেরার পথে সফলতার সাথে হত্যা করা হয়। এসব ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে আক্রমন ছাড়াও বাংলার খেলাফতের মুজাহিদরা মুরতাদদের শিরক মন্দিরে আক্রমন পরিচালনা করেছে। ১৪ই মহররম (২৮শে অক্টোবর, ২০১৫) তারা ইরানি এম্বেসি কর্তৃক অর্থায়িত ও সমর্থিত রাফিদি মন্দিরের হামলা করে। এই আক্রমন বগুড়া জেলাতে সংঘটিত হয় এবং এতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের হামলায় অনেক মুশরিক নিহত ও আহত হয়। এর ঠিক এক মাস পরে আমাদের ইশতিহাদি ভাই আবুল ফিদা আর বাঙ্গালি কাদিয়ানী মুরতাদদের একটি মন্দিরে প্রবেশ করে। তিনি একটি বিস্ফোরক বেল্টের বিস্ফোরণ ঘটান যাতে ৩০ জন আহত হয়। আল্লাহ তাদের শহীদ হিসেবে গ্রহণ করুক। দুই সপ্তাহ পরে খেলাফতের সেনারা সমীরউদ্দিন নামে একজন মুরতাদ যে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে মিশনারী হিসেবে কাজ করছিলো তাকে ঝিনাইদহ জেলায় ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
সূত্রঃ
১। ছবিগুলো দাবিক ম্যাগাজিন থেকে নেয়া
২। অনুবাদে ইংরেজি তারিখগুলো পাঠকের সুবিধার্থে বসানো। মূল লেখায় আরবী তারিখের উল্লেখ রয়েছে শুধু।
মন্তব্য
বাংলাদেশে শক্তিশালী ও কার্যকর ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী আছে। সেটার প্রমাণ প্রায়শ নানা ঘটনায় এবং নিরাপত্তাবাহিনীর নিয়মিত তৎপরতা থেকে বোঝা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে আইএস খুব একটা কার্যকর কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই ব্যাপারে সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী 'অস্তিত্ত্ব নাই' হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু খুব একটা শক্তি তারা ধরে না - এটা বলা যায়। এই ডিডাকশানের ভিত্তি সংঘটিত আক্রমণের ঘটনাগুলো। এই ঘটনাগুলো ঘটার পরপরই কি আইএস এগুলোর দায় স্বীকার করেছিল? না। দাবিক তখনই এগুলো নিজেদের কৃতিত্ব বলে দাবী করছে যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়া/সংগঠনের কেউ সেখানে আইএসের উপস্থিতির ব্যাপারে সম্ভাবনার কথা বলছে। দাবিক যথেষ্ট সময় নিয়ে, ঘটনা বেছে নিয়ে দায় স্বীকার করছে।
দাবিকের এমন প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য কী? একটা হতে পারে সেনসেশনাল ঘটনাগুলোর (কিছু অন্য ঘটনাসহ) দায় স্বীকার করে তারা বাংলাদেশে পটেনশিয়াল রিক্রুটদের নজর কাড়তে চাইছে। আরেকটা হতে পারে এগুলো দিয়ে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদেরকে আরও বিস্তৃত ও শক্তিশালী হিসেবে দেখাতে চাইছে।
এর বাইরে একটা কনসপিরেসি থিওরির কথা ভাবা যেতে পারে। আইএসের দুধ-মধু'র যোগান যারা দেয়, যারা আইএসের লুটের মাল কেনে তারাই আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে ইরাক-সিরিয়ায় নিজেদের সামরিক অবস্থান রাখাসহ একটা দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা পাকিস্তানে আইএসের অস্তিত্ত্বকে বিলোপ করার নামে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে কাঁচকলা দেখিয়ে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আইএসের শক্তিশালী অস্তিত্ত্ব প্রমাণ করা গেলে এখানেও পাকিস্তান মডেলে তারা হাজির হয়ে যাবে।
