চক্রধামাঃ মায়ারাগ (চলছে...) পর্ব-৪

শিশিরকণা এর ছবি
লিখেছেন শিশিরকণা (তারিখ: শনি, ২২/০৭/২০১৭ - ৩:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অভীক আর নকুল এবার ভালো করে তাকালো ছায়ামূর্তির দিকে, এক পা ঘোড়ার রেকাবে আটকানো, অপর পা রাস্তা ধরে লাফাতে লাফাতে এগোচ্ছে।
"অগ্নিমূর্তি, হ্যাহ!?", অবশেষে মন্তব্য করলো অভীক।
" না।" বললো ফুরফুরা, "মানে, আসলে কি বলবো। এ হলো এমন লোক যে ঠাডা পড়া কি সেই কৌতুহল মেটাতে, ঝড় বৃষ্টির রাতে মাথায় তামার শিরোস্ত্রাণ চাপিয়ে কোন পাহাড়ের মাথায় খোদাতালাকে গালি গালাজ করতে রওনা হবে। ইয়ে, তোমাদের কাছে কোন খাবার হবে?"

" মুরগি আছে একটু।" বললো নকুল, "যদি তোমাদের কাহিনী খুলে বলো।"

" ও ব্যাটার নাম কি?" জিজ্ঞেস করলো অভীক, কথোপকথন চালিয়ে যাবার ব্যাপার সে একটু ঢিলে।

"দুকুঁড়ি**।"

" দুই কুঁড়ি?" অভীক নিশ্চিত হতে চাইলো, " কি অদ্ভুত নাম রে বাবা।"

"বৎস", বললো ফুরফুরা, "অদ্ভুতের দেখেছ কি। মুরগি হবে বললে?"

" আগুনের মত ঝাল দিয়ে রাঁধা" জানালো নকুল। জাদুকর মুখ বাঁকালো।

" আগুনের কথায় মনে পড়লো" দু আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করলো নকুল, "ওখানে বিশাল একটা বিস্ফোরণ দেখেছি আমরা, এই ধরো আধ ঘন্টাটাক আগে..."

"তেল বন্ধকি দোকানটা উড়ে গেছে তখন" জানালো ফুরফুরা, আগুনের ফুলকি বৃষ্টির স্মৃতি স্মরণ করে একটু কুকড়ে গেলো সে।

নকুল দেঁতো হাসি দিয়ে তার সঙ্গীর দিকে ফিরলে কিছু গজগজানির সাথে থলে থেকে একটা মুদ্রাও হাত বদল হলো। এসময় রাস্তা থেকে একটা চিৎকারের শব্দ শুরু হয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। ফুরফুরা মুরগি চিবোনো থেকে চোখ না উঠিয়েই বললো,

"ও ব্যাটা যা যা পারে না, ঘোড়ায় চড়া তার মধ্যে একটা মাত্র।"

বলামাত্রই সে হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলো, যেন বালির বাধ ছাপিয়ে আসা বন্যার কোন স্মৃতি তার মনে ভেসে এসেছে, তারপর একটা ছোট আর্তচিৎকার ছেড়ে অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটির দিকে ছুটে গেলো। যখন সে ফিরে ফেলো, তখন তার কাঁধে দুকুঁড়ি নামের ব্যক্তিটির দেহ ঝুলছে। ছোটখাট প্যাকাটি শরীরে একখানি হাফপ্যান্ট পরা, উর্ধাঙ্গের পিরানখানিতে এমন উজ্জ্বল আর জঘন্য সব রঙের সমারোহ, যে এই আধো আলোতেও নকুলের চোখ ধাঁধিয়ে গেলো।

"টিপেটুপে দেখেছি, কোন হাড় ভাঙেনি।" দুকুঁড়ির শরীর পরীক্ষা করতে করতে জানালো ফুরফুরা, "এর উপর নির্ঘাত কোন নেয়ামত আছে।"

"কোন কিছুর আছর হয়েছে নাকি?" হাটু গেড়ে বসে বললো নকুল।

"আরে না না। কিন্তু কোন ধরনের ভূত মনে হয়। ঝাঁড় ফুক এ তেমন কাজ হবে না। এই ভূত সোনাকে রুপান্তর করতে পারে তামাতে, অথচ সেটা দেখতে সোনার মতনই রয়ে যায়, এই ভূত ধনীদেরকে প্রলুদ্ধ করে তাদের সয় সম্পত্তি সব বিকিয়ে দিতে, এর ঘাড়ে চাপলে ভীতুরা নির্ভীকভাবে চোর ডাকাতের মাঝে হেটে বেড়ায়, কঠিন দরজা ভেঙ্গে সমস্ত ধন রত্ন লুটে নিতে পারে এর শক্তি। এমনকি এই মূহুর্তেও এই ভূত আমার উপর এমনভাবে ভর করেছে যে, আমাকে এই পাগলার পিছে পিছে ছুটতে হচ্ছে, সব বিপদ থেকে ব্যাটাকে বাঁচাতে হচ্ছে। এর শক্তি এই অভীক ব্যাটার থেকেও বেশি। নকুল, তোমার থেকেও এ অনেক বেশি ধূর্ত।"

"এই মহাপরাক্রমশালী ভুতের নাম কি হে?"

