প্রথম তরঙ্গ
তিনটে দিন টানা বন্ধেও দেখা যায় অনেকসময় কিছুই করার থাকে না। একগাদা ছবি নিয়ে এসেছি প্রায় মাস দুয়েক আগে। দু'চারটা ছাড়া সেগুলোর বেশিরভাগই দেখা হয় নি। এমনিতেই বিদ্যুৎবিভ্রাট। আর, ওটা থাকলেও প্রায়ই চোখ চলে যায় মুভি চ্যানেলগুলো কী দেখাচ্ছে তার দিকে। তারপর, অদ্যভক্ষ ধনুর্গুণ করে দেখা যায় ডিভিডি প্লেয়ারটা ছাড়ার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনটাই আর থাকে না।
তবে, এবারে ব্যতিক্রম ঘটলো। একদঙ্গল আত্মীয়স্বজন মিলে কক্সবাজার যাওয়ার একটা প্রস্তাব পাওয়া গেলো। তুলে দিলাম বুড়ো আঙুল দুটোই, আর কি!
রওনা হওয়ার কথা সকাল আটটায়। যথারীতি বেরুলাম প্রায় সাড়ে নয়টায়। এসি মাইক্রো, হাইএস। বসেছি সবচে আরামের জায়গাটায়, পা যথাসম্ভব ছড়িয়ে। আগেই শঙ্কিত ছিলাম, বাস্তবায়ন ঘটতে বেশি দেরি হয় নি। পটিয়া পেরুতে না পেরুতেই পেটের বত্রিশ নাড়ি পাক দিয়ে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে এবং পাকস্থলীর আশ্রয়ের বিপক্ষে বিদ্রোহ করে সকালে যৎকিঞ্চিত যা খেয়েছিলাম এবং যা খাই নি, তার অর্ধপাচ্য রূপ-শচীন কত্তার গানটা মনে পড়ে যায়, বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-গীতিতে, হৃদয়ে দিয়েছো দোলা, শুধু 'গীতি'র বদলে 'গতি', আর 'হৃদয়'-এর বদলে 'সারা দেহে' হবে-বেশ নিঃশব্দে ঠাঁই পেলো পরিবেশঘাতক পলিথিনে। পলিথিন পরিবেশও কখনো রক্ষা করে বৈকি। সেই যে প্রবাদোক্ত চতুষ্পদের টামিতে কি একটা দুগ্ধজাত দামি উপজাত যেন হজম হয় না, তেমনি আমারও এসি গাড়ির ঠান্ডা হাওয়া।
জানালা খুলেও রেহাই পাই নি পুরো, সকালে বুদ্ধি করে যাত্রার আগে একটা এভোমিন খাওয়ায় কষ্টটা আরো বাড়লোই শুধু। যাত্রার একটা চমৎকার অংশ সাফারি পার্ক আর তার আশে পাশে প্রাকৃতিক বনের অবশেষদর্শন।
দ্বিতীয়বার জানালা বন্ধ করে এসি ছাড়ায় আবারো আমার অভ্যন্তরের বিদ্রোহ আর বাঁধভাঙার আওয়াজের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটায় ওটাতেও মন দিতে পারলাম না পুরোপুরি।
হায় এসি!
হায় টামি!!
হায়....মি!!!
দ্বিতীয় তরঙ্গ
হোটেলে চূড়ান্ত বিধ্বস্ত দেহ (ওরে বিশ্বাসঘাতক) আর নিস্পৃহ মন (গতি শ্রীবৃন্দাবন) নিয়ে পৌঁছে খাবারের ফরমায়েশ দিয়ে বসতে বসতে একটু ধাতস্থ হতে হতে খিদেটা মরে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার একটু আগেই খাদ্যসামগ্রী এলো।
আশ্চর্য!
ভাত ছাড়া কোনটাই গরম নয়। তাহলে এতো দেরি কেন?