তবে 'বাংলাদেশে আইএস-এর অস্তিত্ত্ব নাই' বলে সরকার আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে পরে পস্তাতে হবে। বাইরে দাবিকের এইরকম প্রতিবেদন প্রকাশসহ দেশের ভেতরে আইএস স্বল্প মাত্রার কার্যক্রম চালালেও লোন উলফ বা লোন ঈগল ধরনের জিনিস দাঁড়িয়ে যাবে। এমনকি লোন গ্রুপও দাঁড়িয়ে যেতে পারে। আদর্শিক প্রশ্নে কিছু সমঝোতা করে জেএমবি, আনসারুল্লাহ্দের মতো শক্তিশালী গ্রুপগুলোর সাথে বৃহত্তর ঐক্যও গড়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশে আইএস স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সংগঠন হলো জেএমবি। জেএমবি খুব একটা শক্তি ধরে না বলতে চান? জেএমবির নিউজ পত্রিকা বিশাল হেডলাইন জুড়ে আসে না। তবে একটু গুগল করলে তাদের অপারেশনের ব্যাপ্তি সম্পর্কে একটু আন্দাজ পাবেন।
প্রতিটা ঘটনার পর আইএস দায় স্বীকার করেনি। এটা তাদের পলিসি হতে পারে। আবার এটাও হতে পারে যে তাদের মিডিয়া উইং আল কায়েদার মতো শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। আল কায়েদা, বাংলাদেশে যেটা আনসারুল্লাহ নামে অপারেট করে তারা আল কায়েদার বৈশ্বিক মিডিয়া আউটলেটের সাথে যুক্ত। কয়েকদিন পরপরই তারা প্রচার সামগ্রীর বাংলা ভার্সন বের করে। এটা একদিনে হয় নি। দীর্ঘদিনের কাজের ফল হিসেবে তারা ভারতীয় উপমহাদেশে গিম্ফের মতো মিডিয়া আউটলেট তৈরি করতে পেরেছে। আইসিসের আন্তর্জাতিক অপারেশন সেদিনকার ঘটনা মাত্র।
আপনি সম্ভবত জেএমবি যে আইসিসের লোকাল আউটলেট এটা জানেন না। এই পোস্টটা দেখতে পারেন।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আমি আপনার আগের পোস্টটি এবং দাবিকের আগের আর্টিকেলটি ঐ সময়েই পড়েছিলাম। সেখানে আইএস নিজেকে বাংলাদেশে নিজেকে যে আমব্রেলা অর্গানাইজেশন বলে দাবী করার চেষ্টা করেছে সেটাতে আমার আপত্তি আছে।
জেএমবি বাংলাদেশে বহুকাল আগে গঠিত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে। জেএমবি'র আগের ও সাম্প্রতিক কার্যক্রম সম্পর্কে আমি অবগত। মূলত তাদের কথা মাথায় রেখেই আমি আগের মন্তব্যে বলেছি, "বাংলাদেশে শক্তিশালী ও কার্যকর ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী আছে"। জেএমবি কখনো আইএস-এর সাথে নিজের কোন সম্পর্ক আছে বলে দাবী করেছে এমনটা শুনিনি। এই ব্যাপারে আপনার কিছু জানা থাকলে জানাবেন প্লিজ। আমার ধারণা, আইএস এমন একতরফা দাবীর মাধ্যমে নিজেকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। জেএমবি'র সাথে আইএস-এর ধর্মীয় ব্যাখ্যাগত পার্থক্য আছে। এই প্রকার পার্থক্যের জন্য এইজাতীয় দলগুলো একে অপরকে মুরতাদ, রাফিদী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে থাকে। তবে চিপায় পড়লে এরা সবাই কৌশলগত ঐক্য গড়ে তুলতে পারে।
জেএমবি আইএসের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্য। তবে আইএস খিলাফত গঠনের পর তারা জেএমবির সাথে সখ্য গড়ে তুলতে পারে। এই বিষয়ে জেএমবির কোন বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি এটা সত্য। এই একটা মিসিং লিংক রয়েছে। তবে জেএমবির অপারেশনগুলোর প্যাটার্ন একরকমের। আনসারুল্লাহ/আল কায়েদার অপারেশনগুলোর সাথে কিন্তু তাদের দাবির কোন ওভারল্যাপিং নেই। আইএস কোন যোগাযোগ না রেখে এতো বিস্তারিত বিবরণও দিতে পারতো না। এই কারণে মনে করি আইএসের দাবির পেছনে সত্যতা আছে। আর দেশে আল কায়েদা থাকতে পারলে আইএস থাকতে পারবে না কেন এটাও একটা প্রশ্ন।