ফুরফুরা কাঁধ নাচালো, "আক্ষরিক অনুবাদ করলে পরে, 'লোলপড়ে যার অনিঃশেষ'***। মদ হবে তোমাদের কাছে?"

"তবে শুনে রাখো, জাদু ফাদু আমিও কিছু কম জানি না।" বললো নকুল, "এই তো গেলো বছরই তো, আমার এই বন্ধুটিকে সাথে নিয়ে, এক এক করে কেড়ে নিয়েছি যমপুরির জাদুকরপ্রধানের জাদুদন্ড, চন্দ্রমানিক খচিত কোমরবন্ধনী, এবং অব...ঠিক শেষে নয়, প্রথমে তার প্রাণপ্রদীপখানি। ঐ সব অবিরাম লোলপড়া ভূতের কথা আমায় শুনিয়ো না। ওসবে ডরাই না আমি। তবে তোমার গল্প শুনে বাকিটা শুনতে আমার ইচ্ছে করছে।"

অভীক রাস্তা ধরে কাছিয়ে আসা অবয়বটির দিকে তাকালো। যেভাবেই দেখা হোক না ভোরের আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছিল -

"বাক্সটা হাটছে?"

"যদি কিছু মদ পেটে পড়ে ", বললো ফুরফুরা, " তাহলে ওটার সব কাহিনী বলতে পারি। "

ওদিকে পাহাড়ের উপত্যকায় শহর থেকে আগুনের গর্জন কমে ফোঁসফাঁসে পরিণত হয়েছে। নদীর পানি যেখানে সাগরে মিশে সেখানের বিশাল খালদ্বারগুলো কেউ বন্ধ করবার নির্দেশ দিয়েছে। ফলে, যাবার জায়গা না পেয়ে নদী উছলে উঠে দুপাশের আগুনে পোড়া রাস্তা গুলো ছাপিয়ে চলেছে।ঘন কালো ঢেউ এর উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খুব দ্রুত মহাদেশসম আগুনের বিস্তার ছোট ছোট দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ধূম আর ধোঁয়া ছাড়িয়ে এখন শহরের উপরে আকাশ ছেয়ে গেছে বাষ্প আর মেঘে। নকুলের মনে হলো যেন শহরের উপর কালো একটা ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে।

গৌরবান্বিত আঁখ আর ফকিরা মরপর্ক মিলে যে যমজ শহর, যার আদলে ইতিহাসের আর সকল শহরের সৃষ্টি হয়েছে, যুগে যুগে এমন বহু বিপদ আপদ সে পাড়ি দিয়ে এসেছে, এবং প্রতিবারই ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এই দাবানলে যা কিছু পুড়তে বাকি ছিলো, পরবর্তী বন্যাতে সে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও তা কেবল একটু বাড়তি উপদ্রব নিয়ে এসেছিলো বেঁচে যাওয়া অধিবাসীদের জন্য। কোনক্রমেই এ প্রলয় শহরের ইতিহাসে দাঁড়ি নয়, বড়োজোর একটা অগ্নুজ্জ্বল যতিচিহ্ন মাত্র, হয়তো কয়লা ঢাকা একটা কমাচিহ্ন বা সাপের মতন একখানা সেমিকোলন।

পুনশ্চঃ
* টেরি প্র্যাচেটের ডিস্কওয়ার্ল্ড এর Color of Magic অনুবাদের পর্ব ৩। আপনাদের মন্তব্য থেকে শোধন করে করে অনুবাদ নিয়ে এগোচ্ছি। নাম আবার বদলে গেছে তাই। চাকতি জগত > চক্রাধাম > চক্রধাম > চক্রধামা।
সকলের মন্তব্য উপদেশ কাম্য।
** দুকুঁড়ি - TwoFlower > দুই ফুল > দুই কুঁড়ি > দুকুঁড়ি।
*** জোক ব্যাখ্যা করে বলে দিলে সেটা আর জোক না থেকে কেঁচো হয়ে যায়। প্র্যাচেট লিখেছিলেন, " পাতাল্পুরীর বাসিন্দাদের থেকে আসা প্রতিধ্বনি" , ইংরেজিতে প্রতিধ্বনি= ইকো, পাতাল্পুরীর বাসিন্দা = নোম > নোমিক্স। বাংলায় শব্দ নিয়ে খেলে দাঁড়ালো, লোল পড়ে যার = ওর থু, অনিঃশেষ = নেই ইতি > ওরথুনেইইতি = অর্থনীতি।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

‌মহা পরাক্রমশালী ভুতের নাম শেষে এসে বুঝলাম। আগে আন্দাজ করেছিলাম মারত্মক কিছু একটা হবে, আসলেই সেরকম কিছু বের হল শেষমেশ।

শুভেচ্ছা হাসি

হাসিব এর ছবি

ধাম কীভাবে ধামা হলো এখানে এসে?

শিশিরকণা এর ছবি

ডিস্কওয়ার্ল্ড এর বাংলা যুৎসই শব্দ পাচ্ছি না, তাই ডিস্ক এর বদলে ধামা ব্যবহার করবো কি না ভাবছি। এরপরে ধামাধরা তেও চলে যেতে পারি। ধামার মত যে ধরা। তাতে এই আজগুবি দুনিয়ার উপযুক্ত নামকরণ যদি হয়।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।