আমার অ্যাডভাইজার অবশ্য দুশ্চিন্তা দূর করে দিলেন অনেকখানি। কাগজপত্র বেশ খুঁটিয়ে দেখে তারপর কাজের কথা শুরু করলেন। এখানে কাগজের দৌরাত্ম্য তুলনামূলকভাবে কম, দুটো এক্সেল ফাইলে যাবতীয় কাজকর্ম সেরে ফেলা হয়েছে। কোথাও এক (হ্যাঁ) আর কোথাও শূন্য (না) দিয়ে গোটা ব্যাপারটার হাল হকিকত একটা সামারি পেজে দেখা যায়। কাজ শেষে প্রফেসর জানালেন, বেশি কোর্স নিয়ে ফেলেছি আমি। এত কোর্স নিয়ে বাটে পড়ার কোন মানে হয় না, তবে আমি চাইলে বাটে পড়তেও পারি। তাঁর পরামর্শ মতোই কিছু কোর্সকে অতিরিক্তের খাতায় যোগ করলাম, কিছু নিয়ে গেলাম পরবর্তী সেমিস্টারে।
কাজ শেষ করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা কামড়ে দেয়নি, হালুম করেই ছেড়ে দিয়েছে! প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দয়ালু অ্যাডভাইজারের কথা মনে পড়ে গেলো, যিনি টার্মের পর টার্ম আবার অবনতি দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন রীতিমতো, শেষের একদিন করুণ কণ্ঠে বলেছিলেন, তুমি একটা ফাইট দাও!
এক বস্তা কোর্স নিয়ে ফেলেছি এবারে। উদ্দেশ্য, সামার সেমিস্টারে হালকা থাকা। বায়ুশক্তির ওপরে দুটো, ফোটোভোল্টায়িকের ওপর একটা, জলশক্তির ওপর একটা, বাড়িঘরের শক্তিদক্ষতার ওপর একটা, আর সাথে একটা সেমিনার আর একটা প্রোয়েক্টশ্টুডিয়ুম, যাকে বলে কাজের ফাঁকে পড়া। দেখি আবার ফাইট দিয়ে। যা হোক একটা নিই কিছু হাতে, একবার মরে বাঁচি।
সামনেই একটা বিশ্রী পরীক্ষা আছে, লাড্ডু খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। দাঁত মেজে রাখছি এখন থেকেই।
২.
আলাদা পোস্ট হিসেবে দেবো ভাবছিলাম, কিন্তু জঞ্জাল না বাড়িয়ে এখানেই লিখছি। বিষয় চা।
আমার চা খাওয়ার হাতেখড়ি আমার বাবার কাছ থেকে, আমার চা পানের অভ্যাসের বয়স প্রায় আমার সমান। আমার স্কুল শুরু হতো বেশ ভোরে, ঘুম ঘুম ভাবটা চায়ের দাপটে একটু একটু করে কেটে যেতো, মনে আছে স্পষ্ট। শুক্রবার সকালে শুধু আয়েশ করে চা খাওয়া যেতো। সন্ধ্যেবেলা খেলেধূলে এসে নাস্তার পর টিভি দেখতে দেখতে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেয়ার পর পড়তে বসতাম, ভূগোলের ম্যাপ হোক বা লগারিদম, সবকিছু জুড়ে তখন মিষ্টি ঝাঁঝালো চায়ের স্বাদ।
চা নিয়ে একসময় খুঁতখুঁত করতাম, কারো বাড়িতে চা খেয়ে ভালো না লাগলে মনে মনে গজগজ করতাম, কিন্তু কলেজে উঠে চায়ের ব্যাপারে একটা বিশ্বগ্রাসী উদারতা জেগে উঠলো মনের মধ্যে, মনে হলো চা হচ্ছে সুন্দরী তরুণীদের মতো, কোন চা-ই একেবারে খারাপ হতে পারে না। উদার রয়েছি উদর মেলিয়া, এই গুণ আমি এখনও বেশ ধারণ করি, হাসিমুখে অন্যের বানানো খারাপ চা খেয়ে যাই।