এই পার্থক্যটা ঠিক কোন কোন জায়গাতে? আইএস এবং আল কায়েদার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যগুলো দেশীয় আনসারুল্লাহর লিটারেচারে পাওয়া যায়। আল কায়েদা/আনসারুল্লাহ মিত্রতা প্রশ্নে অনেক ফ্লেক্সিবল যেটা আইসিস একদমই নয়। মিত্রতা প্রশ্নে হেফাফত, আনসারুল্লাহ, হিজবুত তাহরির, জামাত শিবির (কিছু সংশোধনসাপেক্ষে) একটা গ্রুপ। জেএমবি/আইসিস পুরো অন্য আরেকটা গ্রুপ। পার্থক্যটা যেহেতু ধর্মীয় মতাদর্শে সেক্ষেত্রে এই দুই গ্রুপ সহসা মিলে যাবে এমনটা আশা করা যায় না।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
সংরক্ষণের সুবিধার্থে একটা আলোচনা এখানে করে যাই।
বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা কে কোন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। একটা একটা করে দেখা যাক।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের (ছাত্রসঙ্ঘের আমল থেকে) রিক্রুটরা ছিল মূলত সাধারণ মাদ্রাসার (আলিয়া) ছাত্ররা। সেই আমলে আলিয়া মাদ্রাসার ডিগ্রী দিয়ে চাকুরী পাওয়া যেতো না বলে আলিয়া’র ছাত্ররা নিজেদের কারিকুলামের পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে সাধারণ ধারার টেক্সট পড়তো। আলিয়া’র পাবলিক পরীক্ষার পর পর তারা সাধারণ ধারার পাবলিক পরীক্ষাটাও দিয়ে নিত। যেমন, দাখিল’রা এসএসসি, আলিম’রা এইচএসসি, ফাযেল’রা ব্যাচেলর ডিগ্রী, কামিল’রা মাস্টার্স ডিগ্রী। এতে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের সাথে আলিয়া’র শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ইন্টারঅ্যাকশনের সুযোগ তৈরি হতো। ফলে আলিয়া’র পথ ধরে শিবির সাধারণ শিক্ষায়তনে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। শিবির/ছাত্রসঙ্ঘের নেতৃত্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা মূলত সাধারণ ধারার প্রডাক্ট, কারো কারো অবশ্য অতিরিক্ত হিসাবে আলিয়া’র ব্যাকগ্রাউন্ডও আছে। শিবির মূলত মধ্য-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের সংগঠন। শিবির করার পর ধনী হবার ইতিহাস আছে, তবে ধনী গ্রুপ থেকে শিবিরে রিক্রুটমেন্ট খুব কম। আর শিবিরের ঘাতকবাহিনীর সদস্যরা মূলত নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা।
শিবির থেকে বের হয়ে গঠিত নানা সংগঠন, যেমন, যুব শিবির, ছাত্র মজলিশ, ছাত্র সেনা, ছাত্র আন্দোলনও ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় শিবিরের অনুরূপ। তাদের কাজের ধারাও একই প্রকার। তবে এই সংগঠনগুলোর কোন ঘাতকবাহিনী থাকার কথা কখনো শোনা যায়নি।
নব্বইয়ের দশকে আলিয়া মাদ্রাসার ডিগ্রী যখন সরকারী স্বীকৃতি পেল তখন আলিয়া’র শিক্ষার্থীদের আর ডাবল ডিগ্রী নেবার দরকার থাকলো না। কিন্তু আলিয়া থেকে সাধারণ ধারায় সুইচ করার প্রবণতা তৈরি হয়ে গেল। ফলে শিবিরজাতীয় সংগঠনে রিক্রুটমেন্ট সমস্যা থাকলো না। তাছাড়া ততোদিনে সাধারণ ধারার শিক্ষায় শিবির শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করে ফেলেছিল। আলিয়া’র ডিগ্রী সরকারী স্বীকৃতি পাওয়ায় কওমী বা খারেজী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা পড়লো বিপদে। একে তো তাদের বোর্ডের (বেফাক্ব) সংখ্যা অনেক, সেগুলোতে কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই, এক এক বেফাক্বের কারিকুলাম-কোর্স লেঙথে মিল নেই তারওপর পাশ করে চাকুরীর আশাও