মন গবেষণায় অনিচ্ছুক আর শরীরও কিছুটা বেতরিবৎ বিধায় খাবারগুলো উদরপুরে পাঠানোটাই আশুকর্তব্য মনে হলো।
ভুল করে মাটন নেওয়া হয়েছিলো। কসম থালাবাটিচাম্মচ কি, আমি অর্ডার দেই নি। সেই শরীর বা মন কোনটাই ছিলো না। সমুদ্রের পাশে এসেও যদি ডাঙার খাওয়া খেতে হয়, তালে আর কীওলো। তবে একটাই সুখের বিষয়, ওটায় ঠেসে চিনি দিয়ে বেশ অপরিচিত স্বাদের একটা তরকারি তৈরির কৃতিত্ব বাবুর্চিদের দেওয়াই যায়।
আমিন।
এবার সমুদ্রধর্ষণ...থুড়ি...সমুদ্রদর্শন।
কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের কোন বৈশিষ্ট্য ভিনদেশি কারোর চোখে পড়ার কথা না। দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতসংক্রান্ত জ্ঞানটা বাদ্দিলে কিন্তু নেহাৎই সাদামাটা আর ইদানীংকালে পাড় ঘেঁষে অজস্র স্থাপনা নির্মাণের কারণে কিছুটা কুৎসিত আকারই ধারণ করেছে বলা যায়, যদি চারপাশে তাকানো হয়। আর এর ঢেউগুলোও তেমন একটা নীল নয়। আরো যে কিছুটা অবনতি হয়েছে, সেটা টের পেলাম পরে।
যেহেতু আমাদের সাথে বেশ কিছু ক্যাপসুলট্যাবলেট ছিলো, তাই নীড় সন্ধানীর তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে রেখে শংকায় চারপাশ তাকিয়ে নামলাম সৈকতে। নাহ্, গাড়িগুলো তেমন একটা চোখে পড়লো না।
আমাদের একদল (মানে প্রায় সবাই) বসলো ছাতার ছায়ায় আর আসনের আরামে। আমরা গুটিকয়েক, সাকুল্যে জনা তিনেক, তার মধ্যে একজনের হাতে ক্যামেরা আর কয়েকটা, মানে কয়েকজন পিচ্চিপাচ্চি, বয়োসীমা এক থেকে এগারো কি বারো, চললাম বিপুল বিক্রমে সমুদ্রসঙ্গমে।
কাপড় বদলেছি আগেই, তারপরও ছাতার কাছে ফিরে গেছি বার দুয়েক, একবার গামছাটা রেখে আসতে, অন্যবার .....বাস।
আর বিলম্ব না না, আর বিলম্ব নয়।
আহা, গুগাবাবাকে মনে পড়ে গেলো।
তৃতীয় তরঙ্গ
সাগরের আজ কিছুটা অন্যমূর্তি।
এর আগে কক্সবাজারের ঢেউগুলো তুলনামূলকভাবে বেশ ট্যুরিস্টফ্রেন্ডলি মনে হয়েছে আমার। টেকনাফের সাগরের মতো খুব বেশি ভয়-লাগানো কর্কশ গতিময় আর উঁচুও না, আবার সেন্ট মার্টিনের মতো বাবুরাম সাপুড়ের করে নাকো ঢুঁশঢাঁশ-মার্কা প্রায়-সমতলও না। কিন্তু আজ যেন কিছুটা অফ-সিজন বলেই সে মাতালের মতো তোলাপড়ার বেশ ভালোই তোলপাড়ে কাঁপিয়েঝাঁপিয়ে দিচ্ছে। জলটাও যেন পাল্টে গেছে কেমন। হয়ে গেছে আরো ঘোলাটে, নীলচে আভাটা হারিয়ে গেছে; ফেনা যেটা ফিরে যাচ্ছে, সেটায় লালচে আভা। পরিবেশ দূষণের চিহ্ন। আর, পায়ের তলায় মাঝেমাঝেই পড়ছিলো সিসির (সিমেন্ট-কংক্রিটের) টুকরো। এতদঞ্চলে এগুলোর আঞ্চলিক নাম 'চারা'।
স্থাপনা তৈরির অবশেষ ছড়িয়ে আছে এখানেও, সমুদ্রে!
সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভাবতে ভালোই লাগে!!
যেহেতু, সাঁতারে আমি ইন্টারগ্যালাক্টিক চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ানস, তাই খুব বেশি দূরে যাওয়ার অযথা বাজে কাজ থেকে আমার অবচেতন আমায় বিরত রাখে। আর ভাঁটাও নেমেছে কিছু আগে। লোকজনও বেশ কমই বলতে হয়। ইয়াসিরের ছেলেপুলে কাউকেও দেখা যায় না। তাই, ঢেউয়ের তালে তালে নর্তনকুর্দনই সার। মনে পড়ে যায় এক বিশিষ্ট বাঙালি সুপরিচিত বহুমুখী প্রতিভাদীপ্ত ভদ্রলোকের সমুদ্রস্নানের সারসংক্ষেপ:
এবারেও যে সমুদ্রে স্নান করিয়া খুব আনন্দ পাইয়াছি, তাহা বলাই বাহুল্য। এখনো আমার হাঁটুতে তাহার দাগ আছে। তিন মাসের মধ্যে একটি দিন মাত্র আমার স্নান বাদ গিয়াছিল, সেদিন সমুদ্রে সাইক্লোন হইতেছিল। তখন সমুদ্রের চেহারা দেখিয়া আর নামিতে ভরসা হয় নাই। তার পরই পূর্ণিমার জোয়ার ছিল, তখনো সমুদ্র খুবই চঞ্চল, কিন্তু স্নান বন্ধ হয় নাই। তবে সেদিনকার সেই পাগলা ঢেউয়ের তাহের যে শক্ত দু্ইটা আছাড় হইয়াছিলাম, তাহার কথা অস্বীকার করিতে পারি না। প্রথমে একটা ঢেউ আসিয়া আমাকে নাকি মুখ থুবড়িয়া দিয়া ফেলিয়াছিল। তাহাতে আমি একটু পিছন বাগে জোর করিয়া সাবধান হইলাম, যেন আর থুবড়িয়া ফেলিতে না পারে। কিন্তু তাহার পরের ঢেউটা যখন আমাকে বালির উপর চিৎ করিয়া ফেলিয়া কুড়ি হাত লম্বা বিষম এক ধাক্কা দিল, তখন বুঝিলাম যে এর চেয়ে মুখ থুবড়িয়া পড়া ঢের ভালো ছিল।
এর আগে আরও একবার তিনি পুরী গেছেন, সেসময়ে তার দেখা এক ঘটনার বর্ণনাও দিচ্ছি:
ঢেউ আসিয়া অনেক দূর অবধি ডুবাইয়া ফেলিল, আবার হটিয়া গিয়া অনেকটা স্থান খালি করিয়া দিল। তখন ঐ খালি জায়গায় গিয়া একজন দাঁড়াইলেন। সে সময় তাহার চেহারা ঠিক পালোয়ানের মতন। ঢেউ আসিয়া উপস্থিত। তাহার ফলে মুহূর্তের মধ্যে সেই চেহারা আগে খুব ওস্তাদ বাজিকরের মতন, তারপরে উল্টান কচ্ছপের মতন হইয়া গেল! ঢেউ ততক্ষণে চলিয়া গিয়াছে, আর স্নানের শখও একপ্রকার মিটিয়াছে; এখন এই সুযোগে ডাঙ্গায় উঠিয়া আসিতে পারিলে হয়। কিন্তু উঠিবার চেষ্টায় কচ্ছপের অবস্থা হইতে প্রথমে ব্যাঙের, তারপরে হাতির অবস্থায় আসিতে না আসিতেই পিছন হইতে আর-এক ঢেউ আসিয়া তাঁহাকে