আমার কর্মজীবন শুরু ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার কিছুদিন পর থেকে, এই বাজে ব্যাপারটা থামছে না আর কিছুতেই। পড়া আর কাজের ক্লান্তিকে চায়ে চুবিয়ে মেরে মেরে অনেক বছর কাটিয়ে দিলাম। বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে, রোদে চলে ঘামতে ঘামতে, হিম বাতাসে শুকিয়ে আমসি হয়ে শেষমেষ নিজেকে সঁপে দেই চায়ের কাছে। প্রেয়সীর ঠোঁট হারিয়ে যায়, কিন্তু চায়ের কাপ আমার প্রতীক্ষায় বসে থাকে সবসময়।
কতো ক্লান্তি, কতো দুঃখ, কতো হতাশার চড় খেয়ে বসে পড়ে এক কাপ চায়ের ফরমায়েশ দিয়েছি, হিসেব রাখতে একটা সেই আমলের তিরিশ টাকা দামের খাতা কিনতে হতো।
কিন্তু সবচেয়ে বড়ো দুঃখ হচ্ছে নিজের হাতে বানানো বাজে চা খাওয়া। এক নদীতে দুইবার গোসল করা যায় না, এক ঠোঁটে দুইবার চুমু খাওয়া যায় না, কিন্তু এই পোড়ার দেশে এসে অব্দি আমি একই রকম বাজে চা আশ্চর্য অধ্যবসায়ের সাথে বানিয়ে চলছি। নিজের পারফরম্যান্স দেখে আমি তাজ্জুব। দেশে হরদম চা খেতাম, চাপটা ঘরের লোকের ওপর দিয়ে যেতো, এখানে এসে আমি আমার চায়ের খারাপ হাত দেখে সেটা মাথায় দিয়ে বসে পড়েছি।
কফি জিনিসটা আমার তেমন পছন্দ না, আমার অনেক সফিস্টিকেটেড বন্ধু কফি না খেয়ে এখন তিষ্ঠাতে পারে না, কিন্তু এই আবিসিনিয়ান বেবুনবিচির চেয়ে চায়ের তৃষ্ণাই আমার বেচারা রক্তে বেশি। হয়তো এই বদখদ কফিই খেতে হবে এখন থেকে। কাল একটা প্রেজেন্টেশন, তার তিলেকমাত্র শুরু করিনি এখনো, ভাবছিলাম এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে শুরু করবো যা করার, বয়ামের ভেতর দেশ থেকে নিয়ে আসা প্রায় নিঃশেষ চা দেখে হঠাৎ মনে হলো, এতদিন পর যেন সত্যি সত্যি দেশছাড়া হলাম।
মন্তব্য
হিমু ভাইয়া,আমারও চা ভাল লাগে খুব।আমাকেও খুব ছোটকালেই চা খাওয়া আব্বুই শিখিয়েছেন।এইখানে একা একা চা খেতে ভাললাগে না।আব্বুকে খুব মনে পড়ে।তাও ওয়েলসের বিশ্রী ভেজা শীত চা ছাড়া মানে না।আমি আমার বাবাকে খুব ভালবাসি।আর আমার বাবা চা খুব ভালবাসেন বলে আমি চা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছি পিচ্চিকাল থেকে।আমার বেশি ভাললাগে চিরন্তন দুধ চা ছাড়াও লেবু চা,মশলা চা,আদা চা,এলাচ চা ,গুড় চা আর আমাদের পুরান ঢাকার বিখ্যাত মালাই চা।
চা পচা হয় কেন?একটু জ্বাল দিয়ে নামিয়েন।টিপস লাগলে বিবাগিনী হাজির।
খুব ভাল লাগে আমার প্রবাসে দৈবের বশে পড়তে।সবসময় অপেক্ষা করি।ওহ, আপনার advisor কে ছিলেন? আমার advisor ও খুব কোমলমতি ছিলেন ।শেষ term এ আমাকে শুধু একটা বকা দিয়েছিলেন।
::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::
::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::
ব্রিটিশদের চা খাওয়ার দরকার কি! কফিই ভালো। (কফি কাদের?)