নেই। ফলে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা নিজেদের সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই সময়ে বাইরের অনুদানে বাংলাদেশে হু হু করে কওমী মাদ্রাসা বাড়তে থাকে। তারমানে কওমী মাদ্রাসা ফ্রাস্ট্রেটেড শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। কওমী মাদ্রাসার বেফাক্বগুলোর নিয়ন্ত্রণ মূলত নানা ধর্মগুরুদের (পীর/আল্লামা/শায়খ) হাতে থাকায় তাদের প্রত্যেকের নিয়ন্ত্রণাধীন সংগঠন/ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। হাটহাজারীর আওতাধীন বেফাক্বটি বৃহত্তম হওয়ায় এটির সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আকারও বড়। হেফাজত জাতীয় সংগঠনগুলো তাদের কোন আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা প্রদর্শন করলেও তাদের কোন ঘাতকবাহিনীর অস্তিত্ত্ব টের পাওয়া যায়নি। কওমী মাদ্রাসার প্যাট্রনরা ধনী হলেও এর শিক্ষার্থীরা মূলত হতদরিদ্র।
গত শতকে দুনিয়াব্যাপী ইসলামী জঙ্গীবাদের বিস্তৃতি ঘটলে বাংলাদেশে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের কারো কারো মধ্যে এর সাথে সম্পৃক্ততার আকাঙ্খা তৈরি হয়। ফলে বাংলাদেশে হিজবুত তাহরীরের বাংলাদেশ শাখা গঠিত হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, হিজবুত তাহরীরের নেতৃত্বের বড় অংশের শিবির করার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আর উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানদের টার্গেট করে বেড়ে ওঠা এই সংগঠনটি সাধারণত সরাসরি সংঘর্ষ বা অ্যাকশনে জড়ায় না। উচ্চবিত্তদের স্বাভাবিক নিয়মানুসারে তারা এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেরা না জড়িয়ে অন্যদের দিয়ে করিয়ে নেবার চেষ্টা করে। তাই এদের নিজস্ব কোন ঘাতকবাহিনীর অস্তিত্ত্ব টের পাওয়া যায় না।
আনসারুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র দল-এর মতো গ্রুপগুলোর উত্থান মূলত দেশে আলকায়েদার টাকাপয়সা আসার পর থেকে। সত্তরের দশকে প্যালেস্টাইনে, আশির দশকে আফগানিস্তানে, নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানে, শূন্য দশকে ইরাকে যুদ্ধ করা প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা যখন কাজের জায়গা খুঁজছিল তখন আলকায়েদা তাদেরকে যার যার নিজের দেশে কাজের সুযোগ করে দেয়। ফলে, এই দশকে সারা দুনিয়ায় ইসলামী জঙ্গীবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই দলগুলোর শিবির, হেফাজত বা হিজবুতদের মতো প্রকাশ্য সংগঠন বা গণসংগঠন থাকে না। এরা শুরু থেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি ও টোটালি মিলিট্যান্ট পার্টি। এদের রিক্রুটমেন্ট খুব কম। সুতরাং এদের রিক্রুটমেন্টে শ্রেণী পরিচয় নির্ধারণ করা কঠিন। তবে এদের স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্যরাও মূলত দরিদ্র পরিবার থেকে আসা।