কুমিরের মতন করিয়া ফেলিল, শেষে কলাগাছের মতন করিয়া কূলের কাছে রাখিয়া গেল। বাড়ি আসিয়া ইঁহার কয় কলসী পরিষ্কার জলের দরকার হইয়াছিল, তাহা জানি না। যাহা হউক, তাহাতে নাকের মুখের আর কানের বালি অনেকটা পরিমাণ দূর হইলেও, আর চুলের বালি খানিকটা কমিলেও পেটের ভিতর যে বালি ঢুকিয়াছিল, তাহার যে কিছুই হয় নাই, এ কথা নিশ্চয়। বিচারে যত দোষ, সব অবশ্য ওই সমুদ্র স্নানেরই সাব্যস্ত হইয়াছিল।
ভদ্রলোককে না চেনার কোন কারণই নেই। নাম বললেও ঠোঁট উল্টাবেন সবাই, আরে ইনি? এঁকে তো বেশ চিনি। শুধু একটাই সূত্র দেই-তাঁর পুত্র এবং পৌত্রের ইংরিজিতে নামের আদ্যক্ষর একই।
একটা শিক্ষা হলো এই যে ঢেউয়ের দিকে পেছন ফিরে থাকতে নেই। কখন যে এসে নাকানিচুবানি দিয়ে পায়ের তলার মাটি (এখানে বালি) আর শরীরের ভারসাম্য দুটোই কেড়ে নেবে, তা বোধহয় কেবল দেবাই জানন্তি।
আগেই বলেছি, আজকে ঢেউগুলো বেশ একটু বড়োই। ভালো করে খেয়াল করলে চোখে পড়ে ওগুলোর ওপর যেন টায়ারের ট্রিডচিহ্ন। কোন ব্র্যান্ডের হতে পারে? শার্লক হোমসকে লাগবে, হুমম। অর্ণব-মার্কা হলে কেমন হয় বা বীচিমালা ব্র্যান্ডের?
ঢেউয়ের দুটো তরঙ্গ টের পাচ্ছি এখন। একটা প্রাথমিক জোর ঝাপট আর পরেরটা হাল্কা যেন ডেমো ভার্শন। স্রেফ মোলায়েম একটা দুলুনি আছে, সেকেন্ডারি ওয়েভ বলা যায়, নাচুনিই সার। মাঝেমাঝে দুএকটা এমন ঢেউ আসছে যেগুলো বুকে লাগছে সপাটে ঘুষির মতন। একটা তো পেছন থেকে পিঠে শপাং করে এমন চাবুক মারলো, মুহূর্তের জন্যে বেশ জ্বলে উঠলো পিঠটা। নাকেমুখেচোখে নোনা জল ঢুকছেই।
মাঝেসাঝে দুএক ফোঁটা যে পেটেও যাচ্ছে না, দিব্যি কেটে বলতে পারবো না।
এরমাঝে আবার সামলাতে হচ্ছে বস্ত্রখণ্ডও।
বলি নি বুঝি, নেমেছি লুঙ্গি নামক নিম্নাঙ্গের পরিধেয় ধারণ করে? আসলে বাসায় শর্টস, বক্সার, বারমুদা জাতীয় কিছুই নেই। কিনবো কিনবো করেও কেনাই হয় নি। তাতে কি আর সমুদ্রে নামা থেইমে থাইকপে? হাপ্পেন্টুল যেটা আছে, গতবারের কষ্টকর ভ্রমণে এসে সেটা ব্যবহারের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। ওটা এতো ঢোলা যে ঢেউশালা এসে দুলার কোমরের ওই একটিমাত্র সভ্যতার পরিশেষকেও হিঁচড়ে নিয়ে আমায় প্রকৃতির বড্ড কাছাকাছি নিয়ে যেতে চায়!