আমি কফি খাই অনেকটা ঔষধের মত, চিনি নাই, দুধ নাই, স্রেফ মগে কফি ঢেলে তার মধ্যে গরম পানি দিয়ে নাড়াচাড়া। অবশ্য আয়েশ করে গরমাগরম কফি খাওয়া হয় না তেমন। গোসলের আগে কফি বানিয়ে রেখে দেই। ঠান্ডা হতে থাকে। গোসল সেরে রেডি ওঠে কয়েক চুমুকে ওটা শেষ করেই দৌড়। গন্তব্য অফিস।
দুপুরের পর ঘুমে চোখ বুজে আসলে তখনও বেশ কাজ দেয়। আবার কখনও ঘুম না আসলেও ঘুমের ওষুধ হিসেবে কফি।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
কেন জানি দুটো PUN মনে পড়লো। একটি শিব্রাম চকরবরতীর: "চা খাও আর না খাও, আমাকে একটু চাখাও।"
আরেকটি: "চাচায় চা চায়, চাকরে চা করে।"
শুনে অবাক হয় অনেকেই - চা-কফির প্রতি কোনও টান আমার নেই। পেলে খাই, আবার দীর্ঘদিন না খেলেও কোনও অস্বস্তি বোধ করি না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
"এক ঠোঁটে দুইবার চুমু খাওয়া যায় না"--বুঝলাম না ব্যাপারটা (কোনো কবিতার লাইন ফাইন নাকি?)
হিমু এটি রাধুনীর দোষ না দোষ চায়ের।
জার্মানীতে এসে ওদের বড়পাতার রংহীন চা পান করে একইরকম অবস্থা হয়েছিল। ওদের আগ্রহ গ্রীন টি, জবাফুল ইত্যাদি বিভিন্ন ফ্লেভার্ড টি। আগ্রহ করে জবাফুলের টি ব্যাগ এনেছিলাম। কেউ চায় না খেতে - আমাকেই ওটা শেষ করতে হবে।
দামী চা পাওয়া যায়না তা নয়, আর্ল গ্রে, দার্জিলিং ইত্যাদি কিন্তু দেশী স্বাদের ও অভস্ত্য রংয়ের সিলোন টি/আসাম টি পাওয়া দুস্কর। আমরা তুর্কীদের দোকান থেকে একটি সিলোন ফ্লেভার্ড টি কিনে থাকি। বিপুল পরিমান পাতা দিয়ে তবে রং হয়।
আমরা দেশী কেউ এলে বলি পয়সা দিয়ে দোকান থেকে এদের চা কিনে খাবেন না। বরং কফি খান, অন্তত পস্তাবেন না।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
আমিও এখানকার চা অপছন্দ করতাম। ইনফ্যাক্ট এদের সব চায়ের প্যাকেটে 'Ice Tea' লেবেল দেওয়া; প্রথম প্রথম বুঝতে পারি নাই যে আমেরিকানরা চা জিনিসটাকে ঠান্ডা পানীয় হিসাবেই বেশি চেনে। এখন ইন্ডিয়ান গ্রসারি স্টোর থেকে 'আসাম টি' নামের একটা প্যাকেট আনি। এই জিনিস্টাও ইনিশিয়ালি একই রকম পানসে লাগতো। পরে দেখি প্যাকেটের গায়ে 'বেস্ট টেস্ট' এর জন্য ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে। এককাপ চায়ের জন্যা দুইটা ব্যাগ দরকার যাতে লিকার যথেষ্ট গাঢ় হয়। ওইটা করার পর অনেকটা দেশি চায়ের টেস্ট/ঘ্রান পাই।
উইন্টারে বেশি কোর্স নেওয়া ভালো। সামার সেমিষ্টার নাকি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।
বিভিন্ন বাংলাদেশি দোকানে দেশি চা পাওয়া যাবে। আর ওদের ব্লাক টি ব্যাগ ও খারাপ না।
আমার উপদেষ্টা এখন পর্যন্ত কিছুই বলছেন না। প্রতি টার্মেই আমার রেজাল্ট ই টু দি পাওয়ার মাইনাস এক্সের মত নেমে যাচ্ছে।
আমি ফাইনাল বিস্ফোরণের আশংকায় আছি !
===================================
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
কফির রান্নার উপর আমার লেখা শর্টকোর্সটা উপকারে আসতে পারে। দেখি সময় করে চমৎকার চা রান্না পদ্ধতি নিয়ে একটা পোষ্ট করে দিব।
---
বেশী কোর্স নেয়া খুব ভালো বুদ্ধি। সেমিষ্টারের শেষ দিকে এসে হাগামুতা করার সময়টুকুও পাওয়া যায় না।
কি মাঝি? ডরাইলা?
নতুন মন্তব্য করুন