বাংলাদেশের ইসলামী জঙ্গী দলগুলোর মধ্যে সবচে’ ব্যতিক্রমী হচ্ছে জেএমবি। সাধারণত শহরে দল গঠিত হয়ে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার কালচার থাকলেও জেএমবি গ্রামে তৈরী হয়ে শহরে প্রবেশ করেছে। ‘গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘিরে ফেলা’র মতো পলিসির মতো এরা গ্রামে শক্তি অর্জন করে শহরে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করেছে। ৬৩টি জেলায় একযোগে একই সময়ে বোমা হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে জেএমবি’র বিস্তৃতি, সাংগঠনিক দক্ষতা, আঘাত হানার সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এই মাপের একটা কাজ প্রকাশ্য, সাধারণ রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে যারা বড় এবং সরকার চালানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন – সেই আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র পক্ষে কখনো করা সম্ভব নয়। জেএমবি’র প্রথম দিককার কেন্দ্রীয় নেতাদের মৃত্যুদণ্ড হলেও তাদের নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। বরং এখনো এরা বাংলাদেশের সবচে’ বড় জঙ্গী সংগঠন। জেএমবি’র বড় শক্তি হচ্ছে বিভিন্ন দল ও প্রতিষ্ঠানের সাথে এরা কৌশলগত ও স্বার্থগত মিত্রতা তৈরী করতে সক্ষম। ফলে এরা অনেক জায়গায় অন্যের ঘাড়ে চড়ে পার হয়ে যেতে পারে। জেএমবি’র অর্থায়ণ ও প্রশিক্ষণ শুধু বাইরে থেকে নয়, এবং তাদের রিক্রুটমেন্ট শুধু নিম্নবিত্তদের মধ্যে নয়। ফলে জেএমবি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে’ ভয়ঙ্কর, বিস্তৃত ও শক্তিশালী জঙ্গী সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশে যে আইএস আছে তার প্রমাণ মেলে আইএস-এ বাংলাদেশের রিক্রুটমেন্ট, ফান্ড ট্রান্সফার ইত্যাদি দেখলে। প্রধানত বিদেশের সাথে যোগাযোগ আছে, যাতায়ত আছে বা বিদেশে থাকার রেসিডেন্টশিপ আছে এমন বাংলাদেশী পরিবারগুলো থেকে স্থানীয় আইএস-এর সদস্যরা এসেছে। স্থানীয় সদস্য থাকায় এখানে সংঘটিত ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ বা এখানে সরকারের মুভগুলো সম্পর্কে হেডকোয়ার্টারকে জানানো সম্ভব হচ্ছে। আইএস-এর পক্ষে বাংলাদেশে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, বড় মাপের রিক্রুটমেন্ট হয়তো সম্ভব হবে না তাদের ওয়াহাবী মতাদর্শের জন্য। ওয়াহাবীরা সেই তীতুমীর-হাজী শরীয়তুল্লাহ্-মোহসেন আলী দুদু মিঞাদের আমল থেকে চেষ্টা করেও এদেশের মানুষদের কনভার্ট করতে পারেনি। তবে আদর্শিক ব্যবধান থাকলেও (যেমন, কেন্দ্রীয় খিলাফতে বিশ্বাস করা ও না করা) কার্যসাধনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আইএস জেএমবি’র ঘাড়ে সওয়ার হতে পারে। এই ব্যাপারে জেএমবি অনেক ফ্লেক্সিবল। তবে তারা কখনোই মার্জ করবে না।
মিথ্যা যেমন সকল পাপের আদি উৎস, তেমন বাংলাদেশে সকল জঙ্গীবাদী সংগঠনের আদি উৎস হচ্ছে ছাত্রসঙ্ঘ। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তাদের প্রস্তুতি ছিল বিধায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা তাদের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী সংগঠন মুসলিম লীগকে দ্রুত আউটপ্লে করে দিয়ে তারা পাকিস্তানী বাহিনীর কাছাকাছি চলে আসতে সক্ষম হয়। অক্সিলারী ফোর্স হিসাবে দক্ষতার সাথে কাজ করার পাশাপাশি সন্মূখসমরবহির্ভূত সন্ত্রাসী কার্যকলাপগুলোও সফলতার সাথে চালায়। মুক্তিযুদ্ধ হেরে গিয়ে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, বরং আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে দ্রুত সাংগঠনিকভাবে গুছিয়ে ওঠে। ফলে, ১৯৭৭ সালে শিবির নামে পুনর্গঠিত হবার পর নূন্যতম সময়ের মধ্যে রাজশাহী ও চট্টগ্রামে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। বাকী ইতিহাস সবার জানা।
নতুন মন্তব্য করুন