লুঙ্গি পরে নামতে গেলে বিধেয় বা বাধ্যবাধকতা হচ্ছে মালকোঁচা মেরে নামা। কিন্তু, গিঁটটা নামাতে নামাতে এতদূর নামানোর পরেও (সভ্যতার অনুমোদিত সীমা পজ্জন্ত) কোঁচাটা পেছনে আর আটকে দেওয়া যদি না যায় তাহলে অগত্যা ধুসর গোধূলির প্রোপিক অনুসারে আরেকটু অগ্রসর হয়ে দুহাতেই লুঙ্গির দুদিক আটকে নামাটাই, তথা সামলানোটাই তো ভদ্রস্থ ও পদস্থ থাকার একমাত্র ছহি উপায়, না কি?
আমার এক আত্মীয়ও নেমেছেন আমার সাথে, শর্টস পরে। সাথে এক পিচ্চিনি, যাকে কড়া করে ধমক লাগিয়েছি পানিতে না নামার জন্যে। শোনে নি।
আমি একটু এগিয়েই আছি। একটা মোটের ওপর কড়া ঢেউ সামলে হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার আত্মীয় ভদ্রলোকের মাথাটা আর পিচ্চিনির দুটো পা জলের ওপর দেখা যাচ্ছে। মানে ঢেউ তাকে বেসামাল করে দিয়েছে। ভদ্রলোক তাড়াহুড়ো করে তাকে তুলতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। আমিও বাজপড়া তালগাছের মতো স্তম্ভিত হয়ে যেন আমার সামনে একটা চলচ্চিত্র দেখছি। কিছুক্ষণ পরেই তাকে উদ্ধার করা হলো। সে আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ানোয় তাকে দেখতে পারছি না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারছি সে ঘনঘন দম নিচ্ছে। জল ভেঙ্গে এগিয়ে গেলাম। এবার রাগ জমে উঠেছে। সরাসরি ধমক: "তোকে বারবার বলি নি না নামতে? কেন নামলি? আজ তোর কিছু হলে কী হতো? কী বলতাম তোর মাকে? ঢিশুম, ঢিশুম, ঢিশুম......।" শেষপর্যন্ত বেচারির দম-আটকানো জল-খাওয়া ফ্যাকাশে চেহারা আর বিস্ফারিত চোখ দেখে রেহাই দিলাম।
দায়িত্ব পালিত হলো।
আবার সাগরে।
এর মধ্যে আশেপাশেও দেখছি। পরিবার নিয়ে নেমেছেন কেউ কেউ, ভদ্রমহিলাদের জলসিক্ত বদনের দিকে আমার মতো দুচারজন নিরীহ ভদ্রলোক ছাড়া আর তেমন কেউ তাকাচ্ছে না। একদিকে বেশ আলোকিত কজন উঠতি তরুণী একজন একটু বেশি বয়েসি ভদ্রমহিলাকে জল থেকে টেনে তোলার চরম কসরৎ করে যাচ্ছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তাকে কি জলেই চেপে রাখার প্রচেষ্টা চলছে কি না। কারণ, ওখানটায় জল কমই। তাই, তোলার এতো প্রচেষ্টা অপ্রয়োজনীয়ই মনে হয়। কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো, তারা পাঁচজন সমযোজী বন্ধন গঠন করেছে, মাঝখানে তাদের মা-ই সম্ভবত, সেই একটু বেশি বয়েসি ভদ্রমহিলা, খুব নিরাপদ থাকার প্রচেষ্টায় রত। আরো কিছুক্ষণ পরে দেখা গেলো তারা ভিজবে কি ভিজবে না, বেশিদূর যাবে কি যাবে না, এই দ্বিধায়, কিন্তু এর মধ্যে ঢেউ তার চিরাচরিত ফাজলেমি বজায় রেখে তাদের প্রায় কোমর পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়েছে।
আমি এদিকে ঢেউয়ের সাথে লড়াই চালাচ্ছি। ওগুলোর জোর আর উচ্চতা দুটোই বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। একটা এমন ঢেউ এলো, যেটা অন্তত সাত ফুটের কাছাকাছি। আমার মাথার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় লাফিয়ে ওর সঙ্গ নিলাম। ব্যাটা আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো কিছুদূর, টের পেলাম আমার পশ্চাদ্দেশ বস্ত্রের আশ্রয়বঞ্চিত। তাড়াতাড়ি ঠিক করে নিলাম। চারপাশে চোখটাও বুলিয়ে নিলাম চটপট। আশা করি কেউ দেখি নি। নাহ্, মেয়েগুলো এখনো ব্যস্ত। মানীর মান আল্লায় রাখে।
চতুর্থ তরঙ্গ
এমনি করে সময় কেটে গেলো প্রায় এক ঘন্টা।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো।
আমার একটা ইচ্ছা, বলতে কি, শেষ ইচ্ছা আছে।
শেষবারের মতো দেখা করবো একজনের সাথে। বিদায় নেবো তার কাছ থেকে।
তারপর শুরু করবো হাঁটা। টম হ্যাঙ্কসের 'ফরেস্ট গাম্প' ইস্টাইলে সোজা দক্ষিণ দিকে। ওদিকেই যমের দুয়ার আর বঙ্গোপসাগর দুটোই।
হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে নামবো সাগরে।
আমার প্রিয়তম প্রাকৃতিক স্থান।
মিশে যাবো আমার অপ্রাপ্তি, আমার অপূর্ণতা, আমার ব্যর্থতা, আমার বেদনা সব কিছু নিয়ে। সূর্যাস্তের সাথে নামবে আমার জীবনের আঁধারও।
মন চলো নিজ নিকেতনে।
তবে আজই হোক না যাওয়া?
ঢেউ আজ উন্মাতাল, আশেপাশে লোকজনও কম।
যাই, আরো এগিয়ে যাই সামনে।
সমুদ্র আমায় বুকে টেনে নিক।
মাথা রাখি অপার শান্তির তুলোয়।
আর কোন যান্ত্রিক দায়িত্বপালন নয়, নয় স্বেচ্ছাবৃত সংসারী বানপ্রস্থ, নয় দেনাপাওনার চুলচেরা হিসেবনিকেশ, নয় জীবন্মৃত ঘুম থেকে ঘুমের অলাতচক্রে চংক্রমণ।
সব মিটে যাক, সব ভেসে যাক একপলকের প্রলয়ে।
আমার অস্তিত্ব নাস্তিত্বে রূপ নিক।
চলো।
হঠাৎ শুনি পেছন থেকে কে আমায় ডাকছে।
ফিরলাম পেছনে।
আমার এক বছর পাঁচ মাস নয় দিন আট ঘন্টা বয়েসি ছেলেটা তার মায়ের কোলে, জল দারুণ ভয় পায় সে, নামে নি তাই জলে।
আকুল হয়ে সে আমায় ডাকছে। বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার গলা, তার মায়ের গলা।
ওর ঠোঁটনাড়া দেখে বুঝতে পারছি কি বলে ডাকছে সে আমায়; সে বলছে তার ছোট গলায় যতদূর সম্ভব চেঁচিয়ে: 'পাপাই'।
ওই নামেই আমি তাকে ডাকি, সে-ও ডাকে আমায়, প্রায়ই।
একটা শ্বাস ফেলি। ভাবি, ভেসে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা বোধহয় পিছিয়েই দিতে হবে বছরখানেক।
সান্ত্বনা দেই নিজেকেই, মাত্র বছরখানেকই তো। কেটে যাবে দেখতে দেখতে।
পঞ্চম তরঙ্গ
এই কাহিনির কটি ইশপগুলের বড়ি:
১) আমার মতো বাঙাল-মার্কা হলে বাসে করে দূরভ্রমণে যাওয়াটাই সমীচীন।
২) সমুদ্রের কাছে গিয়ে সমুদ্রখাদ্য খাওয়াই বিধেয়।
৩) জলে নামার সময় টাইটস বা আঁটোসাঁটো শর্টসজাতীয় কিছু পরে নামাটাই সমুচিত।
৪) সাঁতার শেখাটা এই জলীয় গ্রহে একান্তই জরুরি। সমুদ্রে অবশ্য সেই শেখা তেমন একটা কাজে আসে না।
৫) স্বেচ্ছায় চিরবিদায়ে যাওয়ার সময় আশেপাশে নিকটাত্মীয় কাউকে রাখা নিতান্তই অনুচিত।
মন্তব্য
লম্বা লেখা, তবুও পুরোটা পড়ে উঠলাম। আপনার লেখাগুলো বেশ লাগে আমার কাছে
মামুন ভাইয়ের মত আমিও আপনার লেখা ভাল পাই।
দৃশা
বিনম্র কৃতজ্ঞতা আপনাদের।
জনাব মামুনের ‘উরাধুরা’ অনুবাদও আমার বেশ প্রিয় কিন্তু।
আর দৃশা, আপনি এত কম লিখেন কেন?
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
দীর্ঘ লেখা দেখে ভয় পেয়েছিলাম । পড়ার পর মনে হলো আরও একটু বড় হলে ক্ষতি কী হতো !
আপনি শক্তিশালী লেখক । বর্ণনা ও লেখার স্বকীয়তা সত্যিই অসাধারণ । শুভকামনা রইলো ।
ব্যাক্তিগত বিষয় হলেও না বলে পারছি না, প্রিয়জনদের কষ্ট দিয়ে এভাবে মৃত্যুচিন্তা করা ভালো না ।
(এপিটাফের কবি)
দাদা,
লুঙ্গির উপর একটা বেল্ট টাইট করে বেঁধে তারপর সাগরে নামতে পারতেন । তাইলে সমুদ্রের জল দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো করে আপনায় বস্ত্রখন্ড হরণ করতে পারতো না ।
যখন ঊর্মি আই মিন ঢেউ এসে আপনার ইজ্জতের উপর হামলা চালানোর উপক্রম করেছিলো আপনি তখন চেঁচিয়ে বলতে পারতেন, "অসভ্য ইতর লম্পট..তোর কি বাপ ভাই নেই?" কাজ হলেও হতে পারতো ! তবে সাগরে যেমন "ঊর্মি" আর "বীচি"র মতো বখাটে ঢেউও থাকে যারা আপনার মতন নিরীহ নিষ্পাপ পুরুষদের মানসম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তেমনি "লহর" এর মতো শান্ত স্নিগ্ধ রমণীয় ঢেউও সেখানে বিদ্যমান । এমনকি "তরঙ্গ" এর মতো দুষ্টু চঞ্চল আদুরে ঢেউ এবং "হিল্লোল" এর মতো প্রিয়দর্শন প্রিয়ভাষী ছেলেমানুষ ঢেউও সেখানে পাবেন । দাগী সন্ত্রাসী ও সিরিয়াল কিলার জলোচ্ছ্বাসও আছে সেখানে । তাই বলছি ভাই, পরেরবার গেলে সাবধানে চলবেন । বখাটে কিংবা সন্ত্রাসীদের এলাকায় ভুলেও পা দিবেন না ।
অতীব মনোমুগ্ধকর লেখা । পড়িয়া অত্যন্ত আনন্দিত এবং ঈর্ষান্বিত হইলাম । শেষাংশের পূর্বাংশ কিঞ্চিত্ কষ্ট দিলো ।
(মহাউন্মাদের শিষ্য)
ইশুবগুলের বড়িগুলো দারুণ হয়েছে, মানে পুরো লেখাটাই।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন